বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ গুপ্তিপাড়ার নামকরণের ইতিহাস
অনির্বাণ সাহা
পশ্চিমবঙ্গ তথা হুগলি জেলার প্রাচীন জনপদগুলির মধ্যে অন্যতম স্থানে রয়েছে সুপ্রাচীন, বিখ্যাত ও বর্ধিষ্ণু গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের নাম । হুগলী জেলার বলাগড় থানার অধীনে উত্তর-পূর্ব প্রান্তে বর্ধমান জেলার সীমানায় গঙ্গা বা ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই গুপ্তিপাড়া । এছাড়াও বেহুলা নদীর অবস্থানও প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যেত । এই অঞ্চলটি বর্তমানেও “গোপতিপাড়া” নামেও অনেকের কাছে পরিচিত । এই অঞ্চলটির প্রাচীনত্তের প্রমাণ পেতে টাইম মেশিনে করে আমাদের ফিরে যেতে হবে চতুর্দশ শতকে । তৎকালীন সময়ে ১৪১৮ খ্রীস্টাব্দে পান্ডুয়ার রাজা গণেশের পুত্র জালাউদ্দিন মোহাম্মদ শাহের রাজ্যাভিষেক হয় । তারপরই রাজ্যজুড়ে শুরু হয় তৎকালীন হিন্দুদের ওপর বিভিন্ন রকম অত্যাচার । সেই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই সেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মানুষেরা রাজ্যের তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে । অনেকে মনে করেন এই এই অঞ্চলেও তৎকালীন সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা পালিয়ে এসে একটি বসতি স্থাপন করে । হয়তো এই ভাবেই জন্ম নিয়েছিল তৎকালীন গুপ্তিপাড়া । আবার অনেকে মনে করেন হুসেন শাহীর সময় বাংলার কিছু গ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম বলে গড়ে উঠতে থাকে । সেই সময় এই অঞ্চলটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের বসতি (মূলত মৎসজীবি ও মাঝি সম্প্রদায়ের মানুষদের) হিসাবেও গড়ে উঠতে পারে । তারা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমে দিনযাপন করতে থাকেন । আবার গুপ্তিপাড়ার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় বেশকয়েকটি প্রাচীন গ্রন্থে এবং সত্যনারায়ণ কথনে । সেগুলি হল নিম্নরূপঃ
১৬০০ সালে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম লেখেন :
‘বাহ বাহ বল্যা ঘন পড়ে গেল সাড়া
বামভাগে শান্তিপুর, ডাইনে গুপ্তিপাড়া’।
- ১৭০০ শতকে বিজয়রাম সেন কর্তৃক লিখিত “তীর্থমঙ্গল” কাব্যগ্রন্থে তৎকালীন গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় ।
- আবার দুর্গাদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে :
‘অম্বিকা পশ্চিম পাড়ে, শান্তিপুর পূর্ব ধারে
রাখিল দক্ষিণ গুপ্তিপাড়া;
উল্লাসে উলার গতি, বটমূলে ভগবতী
চন্ডিকা নহেন যথা ছাড়া।’ - এছাড়াও সত্যনারায়ণ কথাতেও এই স্থানের উল্লেখ রয়েছে :
“ত্যজিয়া কুবজপুর সাধু গুণনিধি।
নবদ্বীপ রহে পাছে আর খড়ে নদী।।
গুপ্তিপাড়া ডাহিনে রইল বহুদূর।
বামেতে রহিল গ্রাম নাম শান্তিপুর।।”
সুতরাং এই স্থানটির প্রাচীনত্ত, বর্ধিষ্ণুতা এবং গুরুত্ব সহজেই অনুমেয় । এই লেখার মাধ্যমে এহেন প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও বর্ধিষ্ণু জনপদটির নামকরণের বিতর্ক তথা ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করি আমরা ।
যেকোনো প্রাচীন জনপদের মতোই এই গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের নামকরণ নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট মতবিরোধ । বিভিন্ন সূত্র ও বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের দেওয়া তথ্য অনুসারে এই অঞ্চলের নামকরণের পিছনে রয়েছে অনেক সত্য, আবার অনেক অজানা কারণ । এই অঞ্চলের নামকরণ সম্পর্কে বারিদ বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন এই অঞ্চলটির পূর্ব নাম ছিল “মীরডাঙ্গা” । আনুমানিক ৪৫০ বছর আগে (আনুমানিক ১৫০০ শতকে) সত্যদেব সরস্বতী শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্রের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর অঞ্চলটির নাম হয় “গুপ্ত বৃন্দাবন” বা “গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী” । আর সেই থেকেই বর্তমান “গুপ্তিপাড়া” নামের উদ্ভব হয়েছে । আবার কিছু ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, ১৫৮৫ সাল নাগাদ সম্রাট আকবরের সময়কালে জগৎগুরু শঙ্করাচার্যের প্রধান শিষ্য সত্যদেব স্বরসতী গুপ্তিপাড়াতে বৃন্দাবন চন্দ্র ( ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি ) নামে একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন । জানা যায় পরবর্তী সময়ে কালাপাহাড় নামক এক মুসলিম সেনাপতি গুপ্তিপাড়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল তার অধিকারে আনার বাসনায় আক্রমন করেন । সেই সময়ে বৃন্দাবন চন্দ্রের মূর্তিটি মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যেই একটি একটি ফ্রেস্কো চিত্রের আড়ালে মন্দিরের গোপন সিলিং–এর মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো । পরবর্তীকালে বৃন্দাবন চন্দ্রের মূর্তিটির এই গুপ্ত বা লুকানোর কথা থেকেই এই জায়গার নাম হয়তো “গুপ্তিপাড়া” । অনেকের মতেই এই অঞ্চলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই গুপ্ত তন্ত্রসাধনার চর্চা চলতো । মূর্তিহীন দেশকালী মাতার বেদী সেই সাক্ষী আজও নিশ্চুপে বহন করে চলেছে । আবার ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষের মতে এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের গুপ্ত সাধনার চর্চা চলতো । সেখান থেকেই এই অঞ্চলটি “গুপ্তপাড়া” নামে পরিচিত হয় । পরবর্তী সময়ে এই “গুপ্তপাড়া” নামটিই অপভ্রংশিত হয়ে “গুপ্তিপাড়া” হয়েছে বলে মনে করা হয় । অন্য একটি মতে, সুপ্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি জলের তলায় গুপ্ত অবস্থায় ছিল । পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলে জলের তলা থেকে উত্থিত হয়েছে । এই ধারণা থেকেও অনেকে অঞ্চলটিকে “গুপ্তিপাড়া” নামে উল্লেখ করেছেন । আবার ইতিহাসের তথ্য প্রমান থেকে জানা যায় যে, গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের সূচনাকাল আনুমানিক ১৫০০ শতকের শেষের দিকে । একদল ঐতিহাসিকের ধারণা, পান্ডুয়ার রাজা গণেশের পুত্র জালালউদ্দিন সিংহাসনে আসীন হবার পর হিন্দুদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । সে সময় অনেকেই দেশত্যাগ করে এই অঞ্চলে লুকিয়ে সঙ্ঘবদ্ধ হন । এইভাবেই “গুপ্তিপাড়া” গ্রামের পত্তন হয় । ঐতিহাসিক বিপিন মোহন সেন মনে করেন অতি প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি পেতেল অর্থাৎ একরকম শর গাছের বনাঞ্চল দ্বারা আবৃত ছিল । ফলস্বরূপ শর গাছের বনের আড়ালে লুকানো এই পল্লীকে “গুপ্তপল্লী” নামে ডাকা হতো । আর সেই থেকেই হয়তো “গুপ্তিপাড়া” নামের প্রচলন হয়েছে । এছাড়াও অন্য সূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রাক-হুসেনশাহী আমলের মুসলিম অধ্যুষিত প্রাচীন এই জনপদের আদি বাসিন্দা এখানকার মাঝি ও মৎস্যজীবী বা ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষজন । এছাড়াও ছিল এখানকার গোপতি বা গুপ্ত অর্থাৎ বৈদ্যরা এবং প্রসিদ্ধ চট্টশোভাকর বংশ । এই বিশেষ জনজাতি বসবাসের ফলে অঞ্চলটি গোপতিপাড়া বা গুপ্তপাড়া নামে পরিচিত হয় । কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে উচ্চারণের পরিবর্তনের ফলে “গুপ্তপাড়া” থেকে “গুপ্তিপাড়া” নামের প্রচলন হতে পারে বলে অনেকে মনে করে । গুপ্তিপাড়ার লোকমুখে প্রচলিত ছড়াতে এখনও এর উল্লেখ পাওয়া যায় । ছড়াটি হল নিম্নরূপ :
“বাঁদর শোভাকর মদের ঘড়া
তিন নিয়ে গুপ্তিপাড়া। “
তথ্যসূত্র :
– “হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ” (দ্বিতীয় খন্ড) – সুধীর কুমার মিত্র ।
– “হুগলি জেলার ইতিহাস” – সুধীর কুমার মিত্র ।
– “হুগলি জেলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি” – জগবন্ধু কুন্ডু ।
– “বঙ্গ সংস্কৃতির এক পর্ব” – শ্রীযুক্ত নৃসিংহ প্রসাদ ভট্টাচার্য ।
– “হুগলি হেরিটেজ” ওয়েবপেজে ১৩ই আগস্ট, ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত “পাঁচশ বছরের বাঙালি সংস্কৃতির ভাঁড়ারঘর গুপ্তিপাড়ার “গুপ্ত বৃন্দাবন” শীর্ষক প্রতিবেদন ।
– “গুপ্তিপাড়া.কম” নামক ওয়েবপেজে ২৪শে আগস্ট, ২০২০ সালে প্রকাশিত শীর্ষ”গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস” শীর্ষক প্রতিবেদন ।
– উইকিপিডিয়া ওয়েবপেজ ।
– স্থানীয় যেসকল বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলাপচারিতা ও লিখিত মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে । তারা হলেন নিম্নরূপ :
শ্রীযুক্ত তারক নাগ বা নায়েক (সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিক তথা ভোলা ময়রার পরিবারের নবম পুরুষ) ।
শ্রীযুক্ত সুজিত মুখোপাধ্যায় মহাশয় (গুপ্তিপাড়ার পুরোহিতকুলের একজন বিশিষ্ট পুরোহিত,ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষ ও লেখক)।
*******************************
অনির্বাণ সাহা
ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক
তথ্যমূলক লেখা।