সত্যদা এবং………
চন্দ্রকান্তি দত্ত
বাড়ি থেকে বেরোতেই কানুর সাথে দেখা। বলল,”কিরে? কবে এলি?”
বললাম,”কালকে।”
কানুর মুখ কিছুটা থমথমে। বলল,”ঘটনা সব শুনেছিস তো?”
কানুর কথাটা আমার ঠিক মাথায় ঢুকল না। কি ঘটনা,কারই বা ঘটনা,কই,আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।
কানু মনে হয় আমার বিমূঢ় ভাব দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারল। বলল,”সে কি রে? তোর বাড়ির লোকেরাই বা কেমন,এত বড় ঘটনাটা বেমালুম চেপে গেল?”
বাড়ির লোকেদের দোষ দেওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। আমি প্রতিবাদ করলাম,”বাড়ির লোকেদের দোষ দিচ্ছিস কেন? কি এমন হয়েছে যে আমাকে বলতেই হবে?”
“আলবাত্ বলতে হবে”,কানু ঝাঁঝিয়ে উঠল,”সত্যদার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা এভাবে কেউ চেপে যেতে পারে না।”
“সত্যদার হারিয়ে যাওয়া?”,কি বলছিস তুই? সত্যদা হারিয়ে যাবে কেন?”
-“সে অনেক কথা। আজ নিয়ে ষোলদিন হল,সত্যদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
* * * * * *
আমাদের সহযাত্রী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা বলুন বা কর্ণধার,সে আমাদের সত্যদা। আমরা বাকিরা শুধুই সদস্য ও সুবিধাভোগী।
সত্যদা। প্রকৃত নাম সত্যরঞ্জন চক্রবর্ত্তী। আপাদমস্তক ভালমানুষ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রচুর সম্পত্তির মালিক। অন্যদিকে আবার নামকরা লেখক। ‘গরুড়’ ছদ্মনামে ছটা উপন্যাসের বই বেরিয়েছে। এছাড়া,স্বনামে ছোটগল্পের বইও আছে গোটাকয়েক। পাঠক মহলে জনপ্রিয়। সে বাবদও কিছু টাকা আসে। কিন্তু এত ধনী হওয়া সত্ত্বেও অহং ভাব নেই। মাটিতে পা রেখেই চলেন।
সোনাবৌদিকে নিয়ে সত্যদার ছোট্ট সুখী সংসার। ওঁদের একটাই দুঃখ,সন্তান নেই। সে খেদ ওঁরা অবশ্য খানিকটা পুষিয়ে নিয়েছেন আমাদের মাধ্যমে।
সত্যদার প্রাসাদোপম বাড়ির বিশাল বৈঠকখানাটাই সহযাত্রী সংঘের ক্লাবঘর। যারা বেকার তারা দুবেলা আসে। যারা পড়াশুনা করছে বা কাজকর্ম,তারা আসে বিকেলে। তবে,কাউকে কোন চাঁদা দিতে হয় না। ও খরচটা সত্যদাই বহন করেন। সোনাবৌদি মিষ্টি থেকে নোনতা,নানারকম খাবার বানিয়ে খাওয়ান। সাথে চলে আমাদের আড্ডা। তবে সব সময় যে নিছক আড্ডা চলে,তা নয়। কিছু গঠন মূলক আলোচনাও হয়।
আমাদের পাড়ার পূজোটা বারোয়ারী। যে সময়ের কথা বলছি,তখনও কোন ক্লাব আলাদাভাবে পূজো করত না। প্রতি বছর পূজোর মাস দেড়েক আগে একটা মিটিং হত। সেখানে কমিটি গঠন করে দুর্গাপূজো পরিচালনা করা হত। ক্রমে দেখা গেল,মিটিং ঠিক মত হলেও,পরিচালন সমিতির সম্পাদক বা কোষাধ্যক্ষ পাওয়া যাচ্ছে না। মধ্য বয়স্ক সবার মধ্যেই দায়িত্ব নেওয়ার অনীহাটা প্রকট। শেষে সত্যদা বললেন,”ঠিক আছে। আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি একটা সমাধান দিতে পারি।”
সবার ঔৎসুক্য দেখে সত্যদা বললেন,”এবার থেকে পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে একজন সভাপতি ও একজন সাম্মানিক সম্পাদক হবেন। তবে পূজোটা পরিচালনা করব আমরা,মানে আমি ও আমার ছেলেরা। পূজোটা কিন্তু বারোয়ারী হিসেবেই হবে,সহযাত্রীর পূজো হিসেবে নয়।”
এত বড় যজ্ঞের হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়ার লোক এত সহজে পেয়ে পাড়ার সবাই এককথায় রাজি। সেই থেকে গত চার বছর এভাবেই চলছে। সত্যদা নিজেই কার্যকরী সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ। আমরা মানে সহযাত্রীর সদস্যরা হলাম কর্মী। চাঁদা তোলা থেকে বিসর্জন পর্যন্ত সব কাজ আমরাই করি।
সত্যদা শুধু যে ক্লাব বা পূজো নিয়ে মেতে থাকতেন,তা নয়। সত্যদার একটা অ্যামব্যাসেডার গাড়ি ছিল। কিন্তু সত্যদা বা সোনাবৌদি ওটাতে বিশেষ চড়তেন না। ওটা পালা-পার্ব্বনে, আপদে-বিপদে পাড়ার মানুষেরই কাজে লাগত। এ বাবদ সব খরচ সত্যদাই বহন করতেন। এক অসাধারণ মনের মানুষ ছিলেন সত্যদা ও সোনাবৌদি।
সব মিলিয়ে আমরা ভালই ছিলাম। ক্রমে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে পরিবর্তন আসতে লাগল। আমরা ছজন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর চারজন উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে চলে গেলাম। আমি উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়তে চলে এলাম। আরও তিনজন সদস্য চাকরী পেয়ে কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্বাভাবিকভাবে সদস্যদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেল।
আমি বছরে দুবার বাড়ি আসি। গরমের ছুটিতে আর পূজোর ছুটিতে। অন্য সময় আর যোগাযোগ থাকে না। তখন মোবাইল ফোন দূরস্থান,সাধারণ টেলিফোনও সব বাড়িতে থাকত না। তাই চিঠি ছাড়া খবরাখবর নেওয়া একরকম অসম্ভব ছিল।
ডাক্তারীর শেষ বছর ও তারপর আরও এক বছর আমি বাড়ি আসতে পারি নি। ফাইনাল ইয়ারের পড়ার চাপ ও তারপর ইন্টার্নশিপ-ফলে বাড়ি আসার কোন উপায় ছিল না।
অবশেষে এবার বাড়ি এলাম। যাচ্ছিলাম সত্যদার ওখানেই। কানুর সাথে দেখা হতেই সব গোলমাল হয়ে গেল। কানু যা জানালো তাতে শরীর ও মন দুই-ই শিউরে উঠল।
গত বছর পূজোর কিছু পরে সোনাবৌদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার জানান,বৌদির শরীরে একটা মারাত্মক ধরনের ক্যানসার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আয়ু বড়জোর দুই থেকে তিন মাস। আড়াই মাসের মাথায় সব যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে বৌদি চলে গেলেন।
সত্যদা এই আঘাত সহ্য করতে পারলেন না। তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। ক্লাব তো গেলই,সাথে সত্যদার নাওয়া-খাওয়া,ঘুম সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সত্যদা কোন কথা বলেন না। বৌদির ছবির দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন।
এমতাবস্থায় কানু ও স্বপন সত্যদার দায়িত্ব কাঁধে তুলে না নিলে কি হত কেউ বলতে পারে না।
সারাদিন সত্যদাকে দেখাশোনা করা,স্নান-খাওয়া করানোর লোক রাখা,সবকিছুর উপরে সজাগ দৃষ্টি দেওয়া,রাত্রে সত্যদাকে শুইয়ে কেউ একজন পাশে থাকা,সব ব্যবস্থাই ওরা করেছিল। সবার মনে আশা ছিল,সত্যদা একদিন এ আঘাত কাটিয়ে উঠবেন,তাঁকে আবার স্বমহিমায় ফেরত পাওয়া যাবে।
কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হল না। একদিন খুব ভোরে কোন একটা শব্দে পল্টুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সত্যদা বিছানায় নেই। লাফিয়ে উঠে এসে দেখল,সদর দরজা খোলা। সত্যদা কোথাও নেই। সবাই মিলে খুঁজেও কোন ফল হল না।
হারিয়ে গেলেন আমাদের সবার প্রিয় মানুষটা।
সময় পেরিয়ে যেতে লাগল আপন গতিতে। ক্রমে সত্যদার খোঁজ করার কাজেও ভাটা পড়ল। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সত্যদা হারিয়েই গেলেন।
* * * * *
বছর চারেক পরের কথা। আমি তখন কলকাতার এক বেসরকারী হাসপাতালে চাকরি করি। রাতে হাসপাতালে থাকি,দিনে স্নাতকোত্তর (এম.ডি)-এর পড়াশুনা করি। একদিন রাত্রে হাসপাতালে গিয়ে ওয়ার্ড পরিদর্শনের সময় দেখি একজন রোগীকে ওরা বিছানার সাথে বেঁধে রেখেছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম,আমাদের হাসপাতালের সাথে চুক্তিবদ্ধ এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকেরা আজকে এই প্রায় অপ্রকৃতিস্থ রোগীকে ভর্ত্তি করে দিয়ে গেছে। কাছে গিয়ে ভাল করে দেখেই চমকে উঠলাম। একরাশ চুল-দাড়ির জঙ্গলের ভিতরে যাঁকে পাওয়া গেল তিনি আর কেউ নন,আমাদের সত্যদা। অপ্রকৃতিস্থ,নোংরা,নানান রোগে আক্রান্ত ও জর্জরিত।
পরবর্তী সাড়ে চার মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে,বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে দেখিয়ে সত্যদাকে যখন অনেকটা সুস্থ করে তুললাম,তখন আনন্দের কোন সীমা-পরিসীমা রইল না। সত্যদা আমাকে এখনও চিনতে পারেন নি ঠিকই,কিন্তু তিনি এখন আর অপ্রকৃতিস্থ নন। শান্ত,সমাহিত,নিশ্চুপ একজন ভালমানুষ।
আবারও আগের মত সব ব্যবস্থা হল। তবে এবার অনেক বেশী আঁটোসাটো,অনেক বেশী সজাগ।
* * * * * *
অনেক বছর পরের কথা। এম. ডি. করার পর প্রায় ষোল বছরেরও বেশী চেন্নাই-এ কাটিয়ে আমি কলকাতা ফিরেছি। মাঝের বছরগুলোতে সমাজে,সংসারে,দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বাইরের পরিবর্তন যা-ই হোক,অন্ততঃ আমার বাড়ির পরিবর্তনগুলো একটু বলা দরকার। কিছুদিন ওখানে থাকার পরে বাবা মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক বছরের ব্যবধানে দুজনকেই হারিয়েছি। আমি ইতিমধ্যে সংসারী। এক কন্যা সন্তানের জনক। কলকাতার বাড়িতে ভাই তার পরিবার নিয়ে থাকে। আমি কলকাতা ফেরার আগেই একটা বাড়ির ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানেই এখন থাকি।
চেন্নাই প্রবাসে নিজের কথা,নিজের উন্নতির কথা,নিজের সংসারের কথা,সবই ভেবেছি। কিন্তু,সত্যদার কথা কখনও সেভাবে ভাবিনি। কখনো-সখনো মনে যে পড়েনি,তা নয়। মনে পড়েছে। কিন্তু কোনদিন ওঁর বিষয়ে গভীর ভাবে কিছু ভাবিনি। ভাবতে ইচ্ছেও করেনি। আত্মবিস্মৃত সত্যদা কেমন আছেন,এতগুলো বছর তাকে কে দেখছে,কিছুই জানতে ইচ্ছে হয় নি। এতটাই আত্মমগ্ন ছিলাম আমি। অথচ,ছাত্র হিসেবে ভাল ছিলাম বলে অথবা অন্য কোন কারণে সত্যদা ও সোনাবৌদি দুজনেই আমাকে একটু বেশী স্নেহ করতেন। পক্ষপাতিত্বও কিছুটা ছিল বৈ কি। এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে কানাঘুষোও চলত। আমি কিন্তু এই পক্ষপাতিত্বটা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতাম। অথচ,সত্যদার বিপদের দিনে আমি পাশে দাঁড়াই নি। আজ মনে পড়ে সত্যদার নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার সময়েও আমি কোন খোঁজখবর করিনি। নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর আমি,বহির্জগতের খোঁজ রাখার কোন তাগিদ অনুভব করিনি।
আমার পুরনো পাড়ার সমরেশদা ও তাঁর ছেলে একদিন কলকাতার বিশিষ্ট বক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে এলেন। চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু নিজের দম্ভের কারণে গম্ভীর থাকলাম। চলে যাওয়ার আগে পঞ্চাশোর্দ্ধ সমরেশদা বললেন,”একটা কথা বলব?”
বললাম,”হ্যাঁ বলুন।”
সমরেশদা অত্যন্ত কুন্ঠিত স্বরে বললেন,”তুই বোধহয় আমাকে চিনতে পারিস নি। আমি তোর সমরদা।”
মিথ্যেকথা বলতে হল,”ও আপনি মানে তুমি সমরদা? এই দেখো। আমি চিনতেই পারিনি। নামটা দেখে চেনা উচিৎ ছিল। আসলে,এতগুলো বছরের ব্যবধান,তার উপরে কাজের চাপ, কিছুই মনে থাকে না।”
সমরদা বললেন,”সত্যর খবর জানিস?”
বলতে বাধ্য হলাম,”না সমরদা,কিছুই জানি না।”
-“সত্য আবার কোথাও চলে গেছে।”
-“সে কি? কবে?”
সমরদা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,”ছ-সাত বছর হবে,তাই না রে?”
ছেলে বলল,”না বাবা। আট বছর তো বটেই।”
আমি বিস্ময় প্রকাশ করলাম,”ইস,আমি কিছুই জানতে পারি নি।”
ওরা কি মনে করলেন জানিনা। বললেন,”চলি রে।”
বললাম,”দাঁড়াও সমরদা। এই টাকাটা নিয়ে যাও।”
নিতে চাইলেন না। বললেন,”না না। ওটা তোর ফি।”
সবিনয়ে বললাম,’তোমার কাছে ফি নেব,এত অভদ্র হয়ে যাই নি সমরদা। আর হ্যাঁ। ফি নিলাম না বলে আমার কাছে চিকিৎসা বন্ধ কোরো না। আমিই তোমাকে সুস্থ করে তুলব। মনে
থাকবে তো?”
সমরদা হেসে বিদায় নিলেন।
সমরদার চিকিৎসা চলল প্রায় এক বছর। সমরদা এলে কখনো আমি সত্যদার কথা জিজ্ঞাসা করতাম,কখনো বা সমরদা নিজেই বলতেন। সমরদার চিকিৎসা শেষ হলে সত্যদা আবার
স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন।
নিজের উন্নতিতে,নিজের পসারে গর্বিত আমি কলকাতায় থাকলেও নিজের পুরনো বাড়িতে যাই নি বহু বছর। আজ প্রায় সত্তরের দোরগোড়ায় ভাইয়ের ছেলের বিয়েতে গেলাম। পুরনো দিনের যারা ছিলেন,তাদের সাথে নতুন করে চেনাজানা হল। অনেক পুরনো কথারও আদান-প্রদান হল। স্বাভাবিকভাবেই সত্যদার কথাও উঠল। এত বছর পরেও সত্যদার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। সত্যদা চিরতরে হারিয়েই গেছেন।
অনেক রাতে চলে আসার সময় অশীতিপর গনেশকাকু গাড়ির কাছে এগিয়ে এলেন। আমি কাকুর হাত ধরে বললাম,”আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন কাকু?”
কাকু ধীরে ধীরে বললেন,”বহু বছর আগে আমি একটা অপরাধ করেছিলাম। এখনও সেই ঘটনাটা আমাকে বড় কষ্ট দেয়।”
সারাদিনের প্র্যাকটিস,তারপর এই বিয়ে বাড়ির হট্টগোল,সব মিলিয়ে এই প্রায় মাঝ রাতে আর এসব আবেগপূর্ণ কথাবার্তা ভাল লাগছিল না। তবু বললাম,”কেন কাকু? কি হয়েছে?”
কাকু বললেন,”সোনা তখন খুব অসুস্থ। সত্য তোকে একটা চিঠি লিখেছিল মেডিকেল কলেজের ঠিকানায়। নিজে যেতে পারেনি বলে আমাকে দিয়েছিল ডাকবাক্সে ফেলার জন্যে। আমি সেটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কাউকে বলিনি। সত্যকেও না। অনেকদিন পরে একটা বই-এর ফাঁকে সেটা খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই থেকে ওটা আমার কাছেই আছে। আমি খুলি নি। তুই কি ওটা নিবি।”
আমি সাগ্রহে বললাম,”হ্যাঁ কাকা। কেন নেব না? আপনার সাথে কি এখন আছে?”
“হ্যাঁ,এই নে”,বলে গনেশকাকু প্রায় হলদে হয়ে যাওয়া বন্ধ একটা ইনল্যান্ড লেটার আমার হাতে দিলেন।
* * * * * * * *
রাত্রি অনেক হয়েছে। হয়ত বা বারোটা। আমি বাইরের খোলা বারান্দায় বসে আছি। হাতে কালের প্রবাহে জীর্ণ হয়ে যাওয়া সেই চিঠি। সত্যদার লেখা চিঠিটা এই নিয়ে আমি চারবার পড়লাম। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যে উপলব্ধি আজ হল,সেটা সময়ে হলে কি হত সে প্রসঙ্গ আজ অবান্তর। জীবনে আমি পেয়েছি অনেক। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি,যা হারিয়েছি তার মূল্যও কিছুমাত্র কম নয়। সত্যদা ও সোনাবৌদি আমাকে একটু বেশী ভালবাসতেন,সেটা জানতাম। আমার প্রতি যে ওদের পক্ষপাতিত্ব ছিল,সেটাও কারও নজর এড়ায় নি। কিন্তু সে ভালবাসা যে সন্তান স্নেহে ভালবাসা সে উপলব্ধি আমার কোনদিন হয়নি। সন্তানহীন দম্পতি যে আমার মধ্য দিয়েই তাঁদের সন্তানহীনতার দুঃখ কিছুটা অন্ততঃ ভুলতে চেয়েছিলেন সে বোধ আমাকে ছুঁতে পারে নি। আসলে আমি নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে এতটাই বিভোর ছিলাম যে আমি তাঁদের ভালবাসা পুরোমাত্রায় উপভোগ করেছি,কিন্তু তাঁদের এই ব্যবহারের কারণ বা তাৎপর্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাই নি। সত্যদা লিখেছিলেন,বৌদি তাঁর শেষ সময়ে আমাকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আমাকে কিছু দেওয়ার ছিল। চিঠি না পাওয়ায় আমি তা জানতে পারি নি। পেলেও ফাইনাল ইয়ারে আমি সে ডাকে হয়ত সাড়া দিতাম না। কারণ,শেষ দুবছর আমি নিজের বাড়িতেও আসি নি।
পরমা উঠে এল। বলল,”কি হল? শোবে না? অনেক রাত হয়েছে তো।”
আমি বললাম,”হ্যাঁ শোব। তুমি শুয়ে পড়। আমি আর একটু বসব।”
– শেষ –
*************************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে,তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও,শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন,চাকরী থেকে অবসরের পরে,প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
খুব ভালো লাগলো
আমি সম্মানিত হলাম। অশেষ ধন্যবাদ।