ইটাচুনা রাজবাড়ী
মধুমিতা মিত্র
কর্মব্যস্ততার চাপে জীবন যখন জেরবার,মুক্তির আনন্দ পেতে সপ্তাহ অন্তে যাওয়া যাক্ তবে ইটাচুনা রাজবাড়ী। কলকাতা থেকে সামান্য দূরে, মহানগরীর ধুলো ধোঁয়ার ,ইট কাঠের বাইরে- শ্যামলিমার সজল ছায়ায় একদিনের দায়িত্ব বিহীন রাজসুখের আস্বাদ পাবেন এই রাজবাড়ীতে। রাজবাড়ী যাবার আগে ইতিহাসের পাতাগুলি আসুন আমরা একটু উল্টে পাল্টে দেখি।
ছোট্টবেলার সেই ঘুম পাড়ানি গান “ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়োলো বর্গী এলো দেশে”—এই কলিটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে এই রাজবাড়ীর ইতিহাস।আঠেরোশো শতাব্দীতে বাংলায় আলীবর্দী খানের সময়ে মারাঠা দস্যু বর্গীরা আক্রমণ করে বঙ্গদেশ,১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত পর পর পাঁচ বার বঙ্গদেশে এই বর্গীরা হানা দেয়।নবাব আলীবর্দী খান এদের বারংবার দমন করলেও বাংলার অর্থনীতি এবং জনসাধারণের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছিলো বলেই পরিশেষে আলীবর্দী খান বর্গীদের সঙ্গে এক শান্তি চুক্তি স্হাপন করেন।এতে অধিকাংশ বর্গী বঙ্গদেশ ছাড়া হলেও কিছু বর্গী এখানেই থেকে যায়। এমনই এক বর্গী পরিবার কুন্দন বা কুন্দাস।
হাওড়া বর্ধমান লাইনে হুগলী জেলার খন্যান স্টেশনের অনতিদূরেই বর্গীডাঙ্গা বলে স্থানটিই আজ ইটাচুনা রাজবাড়ীর পরিচয়ে পরিচিত। সেই কুন্দন বা কুন্দাসরা এই বর্গীডাঙার অধিবাসী বর্গী।প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হলেও সময়ের সঙ্গে এদের অন্তরের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে।পূর্বের সেই জঘন্য দস্যু বৃত্তি পরিত্যাগ করে এরা ক্রমশঃ ব্যবসায়ে মন দেয় এবং ইট ও চুনের ব্যবসায়ে আরও প্রভূত অর্থ উপার্জন করে।সময়ের সাথে এরা নিজেদের কে এতটাই বদলে ফেলেছিল যে জনহিতৈষণা এবং জন-উন্নয়ন এদের ব্রত হয়ে ওঠে।বর্গী ডাঙ্গার কুড়ি বিঘে জমিতে তারা নির্মাণ করে এক বিরাট প্রাসাদ।ইট এবং চুন দিয়ে যে রাজপ্রাসাদ তারা তৈরি করেছিল তার নাম তাদের অবাঙালি ধাঁচে ইটাচুনা রাজবাড়ী হয়।কালক্রমে যেমন তারা তাদের দস্যু স্বভাব পরিত্যাগ করে তেমনই আস্তে আস্তে মারাঠী থেকে তারা হয়ে ওঠে আগাগোড়া বাঙালি। কুন্দন অথবা কুন্দাস এবার বদলে গিয়ে হয় কুন্ডু। শুধু বাইরের আবরণই নয় ভেতরের আমূল পরিবর্তনও তাদের করে তোলে অঞ্চলের মধ্যে জনপ্রিয়,পূর্ব পুরুষের কালিমালিপ্ত সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপট মুছে এক উজ্জ্বল জন দরদী কুন্ডু পরিবারের স্হাপনা হয়। এই কুন্ডুরা শুধু ষোলআনা বাঙালিই হলেন না —আশেপাশের জায়গার এবং কাছাকাছি সব মানুষের উপকারে,তাদের উন্নয়ন এবং কল্যাণ সাধনে ব্রতী হলেন।
উপর্যুপরি তাদের কুড়ি বিঘের মস্ত প্রাসাদোপম বাড়িটিকে পারিবারিক ব্যবসাকে অবলম্বন করে চালু করলেন এক অতি উচ্চ মানের পর্যটন কেন্দ্র।এতে স্হানীয় কর্মসংস্হানেরও ব্যবস্হা হলো।সমাজ সেবায় এভাবেই তাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে যোগদান করলেন। রাজবাড়ীতে গেলে পাওয়া যাবে রাজপ্রাসাদের জীবনধারার ধারণা,রাজকীয় শয্যা,স্নানঘর,খাবার ঘর এসবের সাথে আধুনিকতার সামঞ্জস্যপূর্ণ মেল বন্ধন।নানা পুরোনো ঐতিহ্য মন্ডিত আসবাব যথাযোগ্য মর্যাদায় শোভা পায় বাড়ির প্রতিটা কোণায় অথবা মূল জায়গাতেও।এছাড়াও দেখতে পাওয়া যায় সুদৃশ্য নাচ ঘরের সাজ এবং খুঁটিনাটি সে সময়ের গৃহসজ্জার নানা সামগ্ৰী।মধুর পাওনা হলো নাটমন্দিরে নারায়ণ শিলার সেবা এবং আরতি।বাঙালীয়ানা গ্ৰহণের সাথে সাথেই কুন্ডুরা বৈষ্ণব ধর্ম গ্ৰহণ করেন। নাটমন্দিরে তাই নারায়ণ শিলার অধিষ্ঠান।সন্ধ্যা আরতির সময় থেকেই নাটমন্দির এবং তাকে ঘিরে যে আলোকমালা রচিত তা-ও বড়ো মনোহারী,নয়নলোভন।
আর খাওয়া-দাওয়া!!!আহা সোনার থালায় রাজভোগ খাবার সে কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা !কাঁসার থালা বাটি,গ্লাস,চামচ সব কিছুই এমন ঝকঝকে যে প্রথম দর্শনেই চমক লাগে যে সত্যিকারের সোনার বাসনেই বোধহয় আমরা খাচ্ছি।গোটা বাড়ির ঝাড়বাতি থেকে কার্পেট সব কিছুতেই আভিজাত্যের মাখামাখি। সবচেয়ে উল্লেখ্য এখানকার কর্মচারীদের আচার ব্যবহার।নীরবে,স্মিতহাস্যে তাঁরা যা পরিষেবা দিয়ে যান ,সুখ অভিজ্ঞতার মধ্যে তা অতি উল্লেখ্য হয়ে থাকবে। এছাড়াও আশে পাশের গ্ৰামের মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এঁরা গৃহসজ্জার নানাবিধ সুদৃশ্য সামগ্ৰী তৈরী করান।তারও বিপণন কেন্দ্র রয়েছে আবার মহিলাদের জন্য শাড়ী,স্কার্ফ, দোপাট্টা,গয়না প্রভৃতির ছোট্ট শো রুম রয়েছে যা অত্যন্ত রুচি সম্পন্ন।গ্ৰামের মহিলারাই এদের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে এগুলি তৈরি করে।এর বিক্রীত অর্থের লভ্যাংশ গ্ৰামের মানুষেরই কল্যাণার্থে ব্যবহৃত হয়। এ যেন অভূতপূর্ব এক সামাজিক আন্দোলন, নিজেদের ইতিহাস,ঐতিহ্য ঐশ্বর্যকে মূলধন করে সমাজকল্যাণে তা বিনিয়োগ করা,এদের এই কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে কিরকম শিল্পপতি টাটাদের কথাই মনে হচ্ছিল।টাটারা যেমন সমাজ কল্যাণ সমাজ গঠনকেই উদ্দেশ্য তাঁদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র বাড়িয়েছেন,এখানেও তারই ক্ষুদ্র সংস্করণ। কুন্ডু পরিবার নিজেদের ঐতিহ্যের,কৃষ্টি,বৈভবের ছটায় আলোকিত করে রেখেছেন নিজেদেরকেই আর চারিপাশের সমস্ত সমাজকেও। আজকের যুগে এ-ও এক শিক্ষণীয়,দেখবার মতো জিনিস যে শুধু মাত্র আত্মসর্বস্ব না হয়ে প্রতিপত্তি দিয়েও কিভাবে সমাজের উন্নয়ন,উপকার,কল্যাণে নিজেদের কে নিয়োজিত করা যায়।
সন্ধ্যালোকে প্রজ্জ্বলিত রাজবাড়ীর একাংশ…
ইটাচুনা রাজবাড়ীর পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসা, শুধু তো ব্যবসা নয় এ যেন এক আন্দোলন। উন্নয়নের আন্দোলন,যেখানে সংবৎসরের কৃষি কর্ম ছাড়া জীবিকার আর কোনো সংস্হান নেই, সেইখানে প্রতিষ্ঠিত পরিবার তার কৃষ্টি,সম্পদ,ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে গড়ে তোলে এমন এক আকর্ষণ যা বহু দূর দূরান্তের লোকেরও মনোযোগ টেনে আনে। গ্ৰামে চারিপাশে তেমন বিশেষ কিছুই দেখবার নেই,শুধুই কুন্ডু পরিবারের রাজবাড়ীর এই পরিকাঠামো দেখা এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সমাজসেবার অসাধারণ উদাহরণ আজকের সমাজে একেবারে অনন্য। ফেলে আসা ঐতিহ্যকে মূলধন করে এমন ব্যবসা যে ফাঁদা যায়,তাই এনাদের কাছ থেকেই বোধগম্য হয় এবং শিক্ষাও লাভ করা যায়। সমাজের অনান্য সম্পন্ন পরিবার গুলি যদি এমন ধারা দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হন তবে সমাজের প্রভূত উপকার। এঁদের কর্মকাণ্ড কেন জানি না শিল্পপতি টাটাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।টাটারা যেমন যে কোনো ব্যবসায়ে নিজেদের লাভ ক্ষতির উর্দ্ধে সমাজ কল্যাণের কথা চিন্তা করেন। এখানেও যেন সেই ছায়া আঁকা রয়েছে।
সন্ধ্যা আরতির সময় প্রজ্জ্বলিত নাটমন্দির….
এঁদেরই নিযুক্ত একজন গাইড রাজবাড়ীর আনাচ কানাচ,নাচ ঘর,ছাদ, পুকুর ঘাট সারা বিকেল-সন্ধ্যে প্রদর্শন করান।সন্ধ্যে এবং ভোরে একজন বাঁশিওয়ালা এসে বাঁশিতে তান দেন ভরে।সেও এক সুমধুর অভিজ্ঞতা।আরো কিছু বেশ মজার চিত্তাকর্ষক ব্যাপার আছে যেগুলি না পড়ে সেখানে সাক্ষাতে গিয়ে দেখলে বেশী ভালো লাগবে।
সমস্ত ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে আমি উপলব্ধি করেছি—এই গোটা পরিবারের এক নিবিড় সংহতিও সমস্ত কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে প্রচ্ছন্ন।তাই নিছক ভ্রমণ নয়,কুন্ডুদের পারিবারিক সংহতি(যা আজকের দিনে বিশেষ ভাবে অনুপস্থিত), পুরোনো দিনের সম্ভ্রান্ত পরিবারের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখা, গোটা ব্যাপারটিকে অনুভব করা এবং শুধুই হাওয়া বদল নয়,রাজকীয় মর্যাদার আনন্দ সম্মান নেবার জন্য আমরা দুটি দিন,একটি রাতের জন্য যেতেই পারি ইটাচুনা রাজবাড়ীতে। বর্ধমান মেন লাইনে হুগলী জেলার খন্যান স্টেশন থেকে অটো কিংবা টোটোতে ইটাচুনা রাজবাড়ী তে যাওয়া যায়।
কলকাতা থেকে মাত্র ১৪০ কিঃমিঃ দূর।খরচ থাকা খাওয়া নিয়ে মাথাপিছু ন্যূনতম ৩০০০টাকা,থাকার ঘর অনুযায়ী ২০,০০০টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বুকিং করার বিস্তৃত বিবরণ নীচের ছবিতে দেওয়া রইলো….
************************************
মধুমিতা মিত্র: পেশা—স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা—আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম–রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার।সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..