হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ
মধুমিতা মিত্র
সোম থেকে শুক্র প্রত্যেকটা দিনই ভোর চারটে থেকে রেল কলোনী বারোর এ ফ্ল্যাটে আলো জ্ব’লে ওঠে ঝপাঝপ।শোনা যায় কচি গলার আধো ঘুমের আর্তনাদ–‘না না আজ স্কুলে যাবো না,আরও একটু ঘুমোতে দাও না!কাল থেকে ঠিক ভোর বেলায় উঠে পড়বো ৷’কে শোনে কার কথা!মা ঠিক ভুলিয়ে ভালিয়ে খানিক আদরে,কিছুটা শাসনে ছোট্ট পুতলীকে বিছানা থেকে তুলে, ঘাড়ের ওপরে ফেলে নিয়ে যায় পটি-খানায় ।কি জানি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কেমন করে পটি করে ছোট্ট সোনা-এরপর আরও কঠিন পর্ব দুধের সাথে চিঁড়ে অথবা মুড়ি আর কলা মেশানো এক মন্ড কোনোরকমে গলাধঃকরণ করিয়ে মায়ের কাজ এবার পুতলীর ঘন চুলে চিরুনি চালিয়ে নীল ফিতে দিয়ে দু-পাশে দুটো ঝুটি বেঁধে তারপর-নীল ঝুটির পুতলীকে স্কুলের সবুজ-সাদা স্কার্ট ব্লাউজে সাজিয়ে তোলা, এরপরও শেষ কোথায়? চকচকে কালো জুতো কিংবা ধবধবে সাদা কেডসের সাথে পরিষ্কার মোজা পরিয়েই তবে মা ক্ষান্ত হয় স্কুল-প্রসাধনী পর্বে।এসবই চলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই,পুতলী তো স্কুলে যায় এমন ঘুমিয়েই আর মা ওই ভোর চারটে থেকে নিরলস খেটে চলে পুতলীকে তৈরি করতে।আকাশ যখন আলো ছড়াতে শুরু করেছে, পুতলীর তখন বাবার হাত ধরে স্কুলে বেরিয়ে পড়ার পালা।বাড়ির থেকে পুতলীর স্কুল বেশ অনেকটা দূর।শহরের যে সীমানায় পুতলীর বাস, সে সময়ে; আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে, সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্হা মূল শহরের সঙ্গে তত ভালো নয় বলেই মোমিনপুরে বাস পাল্টে,পুতলী বাবার হাত ধরে নামে আলিপুরে স্কুলের গেটে।এবার বাসে চড়ে,বাস পাল্টে পুতলীর ঘুম ভাঙছে,স্কুলের গেটে নেমেই কিন্তু পুতলীদের স্কুল বাড়ি নয়-কলকাতার সেই গড়ের মাঠের মতো মিনি গড়ের মাঠ পেরিয়ে-সে আবার একটা নয়!দু-দুটো অমন মিনি গড়ের মাঠ পেরিয়ে তবে পুতলীর স্কুলের বিল্ডিং।আর সেই মাঠ পেরোনোর পথে কত বছরের কত কত গাছ গাছালি!তাতে কত পাখির কত না কল কাকলি!-সেই সব পাখিরা মিলে,আর ভোরের শান্ত ঠান্ডা হাওয়াই পুরোপুরি দেয় পুতলীর ঘুম ভাঙিয়ে।বাবার একটি হাতে ছোট্ট পুতলীর হাত ধরা,অন্য হাতে এ্যালুমিনিয়মের ছোট্ট একখানি ছিটকিনি লাগানো সুটকেস যাতে আবার বিশেষ ভাবে খোদাই করে পুতলীর ইস্কুলের নাম অনুরাধা কর লেখা।
পুতলী নয় -এই ছোট্ট সুটকেসটাই কিন্তু আমাদের আজকের গল্পের নায়ক।
ফেরার সময় আবার অন্য চিত্র,মা পুড়তে পুড়তে ঝুরতে ঝুরতে সারা সংসারের সমস্ত রান্নাবান্না সেরে,আবার মোমিনপুরে বাস পাল্টে পুতলীকে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ফিরতি বাসে বেহালা ফেরে।না,না তখন আর বাড়ি নয়, পুতলীকে পাঠকপাড়া স্টপেজে নামিয়ে দিয়ে সেই বাসেই মা আবার তার স্কুলের দিকে চলে যায়।পুতলীর মনা তার ভোর বেলার স্কুল সেরে পাঠকপাড়া স্টপেজে থাকে অপেক্ষায়-পাঠকপাড়া থেকে রেল কলোনী তো বেশ কিছু টা ভেতরে , ছোট্ট পুতলী কিভাবে আসবে একা একা?-তাই পুতলীর মনা তার নিজের স্কুল থেকে ফিরতি পথে পুতলীকে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ীতে ফেরে।এভাবেই পুতলীর দূরের স্কুলে যাওয়া এবং পড়া চলে নিয়মিত।
এবার সেদিন হয়েছে কি !স্কুল থেকে ফেরার পথে বাসে খুব ভিড়।পুতলীর মা গোতাগুতি করে পুতলীকে ,পুতলীর সেই সুটকেসকে সামলে কোনো রকমে বাসে উঠেছে।লেডিস সীটের সামনে দাঁড়াতেই এক ভদ্রমহিলা দুহাত বাড়িয়ে পুতলীকে কোলে নিল-আর একজন পুতলীর সেই সুটকেস খানাকে ধরলো।কী জানি সেদিন কোন্ গ্ৰহ ছিল!বাসের ভিড় কমবার নয়–ওদিকে রাস্তাতেও জ্যাম।ভেতরের ভিড় নিয়ে আর বাইরের ভিড় ঠেলে বাস তো গন্তব্যে এগোচ্ছে শম্বুক গতিতে।মায়ের এদিকে ছটফটানি বাড়ছে,মায়ের স্কুলে তো দেরি হয়ে যাচ্ছে!সেখানেও যে সময় মতো পৌঁছতে হবে!!বাস যখন পাঠকপাড়া এসে পৌঁছলো মায়ের কোনো দিকে মন নেই।বাস থেকেই পুতলীকে নামিয়ে পুতলীর মনার হাতে পুতলীকে সঁপে, মা আবার সেই বাসেই রওনা দিল স্কুলের দিকে।ভিড়ে বিধ্বস্ত পুতলী তখন মনাকে পেয়ে নতুন আনন্দে বাসে কত ভিড় ছিল,স্কুলে কত না কি নতুন ঘটনা ঘটেছে -সেই কথা মনাকে বোঝাতে বোঝাতে লাফাতে লাফাতে চললো বাড়ির দিকে।মায়ের ও পাঠকপাড়া থেকে ট্রাম ডিপো বাসে পাঁচ মিনিটের পথ পেরিয়ে-তারপর ট্রাম ডিপো থেকে ইস্কুল,বাস থেকে নেমে রিক্সায় চেপে মা ও পৌঁছলো মায়ের স্কুলে। এদিকে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই পুতলীর আর পুতলীর মনার দুজনেরই কেমন জানি একটা খালি খালি লাগছে,কি যেন নেই!স্কুল ড্রেস ছাড়ার পরই খেয়াল হলো এই যাঃ স্কুলের আসল জিনিস- সেই সুটকেসটা কই?-সে তো বাসেই রয়ে গেছে !অত ভিড়ে,মায়ের স্কুলের দেরি হয়ে যাওয়াতে তো ভিড় ঠেলে নামবার সময় সেই সুটকেসের কথা কারোরই মনে নেই-এবার কি হবে!এ তো সেই কোন্ যুগের কথা-গত শতকের ষাটের দশকের এক্কেবারে শেষে,সত্তরের দশককে সে যখন ছুঁই ছুঁই করছে;তখন কি ছাই এত ফোনের বাহার ছিল? কি হবে? পুতলীদের স্কুল আবার যে সে স্কুল নয়-ঠিক মতো বইখাতা না আনলে,হোমওয়ার্ক না করলে দিদিরা খুব রেগে যায়।আর খুব বকাবকি চলে আর শাস্তি দেওয়াও, কি হবে !কি হবে!-এ তো বছরের মাঝখানের সময়-হাজরার সেই মর্ডাণ বুক ডিপো কি পুতলী’র ক্লাস ওয়ানের বই ,এই মাঝ বছর পর্যন্ত রেখেছে?এখনকার সময়ে এগুলো তেমন কোনও সমস্যাই নয়,সেই সময়ে তা প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগে কিন্তু এ সব বড়ো সমস্যা ছিল!বছরের মাঝখানে নতুন করে স্কুলের কোনো বই পাওয়া অথবা ড্রেস নতুন ভাবে করতে দেওয়া ভারী ঝকমারি ছিল।পাওয়া যেত না যে তা নয় কিন্তু বিশেষ ভাবে অর্ডার দিয়ে বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করে তবে তা মিলতো।তার মধ্যে পুতলীর বাবা মায়ের তো অমন ব্যস্ত জীবন,কাকভোর থেকেই দৌড় ঝাঁপ! আবার বেহালা-হাজরা বা বেহালা গড়িয়াহাট করাও খুব মুশকিল।এদিকে পুতলীর স্কুল বেজায় কড়া, একদিন ও এদিক ওদিক হলে পুতলীর শিক্ষিকারা কোনো ভাবেই সেটা মানিয়ে নেবে না।এসব সাত পাঁচ ভেবে পুতলীর মনা তো অস্হির আর পুতলী তখন কেঁদে আকুল তার ঐ ছোট্ট সুন্দর সুটকেসের জন্য-তার মধ্যে ঐ যে দারুণ পেন্সিল বক্স-আর বই খাতা গুলোকে মা বছরের প্রথমেই কেমন সুন্দর মলাট দিয়ে মুড়ে,লেভেল সেঁটে,পুতলীর নাম-ক্লাস লিখে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে,তারাও মহানন্দে ব্রাউন পেপারের জামা পড়ে, পুতলীর নাম-ক্লাস লেখা লেভেলের ফিতে বেঁধে পুতলীর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। পুতলী তাদের কি যে ভালোবাসে,যত্ন করে সে আর কি বলি!পুতলী তো তার সেই সুটকেস আর তার ভেতরের সুন্দর মলাট দেওয়া চকচকে বই, খাতা, পেন্সিল- বক্সের জন্যেই কেঁদে অস্হির।
এদিকে হয়েছে কি!সুটকেস বাবু তো বাসের মধ্যে রয়ে গিয়েছেন তাঁর নতুন মানুষের ঠিকানায়! তিনি আবার শুনছেন চারিদিকে কত কথাবার্তা!কত কোলাহল! হঠাৎ তাঁর মনে হল তার যে ছোট্ট মিষ্টি মালিক বন্ধুটি- তার আওয়াজ তো পাওয়া যাচ্ছে না!কি হল তাঁর মিষ্টি সোনা মালিকের?-কি ভালোটাই না বাসে তাঁর এই প্রিয় মালিক বন্ধুটি তাঁকে-দিনে কতবার যে ঢাকনা খুলে খুলে তাঁকে দেখে, তাঁর সব আবর্জনা জঞ্জাল পরিষ্কার করে,সব বই খাতা পত্র সুন্দর করে বারে বার সাজিয়ে রাখে,তার শেষ নেই। আবার মাঝে মাঝেই নরম মিষ্টি ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে তাঁকে আঁকড়ে ধরে ঐ ছোট্ট মালিকের মনের সবটুকু ভালোবাসা উষ্ণতা উজাড় করে দেয়।এই যে এত ভিড়! ছোট্ট বন্ধু কিন্তু পাশের কাকিমার কোল থেকেও তাঁর ওপর একটা হাত এলিয়ে ফেলে রেখেছিল! কিন্তু এখন সে গেল কোথায়?-সেই ভোর থেকে তো সুটকেস বাবুরও দৌড়োদৌড়ি চলছে,বাসের দুলুনিতে তাঁর চোখেও একটু ঝিমুনি এসেছিল,চটকা ভাঙলো চারিদিকের মানুষের হট্ট গোলে। এখনও তাদের কি নামার সময় হলো না ?-কি সর্বনাশ!তবে কি তাঁর বন্ধু আর তার মা, তাঁকে ভুলে বাসেই ফেলে গেল!!!!
ওদিকে পুতলী আর পুতলীর মনা যখন বাড়ি ফিরে সুটকেস না পেয়ে হা হুতাশ,ছটফট করছে,পুতলীর মা তখন বেহালা ট্রামডিপোতে নেমে আবার একটা রিক্সা নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে পৌঁছলো স্কুলে।ভাগ্যিস প্রেয়ার তখন সবে শুরু হয়েছে।প্রেয়ার শেষ করে হাতে এ্যাটেনডেন্স রেজিস্ট্রার নিয়ে মা যথারীতি তার ক্লাসে।এবার রোলকল করতে করতে অবচেতন মনে খেয়াল হলো!আরে!সর্বনাশ!পুতলীকে যখন পাঠকপাড়ায় বাস থেকে নামিয়ে মনার হাতে ট্রান্সফার করেছে কই তখন তো সুটকেস টা মা নামায় নি,আর ট্রামডিপোতেও তো সুটকেস —বাসেই রয়ে গেল!কি— হবে!দুশ্চিন্তায় মায়ের তখন ক্লাস নেওয়া মাথায় উঠেছে।এই সময়ে মায়েদের স্কুলের আয়া মাসি চূড়ামণি এসে খবর দিলো কে নাকি পুরনো কোন্ ছাত্রী বড়ো দিদিমণির ঘরে এসেছে,সে আবার মঞ্জু দিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে চায়।
ওদিকে বাড়িতে পুতলীর মনা তো দুশ্চিন্তায়,দুর্ভাবনায় ছট্ফট্ করে না পুতলীকে ঠিকমতো স্নান খাওয়া করিয়েছে -না নিজে ঠিকমতো নাওয়া খাওয়া করেছে।পুতলীও সুটকেসের কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে –হঠাৎ দেখে ঐ তো!৭৬ নম্বর বাসে চড়ে সে আবার ফিরছে!আর ঐ তো!ঐ কাকিমার কোলে সুটকেসটা-কিন্তু অমন ভিজে কেন?জলে যেন টুপটুপ করছে তো!তবে সে-ও কি কান্না করছে?-যেই পুতলী ঐ সুটকেসকে জড়িয়ে ধরলো অমনি চারিদিকে যেন হাসির রোল উঠলো।ধড়মড় করে উঠে বিছানার ওপর বসে পুতলী দেখে মা-মনা তার কান্ড দেখে হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।সুটকেসটা পুতলী জড়িয়ে ধরেই শোয়া থেকে উঠে বসেছে,তবে সেই যে কান্না ভেজা জল চুপচুপে সুটকেস?-সে কি তবে স্বপ্ন? পুতলী তখন বোঝে মনের কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে সে ঘুমিয়ে পড়ে চলে গিয়েছিল স্বপ্নের রাজ্যে।স্বপ্ন টা সত্যি করে,মায়ের হাত ধরে সুটকেস বাবু ফেরৎ এসেছে তার কাছে।কি ভাবে?-আসলে ঐ বাসেই ভিড়ের মধ্যে ছিল মায়ের এক পুরোনো ছাত্রী,সে যখন টের পেল যে মঞ্জু দিদিমণি তার মেয়ের সুটকেসখানি ভুল করে বাসে ফেলে নেমে গেছে-সে ই তখন দায়িত্ব নিয়ে মায়ের স্কুলে এসে মাকে সুটকেসটা ফেরৎ দিয়ে গেল।আয়া চূড়া মাসি তারই আসার সন্দেশ মায়ের কাছে ক্লাস শেষে নিয়ে এসেছিল।এভাবেই হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ এসে পৌঁছলো তার নির্দিষ্ট ঠিকানায়….
**********************************
মধুমিতা মিত্র: পেশা–স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ..
মায়া মেদুর অতীতের স্মৃতি জড়ানো গল্পটা পড়ে ভীষণ মিষ্টি একটা অনুরণন হল মনে!
Thank you Surajitda…
পঞ্চমীর সকালে কুলায়ফেরা শারদসংখ্যা “কাশবন” মন ভরালো।নতুন পুরনো কলম নিয়ে, নানা স্বাদের রচনা সম্বৃদ্ধ সুসম্পাদিত এই সংখ্যার সর্বত্রই যত্নের ছাপ।ছোটগল্প গুলি খুব উপভোগ্য।শ্রীমতী ব্রতী ঘোষের ‘দোলা লাগিল রে’ এবং শ্রীমতী মধুমিতা মিত্রের ‘হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ ‘ অত্যন্ত সুপাঠ্য।প্রবন্ধ গুলিও ভালো লাগলো। প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে কবিতা এবং শিশু বিভাগের পাতা আমি খুলতে পারলাম না।