
আনন্দধারা
কলমে — ভারতী ভট্টাচার্য্য
অমিত অফিস বাস থেকে নেমে রিক্সা করে রোজ বাড়ি যায় | কিন্তু শনিবার দিন অমিত রিক্সা নেয় না | বাস থেকে নেমে আনমনে বাড়ির পথে যেতে যেতে শনিবার সন্ধ্যেতে রাস্তার ধারে অতি আকর্ষণীয় ডালের বড়া,গোল-গপ্পা,চাট, এগরোল,আরো কত লোভনীয় খাদ্যের টান সে এড়াতে পারেনা | সেই সুস্বাদু সুগন্ধ ওকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে ! এত কিছু দেখে জিভের জল কি আটকানো যায়? শনিবারের এই সময় টার জন্য অমিত সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে | সন্ধ্যার এই সময়টুকু একা একা অমিত খুব উপভোগ করে | পরদিন বাদুর ঝুলা-ঝুলে অফিস না যাওয়ার আনন্দে সে বাড়ি যেতে যেতে কত কবিতা,গান মনে মনে আওড়ায় | অমিতের মায়ের একটি গাড়ি কেনার মতো স্বচ্ছলতা আছে কিন্তু কলকাতার এই ভীড়ে গাড়ি চালানোর সাহস অমিতের একদমই নেই | তাই গাড়ি কেনা হয়ে উঠেনি | আর আজকাল ড্রাইভার রাখা মানে একটা হাতি পোষা | সে ক্ষমতা এখনো হয় নি অমিতের | কলকাতা শহরে গাড়ি চালানোর উদ্বেগ থেকে বাদুর ঝুলে যাওয়া শতগুনে ভালো বলে অমিতের মনে হয় |
সেদিন শনিবার বাস থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতেই অমিতের চোখ রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধের উপর আটকে গেলো ! কৌতুহল বশতঃ বৃদ্ধের কাছে গিয়ে দেখে তিনি খুব সুন্দর একটি মেয়ে এঁকেছেন | কিন্তু যে কাগজে এঁকেছেন কাগজটি একদম ভালো নয় | একটু এদিক-ওদিক হলেই ছিঁড়ে যাবে | বৃদ্ধের সাথে অমিত যেচেই কথা বলল এবং কেন উনি এতো সুন্দর ছবিটা একটা ভালো কাগজে আঁকলেন না জিজ্ঞেস করাতে ওঁর মুখটা একেবারে মলিন হয়ে গেলো | কোনো উত্তর দিলেন না | এমন সময় হঠাৎ ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমে যাওয়াতে অমিতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেলেন |
এরপর বেশ কয়েকদিন অতিবাহিত হয়ে গেলো,অমিত ভুলেই গেছিলো | হঠাৎ আবার একদিন অফিসের বন্ধুর বাড়ির এক পার্টিতে বৃদ্ধ কে দেখলো | বাইরে এক কোণে একটি চেয়ারে মলিন বস্ত্রে,অত্যন্ত অসহায় চেহারা নিয়ে বসে আছেন | দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ভালো ঘুম ও ভালো খাওয়া জোটেনি | কিন্তু ওঁর চেহারা তে একটা কিছু ছিল যার থেকে বোঝা যাচ্ছে উনি ভদ্রঘরের ছেলে | কিন্তু তিনি এখানে কেনো? অমিতের কৌতূহল বাড়তে লাগলো | ভাবছে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে,এমন সময় সব অফিস কলিগরা এসে ঘিরে ধরলো অমিত কে একটা গান শোনাতে হবে | আজ খুব আনন্দের দিন| বন্ধুর বাবা খুব ভালো আঁকেন| ওঁর খুব নাম-ডাক হয়েছে | অনেক ছবি খুব ভালো দামে বিক্রি হয়েছে, তাই ছেলে এই পার্টির আয়োজন করেছে | অমিত ভালো গান করে | অমিত কে সবাই ধরলো,একটা গান করতেই হবে | অগত্যা …. |
গান পর্ব শেষ হলে খাওয়া-দাওয়ার সাথে জমিয়ে বন্ধুদের আড্ডা চলছে | সব কিছু শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেলো | হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে বন্ধুদের নজর সেদিকে ঘুরে গেলো | হুড়োহুড়ি করে সবাই চিৎকার অনুসরণ করে ছুটলো | এতো রাত পর্যন্ত যে কজন এই পার্টিতে মজুদ আছে এদের পেটে একটু-আধটু পানীয় গেছে সেই কারণেও এই চেঁচামেচি হতে পারে | ছুটে গিয়ে দেখা গেলো বন্ধুর বাবা ওই বৃদ্ধকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছেন এবং সবাইকে ডেকে বলছেন,লোকটা খুব খারাপ ! কোনো কাজ কর্ম করে না,সব সময় শুধু টাকা চায় | একসময় দয়া দেখিয়েছিলেন বলে আজ মাথায় উঠে নাচছে ! উনি কোনো ধর্মশালা খুলে রাখেননি বলে চেঁচামেচি করছিলেন | এরপর বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“ফের যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখেছি তোমায় তাহলে পুলিশে দেবো” | আরো কত কিছু বলছিলেন ! সবাই যখন বন্ধুর বাবার কথা শুনতে ব্যস্ত,অমিত চুপচাপ বাইরে চলে আসে | দেখে বৃদ্ধ মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছেন | অমিতের ভীষণ খারাপ লাগছিলো | ওঁর চোখ বলছে উনি কোনো অন্যায় করতে পারেন না | তবু কেন ওঁর ওপর এই অপবাদ ! নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো গল্প আছে | সময় নষ্ট না করে অমিত ওঁকে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো | আগে একটু পরিচিতি থাকায় হয়তো উনিও অমিতের সাথে যেতে কোনো আপত্তি করলেন না | অথবা যাবার কোনো জায়গা নেই বলে !
রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে | যা আছে সব নিজস্ব গাড়ি | অনেকক্ষণ হাঁটার পর কোনোরকম একটি গাড়ি পেয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো অমিত | বাড়িতে মা ছাড়া আর কেউ নেই | অমিত মাস্টার ডিগ্রী শেষ করে একবছর হলো চাকরি করছে | বিয়ে-থা এখনো করা হয় নি | মা বিয়ের জন্য চেষ্টা করছেন | বাড়ির চাবি মা-ছেলে দুজনের কাছে থাকে | রাতে অমিত মা কে ডাকাডাকি করে না | মায়ের রক্তচাপ বেশি | একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুমাতে পারেন না | সারাদিনে রাতেই মায়ের একটু বিশ্রাম করার সময় | সেটা অমিত কোনোভাবেই নষ্ট করতে চায় না | শনিবার-রবিবার ছাড়া অফিস ফেরত রোজই পাড়ার ক্লাবে একটু আড্ডা মেরে আসে অমিত | তাই একটু রাত হয়ে যায় | শনিবার ওর নিজস্ব আর রবিবারটা মায়ের জন্য তোলা থাকে | সেদিন মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিকল্পনা হয় |
আধঘন্টা পর ওরা বাড়ি এসে পৌঁছালো | গাড়িতে ওঁকে কিছুই জিজ্ঞাসা করার সাহস হলোনা অমিতের | বিবেকে বাধলো | উনি এক কোণায় চুপটি করে বসে আছেন | আধো আলোতে ঠাহর করতে পারছে ওঁর নয়ন বারি অনবরত বয়ে যাচ্ছে | বাড়ি ঢূকেই সময় নষ্ট না করে ওঁকে শুইয়ে দিলো | অমিতের খাটটা বড়ই আছে,দুজন একসাথে শুতে কোনো অসুবিধা হবে না | এরপর অমিত আলো নিভিয়ে বিছানায় নিজের শরীরটাও এলিয়ে দিলো |
সকাল বেলা মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো | বৃদ্ধ তখনো ঘুমাচ্ছিলেন,ওঁকে দেখে আশ্চর্য হয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন,উনি কে? অমিত মাকে অন্য ঘরে টেনে নিয়ে বলল,“মা আমি নিজেও বিশেষ কিছু জানি না | ওঁকে উঠতে দাও | উনি নিজেই আসল ঘটনা বলবেন আজ | এখন এক কাপ গরম চা খাওয়াও তো | ভয় নেই | আমি আছি | আজ আমি অফিস ছুটি নেবো মা | এখানে অনেক গল্প আছে মনে হচ্ছে ! আমাকে আসল কারণ টা জানতেই হবে | অমিতের মা,ছেলের এইসব উল্টো-পাল্টা কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না ! প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে অমিত মা কে ঠেলে রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে বললো,“একটু সবুর করো,সব জানতে পারবে” |
অমিত চা শেষ করতে করতে বৃদ্ধ ঘুম থেকে উঠে অমিতের মা কে দেখে একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন | অমিত বুঝতে পেরে মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে ওঁকে বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে এলো | মা ওঁর জন্যও চা করে নিয়ে এলেন | গত রাতে ওঁর কিছু খাওয়া হয়েছিল কি না জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন,সবার খাবার শেষে সামান্য কিছু মুখে দিয়েছিলেন কিন্তু শেষ করার আগেই একটা বিচ্ছিরি কান্ড বেঁধে গেলো | সেটা তো অমিত দেখেছে ! তাই খাওয়া আর শেষ করতে পারেন নি | শুনে খুব খারাপ লাগলো অমিতের | রাতে সেওতো ওঁকে একবারও খাবার কথা জিজ্ঞেস করে নি | অমিত সুযোগ বুঝে কি কারণে কান্ডটা বেঁধেছিলো তার কারণ জিজ্ঞেস করলো | যদি ওঁর আপত্তি না থাকে তবে কারণটা বলতে অনুরোধ করলো | উনি ম্লান হেসে বললেন,এতদিন এক আশায় এবং কিছুটা ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি,পাছে আমার অধিকার থেকে আমায় বঞ্চিত করে দেয়,কিন্তু গতকাল রাতে বুঝতে পেরেছি আর কিছু অবশিষ্ট নেই লোকটার মধ্যে,সব বেচে খেয়ে ফেলেছে,এখন আর বলতে কোনো বাধা নেই |
শোনো তাহলে –
আমার নাম শৈলেন সেন আর ঋষিকেশ ঘোষ যে তোমার বন্ধুর বাবা,আমরা দুজন এক কলেজে পড়তাম | বন্ধু বললে ভুল হবে,সহপাঠী বলতে পারো | ঋষি খুব বড়লোকের ছেলে আর আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত | সবাই বলতো আমি খুব ভালো আঁকতাম | আমার চিত্রকলা দেখে সবাই অবাক হয়ে যেত |
কলেজের প্রত্যেক প্রতিযোগিতায় আমি আর্টে প্রথম স্থান অধিকার করেছি | ঝড়ের বেগে তিনবছর কি করে যে কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না |
তিনবছর পর আমরা স্নাতক হয়ে গেলাম | সবাই যে যার মতো মাষ্টারি করতে চলে গেলো | আমারও খুব ইচ্ছা ছিল আর্ট নিয়ে পড়বো | সারাজীবন এই নিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম | কিন্তু ভাগ্য আমার বাধা হয়ে দাঁড়ালো | সেই সময় হঠাৎ করে বাবা গত হলেন | বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন,কিন্তু আমাদের ভালোই চলে যেতো | বাবা গত হওয়ার পর কোম্পানি একসাথে কিছু টাকা মায়ের হাতে দেয় | সেই যৎসামান্য টাকা মা বিপদের জন্য ব্যাংকে রেখে দিলেন | এবার রোজকার খরচা কি করে চলবে? মা আমাদের নিয়ে নিয়ে সাগরে পড়লেন | মা নিজে সেলাই করা শুরু করলেন | এতে কিছু পয়সা আসতো কিন্তু পর্যাপ্ত নয় | বাধ্য হয়ে আমি চাকরি খুঁজতে লাগলাম | ছোটোখাটো একটা চাকরি পেয়েও গেলাম | কিন্তু যেমন খাটায় তেমন টাকা পয়সা দিচ্ছে না | এই যখন আমার অবস্থা সেইসময় আকস্মিক ভাবে ঋষির সাথে রাস্তায় দেখা হলো ||
ঋষি আমায় নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলো আমার কেমন চলছে | কি করছি ইত্যাদি ইত্যাদি | আমি সব সত্যি কথা বললাম | সব শুনে সে আমায় এক বিশাল প্রস্তাব দিলো ! শুনে আমি তো অবাক | আমায় বললো,আমি শুধু আঁকবো,সে সব কিছু আমায় সরবরাহ করবে | আমার কোনো খরচা নেই | এগজিবিশনের ও ব্যবস্থা করবে | বিশাল করে করবে | শুধু একটা শর্ত রাখলো,একটা / দুটো ছবিতে ওর নাম টা লিখতে হবে | সেটাও আমার ইচ্ছে মতো | এরজন্য আমি যত টাকা চাই দেবে | ভালো করে ভাই-বোনের পড়া-শুনা,বিয়ে থা সব হয়ে যাবে | ঋষি বললো এতে,আমার ভাই-বোন,মা সবাই খুব ভালো থাকবে | আমি তখন কিছু বলতে পারলাম না ! কোনোভাবে আমার বিবেক সায় দিচ্ছিলো না | ঘরে ফিরে মা এর সাথে আলাপ করলাম | মা কিন্তু আমায় আপত্তি করেছিলেন কিন্তু মায়ের সাথে আলাপ করার সময় ভাই-বোনরাও সব শুনে ফেলে | দুটোই তো ঘর | ওদের প্রস্তাবটা খুব পছন্দ হয় | ওরাও তখন নবম / দশম ক্লাসে পড়ে | বাড়িতে তখন খুব অভাব চলছে | মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছে না | মা আর কাজ করতে পারছেন না | ভাই বোনের স্কুল বন্ধ হবার জোগাড় | অগ্যতা বাড়ির প্রতিকূল পরিস্থিতির কাছে আমার বিবেককে হার মানতে হলো | আমি একটা কাগজে আমার শর্ত গুলো লিখে সই করে আমার কাছে ও ওর কাছে এক এক কপি রেখে ঋষির সাথে কাজ শুরু করলাম | প্রথম দশ / বারো বছর খুব ভালো চলছিল | আমি আমার মতো করে করছিলাম | ঋষিকে বলার আগেই আমায় সব কিছু সরবরাহ করতো | আমাদের ঘর সংসার ও খুব ভালো চলছিল | মা এর চিকিৎসা করিয়েছি | কিছুটা সুস্থ মা | বোনের বিয়ে ও ভাই পড়া শেষ করে একটা চাকরি তে ঢুকেছে | চাকরি পেয়েই ওর পছন্দ করা মেয়ের সাথে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে | এরপর আমরা বাড়িতে একটা পার্টি দিই | ভাইয়ের বিয়ের পর আমার বিয়ে দেবার জন্য মা খুব জোর করতে লাগলেন | আমিও রাজি হয়েছি কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সেই সময় মা গত হলেন | এরপর ভাই আলাদা হয়ে গেলো | বোন অন্য শহরে থাকে | বড়ো সংসার ছেড়ে সে আসতেই পারে না | আমি বড়ো একা হয়ে গেলাম | ভাই-বোন কেউ আমার খোঁজ করে না | মনে খুব কষ্ট নিয়ে ছবি আঁকতাম ! কেমন যেন আনমনা হয়ে চলতাম | সেই সুযোগে ঋষি আমার সব চিত্রতেই ওর নাম লিখতে লাগলো | এবং বাইরে বিক্রি করতে লাগলো | কোনো এগজিবিশন দিতো কি না জানতে পারতাম না | জিজ্ঞেস করলে বলতো সব রাখছে সে | একসাথে এগজিবিশন দেবে | কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম ওর আসল ষড়যন্ত্র | কিন্তু ততদিনে সে তার আখের ঘুছিয়ে নিয়েছিল | সে আমার চিত্র তে নিজের নাম লিখে একজন বড় চিত্রকার হয়ে উঠলো | টাকা-পয়সা অপর্যাপ্ত থাকায় নাম কামাতে তার বিশেষ কোনো বেগ পেতে হয় নি | সে বিয়ে করেছিল অনেক আগে | ওর ছেলেও তখন কলেজে পড়ে | ঋষির মতোই ছেলেটা খুব ধূর্ত | আমাকে তখন থেকে ছেলেটিও অবজ্ঞা করা শুরু করলো | পয়সা-কড়িও ঠিক মতো দেয় না | আমার তখন সব দরজা বন্ধ | চাকরির ও বয়স নেই | তাই অসহায় হয়ে আমি ওর জন্যই আঁকতাম | যা দিতো তাই দিয়ে কোনোরকম আমার দিন চলে যেতো | কিন্তু শেষ যবনিকার টান আজ তো দেখলেই তুমি, কিভাবে ছেলে বাবা মিলে চিরকালের মতো আমায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো | এখন আর আমাকে ওদের দরকার নেই | এখন বুঝতে পারছি প্রথম থেকে ওর জেদ ছিল আমার সব কিছু ছিনিয়ে নেওয়া ! আজ সে পেরেছে ! তাই তো এই আনন্দের পার্টি | আমার সাথে এখন আর কোনো সম্পর্ক রাখলে ওদের প্রতারণা বেরিয়ে আসবে যে !
অমিত ও অমিতের মা হাঁ করে শৈলেন বাবুর কাহিনী শুনছিলেন | দুজনই বাক্যহারা ! সিনেমা-নাটকে এইরকম কাহিনী শোনা যায় কিন্তু বাস্তবে যে কেউ সত্যি এতোটা অমানবিক হতে পারে সেটা আজ নিজের চক্ষে না দেখলে,শুধু কারো মুখে শুনে অমিত আজও বিশ্বাস করতো না | কিন্তু যা হবার তো হয়ে গেছে,এখন অমিতের কি করা উচিত সেটাই ভাবছে | অমিতের মাও খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন,লোকটাকে উচিত শাস্তি দিতে হবে | অমিত একটু চিন্তা করে শৈলেনবাবুকে বললো,আপনি আঁকা শুরু করুন আবার | তবে খুব মন দিয়ে করবেন | নিজের নামটা লিখতে একদম ভুলবেন না | আপনি এখানেই থাকবেন | আমাদের যা জুটবে আপনিও এর থেকে একটু খেয়ে পরে নেবেন | কিন্তু বাড়ি থেকে একদম বেরোবেন না | ওরা যেন জানতে না পারে আপনি আমার বাড়িতে আছেন | তবে আর রক্ষে নেই | অমিতের মানবিকতা দেখে শৈলেন বাবুর চোখে জল আটকাচ্ছে না | ভাবছেন এই সংসারে কত খারাপ লোকও আছে আবার কত ভালো লোকও আছে ! শুধু চিনতে ভুল হলেই মহা বিপদ |
শুরু হলো শৈলেন বাবুর নতুন জীবন | অমিতের বিয়ে আপাতত শিকেয় তুলে রাখা হলো | এখন সব থেকে বড়ো কাজ শৈলেন বাবুর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া | ছয় মাস শৈলেন বাবু জান-প্রাণ দিয়ে একটার পর একটা ওঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতি ঢেলে আঁকলেন | অমিত ওঁর যা টাকা ছিল সব দিয়ে একটা এগজিবিশন করালো | এতে সব বড়ো বড়ো হস্তী কে আমন্ত্রণ করলো | কিন্তু আগে চিত্রকারের নাম কাউকে জানতে দিলো না | অনেক চিন্তা-ভয় নিয়ে কাজটা শুরু করে অমিত | অবশেষে নির্দিষ্ট দিনটি উপস্থিত হলো | বুক টা ধুক ধুক করছে,এতটা খরচা করে যদি চিত্র বিক্রি না হয় তবে সব গেলো | কিন্ত অমিতের বিশ্বাস ভালো লোকের সাথে শেষ পর্যন্ত সব ভালো হবে | ওর সব টাকা আবার ফিরে আসবে এবং ওঁনার কাছেও টাকা আসবে |
সেই শুভ দিনে ঠিক সন্ধ্যার সময় রামকৃষ্ণ মিশনের একজন মহারাজ এসে ফিতা কেটে এগজিবিশন শুরু করলেন | অমিতই ডেকেছিল মহারাজকে | ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর আমন্ত্রিত লোকরা আসা শুরু করলো | এবং ধীরে ধীরে সব চিত্র বিক্রি হয়ে গেলো | সেই মুহূর্তটা দেখার মতো ছিল | শৈলেনবাবু কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না | ঋষি ওঁকে ঠকিয়েও জীবন যুদ্ধে ওঁকে হারাতে পারেনি | ওঁর আজ জয় হয়েছে | উনি জিততে পেরেছেন | জীবনে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া থেকে আর কিছু বড়ো হতেই পারে না | এর আনন্দ-আত্ম তৃপ্তি কাউকে বোঝানো অসম্ভব | সব কিছু সম্ভব হয়েছে অমিতের দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তের জন্য | কিন্তু এখন তো শৈলেনবাবুকে অমিতের বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে ! কি করে অমিত ছাড়া থাকবেন তিনি ! এই কয়েকদিনে ছেলেটা শৈলেন বাবুর মনের অন্তরালে বাসা করে ফেলেছে ! ফিরে যাবার কথা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে | কোথায় ই বা যাবেন ! কথাটা ভাবতে ভাবতে শৈলেন বাবু সেদিন রাতে চোখের পাতা এক করতে পারেননি |
পরদিন সকাল বেলা অমিত যখন এগজিবিশনের লাভের টাকা শৈলেনবাবুকে পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিতে আসে তখন তিনি টাকা গুলি হাতে নিয়ে আবার সব টাকা অমিতের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,আমায় আর ছোট করিস না অমিত। তুই কি চাস, তুই শুধু বড়ো হয়ে থাকবি ! আমি হতে পারি না ! বলতো আমার টাকার কি দরকার ! তুইই তো সব করছিস, সব দেখছিস ! আমি কত ভাগ্যবান দেখ্, বিনা কষ্টে তোর মতো একটা সন্তান পেয়েছি | তুই এই টাকা দিয়ে আমায় কি তাড়িয়ে দিতে চাইছিস? দয়া করে আমার ছেলেটাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিস না | আমার যে এই ছেলেটি ছাড়া আর কেউ নেই | অমিত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না | জাপটে ধরে বললো,এইরকম বোলো না কাকু | তুমি আমার কাছেই থাকবে | তুমি কি ভাবছো টাকাটা দিয়ে তোমায় আমি বিদায় করে দেবো ! ছোট বেলা নিজের বাবাকে হারিয়েছি | আর তোমায় হারাতে চাই না | এই টাকা তোমার প্রাপ্য | আমার নিজের বাবা হলেও আমি ওঁর কষ্টের টাকাটা ওনার হাতেই দিতাম | তুমি কোথাও যাবে না | শৈলেন বাবু হেসে বললেন,আবার তোর কাছে আমি হেরে গেলাম | কিন্তু এই হারা দুঃখের নয় সুখের রে অমিত | অমিতের মা,শৈলেন বাবু,অমিত সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে একসাথে হেসে উঠলেন |
*******************************
ভারতী ভট্টাচার্য পরিচিতিঃ ভারতী ভট্টাচার্য একজন ব্যবসায়ীক মহিলা এবং লেখক। বর্তমানে বাসস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম শহরে।