সমর্পণ
সম্পা চক্রবর্তী
অ্যাম্বুলেন্স থেকে ধরাধরি করে অরুকে নামিয়ে ঘরে নিয়ে গেল সকলে। ঘরের কোণে পাতা চৌকিতে শুইয়ে দেবার সময় দেবু বলল —”অরুদা,ভাগ্যবান তুমি। আমরা চিন্তায় পড়েছিলাম তোমার থাকা নিয়ে।”
—”ক্লাবের বারান্দার একপাশে ফেলে রাখলে কি হোত বল? এ কার বাড়িতে নিয়ে এলি কে জানে। চিনিনা,জানিনা আর তোরা বলছিস দূর সম্পর্কের আত্মীয়!”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বছর চল্লিশের একটা লোক সরল হাসি ঝরিয়ে বলল—”মাস্টারদা,আপনি আমাদের পর ভাববেন না। রক্তের সম্পর্কেই কি আত্মীয় হয়? আত্মার কাছে থাকলেই আত্মীয়। আমার মা আর বউ তাই বলে।”
“মাস্টারদা” ডাক শুনে অবাক হয়ে যায় অরু। ওর সঙ্গী দেবু,পলাশ,মনু,বিলুরা সহাস্যে বলে উঠল—”যাক,অরুদার নতুন ঠিকানার সাথে সাথে নতুন নামকরণও হোল।”
ঠাট্টা-ইয়ার্কি ও চা পানের মধ্য দিয়ে পর্ব সমাপ্ত করে ছেলেরা বিদায় নেয়।
একমাসেরও বেশি নীলরতন হাসপাতালে ভর্তি ছিল কলেজস্ট্রীটে বইয়ের দোকানের কর্মচারী অরু অর্থাৎ অরুদীপ মৈত্র।কলতলায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছিল। চালচুলো বলতে কিচ্ছু নেই। আপাদ মস্তক নির্বিরোধী ও সৎ মানুষটার বর্তমান ঠিকানা এই কুলতলা গ্রাম। অরু এখানে কখনও আসেনি,এমনকি নামও শোনেনি। ও ভেবেই পেল না কে এবং কেন ওকে এখানে আনল? অথচ ওর এরকম একটা আশ্রয়ের বড় দরকার ছিল কারণ ডাক্তার ওকে তিনমাস বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন। সাতপাঁচ চিন্তা বোঝা মাথায় নিয়ে ক্লান্তিতে একসময় ও ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল ঐ বাড়ির বৃদ্ধার ডাকে। গ্রামের শান্ত পরিবেশে ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামবিহীন ডাকে অরুর মনে হোল বেশ রাত হয়েছে।বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসল। পরম স্নেহে বৃদ্ধা গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগল। মায়ের কথা মনে পড়ল ওর। জ্বর হলে মা ওকে এভাবে আদর করত।
মিনিট দশেক পর অবগুন্ঠিতা এক গৃহবধূ দরজার চৌকাঠের সামনে একটা হ্যারিকেন রেখে বলল “মা,এটা জ্বালিয়ে এনেছি।পায়ে খানিক সেঁক করে দিন। আরাম পাবে।”— এই বলে রহস্যময়ীর মতো সে দ্রুত চলে গেল।
বৃদ্ধা তার কথায় সম্মতি জানিয়ে অরুকে বলল—” এসো বাবা,তোমার পায়ের খোলা জায়গায় আর কোমর পিঠে গরম সেঁক দে দি,আরাম লাগবে। কাল চানের আগে তেল মালিশ করে দেবোখন। একটানা শুয়ে শুয়ে গা গতর জমে গেচে একেবারে। “
অরু ভেবে পাচ্ছে না এরা কারা? কেন এত আদর যত্ন ভালবাসা? একসময় ও বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করে বসল—”মাসিমা,আপনারা আমাকে চেনেন? কেন আমার জন্য এত করছেন?”
বৃদ্ধা মুচকি হেসে বলল—”চোকের দেখাতেই কি আর চেনা হয় বাবা? অন্যের চোকেও তো চেনা-জানা হয়। তাই না?”
—(বিস্মিত গলায়)”তা মাসিমা,কে সেই লোক যার চোখ দিয়ে আপনারা আমায় দেখছেন?”
—”কেন? আমার লক্ষীমন্ত পয়মন্ত বৌমা। জানো বাবা,ওরম বৌ মানুষ তপিস্যা করে পায়। এই তো দ্যাকোনা,আমার ছেলে মাত্তর আট কেলাস পাশ। বাজারে একটা মুদি দোকান আছে। আর বৌমা এগারো কেলাস পড়তে পড়তে বে হয়ে গেল। এতটুকু গুমোর নেই বৌয়ের। পত্থমে ছেলে বিয়োলো,সাড়ে চার বচরের মাতায় মেয়ে। দিব্য সুকে ঘর করচে। বৌ আসতে আমার সুমোর(সুমনের ডাকনাম)সংসার ঝ্যানো দুদের ফানার মতো উতলে…..।”
বৃদ্ধা আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল,অরু থামিয়ে দিয়ে বলল—”এসব শুনে আমি কি করব? ঐ অন্য লোকটা কে আমি সেটা জানতে চাই। এদিকে আপনার ছেলে সৌমেন ক্লাবের ছেলেদের বলেছে যে আমি আপনাদের আত্মীয়। কেন? মিথ্যে কেন?”
—”কারণ তুমি আমার বৌমার মাস্টার। গুরুজন। নেকাপড়া জানিনা বাপ কিন্তু মাস্টার দিদিমণি দেবতার সমান—ছেলেকে এই শিক্কে দেইচি। তাই আমার ছেলে…..।”
—”মাস্টার !!”
অরু যেন ভূত দ্যাখার মতো চমকে উঠল। এমন সময় একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে এসে বলল—” ঠাগমা,মা খেতে দেইচে।তোমায় ডাকচে।”
বৃদ্ধা নাতনির হাত ধরে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল—”বৌমাকে দে খাবার পাঠয়ে দিচ্চি।”
অরু মনে করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর ওর ভাবনার দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখে সামনে বকুল দাঁড়িয়ে। অরুর একমাত্র এবং মাথামোটা ছাত্রী। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মায়ের অনুরোধে মাধ্যমিকের বছরে অঙ্ক-বিজ্ঞান পড়িয়েছিল। সব মনে পড়ছে। মেয়েটি অরুদের বাড়িতে খাবার জল দিত। বিধবা মা ও ছেলের সংসারে টুকটাক কাজও করত সে। মায়ের শয্যাশায়ী হওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাশ ছেড়ে যায় নি। দরজার দিকে তাকিয়ে অরু ভাবে—তাহলে এই অবগুন্ঠিতাই কি সে যার অদৃশ্য অদম্য টানে ওকে এখানে আসতে হয়েছে? কিন্তু কেন? ও তো কখনো বকুলকে ভালোবাসেনি।
হেমন্তের হাওয়ায় তখন জোনাকিরা ঝোপের গায়ে গায়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। অরু ফিরে গেল অনেক বছর আগেকার তেমনই এক জোনাক জ্বলা রাতে যেদিন ওদের বাড়ির কুয়োপাড়ে যৌবনের তাড়নায় সে বকুলকে জাপটে ধরেছিল। বকুল ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারেনি নিজেকে কেবল মোমের মতো একটু একটু করে গলিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী বোহেমিয়া জীবনে একটিবারের জন্যও সে বকুলকে মনে করেনি। বকুল বলেছিল—”অরুদা,আমি তোমাকে ভালবাসি।”
ও থুথু ফেলে বলেছিল—”লজ্জা করে না তোর বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে?”
আসলে শহুরে কলেজে পড়ার গর্ব,কৌলিন্য,সামাজিক মর্যাদা অরুদীপকে সেদিনের সুকোমল কিশোরী হৃদয়ের আড়ালে উঁকি মারা আবেগী মনটাকে চিনতে শেখায়নি। এই সব রোমন্থনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে ও অন্য জগতে পৌঁছে গেল। চমক ভাঙল বকুলেরই ডাকে। —”শুনছেন? এই নিন আপনার রাতের খাবার। সঙ্গে শাশুড়ীমায়ের হাতে বানানো নারকেলের সন্দেশ দিয়েছি।উনি খেতে বললেন। আর হ্যাঁ,খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন,ওষুধ দেব।”
অরু এই সেবাময়ী বধূটির তল খুঁজে পেল না। ওর মনে হোল বকুলকে আজ আর একটিবার জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইবে। পারল না। অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়ে পিছিয়ে গেল।
মাঝরাতে ক্র্যাচে ভর দিয়ে অরু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। নদীর দিক থেকে ছুটে আসছে ঝিরঝিরে বাতাস। অনিশ্চিত জীবনের মাঝে এমন ভালোলাগার ঢেউ আগে কখনো অনুভব করেনি সে। ফুরফুরে এলোমেলো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে গুনগুন করে গেয়ে উঠলো —”ইয়ে রাতে ইয়ে মৌসুম নদী কা কিনারা,চঞ্চল হাওয়া……”
পিছন থেকে বকুল ডাক দিল—” অরুদা !!!! “
***********************************************
শম্পা চক্রবর্তী পরিচিতি –
ঠিকানা— চুঁচুড়া, হুগলী।
শিক্ষাগত যোগ্যতা— বাংলা সাহিত্যে এম্.এ.
পেশা— শিক্ষকতা।
নেশা— সাহিত্যচর্চা (মূলতঃ লেখালেখি),সিনেমা দেখা,বই পড়া,গান শোনা,অনাবিল হাসিতে ফেটে পড়া, মানুষের মনের গভীরে ডুব দেওয়া এবং কাছে-দূরে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া।
প্রতিবারের মতই খুব খুব খুউউউউব ভাল। চারিদিকের এত কলুষতার মাঝেও ভালবাসা থিক ই রয়ে যায়। অসাধারন।
খুব খুব ভালো লাগল। অল্প কথায় অনেকটা ভালোবাসার কথা রয়েছে অনুগল্পটিতে।