Shadow

নতুন ভোরের সন্ধানে – জলি চক্রবর্তী শীল

pc . ব্রতী ঘোষ

নতুন ভোরের সন্ধানে

জলি চক্রবর্তী শীল

শরীরটা আজ একদমই ভালো লাগছে না সিঁথির | বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না | সমস্ত শরীর কেমন যেন নেতিয়ে আছে | হাতেপায়ে কোথাও যেন কোন শক্তি নেই | এইসব দিনগুলোতে শরীর বড্ড খারাপ লাগে | কিছুই যেন করতে ইচ্ছে করে না | তবু নিজেকে হাঁচড়পাঁচড় করে টেনে তোলে সে | মেয়েটা ম্যামের কাছে বসে পড়ছে পাশের ঘরে | ম্যামকে চা দেওয়াও হয়নি | ম্যাম কি ভাবছে কে জানে! রান্নাঘরে গিয়ে চা বসায় সে | নিজের জন্যও এক কাপ চা করে সে | তারপর কাপে ঢেলে বিস্কুট সাজিয়ে একটা ছোট ট্রেতে করে দিতে আসে মেয়ের ম্যামকে |
বৌদির কি শরীরটা খারাপ? মুখ চোখ কেমন যেন বসে গেছে‘ | মেয়ের ম্যাম জানতে চায় |
হ্যাঁ,মানে আর কি শরীরটা ঠিক জুতের নেই |’ মৃদু হেসে উত্তর দেয় সিঁথি | ‘তুমি চাটা খেয়ে নাও | আমি যাই‘ | বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে | নিজের কাপের চাটা নিয়ে গিয়ে ঘরে খাটের ওপর বসে | কাজের তো শেষ নেই | মেয়ের পড়া শেষ হলেই খেতে চাইবে | সন্ধ্যের টিফিনটা বানাতে হবে | তারপর রাতের খাবার | মাসের শেষহাতে তেমন টাকাও নেই যে কিনে চালিয়ে দেবে আজকের রাতটা | ত্রিনাথ সংসার চালানোর যা টাকা দেয় তার থেকে কিছুই প্রায় মাসের শেষে বাঁচে না | চা শেষ করে রান্নাঘরের কাজে লেগে পড়ে | টিফিন বানায় | নিজের যদিও খেতে তেমন একটা ইচ্ছে করে না তবু নিজের জন্যও বানায় | এই কয় বছরে বুঝে গেছে নিজের যত্ন নিজেকেই নিতে হবে| এখানে খেটে যাও যত পারোকিন্তু বিশ্রাম নিও না | দিনের শেষে সংসারের জোয়ালে তুমি যতই খাটো কেউ জানতে চাইবে নাতুমি আজ ভালো আছো তো ?’ অন্তত তার জীবনে এমন দিন কোনদিন আসবেই না | তাই সে নিজেই নিজের যত্ন নেয় |
রাত হচ্ছে ত্রিনাথ তখনো ফেরেনি | মেয়েটাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে | কিন্তু ত্রিনাথের দেখা নেই | এটা প্রায়দিন ঘটে | কোথাও মদ গিলতে বসেছে নিশ্চয়। নিজের খাবার নিয়ে খেতে বসে সে | অথচ বিয়ের পর পর কতদিন এমনভাবেই খাবার সাজিয়ে বসে থেকেছে ত্রিনাথের জন্য | ফিরলে একসাথে বসে খাবে | বেশিরভাগ দিনই ত্রিনাথ ফিরেছে পুরোপুরি লোড হয়ে | এখন এসব অভ্যেস হয়ে গেছে | খেয়েদেয়ে ত্রিনাথের খাবার গুছিয়ে বাসনগুলো মেজেধুয়ে শুতে চলে যায় সে | ত্রিনাথের কাছে দরজার চাবি আছে |
বিছানায় শুয়েও ঠিক ঘুম আসে না | রাজ্যের চিন্তা মাথায় | খুব শিগগিরি একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সে | ত্রিনাথের সঙ্গে আর থাকা যাচ্ছে না | এই ত্রিনাথের সঙ্গেঁ আগের ত্রিনাথের কোন মিলই খুঁজে পায় না | যে মানুষটাকে ভালোবেসে একদিন সে পথে এসে দাঁড়াতেও বিন্দুমাত্র শঙ্কিত হয়নি আজ সেই মানুষটার কাছ থেকেই সে পালাতে চায় | ত্রিনাথের কাছে সে একটি শরীর মাত্র | যার কোন দুঃখ নেইবেদনাকষ্টখারাপ লাগা কোন কিছুই নেই | সেই শরীরের কোন অসুস্থতাও থাকতে নেই | এইভাবে প্রতিরাতে নিজের কাছে একটু একটু করে ছোট হয়ে যাচ্ছে সে | মাঝে মাঝেই ঘিরে ধরছে অপরিসীম হতাশা | বেরতেই হবে এই অসুস্থ সম্পর্ক থেকে | না হলে সে একদিন ঠিক পাগল হয়ে যাবে | ছোটবেলার বন্ধু রীমাকে খুব করে ধরেছে একটা গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করে দেবার জন্য | হয়ত হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি | কিন্তু ততদিন এই সম্পর্ক বয়ে চলতে আর পারছে না সে|
দুম দুম করে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে যায় | একরাশ বিরক্তি চেপে বসে | রোজকার এই জীবন আর ভালো লাগছে না | মেয়েটা আওয়াজে না উঠে পড়ে | বিরক্তি নিয়েই বিছানা থেকে নেমে দরজা খোলে সিঁথি |
কি হয়েছে টা কিযে এইভাবে দরজা পেটাচ্ছ ? জানো না মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে |’বলে সিঁথি |
সরিসরি তুমি দরজাটা না দিলে তো আমি ধাক্কাতাম না |’ বলে ত্রিনাথ ঈষৎ জড়ানো গলায়।
তোমার ঘরে খাবার রাখা আছে খেয়ে নাও |’
তুমিও চলো প্লিজ।ত্রিনাথ বলে।
নাআমার শরীর ভালো নেইতুমি যাও খেয়ে নাও |’ বলেই দরজাটা বন্ধ করতে উদ্যত হতেই খপ করে হাতটা ধরে ফেলে ত্রিনাথ |
প্লিজ চল।
তোমায় বললাম না আমার শরীর ভালো নেই |’
আমি ভালো করে দেব | প্লিজ চলো‘ |
নাত্রিনাথ তুমি যাও | মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে পড়বে |’
পড়ুক | তুমি যখন আমার ঘরে যাবে নাতখন তোমার ঘরেই না হয়‘‚একটা বিশ্রী হেসে কুৎসিত ইঙ্গিত করে ত্রিনাথ |
মাথাটা জ্বলে ওঠে | তবু নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে যায় সে | সবে মাত্র দশে পা দিয়েছে তার মেয়ে বিন্নী | ফুলের মত মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে চায় না | মেয়েটার মুখ চেয়ে অনেকদিন ধরেই এই অত্যাচার সে সহ্য করেছে কিন্তু আর না | এবার এর শেষ  হওয়া দরকার | খুব তাড়াতাড়ি সে এখান থেকে বেরোবেই | একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতেই হবে |
তোমার ঘরে যাও আমি আসছি|’  বলে সিঁথি।
শব্দ করে ত্রিনাথ হাসে | ‘এই তো গুড গার্ল | জানো তো প্রতিটা রাতে তোমাকে না হলে আমার চলে না | তবু এই নখরাবাজী করবেই তুমি | তাড়াতাড়ি এসো |’ বলে ত্রিনাথ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
সিঁথির মাঝে মাঝেই মনে হয় লোকটাকে খুন করে ফেলে | শুধু বিন্নীর কথা ভেবেই নিজেকে শান্ত রাখে | না হলে প্রতিরাতে স্বামীর হাতে এইভাবে লাঞ্ছিত হতে কোন মেয়ে চায় ? ধীরে ধীরে সে ত্রিনাথের ঘরের দিকে পা ফেলে |
———————–

হোয়াটসাপে মেসেজটা ঢুকতেই একটা  রিনরিনে ভালো লাগা ছড়িয়ে যায় সিঁথির মন জুড়ে | অবশেষে চাকরীটা হয়ে গেছে | গত সপ্তাহে ইন্টারভিউটা দিয়েছিল একটা নামকরা ডায়গোনিষ্ট সেন্টারে | কাল থেকেই জয়েনিং |
মোবাইলটা বেজে ওঠে | রীমা ফোন করেছে | কলটা ধরে নিয়েই একপ্রস্থ ধন্যবাদ জানায় সিঁথি |
তুই না সাহায্য করলে এই চাকরিটা হত না রীমা | কিভাবে যে তোর ঋণ শোধ করব জানি না |’ চোখে জল চিকচিক করে তার |
সত্যি জানে না  সে কিভাবে রীমার ঋণ শোধ করবে | বস্তুত রীমা না থাকলে অসুস্থ সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হত না | রীমা মানসিকভাবে এবং আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য না করলে  এত তাড়াতাড়ি সে জীবনের ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারত না | প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় এক কাপড়ে মেয়েটাকে নিয়ে রীমার বাড়িতে এসে উঠেছিল | স্কুল আর কলেজ জীবনের একমাত্র বন্ধু ছিল রীমা | রীমা বরাবরই চেয়েছিল নিজের পায়ে দাঁড়াতে | আর সিঁথি চেয়েছিল একটা সুন্দর সংসার | একজন দায়িত্ববান স্বামীসন্তান নিয়ে ভরপুর সংসার করতে | মানুষ চায় এক আর হয় এক।
রীমার এই ফ্ল্যাটটাই এখন তার একমাত্র আশ্রয়স্থল | রীমা এখানে থাকে না | বিয়ের আগে থাকত | ফ্ল্যাটটা খালি পড়ে আছে | রীমা তাকে এখানেই বরাবর থেকে যেতে বলেছে | কিন্তু সেটা ঠিক নয় | একটা আশ্রয় তাকে খুঁজে নিতেই হবে স্বনির্ভর হলে | বাবামা ছোটবয়সেই মারা যাওয়ার পর মামার আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা | সেই আশ্রয়ও সে খুইয়েছিল ত্রিনাথকে বিয়ে করে | ত্রিনাথের কথা আর ভাবতে চায় না সে | ভুলে যেতে চায় অধ্যায়কেজীবন থেকে  মুছে দিতে চায় সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোকে | মেয়েটাও এই কদিনে বেশ ম্যাচিওর হয়ে উঠেছে | একটিবারের জন্যও সে বাবার কাছে ফিরে যেতে চায়নি | চাইবেই বা কেন? সেইভাবে তো বাবাকে সে পায়নি কখনও,কাছে থেকেও কখনও আপন হয়নি মানুষটা | নাহ আর ভাববে না | কোর্টে কেসটা উঠেছে | জানে না কবে ডিভোর্স পাবে | পেয়ে গেলে শাপমুক্তি হবে  | নিজের জীবনটা তখন অন্যভাবে গড়ে তুলবে সে | মেয়ের জীবনটাও  শক্তপোক্ত করে গড়ে তুলবে সে | টুকরো ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় সে | একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাবার পর একটা নরম রোদ উঠেছে | মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে সূর্য চরাচর রোদে ভাসিয়ে দিচ্ছে | আগামী সুন্দর হবেসুস্থ হবে যেন এই প্রতিশ্রুতি প্রতিটা সুর্যরশ্মিতে বহন করছে | প্রকৃতির সাথে মানুষের এক আত্মিক সম্পর্ক এই প্রথম সে টের পায় | আগামীকাল থেকে শুরু হবে নতুন দিননতুন আশানতুনভাবে বেঁচে ওঠা | অনেকদিন পর বড় ভালো লাগে তার |
*************************
This image has an empty alt attribute; its file name is ---150x150.jpg

জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতিঃ
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি  সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!