Shadow

উইশ স্পট – দেব মুখার্জি

উইশ স্পট

দেব মুখার্জি

এখন আমি মারগাঁও থেকে ১০ কিমি দূরে,স‍্যালসেটের লৌটোলিম গ্ৰামে,সাউথ গোয়ায়,রাজুর বাড়িতে। একেবারে ক‍্যালেন্ডারের পাতায় দেখা ছবির মতো বাড়িটা,উঁচু নীচু রাস্তার ধারে,সারি সারি নারকোল গাছ,সবুজে সবুজ চারপাশটা,আমগাছ একটা মস্ত বড়,দুটো পেয়ারা গাছ। নতুন বৃষ্টির জল পেয়ে লতানো আগাছাগুলো পথের ধারের অন‍্যগাছগুলোকে ঢেকে ফেলেছে। দোতলার বারান্দায় বসে দেখছিলাম চারদিকটা,ফুল পাতা ভর্তি রঙীন টবগুলো ঝুলিয়ে রাখা রেলিংয়ের এদিকে ওদিকে।
মাছটা রেঁধেছিল নারকোল দিয়ে,হয়ত কোঙ্কনী রান্না,বেশ  হয়েছিল খেতে, চাখনা। সেই সঙ্গে একটা গ্লাসে লেবুর রস নিংড়ে একটা বোতল থেকে ঢাললো জল রঙের একটা তরল, বোতলটা হাতে নিয়ে দেখি লেখা লেমব্রানকা,কাজু ফেনী,হেরিটেজ গোয়ান স্পিরিট।
এর আগে তো কোনোদিন এখানে আসা হয়নি,মনে মনে ইচ্ছে ছিল খুব,সেই যৌবনের শুরুতেই। কিন্তু সময়,সুযোগ,অর্থ,প্রয়োজনীয়তা,আবশ‍্যকতাতখন কত শত প্রতিবন্ধকতা,সে সব কঠিন দিনগুলো আমি ভাবি,তারপর চারটে লাইন মাথায় আসতেই মনে মনেই বলে উঠি

इच्छाओं की सड़क

तो बहुत दूर तक जाती है,

बेहतर यही है कि हम

ज़रूरतों की गली में मुड़ जाएं 

(ইচ্ছেগুলোর চলা সুদূর পানে
সে পথ ছেড়ে বিনা আয়োজনে
ধরাই ভাল গলির সরু পথ
হঠাৎ এবং ভীষণ প্রয়োজনে)

গেলাসটা হাতে নিই, বোতলের দিকে তাকাই, লেখা আ্যলকোহল ৪০%… গ্লাসটায় একটা চুমুক দিয়ে নামিয়েই রাখি, না বয়সটা বারণ করে। গুনগুনিয়ে উঠি

हजारों ख्वाहिशें ऐसी

(হাজার খোয়াইশে এ্যয়সী…)

রাজু শুনছিল চুপ করে,গোয়া আর কর্ণাটকের বর্ডারে ওর বাড়ি, জন্মসূত্রে কানাড়ি,আবার কর্মসূত্রে কিছুটা সময় কাটিয়েছে মহারাষ্ট্রে পরে কোঙ্কন উপকূলেও।
কানাড়ি,মারাঠি কোঙ্কনী ভাষাতে স্বচ্ছন্দ সে,আর সেই সঙ্গে হিন্দিও। জিজ্ঞেস করলেখোয়াইশ মতলব কেয়াউইশ“,আমি ঘাড় নেড়ে বলি…”হ্যাঁ ইচ্ছে,অভিলাষা,তমান্না মনোকামনা ফের জিগ্যেস করে কোই অধুরী খোয়াইশযো পুরী নেয়ী হুই,” আমি মুখ তুলে তাকাই আর তখনই হাতটা ধরে টানে বলে…”চলো“,জিগ্গেস করি…” কোথায় যাবো“… বলেবিগ ফুটউইশ স্পট
লৌটোলিমের বিগ ফুট মিউজিয়াম,যারা গোয়ায় এসেছেন তারা হয়তো দেখে থাকবেন,আর এই মিউজিয়ামের এককোণে রয়েছে  গুহার মধ্যে পাথরের ওপর কারোর পায়ের ছাপ,মায়াবী আলো,ধূপ ধুনোর গন্ধ,বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টির শব্দ। এখন কেউ কোথাও নেই,এই আবহাওয়ার মধ্যে কে আর আসবে। রাজুর হাতটা ধরে আমি সামনে এসে দাঁড়াই। রাজু ফিসফিস করে বললে,”কথিত আছে যে এই পদচিহ্ন তাদের জন্য পবিত্র আশীর্বাদ যারা এখানে প্রার্থনা করতে আসেন এবং যে কোনো কারোর মনোকামনা পূরণ হয়। যে কেউ এই পদচিহ্নের সামনে এসে প্রার্থনা করতে পারে,নিজের বা অপরের জন্যে।
কার পদচিহ্ন সেটা তো জানা হলনা,ঘাড় ঘোরাই রাজুকে খুঁজি দেখি একটু এগিয়ে সে হাতদুটো জড়ো করে,ডান দিকের দেওয়ালে একটা ঘন্টা,বাজাই একবার। তারপর হাত দুটো জুড়ে চোখটা বুঁজি,চোখের সামনে ফের ফিরে আসে ছোটবেলা,পাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো,দেবীর পায়ে একটা পদ্মফুল দিয়ে পুরোহিত মশাই ইন্দুবাবু সংকল্প করছেনসকল পল্লীবাসী যেন ভালো থাকে,মনোকামনা পূর্ণ হয়।
চোখটা খুলতেই দেবীর আলতা পরা দুধে আলতা রঙের পা টা মিলিয়ে যায়,তখন আবার চোখের সামনে,পাথরের উপরে সেই পদচিহ্নটা,একটা মালা পরানো রয়েছে,দেওয়ালে হালকা নীল আলো ক্রমশ রঙ বদলে লালচে হচ্ছে,আমি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকি,মনের মাঝে কে যেন বলে ওঠে

মন যেন রহে তব শ্রীচরণে

গুরুদেব দয়া কর দীন জনে

ছবি তুলি বেশ কয়েকটা আর তারপর আজ লিখতে বসে ভাবি আপনাদের দেখাই, যারা এখানে আসেননি, ইচ্ছে হলে তারা বাড়িতে বসেই না হয় প্রার্থনা করবেন,আর যারা পরে আসবেন গোয়ায়, তখন ইচ্ছে হলে আসবেন একবার,এই উইশ স্পটে।
পু:- ওয়াটসয়‍্যাপে পাওয়া শায়েরীটা বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছে মৌসুমী। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ওকে।
*****************************

দেব মুখার্জিঃ
চন্দননগরের আদি বাসিন্দা,কর্মসূত্রে প্রবাসী বহুদিন ধরে। ভ্রমণ ছিল তাঁর পেশার অঙ্গ। এখন নেশায় দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে কাজে অকাজে ঘুরে বেড়িয়ে,সেই পথ চলার কিছু কথা,পথচলতি মানুষের কথা-অল্প কয়েক বছর আগে শখ করেই লিখেছিলেন ফেসবুকে। সেই লেখা পছন্দ করেন অনেকেই। লেখা চালিয়ে যেতে বলেন। উনি আর থামেননি। মাঝে মধ্যে বেশ কয়েকটি লিটল ম‍্যাগাজিন,নানান লেখকের লেখার সংকলন বইয়ে আর ই-বুকে অনেক লেখা ছাপাও হয়। সবাই প্রশংসা করে। ফেসবুকে পরিচিতি পেয়েছেন,ধারাবাহিক ভাবে লিখে গেছেন কয়েকটি ফেসবুক গ্ৰুপে দীর্ঘদিন। আজও তিনি নিয়মিত লেখেন ফেসবুকে তাঁর টাইমলাইনে,এবং কিছু গ্ৰুপে। এবার নিজের লেখা নিয়ে বই হোক,মলাটবন্দী হোক সৃষ্টিগুলো-বন্ধু বান্ধব,পাঠক পাঠিকা আর শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধ,আবদার ছিল দীর্ঘদিনের। জনপ্রিয় কয়েকটি লেখা বেছে দিয়েছিলেন তাঁরাই।
ছাপা অক্ষরে দুটি বই ‘পাড়ি’ এবং পাড়ি-২ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। আশা রাখি ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক  অপরিচিতই,কাছের মানুষ হয়ে উঠবেন ওনার জীবন সফরের লেখনীর ছোঁয়ায়।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!