Shadow

দশভূজা – অমৃতা লাহিড়ী


দশভূজা

    অমৃতা লাহিড়ী 

  *‌‌দশভূজা*
বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে সৃষ্টিকর্তা বিরাট পুরুষের আপন সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে উপলব্ধির ইচ্ছা থেকেই নারী সত্তার উৎপত্তি-“আত্মবেদমগ্র আসীদেক এব,সোহকাময়ত জায়া মে স্যাৎ”। অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে আত্মাই একমাত্র ছিলেন। তিনি কামনা করলেন আমার জায়া উৎপন্ন হোক। এই ঔপনিষদিক বাণী প্রকৃতপক্ষে নারী জাতির মহিমা সম্বন্ধে ভারতীয় ধারণাকেই তুলে ধরা হয়েছে। ভারতীয় দর্শনে নারী সৃষ্টির সঙ্গে অভিন্ন অখন্ড সত্তার প্রকাশ বৈচিত্র্যের রূপায়ণে  নারী অপরিহার্য।
শাস্ত্রে পাওয়া যায়, অতি পাতকীও দুর্গা নাম স্মরণ মাত্র পাপ থেকে মুক্ত হয়, দুর্গা নাম জপ করলে তৎক্ষণাৎ পাপ মুক্তি পায়।
                             দুর্গা মন্ত্র মহামন্ত্র সমস্ত বিষ্ণু মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা।
                  “সর্ব্বেষাং বিষ্ণুমন্ত্রাণাং দুর্গা অধিষ্ঠাত্রী দেবতা”
মহাভারতে আছে দেহ বন্ধ বিমুক্তির জন্য মুমুক্ষুগণ কর্তৃক দেবীর নিষ্কল,সূক্ষ্ম,বাক্যের অতীত,সুনির্মল,নির্গুণ,পরমজ্যোতি,সর্বব্যাপী সৃষ্টি,স্থিতি,সংসারের একমাত্র কারণ স্বরূপ। নাগাধিরাজ হিমালয় ও মাতা মেনকা কর্তৃক দেবী কন্যা রূপে আরাধিতা। উমা নিজের যথাযথ পরিচয় স্বরূপ বলেছিলেন মহেশ্বর এর আশ্রয় ভূতা,শাশ্বত ঐশ্বর্য ও বিজ্ঞান ঘন মূর্তি সর্ব প্রকৃতি কারণস্বরূপা,সৃষ্টি,স্থিতি,নাশের বিধাত্রী ও জগজ্জননী পরমা শক্তি আমি। আমি সর্বভূতের অন্তর যামিনী,সংসারার্ণবতারিণী,নিত্যানন্দময়ী,নিত্যা,ব্রহ্ম রূপা ও ঈশ্বরী।                                 কেনোপনিষদে পাওয়া যায় দেবী দেবরাজ ইন্দ্রের সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছিলেন। “স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়জগামবহুবহু শোভমানামুমাং হৈমবতীম্”। ইন্দ্র সেই আকাশে নারী রূপা অতি সৌন্দর্য শালিনী হৈমবতী উমাকে দেখেছিলেন।
                      “বন্দে বাঞ্ছিত লাভায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম।
                     বৃষারূঢ়াং শূলধরাং শৈলপুত্রীংযশস্বিনীম্।।”
আশ্বিন মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে মহালয়ার পর দিন দেবী শৈল পুত্রীর পূজার মাধ্যমে শুরু হয় নবরাত্রি উৎসব। শৈল পুত্রীর নামের অর্থ পর্বতের কন্যা। সেই অর্থে পার্বতী ও শৈলপুত্রী সমার্থক তিনি দেবীকবচোক্ত নবদুর্গার প্রথম রূপ।
দেবী “শৈল পুত্রী” দ্বিভুজা,তার এক হাতে পদ্ম,অপর হাতে ত্রিশূল। দেবীর মস্তকে অর্ধচন্দ্র,তার মুখাবয়বে শান্তির ভাব, আশীর্বাদের সুন্দর হাসি ফুটে থাকে। দেবীর এই স্বরূপ আনুগত্য,  পবিত্রতা,আস্তিকতা,দৃঢ়তা সংযম ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
                               দেবী দুর্গা শ্রীকৃষ্ণের যোগ্য মায়া যিনি হরি সহায়িনী তথা হরি ভক্তি প্রদায়িনী,নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ “ব্রহ্মচারিণী”। যিনি জ্যোতিতে পূর্ণ অতি মহিমা মন্ডিত,ডান হাতে জপের মালা এবং বাম হাতে কমন্ডলু ধারণ করে আছেন। তৃতীয় রূপ “চন্দ্র ঘন্টা”। পরম কল্যাণকারী। মস্তকে অর্ধচন্দ্র বিদ্যমান। চতুর্থ রূপ “কুষ্মান্ডা”। কারুণ্যে ভরপুর মায়ের সৌম্য প্রতিমা। দেবী অষ্টভুজা।  পঞ্চম রূপ “স্কন্দ মাতা”,কার্তিকের মাতা রূপে পূজিতা। ষষ্ঠ রূপ “কাত্যায়নী”,সপ্তম রূপ “কাল রাত্রি” দেবী কৃষ্ণ বর্ণা,আলুলায়িত কেশে তিনি শত্রুর দিকে ধাবিতা।  অষ্টম রূপ “মহাগৌরী”,নবরাত্রির অষ্টম রাতে তাঁর পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায়-এটি প্রচলিত বিশ্বাস। নবম রূপ “সিদ্ধিদাত্রী”। দেবী চতুর্ভূজা,সবাইকে বরাভয় দেন এই মাতৃকা মূর্তি। ।
        দেবী দুর্গা সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম। দেবাদিদেবের উপাস্য দেবতা,লক্ষ্মী ও সরস্বতী রূপে নিজ অংশে বিষ্ণুর বণিতা এবং সাবিত্রী রূপে ব্রহ্মের দয়িতা। দুর্গা মাহেশ্বরী শক্তি,লক্ষ্মী বৈষ্ণবী শক্তি,সরস্বতী ব্রহ্মাণী শক্তি। এক শক্তি ত্রিমূর্তি ধারণ করেছেন-জ্ঞান,ইচ্ছা,ক্রিয়া।
                          দেবী দশভূজা,দশ হাতে দশ টি অস্ত্র ধারণ করেছেন।আমরা হয়তো সকলে জানিও না দশ অস্ত্রের অর্থ কি? ত্রিশূল- তিনটি ফলায় আছে সত্ব,রজঃ,তমঃ। গদা-আনুগত্য ও ভালোবাসার প্রতীক,ভক্তি ও জাগায় এই গদা। বজ্রাস্ত্র- দীর্ঘতা ও সংহতির প্রতীক। সাপ-বিশুদ্ধ চেতনা জাগায়। অগ্নি-জ্ঞান ও বিদ্যা প্রদায়িণী,শঙ্খ-জগতে প্রাণের সৃষ্টি, চক্র-সৃষ্টি ও জগতের কেন্দ্রে অধিষ্ঠান,তীর-ধনুক-সব সময় ইতিবাচক শক্তি ও সাহসের প্রতীক,পদ্ম-অন্ধকারময় জগৎ থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসে। তলোয়ার-বুদ্ধির দ্বারা বৈষম্য ও মনের অন্ধকার দূরীভূত হওয়ার প্রতীক।
                    শক্তি পূজার ফল-যোগ ও ভোগ। বিশেষ দুর্গা পূজায় ত্রিশক্তির আরাধনা হয়। শক্তি পূজার আর একটি অঙ্গ নারীর সম্মান। সব নারী শক্তির অংশ। রামপ্রসাদ গেয়েছেন-“মা বিরাজে ঘরে ঘরে,জননী,তনয়া,জায়া,সহোদরা কি অপরে।” যুগ যুগান্তরের এই মাতৃ পূজার মূল মন্ত্র-“মাতা বল প্রদা,”আজও প্রকটিত। দুর্গম অসুর চতুর্বেদকে হস্তগত করলে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় দেবী পার্বতী দশভুজা রূপী মঙ্গলময় দেবী রূপে আবির্ভূতা হন। তারপর দুর্গম কে শূলের আঘাতে বধ করেন। দেবী পার্বতী হলেন স্বয়ং মহাকালী। তিনি জয় দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী,বন দুর্গা,চন্ডী,নারায়নী,শিবানী,গৌরী,তিনি জগদীশ্বরী,আপন মহিমায় এই পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন প্রতিটি জীবের শরীরে। তিনি ঘটন অঘটন পটিয়সী, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী,তিনিই আবার প্রলয় কালে প্রলয়ঙ্করী দেবী কালিকা । ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে;’উ’কার বিঘ্ন নাশ করে;’গ’ পাপ নাশ করে অর্থাৎ দৈত্য,বিঘ্ন,রোগ,পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দশভূজা দুর্গা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “মাতৃ শক্তিই পক্ষপাত শূন্য মহাশক্তি। মায়ের কাছে অকুন্ঠ শরণাগতি আমাদের শান্তি দিতে পারে। তাকে ভালোবাসো,কারণ তুমি সন্তান। তবেই আমাদের মনে সমত্ব ও চিরশান্তি বিরাজ করবে। এটাই মায়ের স্বরূপ।” চন্ডীতে বলা হয়েছে-“ত্বং বৈষ্ণবী শক্তি অনন্তবীর্যা,বিশ্ববীজস্য পরমাসি মায়া” তিনি হলেন পরমা প্রকৃতি এই প্রকৃতির স্তুতি ভক্তি সহকারে করণীয়।
**********************************************
  

অমৃতা লাহিড়ী পরিচিতি: রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর। ঠাকুর্দার(প্রমথনাথ তর্কতীর্থ )অনুপ্রেরণায় বড় হয়ে ওঠা, সাংস্কৃতিক জগতে প্রবেশ করা। 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!