Shadow

পদক্ষেপ – ব্রতী ঘোষ

PC: i stock

পদক্ষেপ
ব্রতী ঘোষ

সকাল সাতটা বেজে গেল – এখনো সরস্বতী এলো না !! এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না ৷ আজ সোমবার-এখনো যদি না আসে, সকালের রান্না, বাড়ির কাজ সব সেরে তপতী যে কি করে অফিস যাবে ? ভাবতে ভাবতে ওর মাথাটা বেশ গরম হতে শুরু করে ৷ ঠিক সেই মুহূর্তে ‘টিংটং’ বেজে ওঠে ৷ যাক বাবা !!
“আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল গো বৌদি !!” – শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে বলে সরস্বতী।
“বলো কি রান্না হবে ? দাদাবাবু , তুমি টিফিনে কি নেবে ? কি হলো বলো ?” তপতী বেশ গম্ভীর গলায় বলে, “দেরি করলি কেন ? তোকে কতদিন বলেছি একটা মোবাইলটা কেন্‌ ৷ শুনলি কথা ? সকালবেলা এত দেরি করলে চলে ? এক্ষুণি তোর দাদা বাবু খেতে বসবে । স্নান করতে চলে গেছে ৷”
“আচ্ছা আচ্ছা ! তুমি দেখো না ! সব হয়ে যাবে ৷ তুমি রান্নাটা বলে নিজের কাজে যাও দেখি ৷”
তপতীর এটা যোগা করার সময় ৷ সকাল সাতটা থেকে আটটা যোগা করে ও বাথরুমে ঢোকে। ঠিক নটা বাজতে দশে ও আর সুশান্ত বেরিয়ে যায় অফিসে । বাড়ির গাড়িতেই যায় দুজনে। তপতীকে ওর অফিসে নামিয়ে দিয়ে সুশান্ত নিজের অফিসে চলে যায় ৷ স্বামী স্ত্রীর দরকারী কথাবার্তা এই সময়ের মধ্যেই ৷ বিকেলে অবশ্য তপতী আগে ফিরে আসে, সুশান্তর ফিরতে দেরি হয়। কোন কোন দিন অফিস থেকে ফেরার পথে মার সাথে দেখা করতে ওকে যেতে হয় বালিগঞ্জে ৷ মার এখন চুরাশি চলছে ৷ যদিও হেঁটে চলে বেড়ান এখনো তবুও মালতীদি আছে বলে তপতী বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত ৷
সুশান্ত ভাত খেয়ে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। তপতী এসে বসে। সকালে অল্প হলেও ভাত না খেলে ওর চলে না ৷ গরম মাছের ঝোলটা পাতে ঢালতে ঢালতে সরস্বতীর মুখের দিকে তাকায় ও ৷ দেড় ঘন্টার মধ্যেই ওদের অফিসের ভাত, টিফিন সব রেডি। মেয়েটার গুণ আছে। এবার ঘরদোর পরিষ্কার করে কাপড়জামা কেচে মেলে দিয়ে ও চলে যাবে ৷
” সরস্বতী তোর জন্য রুটি করেছিস তো?”
” হ্যাঁ গো বৌদি! তোমাকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না ৷ আমার সব হয়ে গেছে ৷”
” কি ব্যাপার বলতো ? আজ এত দেরি করলি কেন ? ছটায় আসিস। এলি সাতটায় ৷ আমি তো ভাবলাম আজ আর এলিই না ৷
” না গো বৌদি। গতকাল সারারাত ঘরে ফেরে নি মানুষটা, খুঁজতে গেছিলাম গো ৷ গিয়ে দেখি রাস্তার ও ধারে সুবলের দোকানের বেঞ্চে শুয়ে আছে ৷ “
” কেন রে ? “
” আর নতুন কথা কি বলবো বলো ? নেশা করলে কি আর মানুষটা মানুষ থাকে ? “
তপতী খাওয়া সেরে উঠে পড়ে ৷ সরস্বতী রান্না যে খুব ভালো করে তা নয় তবে চালিয়ে দেয়। ওর মধ্যে একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। এর আগে সরস্বতীর মা রান্না করতো ওদের বাড়িতে। তখন ও অনেক ছোট, মার হাত ধরে আসতো এ বাড়িতে । মা মারা যাবার পর ও নিজে থেকেই এ বাড়ির কাজের দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নেয়। তাও বেশ কিছুদিন হলো ৷ যখন হাসি জন্মালো তখন থেকেই ও কাজ করছে ৷ এর আগে যখন ওর ছেলে তাতা হলো তখন তো ওর মা সারদা মাসিই সব সামলে ছিল ৷ তখন যদি সারদা মাসি না থাকতো তাহলে তপতী ওর চাকরিটাই হয়তো আর করতে পারতো না ৷ শ্বশুরমশাই ছিলেন না তবে শাশুড়ি মার কোন সাহায্য তপতী পায়নি এ ব্যাপারে ৷ ওঁর একটা অদ্ভুত নিরাসক্ত ব্যাপার ছিল ওর চাকরি করা নিয়ে ৷ ঠিক যেমন নিরাসক্ত সুশান্ত-ওর চাকরিটা যেন কোন চাকরিই নয় ৷ যেন ও সেজেগুজে বেড়াতে যায়-না গেলেও হয় ৷ অথচ যে কোন সাংসারিক খরচ খরচার ব্যাপারে সব সমান সমান ৷ সে তাতার আর হাসির কলেজের বেতনই হোক বা পুজোর জামা কাপড় কেনা, বাড়ির মাসের খরচ, বেড়াতে যাওয়া সবকিছুতেই অর্ধেক খরচ করে থাকে তপতী ৷ যদিও আরও একটা দায়িত্ব তপতীর আছে-মালতীদির মাইনেটা ও দেয়-এটাকে দায়িত্ব না ভেবে কর্তব্য বলে ভাবতেই ও পছন্দ করে ৷
“তোমার হলো? আমি গাড়ি বের করছি, তুমি আমার ব্যাগগুলো নিয়ে এসো ৷”
” হুম “,শাড়ির আঁচল টা ঠিক করতে করতে বলে তপতী ৷ অদ্ভুত এই মানসিকতা সুশান্তর। ও যেহেতু গাড়ি বার করবে ওর অফিসের ব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার,জলের বোতল সব তপতীকে নিয়ে নীচে নামতে হবে। অথচ তপতীর নিজের ও দুটো ব্যাগ থাকে ৷ আসলে চাকরি তো সুশান্ত করছে আর ও তো বেড়াতে যাচ্ছে ৷ ভাবখানা এমন যেন এই যে যেতে দিচ্ছি এই কতো না ! অথচ বিয়ের আগে ও কিন্তু জানিয়ে দিয়েছিল যে বিয়ের পরেও চাকরি করবে ও, তখন শাশুড়ি মার কি মিষ্টি মিষ্টি কথা, ভাবলেও ওর এখন গা জ্বালা করে ৷
সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই  হয় তপতীর। মার্চ মাসের ইয়ার এন্ডিং | ওদের আর্থিক সংস্থায় বেশ চাপ এখন কাজের। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখে সুশান্ত এসে গেছে ৷ সরস্বতী রাতের রান্না করছে ।
” কি গো বৌদি তোমার আজ দেরি হল ? ”
” কাজের খুব চাপ রে সরস্বতী ! এই সপ্তাহটা দেরি হবে ৷ ”
” হ্যাঁ-সরস্বতী !! তোর বৌদি রাজকার্য করে এসেছেন ৷ তাড়াতাড়ি চা টা দে -”
সুশান্তর বক্রোক্তি শুনে তপতীর মাথাটা দুম করে গরম হয়ে যায় ৷ অফিস নিয়ে কোনরকম বক্রোক্তি ওর ইদানিং অসহ্য লাগে ৷ সারা জীবন শাশুড়ি মার বিভিন্ন কথা শুনে এসেছে ও  অথচ জামাইষষ্ঠী, পূজার সময় মেয়ের বাড়ির তত্ত্ব সবকিছু ওকেই সামলাতে হয়েছে  এই যে একটা সাজানো গোছানো চার কামরার ফ্ল্যাট, হাসি, তাতার পড়াশুনো সব একা সামলাতে পারতো সুশান্ত ? যতই চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হোক না কেন !!  কিন্তু অসহ্য লাগলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে ওর শিক্ষায় বাঁধে ৷ ছোট থেকে বাবার কাছে এই শিক্ষাই পেয়েছে তপতী, যে কোন কাজই ছোট নয় আর মানুষকে সম্মান করলে তবেই সেই সম্মান ফিরে পাওয়া যায় সুশান্ত এত পড়াশোনা শিখেছে আর নিজের স্ত্রীকে সম্মান করতে শেখেনি ৷ নাকি ইচ্ছে করে ওকে দাবিয়ে রাখা, সংসারে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য??
সরস্বতী রান্না করে দিয়ে চলে যায় ৷ চা খেতে খেতে রাত নটা বেজে গেল ৷ এই সময়টায় রোজ একবার করে হাসি আর  তাতাকে কল করে ও নিয়মিত ৷ আজও তার ব্যতিক্রম হলো না ৷  দুজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিন্ত হয়ে তপতী একটু সেদিনের পেপার টা নিয়ে বসে । কিন্তু কোন খবরেই  ওর আজ আর মন বসে না ৷ একটা অসম্ভব কষ্ট বুকে চেপে বসতে থাকে ৷ একটা কথাই কানে বাজতে থাকে,’তোর বৌদি আজ রাজকার্য করে এসেছে ৷” অথচ এরকম কথা তো আজ নতুন নয় ৷ এটা ওরই দোষ। আজ এতদিন ও কোন  প্রতিবাদ করেনি বলেই এইভাবে কথা বলার সাহস পেয়েছে সুশান্ত। ওর কিছু না বলার অভ্যাস ওদের আরো স্পর্ধা দিয়েছে। শোবার ঘর থেকে ব্যালকনিতে এসে বসে ও ৷  সারা বাড়িতে এই জায়গাটা ওর বিশেষ পছন্দের ৷  মার্চ মাসের শেষেই এত গরম ৷ এরপর এপ্রিল, মে মাসে না জানি কি হবে !!  আর অন্য কিছু ভাবতে চেষ্টা করলেও পারছে না তপতী
মনে পড়ে যাচ্ছে !! সব মনে পড়ে যাচ্ছে !! ও মনে করতে চায় না !! চায় না !! সরকারি চাকরিতে প্রমোশন একটু দেরিতেই মেলে ৷ ওপরমহলে তৈল মর্দন না করলেও দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে যে জায়গাটা ও তৈরি করেছিল তারই  ফলশ্রুতি ছিল এই প্রমোশন। সুশান্ত জানতো সে কথা ভালো করেই আর জানতো বলেই ওকে একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছিল দ্বিতীয়বার মা হতে ৷ যদিও হাসি এসে ওর জীবনে মাতৃত্বে পূর্ণতার স্বাদ এনে দিয়েছিল কিন্তু আর দুটো বছর কি ওকে সময় দেওয়া যেত না ? তাহলে তো ও সব সামলে খুশি মনে হাসিকে সংসারে আনতে পারতো ৷ দুঃখে ও সারা জীবন আর প্রমোশানের দিকে পা ই বাড়ালো না। হাসি তাতাকে মানুষ করতে, এই সংসার কে ভালবাসতে, সব কিছু সামলাতে সামলাতে ও নিজেকে ভালোবাসতেই ভুলে গেছে ৷ কতক্ষণ যে বসে আছে ব্যালকনিতে খেয়াল নেই ৷ সুশান্তর গলার আওয়াজে হুঁশ ফিরে আসে –
” কি ব্যাপার ?  আজ কি খাওয়া-দাওয়া হবে না ? “
সেই এক ‘থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় ‘- দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তপতী 
                ***************
বালিগঞ্জে মার কাছে সপ্তাহে অন্তত দুদিন আসে তপতী  ৷ দাদা চলে যাবার পর থেকে মাকে দেখাশোনার পুরো কাজটাই ওকে করতে হয় ৷ মালতীদির কি লাগবে না লাগবে জেনে নিতে হয়। আজও এসে মার বিছানার পাশে বসে ৷
” কিরে? মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন ? ও মালতী ! তোর দিদিকে একটু চা টা দে ৷ “
“হ্যাঁ গো – মাসিমা !  দিচ্ছি ৷ “ 
তপতী মার কথার কোন উত্তর খুঁজে পায় না সেভাবে  ৷ নিজের অভিযোগ , অনুযোগের কথা কোনদিনই সেভাবে   মাকে   বলেনি ও | বাবা-মা কষ্ট করে  মানুষ করেছে ,  চাকরি করতে দিয়েছে,  বিয়ে দিয়েছে। তাদের আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না ৷ তবে বুকের ভার মা বুঝতে পারে  বলেন – ” কি হয়েছে বল না তপু ! ”
” কিছু না মা ! “
দেখ তপু ! এ সংসারে সবকিছু কি আর মনের মত হয় ? এত ভালো স্বামী তোর, তুই নিজে প্রতিষ্ঠিত | এত সুন্দর দুটি ছেলে-মেয়ে !  কিসের অভাব তোর ? যেটুকু পাসনি সেটুকু মানিয়ে নে। এ সংসারে ছেলে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। সংসার  ঠিক রাখতে গেলে মেয়েদেরকে অনেক ত্যাগ করতে হয়। নিজের স্বাদ আহ্লাদ এসব কিছুর দিকে মেয়েদের তাকালে চলে না আর তুই তো চাকরি করিস। তোর আর কি চাই ?”
কোন কথার জবাব দেয় না তপতী ৷ কারণ এই কথাগুলো নতুন কথা নয়, এত বছর ধরে এই কথাগুলোই শুনতে শুনতে ও বড় হয়েছে ৷ কিন্তু এখন মনের ভেতর একটা কথাই শুধু ঘুরপাক খায়  ৷ কেন শুধু মেয়েদেরকেই মানিয়ে নিতে হবে ? কেন ? কেন ? সারাটা জীবন ধরে স্বামী সংসারকে ভাল রাখতে ও চেষ্টা করেনি পাগলের মত ? চেষ্টা করেনি সন্তানদের কাছে শ্রেষ্ঠ মা হয়ে উঠতে ? স্বামীর কাছে শ্রেষ্ঠ স্ত্রী হতে ? কিন্তু যে দায় ওকে নিতে হয়েছে নিজেকে সবার কাছে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে সেই দায় তো সুশান্তর নেই ৷ সুশান্তর  অফিসের কাজ থাকতে পারে, বাড়ি ফিরতে দেরি হতে পারে, সেটা সবার কাছে স্বাভাবিক কিন্তু ওরটা অস্বাভাবিক। অথচ সংসারের জন্য ওর এই যে ত্যাগ এর কোন মূল্য কি তপতী প্রতিদানে ফেরত পেয়েছে ? বরং যখন তখন সুশান্ত ওকে শাশুড়ির কাছে, ওর বন্ধুদের কাছে ছোট করেছে, রান্না নিয়ে ঠাট্টা করেছে। অথচ ও যে দুটো সন্তানকে নিজে পড়িয়ে এত ভালো কলেজে ভর্তি করালো তার জন্য এতটুকু প্রশংসা কারুর কাছে পেয়েছে ? কোনদিন সুশান্ত কি ওকে বলেছে যে তুমি ছেলেমেয়েদের জন্য যা করেছ তা আমি করতে পারিনি। নাকি ও শিক্ষিত মা বলে সেই দায়িত্বটা একমাত্র ওরই ৷ নাকি ওর রান্না করতে ভালো না লাগাটা একটা সাংঘাতিক অপরাধের  মধ্যে পড়ে ? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তপতী কখন যেন বাড়ি ফিরে আসে।                  *************
দুদিন পরের কথা –
দুদিন হয়ে গেছে সরস্বতী কাজে আসছে না। মেয়েটার মোবাইলও নেই যে খবরা খবর নেবে ৷ কি মুশকিল যে হয়েছে ! সকাল থেকে কাজ করতে করতে  ভাবতে থাকে তপতী ৷ আজও ভোরে উঠে রান্না বসিয়ে দিয়েছে ৷ যোগাটাও  ঠিক মত করা হচ্ছে না। কোমরটা গতকাল থেকে অসম্ভব ব্যথা করছে ৷ কবে যে সরস্বতীটা আসবে ? ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলটা বেজে ওঠে, দরজাটা খুলে সরস্বতীকে দেখে মনটা একটু শান্ত হয়। যাক বাবা ! সবে মেয়েটাকে বকতে যাবে দুদিন না বলে কামাই করার জন্য কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না।
” কিরে সরস্বতী ? তোর কি হয়েছে ? মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন ?”
কিছু বলতে পারে না মেয়েটা । ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সরস্বতী,”বৌদি আজ দুদিন মানুষটা থানায় ৷”
” সে কিরে ? কি হয়েছে? ”
“তুমি তো জানো বৌদি সংসারের জন্য, মেয়ের জন্য আমি কতটা পরিশ্রম করি অথচ কি শাশুড়ি কি আমার বর এদের কোন কৃতজ্ঞতা আছে ? উঠতে বসতে শাশুড়ি আমাকে কথা শোনায় ৷ আমি সেজেগুজে বেড়াতে যাই অথচ নিজের ছেলে যে মদ খেয়ে সব পয়সাগুলো ওড়ায়, সংসারটা চলে কিসে শুনি? অনেকদিন বলেছি আমাকে আজেবাজে গালি দেবেনা ৷ গত বুধবার বরটা মদ খেয়ে বাড়ি ঢুকেছিল ৷ শাশুড়ি এ অবস্থায় উস্কাতে লাগলো,” বউ সারাদিন কি করে খোঁজ রাখিস ? এইতো দেখলাম আজকে গোপালের সাথে হেসে হেসে কথা কইছিল। “
ব্যাস এসব শুনে ওর ও গেল মাথা গরম হয়ে, আমাকে ধরে মারতে শুরু করলে। আমি কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা থানায় গিয়ে নালিশ করে দিয়েছি ৷ শাশুড়ি আর বর দুজনকেই থানা থেকে এসে ধরে নিয়ে গেছে ৷ চোখের জল মোছে সরস্বতী,’আমি কি ভুল করেছি বৌদি? কেন আমি সারা জীবন এরকম কষ্ট করে কাটাবো বলো ? অনেক সহ্য করেছি, আর না ৷ এবারে আমি একাই থাকবো, মেয়েটাকে মানুষ করবো। আর যা রোজগার করি মা-মেয়েতে ঠিক চালিয়ে দেব বৌদি ৷ আমি কি ভুল করলাম ?”
তপতী যেন সম্বিত ফিরে পায়
” না – তুই এতটুকুও ভুল করিসনি ৷”
                   *********
দিন দুয়েক পর —
আজ সুশান্ত ওর দুজন অফিসের বন্ধুকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছে ৷ শনিবার তপতীর ছুটি, তাই যথাসাধ্য রান্না করেছে ও। সন্ধ্যেবেলা ঘরদোর গুছিয়ে যথাসম্ভব সুন্দর করে সেজেছে আজ ও ৷ অনেকদিন পরে আজ মনটা বেশ ভালো লাগছে। বাড়িতে তো আজকাল লোকজন আসাই বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর থেকে সুশান্তও বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং টেবিলে ওদের চারজনের আড্ডাটা বেশ জমে উঠেছিল ৷ প্রতিটি রান্নার যেন আজ একটু বেশি বেশি ই প্রশংসা করছিলেন পিনাকীদা ৷ সুপ্রতীক ও ওর সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছিল -” সত্যি বৌদি ! সারাদিন অফিস, সংসার সামলে আপনি যে কি করে এত কিছু করেন সেটা ভাবলেই অবাক হয়ে যাই আমরা !! তারপর আপনি আবার একটা এনজিও চালান ! কি করে যে করেন এতসব ! ”
তপতী যদিও বুঝতে পারে এ কথাগুলো ওরা বলছে ওকে খুশি করার জন্য তবুও কথাগুলো শুনতে ওর বেশ ভালোই লাগছিল ৷
হঠাৎই সবাইকে সচকিত করে দিয়ে সুশান্ত বলে ওঠে,”হ্যাঁ সে আর বলতে ! তোমাদের বৌদি চাকরি করেন, সংসার সামলান, এনজিও চালান, আবার রান্নাও করেন, খাওয়া দাওয়া করেন ওর তুলনা নেই !! কি হল তুমি কি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করবে নাকি আমাদের আইসক্রিমটা দেবে ?”
সুশান্তর গলার স্বরে চাটনির মিষ্টি স্বাদটা সবার মুখেই তেঁতো হয়ে যায়। চুপচাপ সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যায়।
এইরকম ঘটনা আজ নতুন নয় ৷ সুশান্ত যখনই তপতীকে বাইরের মানুষের প্রশংসা পেতে দেখেছে তখনই এক লহমায় বাক্যবাণে ওকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে ৷
সুপ্রতীক ও পিনাকীদা চলে যাওয়ার পরে সুশান্ত ঘরের পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করে ৷ ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করে তপতী রাতে শোবার ঘরে ঢুকলে ও বলে,”এই শাড়িটা গতবার বিবাহ বার্ষিকী তে দিয়েছিলাম না !! বেশ লাগছিল তোমাকে।”
তপতী পোষাক পাল্টাতে বাথরুমে ঢোকে ৷ ইচ্ছা করে যেন দেরি করে আরো বেশি ৷ বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের বালিশ আর চাদর টা নিয়ে ও বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ৷ সুশান্তর মুখে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে ৷ কত দেখলাম ! আবার তেজ দেখিয়ে অন্য ঘরে শোওয়া হচ্ছে !
পরদিন সকালে –
রবিবার বলেই সুশান্তর আজ বোধহয় ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায় ৷ সরস্বতী এসে বেল বাজাচ্ছে ৷ কি ব্যাপার !
“তপতী ! তপতী !” কারো সাড়া নেই ৷ খুব বিরক্তমুখে দরজা খুলে দিয়ে গেস্টরুমটাতে উঁকি মারে ও ৷ না এখানেও তো তপতী নেই ৷ যত্তসব!! সরস্বতী এসে সুশান্তর হাতে চায়ের কাপটা তুলে দেয় ৷ আর দেয় ছোট্ট একটি চিরকুট ৷ সুশান্ত অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায় সরস্বতীর দিকে।
“আপাতত ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি। দিনের পর দিন নিজেকে আর অপমানিত হতে দেব না। সরস্বতী আমার চোখ খুলে দিয়েছে ৷ উকিলের নোটিস পেলে অবাক না হয়ে সই করে দিও। মনে করো সেটাই তোমার সারা জীবনের প্রায়শ্চিত্ত – তপতী” ৷
**********************************************

ব্রতী ঘোষের পরিচিতি
জন্ম,পড়াশোনা সবই কলকাতায় ৷ তিরিশ বছর ধরে ভারতীয় জীবন বীমা নিগমে কর্মরতা। সঙ্গীত অনুরাগী মানুষটি এখন ভালোবাসেন লিখতে ৷ 

 

4 Comments

  • দেবব্রত চৌধুরী

    সুন্দর লেখনীতে বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে । চাকুরতা মহিলাদের ঘরে-বাইরে এই ধরণের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আপোষ নয়, প্রতিবাদী শেষটা ভালো লাগলো ।

  • অগ্নিমিত্র ভট্টাচার্য

    দৈনন্দিন জীবনের গল্প। ” ঘর ঘর কি কহানী” বলা যায় এককথায়। ভালো লাগলো।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!