আগমনী
তিতিলা মুখার্জি
কাল মহালয়া l রমলা আর সমর বসে টিভি দেখছিল l রমলা তাড়া দিল l সেই কোন ছোটবেলার অভ্যেস রেডিও তে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ না শুনলে ওর চলবেই না l রমলা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে l সবাই মিলে দাদুর ঘরে বসে একসঙ্গে শোনা হতো l যদিও রমলা একটু পরেই ঢুলতে শুরু করতো,তবুও ওখানেই বসে থাকতো l ঘুম কেটে গেলে,‘রূপং দেহি জয়ং দেহি’ শুনতে পেত l কি করে যে প্রত্যেকবার এক সময়েই ঘুম ভাঙত সেটা ও ভেবে পেতো না l সেই এখনো এক ব্যাপার রয়ে গেছে,কি করে কে জানে !!
রমলা সমরকে আবার তাড়া দিলো,-“এই চলো চলো ! খেয়ে নাও কাল তো সকালে উঠতে হবে l”
সমর হাসলো-“কি শুনবে ? একটু পরেই তো ঘুমোবে l খালি আমাকেও উঠিয়ে দাও l”
-“তা হোক তবুও ভোরেই শুনতে হবে l এমনিতে আজকাল তো ইউটিউবে সারা বছর শোনা যায় l কিন্তু ভোরে উঠে শোনার আনন্দই আলাদা l”
সমর সব জানে তাও মজা করে l তিরিশ বছরের সংসার,দুজনেরই দুজনে কি কি করে জানা হয়ে গেছে l একমাত্র ছেলে রাজা জার্মানিতে l এম টেক করে ওখানেই চাকরি করছে l ওদের ইচ্ছে ছিল পড়া শেষ হয়ে গেলে দেশে ফিরে আসুক l কিন্তু রাজা ওখানেই চাকরি নিয়ে থেকে গেলো l ছেলে এখন বড়ো হয়েছে,ওকে তো আর বেশি জোর করা যায় না l জানতে চেয়েছিল জয়েন করবে কিনা l ওর ইচ্ছা বুঝে ওদের আর কিছু বলার ছিল না l
পূজোর সময় রাজা আসে না l সেই ডিসেম্বরে আসবে | এতো খারাপ লাগে l মায়ের আগমন তো সবার ঘরে ফেরার সময় l কিন্তু কি আর করা l বড়ো ফাঁকা লাগে l ওদের হাউজিং এ পুজো হয় সেখানেই সময় কাটায় l মণ্ডপে বসে অনুষ্ঠান দেখা,আড্ডা এই আর কি l কারুর ছেলে মেয়ে বাইরে থেকে এসেছে দেখলে যেমন ভালো লাগে তেমনি ঘরে ফেরার পরে চোখে জলও আসে l
ভোরবেলা ইউটিউবে এ চালিয়ে দিলো মহিষাসুরমর্দিনী l সারা ঘর যেন ভরে উঠল–বাজলো তোমার আলোর বেণু l ‘একটু পরেই সেই এক রমলার ঘুম l সমর গজ গজ করলো…
“- প্রতিবছরই এক ব্যাপার,চালিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে l ডাকলে বলবে শুনছি তো l সত্যি বাবা l”
সেই এক সময়ই উঠে পড়ল রমলা,উঠে যেন মোটেই ঘুমিয়ে পড়েনি এমন ভাব করে বাকিটা শুনল। শেষ হলে উঠে চা বসালো, নিজের মনেই বকতে শুরু করল,”মহালয়া শুনলে মনটা কেমন করে ওঠে | সেই ছোটবেলার কত স্মৃতি | তখন কেউ ভাবতেই পারতো না যে পুজোতে বাড়ির ছেলে মেয়েরা কেউ দূরে থাকবে । দুই পিসি পিসতুতো ভাই বোন সবাই পঞ্চমীতে চলে আসতো | বাড়ি জমজমাট | কত হইচই,নানা রকমের রান্না হচ্ছে | আর এখন ছেলেরা নাকি আসতেই পারে না |ভারী কাজ করছে কিনা !”
সমর বললো,“কি আর করবে বলো l ওদের তো আর জোর করা যায়না l তাছাড়া ওদের ছুটির সময় আলাদা l বুঝতে হবে তো l কান্নাকাটি শুরু কোরো না যেন l”
-“কেঁদেই বা কি হবে বলো তো ? যাকগে রান্নাঘরে যাই কাজ সেরে নি“-উঠলো রমলা l
হঠাৎই সমরের ফোন টা বেজে উঠলো l বললো “রাজা কল করছে l এমন সময় ?” একটু আশ্চর্যই হলো ওরা |
রমলা তাড়া দিল “ধরতো আগে,স্পিকার অন করো l”
রাজার গলা-“মা ! বাবা ! তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে – – ভী – ই – ষ – ণ l”
রমলার গলা ধরে এলো -“আজ মহালয়া l আমাদেরও তো একই অবস্থা l কিন্তু কি করবো? তুই ঠিক আছিস তো বাবা“?
ওদিক থেকে রাজার হাসি -“তাহলে দেখা করো l দরজা তো খোলো “l দরজা??
ছুটে গেলো সমর l দরজা খুলে দেখে সামনে হাসিমুখে রাজা l গোল চোখে সমর বলে-“তুই? আমি ঠিক দেখছি ?”
-“আরে ঢুকতে তো দেবে l কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? আগে থেকে জানিয়ে দিলে এমন হতো?”
কেঁদে ফেললো রমলা l রাজা এসে জড়িয়ে ধরলো l
একটু ঠিক হয়ে রমলা চা দিলো রাজাকে l চা খেয়ে রাজা বললো “এবার একটু ঘুমাবো l কি কি খাওয়াবে আজ ঠিক করে নাও l কাল থেকে আমার মেনু l”
“তুই না থাকলে আমরা সেভাবে কিছু খাই নাকি ? তোর বাবা বাজার যাক l দেখি কি করি l যেমন না জানিয়ে এসেছিস l কি যে তোদের এক হয়েছে l এ নাকি নতুন! সারপ্রাইজ ভিজিট l পারিস বাবা l”
রাজা শুতে গেলো l সমর বাজারে l রমলা রান্নাঘরে l মণ্ডপে গান বাজছে l মুচকি হাসলো রমলা l ভাগ্যিস এইসব সারপ্রাইজ ভিজিট হয়েছে তাই তো আজ মহালয়ার সকাল টা হঠাৎ করে এতো সুন্দর l
******************************
তিতিলা মুখার্জী ~ কলকাতাতেই জন্ম ও বড় হওয়া । কর্ম জীবন থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার পর সাহিত্য,গান,কবিতা নিয়ে পথ চলা