অঙ্গীকার
স্বাগতা ব্যানার্জি
সকাল থেকেই মন টা খচ খচ করছে। কতকরে বারণ করলো শীলা আজ বাড়ি থাকো,যেও না।
সীমান্ত একটু কাছে এগিয়ে গাল ধরে আদর করে বললো,
ওই তো একটু দোকান,ডিসেম্বর মাস,জানো তো কত লোক বেড়াতে বেরোয়,চা টিফিন একটু বেশি ই বিক্রি এখন । এই ভরা ব্যবসার সময় বাড়ি থেকে সময় নষ্ট করা উচিত?
শীলা জানে সব বোঝে ও । একটু আবদার করেই বলে একদিন ও কি নিয়ম ভাঙতে নেই। একদিন না হয় একটু আনন্দই করলাম। ফড়িং দূরে বসে শুনছিলো হঠাৎ ই বলে,’হ্যাঁ দাদা আজ থাক।’
ফড়িং ডাক নাম,ভালো নাম সুমন্ত। কিন্তু কেউ ই ফড়িং ছাড়া ডাকে না। ফড়িং ক্লাস টেনের এর ছাত্র। ছুটির দিন দাদাকে পূর্ণ সাহায্য করে।
সীমান্ত চোখ বড় বড় করে বলে এলেন বৌদির পোঁ,’ তুই ও চল আজ দোকানে।সীমান্ত এক প্রকাশনীর প্রুফ রিডার, কিন্তু কাজ শেষে দম দম স্টেশনে ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এই টিফিনের ছোট্ট দোকান। বিকালে কাজ সেরে প্রতিদিন ৫ টা থেকে ১০ টা দোকান চালায়। আর ছুটির দিন সকাল বেলা খোলা হয়।দুটো একবারে ভিন্ন জীবিকা কি করে সামলায় তা সে নিজেই জানে। কিন্তু সকলেই এই শিক্ষিত ছেলেটিকে খুব স্নেহ করে ভালোবাসে।
প্রায় জোর করেই ফড়িং কে নিয়ে চললো সীমান্ত।
বেলা আড়াইটা নাগাদ দুজন ফিরবে,এরমধ্যে রান্না শেষ করে শীলা খুব যত্ন করে নিজেকে সাজাচ্ছে।
সিঁদুর পড়তে গিয়ে কিভাবে জানি হাত থেকে গেল পড়ে।
বার বার নিজের শাঁখা,পলা, নোয়া মাথায় ঠেকিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে সে, রক্ষা কর প্রভু।এও ভাবলো সীমান্ত থাকলে ঠিক বলতো কোনো ভয় নেই,অন্যমনস্ক ছিল তাই পরে গেছে।
কিন্তু এখন কেউ এলো না কেন? ৩ টে যে বেজে গেল।
খানিক পর ই বাচ্চু দা, ওদের পাশের দোকানদার , সে এসে বললো, ‘চলো একটু যেতে হবে। ‘
‘কোথায়?’
জানতে চাইলে বাচ্চু দা বলে ‘চলো না।
শীলা বলে,’ ও আর ফড়িং এখনই খেতে আসবে ,আমি গেলে ঘরে ঢুকবে কি করে?
তুমি বস দাদা,ওদের সাথে দুটো খেয়ে ওকে বলেই যাবো না হয়।’
বাচ্চু অস্থির হয়ে ওঠে,’ না,ওরাই নিয়ে যেতে বললো তোমায়।’
শীলা বলে ,’ ও তোমায় নিয়ে যাবার কথা বলেছে কেন? বললে তো আমি একাই চলা যেতাম।’
বাচ্চু দা বলে ,’ চল দেরি হয়ে গেছে ।’
অগত্যা শীলা দরজায় তালা দিয়ে বলে চলো।
বাচ্চু দা একটা অটো নেয়। শীলা বলে ,’স্টেশন তো হেঁটেই যাই অটো কেন দাদা?’
বাচ্চু বলে ,’তাড়াতাড়ি যেতে হবে তো।’
অটো যখন স্টেশনের দিকে গেল না,তখন শীলা র মন কিরকম একটা করছে কিন্তু কিছু বলে নি।
কিছুক্ষণ পর R.G.Kar Medical College Hospital এর সামনে থামতেই বুঝলো । ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে একটা স্ট্রেচারের ওপর সীমান্ত,ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে।
ফড়িং কিছু দূরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
বৌদি কে দেখেই বললো প্ল্যাটফর্মে উঠেই বলে,’ ফড়িং আমাকে একটু জল দে তো। বুকটা কেমন করছে।’
ফড়িং জল দিতেই পড়ে যায়। ওরা মিনিট ৫ এর মধ্যেই অটো করে হসপিটালে আনে, কিন্তু ততক্ষণে শেষ। ম্যাসিভ হার্ট এট্যাক।
শীলা কিছু বুঝতে পারছিল না, বার বার সীমান্ত কে ঠেলে তুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে তো চির নিদ্রায়।
শ্মশান এ পোড়ানোর আগে সীমান্তের পকেট থেকে অনেক গুলো টাকা , আর একটা চিরকুট পেয়েছিল। সীমান্ত প্রতিদিন একটা করে কিছু লিখে, এই ৪ বছরের সংসারে অন্তত ৪০০ টা চিরকুট দিয়েছে শীলা কে। আজ শেষ দিনেও সে ভুল হয়নি। শুধু নিজের হাতে দিতে ভুলে গেছিল।
চিরকুট টায় লেখা ছিল,
দিতে চাই তোমাকে,
একটা নীল আকাশ, শান্ত সমুদ্র, আর দুহাত ছড়ানো এক সবুজ পাহাড়।
কিন্তু সাধ থাকলেও সাধ্য নেই গো, আমার।
ওই তুমি নামের ফুলের ওপর ফড়িং,
আধখানা দোকান আর শ খানেক চিরকুট,
এই রইলো আমি হয়ে তোমার কাছে,
পারবে না পার হতে পারাবার?
যে মানুষ টা তার স্বপ্নের সব কিছু তে শীলা কে রেখে গেছে বিনা দ্বিধায় ,কেন পারবে না শীলা ঘুরে দাঁড়াতে, তার কাছে তো একটা সিঁড়ি আছেই।
শীলা শক্ত হয় ফড়িং কে বলে ,’আমি তো আছি ভাই, ভরসা রাখ তোর বৌদির ওপর। তোর দাদা ভাসিয়ে দিয়ে যায় নি আমাদের , আমরা ঠিক পারবো। পারতেই হবে।’
শীলা চিরকুট টার তলায় লেখে,
কে বলেছে সাধ্য নেই তোমার?
তুমি তো জানো? আমার চাহিদা তে কোথাও আকাশ,সমুদ্র ,পাহাড় ছিল না।
ছিলে,তুমি, ফড়িং আর তোমার চিরকুট।
তুমি তো সঙ্গেই রইলে আমার আর বাকি যেটুকু সম্বল তাই নিয়েই করবো পার,পারাবার ,
এ রইলো আমার অঙ্গীকার।।
******************************************
স্বাগতা ব্যানার্জী পরিচিতিঃ
বাণিজ্য বিভাগে অনার্স সহ স্নাতক। খুব ভালবেসে সকল কে নিয়ে থাকতে ভালবাসেন। ছোটবেলা থেকে লেখা লিখি করেন আর ভালবাসেন গান গাইতে ও পড়তে।
করুণ কথার কাহিনী 😌