হারায়ে খুঁজি
রম্য রচনা
কল্যানী মিত্র ঘোষ
বহু বছর প্রবাসে বসবাস করার ফলে স্বভাবটা কেমন যেন “কাছা খোলা” টাইপের হয়ে গেছে। প্রবাস অর্থাৎ আমেরিকা বলেই এই বদভ্যাস,ইউরোপের কয়েকটা দেশে অবশ্য একটু অসাবধান হয়েছ কী মাল গায়েব! আমেরিকায় এসে পড়েছি প্রায় চব্বিশ বছর আগে। তার আগে কলকাতায় জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছি আর নানা ভাবে বিভিন্ন প্রিয় বস্তু হারিয়ে (পড়ুন চুরি হয়ে) বিষণ্ন হয়েছি। বাসে উঠলে পকেটমারী না হওয়াটাই আশ্চর্যের,কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের ব্যাগে কত ই বা টাকা পয়সা থাকে,তবু তাতেও নির্দয় কাঁচি চালিয়ে চামড়ার ওপর বাটিকের কাজ করা প্রিয় ব্যাগকে ফর্দা ফাঁই করে দিয়েছে। টাকার শোকের চেয়েও বোকা বনে যাওয়ায় খুব অপমানিত মনে হয়েছে নিজেকে।
কলেজ জীবন শেষে চাকরিতে ঢুকি। এক বান্ধবীর বিয়ে স্থির হয়। তার বাবা অত্যন্ত বিত্তশালী,বেক বাগানের একটি বিশাল বাড়িতে তার বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আমি ও আরেক বান্ধবী সেখানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছে যাই। আমার সঙ্গের বান্ধবীটি মাদ্রাজি। তার মা,বাবা ও ভাই মাদ্রাজে থাকে,কলকাতায় সে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে চাকরি করে। বিয়ে বাড়ি দেখে আমাদের তাক লেগে গেল,বিশাল বাগানের ভেতর ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে,কনে বসে আছে দূরের একটি দোতলা বাড়িতে,অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে,সর্ব অঙ্গ সোনায় মোড়া। সেই ঘরের লাগোয়া একটি ছোট ঘরে অনেকেই তাদের জিনিস পত্র রেখেছিল,আমরাও ভ্যানিটি ব্যাগ দুটো সেখানে রেখে নীচে বিয়ে দেখতে গেলাম,শাড়ির সঙ্গে ব্যাগ গুলো বড্ড বেমানান ঠেকছিল। আমার ব্যাগে পঁচিশ টাকা ছিল,ফেরার গাড়ি ভাড়া। আমরা দুই বন্ধু মিলে একটা বড়সর কিছু উপহার কিনেছিলাম,সেইটা ওর হাতে তুলে দেওয়ার পর আমরা ঝাড়া হাত পা হয়ে বাইরের মাঠে বর দেখতে গেলাম। আরো কিছু পরে কনে নেমে এল,বিয়ে শুরু হলো। পুরো সময়টা থাকলে আমাদের দেরী হয়ে যাবে তাই মাঝপথে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। এরপর আবার ওই ওপরের ঘরে গেলাম ব্যাগ নিতে,গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ,ঘরটা লন্ড ভন্ড হয়ে আছে আর আমাদের ব্যাগ দুটো হাওয়া। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাগান বাড়ি,চারিদিকে প্রহরী মোতায়েন,নিমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া কাকপক্ষীও গ‘লে আসতে পারবে না,তাহলে?
আমার তো চামড়ার ব্যাগের শোকে দুচোখ দিয়ে বন্যা নামল কিন্তু আমার বান্ধবীর শোক আরো গুরুতর,সেদিন সকালেই আমাদের মাইনে হয়েছে,সে পুরো টাকাটাই ওই ব্যাগে রেখেছিল, এবার কী করে মাসের হাত খরচ চালাবে এই চিন্তায় সে পাগল হয়ে গেল। কনে অর্থাৎ আমাদের বান্ধবীর বাবা সব জানতে পেরে আমাদের আশ্বস্ত করলেন যে ঠিক অপরাধীকে খুঁজে বের করবেন। আমরা অশ্রুসজল নয়নে বিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় নিলাম। কারোর কাছেই কানা কড়ি নেই,অফিসের একটি ছেলে আমাদের ট্যাক্সি করে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে তারপর নিজের বাড়ি গেল। দু দিন পরে আমাদের ব্যাগটা ফেরত পেলাম কিন্তু ভেতরে মালকড়ি সব হাওয়া। চোর নাকি ভদ্র পোশাক পরে ঢুকেছিল,টুকটাক অনেক হাতসাফাই করেছে,আমাদের ব্যাগ হাতিয়ে সব নিয়ে টিয়ে পাঁচিলের কাছে ব্যাগ দুটো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাঁচিল টপকে পালিয়েছে,সকালে সে দুটো উদ্ধার করা হয়। সকলে অনুমান করছে চোর ঢুকেও ছিল পাঁচিল টপকে,এবং ওই অঞ্চলের পাকা চোর সে। ব্যাগে থাকা আমার প্রিয় লিপস্টিক আর চিরুনি টাও ছাড়েনি ।
এই ঘটনার পর থেকে আমি অত্যন্ত সতর্ক হয়ে গেলাম। বুকের কাছে ব্যাগ একেবারে আঁকড়ে ধরে চলাফেরা করতাম। এর বছর পাঁচেক পরে আমার তিন নম্বর চাকরি টা পেলাম কনক বিল্ডিংয়ে। রবীন্দ্র সদনের দিক থেকে আসার সময় বাস আমাকে জীবন দীপ স্টপে নামিয়ে দিত আর সেখান থেকে পায়ে কিছুটা হেঁটে আমি অফিসের সামনে এসে রাস্তা পার হতাম। তখন ওই রাস্তার বাঁ পাশে বেশ লম্বা একটা পার্ক ছিল,মোটামুটি ফাঁকাই থাকত। একদিন একটা কাজ সেরে এগারোটা নাগাদ অফিসে আসছি,জায়গাটা খুব ই ফাঁকা। আমি ব্যাগ বুকে করে হেঁটে চলেছি, হঠাৎ উল্টো দিক থেকে একটা ছেলে লুঙ্গি টা কোমরে গুটিয়ে অসম্ভব দ্রুত গতিতে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই বেচারাকে কেউ তাড়া করেছে,প্রাণ ভয়ে অমন দৌড়চ্ছে, প্রায়ই তো ছোটখাটো গ্যাং এর মধ্যে ঝামেলা শুনতে পাই। আমি আরেকটু পার্কের দিকে ঘেঁষে গেলাম যাতে ও রাস্তা ফাঁকা পেয়ে দৌড়তে পারে। ও দৌড়ে প্রায় আমার কাছে চলে এল,আমি একটু থমকে দাঁড়ালাম,ও কিন্তু ব্রেক কষল না,উল্টে ওই প্রচণ্ড গতিতে দৌড়তে দৌড়তে আমার গলায় হ্যাঁচকা টান মেরে আমার সদ্য কেনা বেশ ভারী সোনা র চেন টা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আমি সেদিন বুঝলাম চুরি আর ছিনতাইয়ের মধ্যে পার্থক্য। তারপরেও সে ছুটতেই লাগল,জানিনা কোথায় গিয়ে থামল। আমি চিৎকার করব কি,গলার অসম্ভব যন্ত্রণা আর অসহ্য অপমান দু গাল বেয়ে গলে গলে পড়তে লাগল। অফিসে পৌঁছে সকলকে বলতে অনেকেই পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে ডায়রি করে এল,কিন্তু কিছুই সুরাহা হলো না,শুধু কলকাতার রাস্তায় গয়না পরে চলার সাধ আমার চিরতরে মিটে গেল। মা অবশ্য সব শুনে বলল অল্পের ওপর দিয়ে গেছে,হয়ত আরো বড় কোনো ক্ষতি হতে পারত। এই যে বার বার মানুষের দ্বারা প্রতারিত হওয়া এর প্রভাব কিন্তু মনে পাকাপাকি ভাবে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে।
এর পরেও বহু বার ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মানুষ আমাকে ঠকিয়েছে,উঠে দাঁড়াতে সময় লেগেছে,তবুও মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ,এই মন্ত্র নিয়েই এগিয়ে চলেছি।
মধ্য বয়সে এসে উপস্থিত হয়েছি আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এক মনোরম শহরে। মানুষজন কাউকেই চিনি না,বাঙালি গোষ্ঠী খুঁজে পেতে বহুদূর গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। নির্বান্ধব পুরীতে প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। বাইরে যাওয়া বলতে দোকান বাজার আর ডাক্তারখানা। মেয়ে তখন বছর দুয়েকের,ওকে নিয়েই একবার সপরিবারে ভারতে আসার জন্য ভ্যাকসিন নিতে যেতে হলো। মেয়ে খুব দুরন্ত,কোলে থাকলে বড্ড ছটফট করে। কোনমতে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে কাপড় জামা বদলাতে গিয়ে চক্ষু চড়ক গাছ! এক কানে দুল নেই আমার। কিছুদিন আগেই কিনেছিলাম একটু দামী পাথরের,মেয়ে বোধহয় টেনেছে আনমনে! আর কী পাবো! খুব মন খারাপে কাটল দুটো দিন। দু দিন পরে ওই অফিসেই মেয়ের জন্য ম্যালেরিয়ার একটি বিশেষ ওষুধ আসবে সেটি আনতে গেলাম। অফিসে ঢুকেই ইতিউতি খুঁজতে লাগলাম যেখানে যেখানে বসেছিলাম,তারপর কত মানুষ এসেছে গেছে,আর কী পাবো? রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বলল,”কিছু কী হারিয়েছেন?”
বললাম “হ্যাঁ“।
“কী“
“ইয়ার রিং,সেমি প্রেশাস স্টোনের,ব্র্যান্ড নিউ!”
সে বলল,”দেখুন তো এটা কিনা,অফিস বন্ধ করতে যাওয়ার আগে ভ্যাকুম করতে যাওয়ার সময় পেয়েছিলাম।“
আমি লালমোহন বাবুর মতো লাফ দিয়ে “এটা আমার” বলে সেটা পকেটস্থ করে মেয়েটিকে “হাগ” দিলাম।
এরপর আরো বহু বার এদেশে আমি গয়না,দামী বস্তু,গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পত্র এমন কি মায়ের হুইল চেয়ার থেকে খুলে পড়ে যাওয়া ছোট্ট স্ক্রু পর্যন্ত খুঁজে অথবা ফেরত পেয়েছি আর প্রত্যেক বারই অদৃশ্য কোনো শক্তিকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। একবার একটি বড় স্টোরে জিনিস কিনে ক্রেডিট কার্ড ফেরত না নিয়ে চলে এসেছি আর সেটা খেয়াল করেছি পরের দিন। কোথায় খুঁজব ভেবে না পেয়ে ভাবছিলাম ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ডিপার্টমেন্ট কে ফোন করে জানিয়ে দি যেন সমস্ত লেন দেন বন্ধ করে দেওয়া হয় তার। আগে একবার কপাল ঠুকে যে যে স্টোর গুলোয় সেদিন গেছিলাম সেগুলোর লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড সেকশনে ফোন করতে থাকি,তিন নম্বর স্টোর বলল হ্যাঁ তাদের কাছে আমার কার্ড রয়েছে।
এ ভাবেই একদিন আমার বছর চারেকের মেয়েকে নিয়ে বাজার করছি,শপিং কার্টের সামনেটায় ও পা ঝুলিয়ে বসে আর কোলে ওর প্রিয় সফট টয় ভালুক ভোলু। আমি জিনিস পত্র কিনে বাড়ি চলে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি,দু দিন পর মেয়ের খেয়াল হলো ভোলু কই! খোঁজ খোঁজ সারা বাড়ি,কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে,মেয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলল,কোথা থেকে সেটা কিনেছিলাম সেটাও আর মনে নেই যে আরেকটা নিয়ে আসবো। মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করা হলো। ভোলু বিনা আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল। আবার সেই স্টোরেই কেনাকাটি করতে গেছি। সব সেরে টাকা দেওয়ার জন্য কাউন্টারে যাবো হঠাৎ মেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“মা,ভোলু!”
আমি ভাবলাম যাক তাহলে ওরকম একটা টয় আছে,কিনে নেওয়া যাবে। ও আমাকে টানতে টানতে একটা জামা কাপড়ের সেকশনে নিয়ে গেল,সেখানে একটা টেবিলের ওপর ভোলু বসে আছে, এটা আমার মেয়ের ই ভোলু। ও তাকে বুকে তুলে আদর করতে লাগল আর আমি কাস্টমার সার্ভিসে গিয়ে জানালাম যে সম্ভবত ওটা আমার মেয়ের খেলনা। ওরা দেখেই বলে দিল এটা ওদের দোকানের নয় এবং ওর গায়ে প্রাইস ট্যাগ ও নেই অতএব এটা আমার মেয়ের।
মেয়ে বলতে লাগল টয় স্টোরির মতোই ভোলু একটু দোকানে ঘুরে নিল,বাড়িতে থেকে থেকে “বোর” হয়ে গেছিল তো!
আমিও ভাবলাম সত্যি তো,একঘেয়ে জীবনে মাঝে মাঝে জিনিস পত্র হারালে তবেই তো তা নাটকীয় হয়ে ওঠে,কখনও কিছু চিরতরে হারিয়ে যায় আর কখনও বা ফিরে আসে।
*****************************
কল্যানী মিত্র ঘোষ পরিচিতি :
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে বসে বাংলার জন্য মন কেমন থেকেই লেখালেখির শুরু ২০১৮ সাল থেকেই নিয়মিত। ভূগোল নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ভারতে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে কাজ করার পর আমেরিকা তে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু ২০০৩ থেকে।
জীবন পরিক্রমায় অভিজ্ঞতার বিবর্তনের চমৎকার ছবি আঁকলি রে!!!ভারী উপভোগ্য ❤️