**স্মৃতিচারণ সূত্রে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন**
||অখ্যাত মহান শিক্ষক ‘ননী স্যার’||
জয়িতা সরকার
স্কুল,টিউশন,বইপত্র বাছাই ইত্যাদি নিয়ে আজকাল অভিভাবকদের চিন্তার শেষ নেই। বাড়ির পরে ছাত্রজীবনে ছেলে-মেয়েদের জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটে স্কুলে, নানা কোচিং সেন্টারে।আগামী দিনে তারা কেমন মানুষ হয়ে উঠবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে পথপ্রদর্শকের দক্ষতা-আন্তরিকতার উপর। আমার দেখা এমন এক শিক্ষকের কথা এখানে লিখছি, যিনি নীরবে বিস্ময়কর সেবাদান করে গেছেন অতুলনীয় পরিশ্রমে, দিনের পর দিন। নিঃশর্ত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে।বীরভূমের দুবরাজপুর ও তার আশপাশের অঞ্চলের মানুষের কাছে সুপরিচিত সেই এক মহান শিক্ষকের স্মরণে এই লেখা।তিনি স্বর্গীয় ‘ননী স্যার’ (ননী গোপাল দত্ত), এক আদর্শ শিক্ষাব্রতী। কি তার পুরস্কার? কই উপযুক্ত মানপত্র?
নাঃ ।সেই অনুসন্ধান বুঝি বা এক অবান্তর ভাবনা। কিছু ছাত্রের হৃদয়ে-শিক্ষা-দীক্ষায় তিনি বসত করেন,এইটুক প্রাপ্তি কেবল। অলক্ষ্যে কর্মের ঈশ্বর বলে কেউ যদি থাকেন, তবে তিনিই কেবল দেখেছেন।আর বড় স্বীকৃতি কিছু নেই, দেশের আরো অনেক মহান অথচ অবহেলিত মানুষের মতন।
মহাপ্রাণের ঔজ্জ্বল্যের ধারে কাছে পৌঁছতে পারেন এই সমাজে কয়জন, খুঁজে পাওয়া মুশকিল।জনপ্রিয় এক মহান শিক্ষক স্বর্গীয় ননী স্যার।ছাত্রদের ভালোবাসা ও পাঠদানের ক্ষেত্রে সর্বত্যাগী মানুষটির তুলনা মেলা ভার,এটা একদম সত্যি কথা। ওখানকার মানুষজন জানে ,কত অকল্পনীয় পরিশ্রম এই অতি সহজ সরল প্রচারবিমুখ মানুষটির।তাঁর কর্মক্ষেত্র দুবরাজপুর নিম্নবুনিয়াদী শিশু বিদ্যাপীঠ-এর সামনে আমাদের বাড়ি ছিল, উদার মাঠ, প্রান্তর ,চারপাশে ছোট বড় পাথর, অদূরে মামা-ভাগ্নে পাহাড়-কালীমন্দির-থানা- লাইব্রেরি- লায়েকপুকুর… বারান্দা থেকে বা জানলা থেকে তাঁর আসা-যাওয়া দেখতে পেতাম আমরা। মুখে সব সময় শিশুর মতন নির্মল হাসি লেগে থাকতো। পায়ের সমস্যা ছিল ।তাই চটি,জুতো পরতেন না। এই বিষয়ে কেউ হয়তো একটু যত্ন নিয়ে কিছু ব্যবস্থা করে দেবারও ছিল না। খালি পায়েই সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতেন কর্মক্ষেত্রে এবং কাজ করতেন নির্ধারিত সময়ের বাইরে বাড়তি সময়েও। হ্যাঁ, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও অন্য গ্রাম থেকে হেঁটে অনেকটা রাস্তা পার হয়ে খালি পায়ে চলে আসতেন কোন মন্ত্রবলে কি জানি!
একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। কিন্তু এত স্বার্থ ত্যাগ, চাহিদা ও অভিযোগ দূরে রেখে এত সরল অথচ কষ্টকর জীবনযাপন খুব কম মানুষই করতে পারে। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সমস্ত প্রচারের আড়ালেই রয়ে গেলেন স্যার। শুধু স্থানীয় কয়েকজনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে থেকে গেলেন।তাঁর একটুখানি ছায়া,শব্দ দেখতে শুনতে পেলে দূর দূর থেকে লোকে ছুটে আসতো প্রণাম করার জন্য। যেন প্রণামের মাধ্যমে পুণ্য অর্জনের প্রতিযোগিতা লেগে যেত শিশুদের মধ্যে, আর তিনি হাসিমুখে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে সেই অত্যাচার সহ্য করতেন থেমে থেমে হাঁটতে হাঁটতে। থাকতেন সদাহাস্যময়। সাধারণ মানের সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে ছাত্রদের জন্য বেশ কিছু বই একখানা সাদা থলির মধ্যে ভরে নিয়ে খানিকটা হাতে আর খানিকটা পিঠে-কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতেন ।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘর ও বারান্দাগুলোর একটা জায়গায় বসে বিনা পয়সায় পড়াতেন।কারা তা থেকে ফায়দা তুললো, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কারণ অর্থ তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না। পিছিয়ে পড়া বদমাশ ছাত্রকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাস করতে দেখেছি এইভাবে পড়ে। তাঁর পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছা হয় নীরবে এই স্মৃতিচারণের রচনাটি লিখতে লিখতে।
তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্র মাননীয় আসিফ আহম্মদ একবার স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ” বড় বড় দাদা দিদিদের বই হাতে নিয়ে আসা ধুতি পাঞ্জাবি পড়া মৃদুভাষী স্যার হাসতেন ভারী চমৎকার৷ মুখমন্ডলে কোন রাগ দেখেছি বলে মনে পড়ে না কখনো৷ কোন শিক্ষার্থীকে মারতে দেখিনি৷ স্কুল শেষে কলেজের অনেক দাদা দিদি একত্রিত হতেন ওনার কোচিং ক্লাসে৷ স্কুলে ছুটির ঘন্টার পর শিশু বিদ্যাপীঠের ক্লাসরুমে মেঝেয় বসে পড়াতে দেখেছি৷” তিনি স্যারের বিদ্যালয়ে পড়ানোর কৌশল সম্পর্কে মূল্যবান অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, ” অসাধারণ তাঁর পড়ানোর কৌশল৷ ছোটদের পড়ানোর সময় এক মজার বাতাবরণ তৈরি করার যেমন মুন্সিয়ানা, আবার অন্যদিকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ভাবগম্ভীর পরিবেশে পড়াতেন…৷” স্থানীয় দীপক মুখার্জী, অপূর্ব মুখার্জী ,শ্যামাপ্রসাদ কর্মকার, শ্রাবন্তী গাঙ্গুলি ,শিউলি মিশ্র নায়েক, অদিতি চ্যাটার্জী, বিপ্লব রায়, রজত সরকার প্রমুখ আজও তাঁর কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধায় নতজানু হন। জনৈক ছাত্রের স্মৃতিচারণ, ” স্যারের হাতের লেখা ছিল মুক্তাক্ষর, তিন রকম কালির কলম ব্যবহার করতেন লাল, সবুজ ও নীল, স্যারকে কোনোদিন কালো কালি ব্যবহার করতে দেখিনি। কোনো বানান ভুল হলে স্যার সেটি লাল কালির কলমে কেটে সংশোধন করে দিতেন।স্যারকে কোনোদিন রুষ্ট হতে বা দুঃখ পাওয়ার মতো ধমক দিতে দেখিনি।আমি ভাগ্যবান, তাই আমার জীবনে একজন এমন আদর্শ শিক্ষক মশাই-এর কাছে শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছি। ভগবানের শ্রী চরণস্পর্শ পেয়েছি।”
সত্যিই তাঁর মূল্যায়ন হয়নি। তবুও এক দরদী সমাজসেবী,আদর্শ শিক্ষক হয়ে আজীবন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন মহান ননীস্যার । ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি,এমন প্রণম্য মানুষের বিষয় মোটেই ঠিকঠাক ভাবে তুলে ধরতে পারলাম না। তবুও যেটুকু লিখলাম তাতে আমি ধন্য।
(ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : শ্যামাপ্রসাদ কর্মকার,বিপ্লব দাস।)
*************************************
জয়িতা সরকার (বৈদ্যবাটী,হুগলী জেলা)