পথ্য
সুজয় দত্ত
দুশো বাহাত্তর নম্বরের রুগী আজই ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট থেকে ছাড়া পেয়ে জেনারেল বেডে এসেছে। অবস্থার উন্নতিতে সকলের চোখে মুখে স্বস্তির ছাপ। আর ইন্ট্রাভেনাস নয়,এবার পথ্য খাবে। নিজের মুখে। জেনারেল ওয়ার্ডের মেট্রনের কাছ থেকে নির্দেশ যায় রান্নাঘরে। কী কী খেতে বলেছেন ডাক্তারবাবু,কী কী দেওয়া বারণ। পাশে দাঁড়ানো একশো সাতান্নর আয়া। কাঁচুমাচু মুখ,বিব্রত,মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। একটু আগেই সবার সামনে বকুনি খেয়েছে মেট্রনের। সেখানকার হার্টের রুগীকে আজ দুপুরে নুন ছাড়া খাবারের বদলে নুন দেওয়া খাবার খাওয়ানো হয়েছে ভুল করে,ওয়ার্ডের আর-এম-ও এসে মেট্রনের ওপর চোটপাট করে গেছে। সেই ঝাল ঝাড়া হচ্ছে এখন আয়ার ওপর। “ট্রে-র গায়ে লেখা থাকে না তো কী হয়েছে? যখন ট্রলিতে করে দিয়ে গেছিল তখন কোথায় যাওয়া হয়েছিল ঘর ছেড়ে? রিপোর্ট করব সুপারকে?”
“সরকারি হাসপাতালের ব্যাপার স্যাপারই ঐরকম। জানেনই তো সব” পান চিবোতে চিবোতে মারুতি গাড়ীর দরজা খুলে হার্টের রুগীর ছেলেকে বলল তার ভায়রাভাই,”সেইজন্যেই তো আপনাকে বলেছিলুম,বাড়ীর কাছে অত ভাল লাইফকেয়ার নার্সিং হোম রয়েছে,ওখানে দিন। আপনি শুনলেন না। খরচা পাতি যা লাগত সে নাহয় আপনি আমি দুজনে মিলে–“
যাঁকে বলা হচ্ছে তাঁর মেজাজ একটু আগে হাসপাতালের আর এম ও-র সঙ্গে রুগীর পথ্য নিয়ে খিটিমিটির দরুণ এমনিতেই খিঁচড়ে ছিল। ভাইরাভাইয়ের ঠেস দেওয়া কথায় তা একেবারে চিড়বিড়িয়ে উঠল। তাই সামান্য একটা গর্ত পেরোতে গিয়ে গাড়িটা একটু ঝাঁকুনি দিতেই “কী হয়েছে কী তোর? দেখে চালাতে প্যারিস না?” বলে ছোকরা ড্রাইভারকে এমন ধমক দিলেন,সে বেচারার হাত থেকে স্টিয়ারিং কেঁপে গিয়ে গাড়ীর একটা চাকা উঠে পড়ল ফুটপাথে। সেখানে পা ছড়িয়ে শুয়ে বিশ্রাম করছিল একটা নেড়ি কুকুর–তার পিছনের পা দুটো একেবারে পিষে দিয়ে চলে গেল। আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হল তার আর্তচীৎকারে।
অবশ্য বাবাকে তিনি সরকারী হাসপাতালের বদলে লাইফকেয়ার নার্সিং হোমে ভর্তি করতেনও যদি,আজ অন্ততঃ সেখানকার কারো কাছেই পাত্তা পেতেন না সেই অশীতিপর বৃদ্ধ। কারণ সেখানে এখন অন্য নাটক চলছে। এলাকার এক জাঁদরেল রাজনৈতিক নেতার বাড়ীর লোক সেখানে ভর্তি হবে আজ,তাই একেবারে সাজোসাজো রব। সুপার থেকে ঝাড়ুদার অবধি সবাই শশব্যস্ত। শহরের সেরা সার্জন অপারেশন করতে আসছেন,তাই অপারেশন থিয়েটারে সবকিছু একদম ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে রেডি। তিনতলার স্পেশ্যাল কেবিনেও পরিপাটি ব্যবস্থা–স্পেশ্যাল নার্স,স্পেশ্যাল অ্যাটেন্ডেন্ট,এবং অবশ্যই স্পেশ্যাল মেনু। এরকম ভি আই পি পেশেন্টকে কি সাদামাটা পথ্য খাওয়ানো যায়?
নার্সিং হোমের বাইরেটাও পরিষ্কার-টরিস্কার করে ঝকঝকে তকতকে রাখা হচ্ছে। উপচে পড়া ডাস্টবিন আর জঞ্জালের ভ্যাটগুলো সাফাই করা হয়েছে অনেকদিন বাদে। ফলে বিরাট পাঁচতলা বাড়ীটার পেছন দিকে দারোয়ানদের খুপড়িগুলোর ফাঁকে ফাঁকে যে কুকুর-বেড়ালেরা সংসার পেতে আছে বংশ পরম্পরায়,তাদের আজ খাবার জুটবে কোথা থেকে কে জানে? ওই ভ্যাট থেকেই তো রোজ কাড়াকাড়ি,মারামারি করে খায়।
যাইহোক,এদিকে অপারেশনের আয়োজন তো সব শেষ,কিন্তু সার্জন কোথায়? তাঁর তো দেখা নেই। ও-টির সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, নেতাসাহেব ভুরু কুঁচকে বারবার মোবাইলে ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছেন। কিন্তু আসল লোক সেই নো-পাত্তা। শেষে জানা গেল শহরের সবচেয়ে বড় আর দামী বেসরকারী হাসপাতাল-এ আজ সকাল থেকে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির অর্থাৎ খাদ্যপাচনতন্ত্রের ওপর যে সেমিনার চলছে সেখানে তিনি প্রধান বক্তা। সেমিনার শুরু আর শেষ–দুটোই হয়েছে দেরী করে,তাই আটকে পড়েছেন। এবার আসছেন। আসলে ওখানে এই বার্ষিক সেমিনারের পাশাপাশি এবছর আরো একটা জিনিস হচ্ছে–ক্যুলিনারি মেডিসিনের বড়সড় কনফারেন্স। সারা দেশের অসংখ্য হাসপাতাল,মেডিক্যাল কলেজ আর নার্সিং হোমের হেঁশেলের অভিজ্ঞ,আধা-অভিজ্ঞ বা শিক্ষানবীশ রাঁধুনিরা শিখতে এসেছে কিভাবে কম অপচয়ে আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভাল পথ্য রাঁধা যায় নানাধরণের রুগীর জন্য,কিভাবে পথ্যই হয়ে ওঠে রোগ প্রতিরোধ আর রোগ নিরাময়ের হাতিয়ার। সেখানেও সার্জন সাহেব গালভরা বক্তৃতা দিয়ে এসেছেন এথনোমেডিক্যাল গ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে। কিন্তু তারপরেই যে মোটরে চেপে হুশ করে চলে আসবেন নার্সিং হোমে অপারেশন করতে,সে-গুড়ে বালি। এমনই কপাল,আজই আবার শহরের এই দিকটায় পৌরসভার স্থানীয় ওয়ার্ডের গাড়ী এসেছে সাতসকালে বেওয়ারিশ কুকুর ধরার অভিযানে। এটা সত্যি যে এই এলাকার পথেঘাটে ইদানীং বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বেড়েছে বেশ,কিন্তু পৌরসভার টনক নড়েছে মাত্র কদিন আগে,যখন খোদ স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীকে এই হাসপাতালের গেটের সামনে ঘেয়ো পাগলা কুকুরে কামড়ালো। তাই কর্তৃপক্ষ আজ বাহিনী নিয়ে এসেছে নেড়িকুত্তার বংশ উজাড় করতে। অতএব দুর্ভোগ–এই রাস্তা বন্ধ,ওই রাস্তা ওয়ান ওয়ে,সেই রাস্তায় বিরাট জ্যাম। সার্জন সাহেবের চকচকে নতুন টয়োটা ইনোভা তাতেই ফেঁসে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে। আর ঘড়ির কাঁটা দৌড়োচ্ছে।
না না,শেষ অবধি তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশনও হয়েছিল ভালভাবে। রুগীকে স্পেশ্যাল কেবিনের স্পেশ্যাল যত্নআত্তি আর স্পেশ্যাল পথ্যের জিম্মায় রেখে নেতাবাবুও নিশ্চিন্তে বাড়িমুখো হয়েছিলেন। আর সস্তা সরকারী হাসপাতালের জেনারেল বেডের সেই হার্টের রুগীকেও ঠিকঠাক নুন ছাড়া পথ্যই দেওয়া হয়েছিল তারপর থেকে। আর ভুল হয়নি।
ব্যস,গল্প তো তাহলে এখানেই শেষ,তাই না? হ্যাঁ,শেষই হয়ে যেত,কিন্তু–কিন্তু হল না। কারণ? কারণটা খুব অদ্ভুত। একটা বুড়ী– একটা ময়লা-ময়লা কাপড় পরা,ছেঁড়া চটি পায়ে,সাদামাটা চেহারার বুড়ী। লোকে বলে তাকে নাকি রোজ দুপুরে ওই সরকারী হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে,বিকেলে ওই পাঁচতলা নার্সিংহোমটার পিছনের গলিঘুঁজিতে আর সন্ধ্যেবেলায় ওই বিশাল বেসরকারী হাসপাতালের উল্টোদিকের চিলতে মাঠটায় দেখা যায়। কোনো মারুতি-সুজুকি বা টয়োটা ইনোভা নয়,বাস-ট্রামও নয়, সে পায়ে হেঁটেই এতটা পথ,আবার পায়ে হেঁটেই মিলিয়ে যায় সন্ধ্যের অন্ধকারে কোথায় যেন। অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটে,মুখে সারাক্ষণ কী যেন বিড়বিড় করে,আর দুহাতে ধরে থাকে দুটো রংচটা বালতি। সবাই ওকে “পাগলী” বলে হাসাহাসি করে,ফুটপাথের বাচ্চা ছেলেগুলো ওর গায়ে ঢিল ছোঁড়ে,কিন্তু ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। একেকটা জায়গায় গিয়ে উবু হয়ে বসে,কাঁধের ছেঁড়া ব্যাগটা থেকে বার করে কয়েকটা সস্তা প্লাস্টিকের থালা। আর তারপর? সেই থালায় বালতি থেকে বেড়ে দেয় বাসি ফেনাভাত। মুখে শব্দ করে ডাকে “আঃ আঃ আঃ আঃ”। যাদের ডাকে তারা ওর ভাষা বোঝে না ঠিকই,কিন্তু আসে। লাফাতে লাফাতে,লেজ নাড়তে নাড়তে,কুঁই কুঁই করে গা ঘষাঘষি করতে করতে। হাড়জিরজিরে,ঘেয়োপচা চেহারাগুলো তৃপ্তি করে খেতে থাকে যতক্ষণ না ফুরিয়ে যায়। সেই যে ফুটপাথের নেড়ি কুকুরটা–যার পায়ের ওপর দিয়ে গাড়ীর চাকা চলে গেছিল–মনে আছে? সেই যে নেতা আসবে বলে জঞ্জালের ভ্যাট পরিষ্কার করায় একদল কুকুর-বেড়ালের সারাদিন খাওয়া জোটেনি। সেই যে দু-মাসের পোয়াতি মা-কুকুরটা পড়িমরি করে পৌরসভার সাঁড়াশি অভিযানের নাগাল এড়িয়ে পালিয়ে সারাদিন লুকিয়েছিল একটা ড্রেনপাইপে। ওই বুড়ী নাকি এসে ওদের আজ খাইয়ে গেছে পরম স্নেহে,যত্নে,মমতায়। ইস,কী নোংরা,বিচ্ছিরি ব্যাপার বলুন তো !
************************************
সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।