*যাযাবর*
ব্রততী সেন দাস
আমি বাঙালি হয়েও ভ্রমণপিয়াসী নই,এই কথাটা বললে বেশির ভাগ বন্ধু-বান্ধব আশ্চর্য হয়ে মুখের দিকে চেয়ে ভাবে-এই কোন গ্রহের এলিয়েন এলো?
সত্যি আমি ঘুরতে ভালবাসি না। এ নিয়ে আমার একটা নিজস্ব থিওরি আছে। ভাবি,চারদিন বা এক সপ্তাহ বা দিন পনেরো কোন নতুন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে কে কতটুকু সেই জায়গাটি চিনতে পারে? নাকি ঠাঁইনাড়া হওয়াই ঘোরার একমাত্র আনন্দ? টিকিট কাটলাম,হোটেল বুক করলাম,আশেপাশে দ্রষ্টব্য স্থান দেখলাম,ভালমন্দ খেলাম,ছবি তুললাম,ফেসবুকে পোস্টালাম,ব্যস ফিরে এলাম! দুদিন পরে ভুলে গেলাম! সেই জায়গার কৃষ্টি-সংস্কৃতি- আচার-আচরণ-খাওয়াদাওয়া-ভাষা-মানুষ কিচ্ছু জানলাম না। জানলাম না ওরা কেন এত পরিশ্রমী,কীভাবে অর্থ রোজগার করে,কেন মিশুকে বা অমিশুকে,শিক্ষার হার কেমন,কী খায়,কেন ওদের আচার ব্যবহার আমাদের থেকে ভিন্ন এ সব না জানলে দেশ ঘোরা কী হল?
তাই বলে আমি ঘরকুনো একেবারেই নই। আমি দেশ বিদেশ ঘুরতে ভালবাসি যদি সেখানে বাস করার সুযোগ পাই। অন্ততপক্ষে যদি কিছুদিন থাকি,সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাই তাহলেই সে দেশ দেখা সার্থক!
আমার ভাই ভারতে পশ্চিমপ্রান্তে এক পাহাড়ি ছোট শহরে থাকে।আমরা কুড়ি বছর ধরে আসা-যাওয়া করছি। নতুন অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।তবে এবার সম্পূর্ণ নব অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় ঘটল।
সেদিন রাতভোর বৃষ্টি ছিল। ভোরবেলা জানলা খুলতেই দেখলাম সোনালী রোদ বাঁকাভাবে ঢুকে বারান্দা,ঘরের মেঝেতে আলোর আসন পেতে রেখেছে। সে সঙ্গে শুনলাম একদল ছাগল তারস্বরে ডাকাডাকি করছে। সাততলার বারান্দা থেকে উঁকি মেরে দেখি কী কান্ড!
পাশের পোড়ো পাথুরে জমিতে প্রায় হাজার,দু হাজার ছাগল বিচরণ করছে! কোথা থেকে এলো,কারা নিয়ে এলো এদের? গতকালও তো ছিল না। পরে ভায়ের কাছে শুনলাম মহারাষ্ট্রের যাযাবর বা জিপসি শ্রেণীর কথা,এরা প্রতিবছর পোষ্য,সংসারের লটবহর, বউ-বাচ্চা সহ এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়ায়।খোলা জায়গায় থাকে,খায়,রান্নাবান্না করে,পোষ্যদের ঘাসপাতা খাওয়ায়,তারপর আবার যাত্রা পথে চলে। চলতে চলতেই তাদের জন্ম-মৃত্যু। এ এক আশ্চর্য দুনিয়া,ভুগোল বইতে যাযাবর শ্রেণীর কথা পড়েছি। এবার নিজের চোখেই দেখলাম। আলাপ করতে পারলে ভাল লাগত কিন্তু এরা নাকি নিজেদের সম্প্রদায়ের বাইরে খুব একটা মেলামেশা পছন্দ করে না। রং-বেরঙের,হাতের কাজ করা কাপড়ের ছাউনি টাঙিয়ে দিব্যি সপ্তাহ দুয়েক কাটিয়ে গেল।
মেয়েরা সংসার সামলানোর দিকটা দেখে। পুরুষ দেখে পালিত পশু আর সম্পূর্ণ বাহিনীকে। এদের মত ছোটদলের সঙ্গে দশ বারোটা ঘোড়া এবং কুকুর থাকে।ঘোড়া মালবাহকের কাজ করে,কুকুর দলকে পাহারা দেয়। পুরুষদের পরনে ট্রাডিশনাল সাদা পরিচ্ছদ,মাথায় সাদা টুপি।মেয়েরা মস্ত ঘেরের ঘাগরা পড়ে,হাতে পায়ে রূপোর(?) গয়না। ইট-কাঠ যোগাড় করে উনোন বানিয়ে রান্নাবান্না করে,বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। ওদের কলসি-বাসনকোসনগুলো রূপোর বাসনের মত ঝকঝক করছিল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার কোন বালাই নেই। ছোট থেকেই এরা পশুপালনে দক্ষ আর মেয়েরা মায়ের হাতে হাতে কাজ করা শেখে।
যাযাবররা মূলত: পশুপালন এবং কৃষিকাজ করে।পশুপালকদের মহারাষ্ট্রে ধানগার বলে,এরা দু ধরনের,হাটকার ধানগার (রাখাল) আর গাভেলি বা ডাঙ্গে ধানগার (গোপালক)। আর একদল আছে যারা পাহাড়ের পাদপদেশে অনুর্বর ল্যাটেরাইট মাটিতে রাগি বা জোয়ার চাষ করে।
আমাদের প্রতিবেশি হয়ে যারা এসেছিল তারা হাটকার ধানগার। ঘুরে ঘুরে বেড়ালেও বর্ষাকালে কোঙ্কন উপকূল ছেড়ে রাজ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে চলে আসে,ওদের ভেড়া বা ছাগল উপকূলের আর্দ্র আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না। মোটামুটি জুন থেকে আগস্ট কোন একটা অঞ্চলের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করে।বছরের বাকি সময় তৃণভূমির খোঁজে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঘোরে।
সেদিনও খুব বৃষ্টি নেমেছিল। ভাবলাম দেখি তো যাযাবররা কোথায় আশ্রয় নিল? দেখলাম বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা চারকোণে চারটি খুঁটি পুঁতে ওপর দিয়ে ছোট ছোট প্লাস্টিকের চাদর পেতে তার তলায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আর প্রবল ধারাবরিষণে পোষ্যরা অগত্যা নির্বিকার ভাবে ভিজে চলেছে। ওদের শাবকদেরকে খুঁটি পুঁতে মশারির মত জাল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় ছাউনির নীচে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।সকাল হলেই গরু,ভেড়া,ছাগলদের সঙ্গে ঘোড়াগুলোও চরতে যায়।কুকুররা খেয়াল রাখে।আমাদের ক্ষণিকের প্রতিবেশি যাযাবররা নারী পুরুষ মিলিয়ে সংখ্যায় দশ বারোজন ছিল।মূলত:এরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়, বিষ্ণু,শিব,মহালক্ষ্মী,পার্বতীর উপাসক হয়।জন্মাষ্টমীর দিন দেখলাম গোপালকে পুজো করল।এরা আমিষাশী হয়,তবে গরু-শুয়োর খায় না।এদের স্ববর্ণে বিয়ে হয়।ইদানীং মেয়েরা শহরের আগত পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে বিয়ে করে সংসার পাতছে।পশ্চিমঘাট পর্বতমালার রুক্ষ্ণ অনুর্বর জমিতে চাষাবাদ করার ক্ষেত্রে এই পালিত পশুরা উর্বর করতে সহায়তা করে। এছাড়াও এদের দুধ,মাংস বা ভেড়ার লোম বিক্রি করে এরা বেঁচে থাকে।
সপ্তাহ খানেক পোড়ো জমিতে সংসার ধর্ম পালন করল,ছাগল-ভেড়া চরালো। তারপর একদিন তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্যত্র পাড়ি দিল। বেশিদিন কোথাও মন টেঁকে না এদের।নির্বিকার,উদাসীন। দূরে,পাহাড়ের ঢালে আপাতত থিতু হয়েছে।আমি জানলা থেকে দেখতে পাই হলুদ-লাল ছাউনি টাঙিয়েছে,পোষ্যরা আশেপাশে চরছে।
আমরা সহজে শেকড় ওপড়াতে পারিনা,মাটির সঙ্গে আমাদের সংস্পৃষ্টতা অতি গভীর।অদৃষ্ট,ফেলে আসা দেশ আজও আমাদের সাথে আবেগের সুতোয় জড়ানো।মা,ঠাকুমার কাছে শোনা গল্পেও দেশের মাটির গন্ধ পাই।আর এই “তারাপদ” র মত অতিথিরা কত অনায়াসে সব ফেলে এগিয়ে চলে! এরা কি আপনজনদের সঙ্গেও এমন নিস্পৃহ,সন্তান-পরিবারকে এভাবে তুচ্ছ করতে পারে?
জানালা দিয়ে ওদের দেখতে দেখতে ভাবি আর কয়েকদিন পরে আবার কোথায় এরা উধাও হয়ে যাবে! কোন পদচিহ্ণ না রেখে হারিয়ে যাবে অনন্তের পথে।
***************************************
ব্রততী সেন দাসের পরিচিতিঃ
ব্রততী সেন দাসের জন্ম দক্ষিণ দিনাজপুরে কিন্তু পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা মহানগরে।রবীন্দ্রনাথে আদর্শে দীক্ষিত পাঠভবনে স্কুলে পড়তেন,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন। পরিণত বয়সে লেখালেখি শুরু করেন যখন ছেলে মেয়েরা অনেকটাই বড়।প্রথমে শুরু করেন অনুবাদ দিয়ে। পরে স্বকীয় লেখায় নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন। বাংলার প্রখ্যাত পত্র-পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে।দেশ,আনন্দ বাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়, যুগশঙখ,উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্র,ফেমিনা ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া ওঁর অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,প্রতিভাস,পারুল প্রকাশনী,ভাষাবন্ধন ইত্যাদি প্রকাশনালয় থেকে।