পৃথিবী গা, মা, গা গায়:
মণি ফকির
এই উক্তি কার জানেন? কোন সঙ্গীতজ্ঞের নয়। জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারের। “হারমোনিসেস মুন্ডি” গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।
মধ্যযুগীয় দার্শনিকরা যখন “সঙ্গীত গোলকের” এর রূপক ব্যবহার করছেন,তখন কেপলার গ্রহের গতিতে একটি সামঞ্জস্য আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি দেখতে পান যে একটি গ্রহের কক্ষপথে সর্বাধিক এবং সর্বনিম্ন কৌণিক গতির মধ্যে পার্থক্য একটি সুরেলা অনুপাতের সমান। সহজ করে বলি ব্যাপারটা।
সূর্য থেকে পরিমাপ করা পৃথিবীর সর্বাধিক কৌণিক গতি একটি সেমিটোন বা হাফ নোট(১৬:১৫ অনুপাত) দ্বারা পরিবর্তিত হয়,অর্থাৎ শুদ্ধ গান্ধার থেকে শুদ্ধ মধ্যম অবধি।
কেপলার পৃথিবীর ছোট হারমোনিক পরিসরের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক মহাজাগতিক গায়ক দল তৈরি করেন।
আমরা জানি ভোকাল রেঞ্জ এর চারটি মূল ভাগ–সোপরানো,অল্টো,টেনর,বাস–পাশ্চাত্য মতে SATB. স্বর্গীয় গায়কদল গঠিত হয়েছিল একটি টেনার (মঙ্গল),দুটি খাদ (শনি এবং বৃহস্পতি),একটি সোপ্রানো (বুধ),এবং দুটি অল্টো (শুক্র এবং পৃথিবী) দিয়ে। বুধ,তার বৃহৎ উপবৃত্তাকার কক্ষপথ সহ,সর্বাধিক সংখ্যক নোট তৈরি করতে সক্ষম বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ,তাই যখন শুক্র শুধুমাত্র একটি নোট তৈরি করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়েছিল,কারণ এর অরবিট প্রায় বৃত্তাকার। কেপলারের ভবিষ্যৎ বাণী ছিল:বিরল ব্যবধানে সমস্ত গ্রহ একসাথে “নিখুঁত সমঝোতায়” গাইবে।
কেপলার আমাদের মনে করিয়ে দেন যে সুরেলা ক্রম কেবল মানুষই নকল করে,তার উৎপত্তি স্বর্গীয় সংস্থাগুলির সারিবদ্ধতায়।
গ্রহের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন গতির একটি অনুপাত বাদে বাকি সবগুলিই আনুমানিক বাদ্যযন্ত্রের সুরে একটি ডিসিসের কম ত্রুটির মার্জিনের মধ্যে (একটি ২৫:২৪ ব্যবধান)। মঙ্গল এবং বৃহস্পতির কক্ষপথগুলি এই নিয়মের একটি ব্যতিক্রম তৈরি করে,যা( ১৮:১৯ )অসঙ্গতিপূর্ণ অনুপাত তৈরি করে।
কেপলার ১৫৯৯ সালের দিকে হারমোনিস মুন্ডিতে কাজ শুরু করেন,যে বছর কেপলার মাইকেল মেস্টলিনকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি তাঁর আসন্ন পাঠ্যের জন্য ব্যবহার করতে চান এমন গাণিতিক তথ্য এবং প্রমাণের বিবরণ দিয়েছিলেন,যা তিনি মূলত ডি হারমোনিয়া মুন্ডি নামকরণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কেপলার সচেতন ছিলেন যে হারমোনিস মুন্ডির বিষয়বস্তু টলেমির হারমোনিকার বিষয়বস্তুর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ,কিন্তু উদ্বিগ্ন ছিলেন না। নতুন জ্যোতির্বিদ্যা কেপলার ব্যবহার করবে (সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কোপারনিকান সিস্টেমে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ গ্রহণ) তাঁকে নতুন উপপাদ্য অন্বেষণ করার অনুমতি দিয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ যা কেপলারকে তাঁর স্বর্গীয়–হারমোনিক সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয় তা হল সঙ্গীত ব্যঞ্জনার ভিত্তি হিসেবে পিথাগোরিয়ান সুরের পরিত্যাগ এবং জ্যামিতিকভাবে সমর্থিত বাদ্যযন্ত্রের অনুপাত গ্রহণ;শেষ পর্যন্ত এটিই হবে যা কেপলারকে বাদ্যযন্ত্রের ব্যঞ্জনা এবং গ্রহগুলির কৌণিক বেগ সম্পর্কিত করতে দেয়।
কেপলারের পূর্বে মধ্যযুগীয় দর্শনে গ্রহের ব্যবধানের মধ্যে অন্তর্নিহিতভাবে বিদ্যমান বাদ্যযন্ত্রের সুরের ধারণাটি বিদ্যমান ছিল। মিউজিকা ইউনিভার্সালিস ছিল একটি ঐতিহ্যগত দার্শনিক রূপক যা কোয়াড্রিভিয়ামে শেখানো হত এবং প্রায়ই “গোলকের সঙ্গীত” বলা হত।
সাম্প্রতিক রচনাগুলির মধ্যে যে স্বল্প সংখ্যক সঙ্গীত,সঙ্গীতজ্ঞেরা সৃষ্টি করেছেন হারমোনিস মুন্ডি বা হারমোনি অফ দ্য স্ফিয়ারের ধারণার উল্লেখ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
লরি স্পিগেল:কেপলারের হারমনি অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস (১৯৭৭)। ভয়েজার মহাকাশযানে লঞ্চ করা ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ডে অন্তর্ভুক্তির জন্য কার্ল সেগানের দ্বারা টুকরোটির একটি অংশ নির্বাচন করা হয়েছিল ।
মাইক ওল্ডফিল্ড,(ইংরেজি সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুরকার,জন্ম ১৯৫৩),মিউজিক অফ দ্য স্ফিয়ারস (২০০৮ সালে মার্কারি রেকর্ডস দ্বারা প্রকাশিত অ্যালবাম )।
ফিলিপ গ্লাস,আমেরিকান সুরকার,কেপলার অপেরা মারফৎ (২০০৯),জোহানেস কেপলারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
টিম ওয়াটস,(ইংরেজি সুরকার,জন্ম (১৯৭৯),কেপলার্স ট্রায়াল (২০১৬-১৭),সেন্ট জনস কলেজ,কেমব্রিজে প্রিমিয়ার (২০১৬);
পল হিন্দমিথ,(জার্মান সুরকার),ডাই হারমোনি ডার ওয়েল্ট সিম্ফনি (মূলত জার্মান ভাষায় সিম্ফনি “ডাই হারমোনি ডার ওয়েল্ট” নামে পরিচিত),আইপিএইচ ৫০, ১৯৫১ সালে রচিত একটি সিম্ফনি,এবং যা ১৯৫৭ সালের অপেরা ডাই ওয়েল্ট হারমোনির ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল।
ইংরেজ সুরকার গুস্তাভ হোর্লস্ট এর “দ্য প্ল্যানেট সুইটস” কেপলারের এই সূত্রের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়।
এই অত্যাশ্চর্য তথ্যসমৃদ্ধ বইটির ব্যাপারে আমার এক বস্ আমায় প্রথম বলেন। তিনি IT consultant হলেও একজন দুর্দান্ত পিয়ানো বাদক ছিলেন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অপটিক্স নিয়ে তাঁর গভীর পড়াশোনা ছিল। পুনে Tech Mahindra এ চাকরি করার সময় তাঁর সাথে পরিচয়। বহু বছর হলো তিনি গত হয়েছেন।
যদি এ বিষয়ে আরও জানতে আগ্রহী থাকেন,Harmonices Mundi বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
*****************************
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত্য চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।