
উপস্থিত–বুদ্ধি
মধুমিতা মিত্র
বুড্ঢা বুঢ়িয়া ছোট্ট দুটি ভাই আর বোন
তারা আপন মনে আপন হারা,দিনের সর্বক্ষণ
বয়স তাদের পিঠোপিঠি,
করে তারা ছুটোছুটি
তাদের লাফালাফির তালে,
অতিষ্ঠ সর্ব জন…
বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার বাবা যথানিয়মে অফিসে যান,মা পড়াতে যান স্কুলে,তাই ছুটির দিন গুলোতে দুটি ভাই বোনে বাড়িতে একাই–একা মানে মা বাবা ছাড়া খালি দুজনেই থাকে। না না,এমনটিও বলা চলবে না,ওদের বাড়িতে সব সময়ের কাজের লোক না থাকলেও সারা দিনের লোক অবশ্যই একজন আছে, মদনের মা। প্রচন্ড চটপটে,ভীষণ বিশ্বাসী,কাজে কর্মে হাতে পায়ে পটু।
সেদিন বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার বাবা যথারীতি তাঁর নির্ধারিত সময়ে অফিসে বেরোলেন,তাদের মা–ও তার কিছুক্ষণ পরেই বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার অন্য আর সব ছুটির দিনের মতই,মদনের মায়ের হেফাজতে দুই ভাই বোনকে রেখে স্কুলে যাওয়ার রিক্সা চেপে রওনা দিয়েছেন। মদনের মা বাড়ির কর্তা গিন্নীকে সেদিনকার মতো তাঁদের কর্মস্থলে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ির সদর দরজাটি বন্ধ করে রান্নাঘরের বাকি কাজ সারায় ব্যস্ত ,এমন সময়ে সদর দরজায় কলিং বেলের সে কি ঘনঘটা ! জোরে জোরে কলিংবেল বারবার বেজে উঠছে আর তার সঙ্গে বেশ বাজখাঁই গলায় ডাক “ও বুড়া—ও বুড়ি“….
মদনের মা বুড্ঢা–বুঢ়িয়াদের বহুদিনের কাজের লোক,তাই এদের পরিবারের খুঁটিনাটি,আঁতিপাতি সব কিছু জানা তার। এর ওপরে আবার বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার দুই পিসির বিয়ে এই কিছুদিনই হল হয়েছে,সেই বিয়ের সময়ে যাবতীয় আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে মদনের মার ভালোই পরিচয় হয়ে গিয়েছে। মদনের মায়ের সঙ্গে বুড্ঢা–বুঢ়িয়াও বেল বাজানোর ঢঙে আর বুড্ঢা–বুঢ়িয়াকে ডাকার ঢঙে সচকিত হয়ে ওঠে ! এমন অপরিচিত গলায় অথচ অত পরিচিতের সুরে কে ডাকে? হঠাৎ করে কোন্ অতিথি এল তাদের দরজায়?
ওঃ হো! একটা বিশেষ কথা তো বলাই হয় নি | এই গল্পের কাহিনী কিন্তু আজকের নয়,আজ থেকে সে প্রায় পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর আগেকার । সে সময়ে আত্মীয়তার বহরও ছিল আজকের থেকে দশ গুণ বেশী। যেমন কারণে তেমনি অকারণে,কারুরই কিছু প্রয়োজন হোক বা না হোক,নিছক কুশল সংবাদ নেওয়ার জন্য আত্মীয়রা যখন তখন নিজেদের লোকেদের বাড়ী চলে আসত। তা–ও আবার বুঢ়িয়ারা ওপার বাংলা থেকে আসা;সেই দেশ ছাড়ার শোক লাঘব করতেও,আবার অনেক সময়তেই পুরোন সেই যৌথ পরিবারের সুঘ্রাণ নিতে অথবা দেশের স্মৃতি রোমন্থন করতে আত্মীয়রা তাদের তথাকথিত নিজের জনের কাছে চলে আসত বেটাইমে, বিনা নোটিশে। তিথি না মেনে যিনি আসেন তিনিই তো অতিথি;এই তত্ত্বেই তখনকার সমাজ চলত। অতএব আপনজন তথা অতিথিদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটিও থাকত না।
তেমনই সেই সকালে বুড্ঢা বুঢ়িয়াদের সদর দরজার কলিং বেলের সেই ঝপাং ঝপাং আওয়াজে ,কে এল? কে এল? করে দু ভাই বোন দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই দু জনা দে’খে দায়িত্ব পরায়ণ মদনের মা দরজায় আইহোলে চোখ রেখেছে | ওপাশ থেকে ক্রমাগত হাঁক ডাক আসছে
“অ বুড়া বুড়ি দরজা খোল রে,আমি তোদের চন্দন কাকু“। মদনেরমা তো ভুরু কুঁচকে আইহোলে চোখ রেখেই বলছে–
“কে চন্দন কাকু?-সাত জন্মে তো তোমার নাম শুনিনি!!!!!!”
বুড্ঢা বুঢ়িয়াও প্রথমে চমকে যায়—কে রে বাবা চন্দন কাকু? হঠাৎ বুড্ঢার মনে পড়ে আরে!! এ তো সেই চন্দন কাকু যে এই কিছুদিন আগেই জবাদিদির বিয়েতে মুখে আঙুল দিয়ে উলু দিয়েছিল! আর মা জ্যেঠিমা কাকীমাদের সঙ্গে খুব হুল্লোড় করছিল ! হয়েছে টা কি বুড্ঢা বুঢ়িয়ার বাবার খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে মানে বুড্ঢা–বুঢ়িয়ারও খুড়তুতো দিদির বিয়েতে (এত দূরের সম্পর্ক শুনে ঘাবড়ানোর কিছু নেই–তখনকার সময়ে এমন এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলিও নিতান্তই আপনার জন ছিল) এই চন্দন কাকুর দেখা বুঢ়িয়ারা প্রথমবার পেয়েছিল। চন্দন কাকু খুব লম্বা চওড়া,অমায়িক গলার একজন হুল্লোড়ে কাকু,যে গোটা বিয়ে বাড়িটা হৈ হৈ করে অত সমস্ত আত্মীয়কে একযোগে একসূত্রে বেঁধে একেবারে জমিয়ে রেখেছিলেন। তার সঙ্গে তাঁর দোসর ছিলেন চন্দন কাকিমা থুড়ি ডালিয়া কাকিমা। চন্দন কাকুকে বুড্ঢা–বুঢ়িয়ারা আগে কখনও দেখেনি কারণ চন্দন কাকু মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আর ডালিয়া কাকিমাও চন্দনকাকুর সঙ্গে দেশান্তরেই থাকেন। ইনিও বুড্ঢার বাবার আর এক কাকার ছেলে। সমুদ্রে ভেসে থাকার কারণেই বুড্ঢাদের পিসিদের বিয়েতে এরা আসতে পারেন নি,তাই বুড্ঢা বুঢ়িয়ারও অচেনা ছিল।
যাই হোক বিয়ে বাড়ি মিটে টিটে যাবার পর তো সবাই যে যার নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে সেই পুনর্মূষিক হয়ে গিয়েছে। যে যার নিজস্ব জীবন আবর্তে ঢুকে পড়ে বিয়ে বাড়ির মধুর স্মৃতিটুকু আলমারির লকারে যত্ন করে তালা বন্ধ করে রেখেছে। এর মধ্যে চন্দনকাকু যে না বলে কয়ে বুড্ঢা–বুঢ়িয়াদের বাড়ি হানা দেবেন তা কে জানে !
চন্দনকাকু সমুদ্রে সমুদ্রে ভেসে বেড়ান বলেই এতদিন বুড্ঢা বুঢ়িয়াদের বাড়িতে আসেনও নি আর মদনের মা সেজন্যই তাঁকে চেনেও না। এবার মদনের মা বুঢ়িয়াকে ধরলো
– “কে রে তোর চন্দন কাকু? আগে তো একে কখনও দেখা দূরস্হান,নামও শুনি নি কখনও! বন্ধ দরজার এপাশে বুঢ়িয়া তখন বলে
-“দরজাটা তুমি খোলো না | ইনি আমাদেরই কাকু,জবাদিদির বিয়েতে দেখেছি এঁকে,খুব মজা করেন ইনি“।
বুঢ়িয়াদের চাপে সন্দিগ্ধমনা মদনের মা দরজা তো খুললো কিন্তু আগন্তুককে ঢুকতে না দেবার জন্যই দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুড্ঢা বুঢ়িয়া তখন জোর করে মদনের মাকে সরিয়ে চন্দন কাকুকে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্হা করে দিল। চন্দনকাকু তো সাত ঘাটের জল খাওয়া মানুষ | পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করে মদনের মাকে তোল্লাই দিয়ে বেশ অমায়িক গলায় আলাপ জুড়লেন “আরে!! তুমি ই মদনের মা? বৌদিদি সারাক্ষণ বিয়া বাড়িতে তুমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ,আমি তখন থিক্যাই ঠিক করসি তুমারে দ্যাখনের লাইগ্যা একদিন আইতেই হইব এই বাসাত“এই বলে বড়সড় একটা মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিল মদনের মায়ের হাতে। সন্দেহের ভাবে, অপ্রসন্ন চিন্তায় মদনের মা তখন চন্দন কাকুকে প্রশ্ন করতে লাগলো
-“আপনি জানেন না বৌদি যে এই সময়ে বাড়ি থাকে না?”
চন্দন কাকুর চট্জলদি জবাব,
-“আরে !!জানতাম তো বটেই কিন্তু খেয়ালই আসিল না যে বৌদি স্কুলে বাইরোইয়া যায় এই সময়তেই! এই কাছেই ছুডু একটা কাম পরসিলো,তাইইই ভাবলাম আইয়া পড়ি,বৌদির লগে দুপুর বেলা গপ্পো কইরা ফিইরা যাইমু বাসাত“…
মুখে ভদ্রতা করলেও মদনের মা খানিক অপ্রসন্ন মনে আর অনেকটাই সন্দিগ্ধচিত্তে চন্দনকাকুকে জরিপ করে যাচ্ছিলই, কিন্তু ভদ্রতার আচরণে কোনো তার ফারাক ছিল না। দুপুরে খাবার সময়ে অতিথি এসেছে,মদনের মায়ের বৌদি যা যা রান্না করে রেখে গেছেন তাতে এবেলা, ওবেলা মিলিয়ে ভালই খাইয়ে দেওয়া যাবে। তখন তো আর ঘরে ঘরে ফ্রীজ আর গ্যাসের যুগ নয় যে সবসময়তেই কিছু বেশী খাবার মজুত থাকবে! তবুও টুকটাক ভাজাভুজির সঙ্গে একজনের বাড়তি ভাত মদনের মা জনতা স্টোভে বসিয়ে দিল। এর ফাঁকে বুড্ঢা–বুঢ়িয়াকে একদিকে টেনে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসাও করে নিল
-“একে চিনিস তো তোরা? ঠিক তো এ–ই তোদের চন্দন কাকু তো?” বুড্ঢা–বুঢ়িয়া তো একবাক্যে অনেকটা মাথা হেলিয়ে সায় দিল | বলল
-” হ্যাঁ গো…ইনি আমাদের চন্দন কাকুই গো,জবাদিদির বিয়েতে মুখে আঙুল দিয়ে উলু দিচ্ছিলো“….
মদনের মা সযত্নে বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার চন্দন কাকুকে বুড্ঢার বাবার পাজামা–পাঞ্জাবী দিয়ে হাতে একটা ধোয়া শুকনো গামছা ধরিয়ে স্নানে পাঠালো ,তারপর পঞ্চ ব্যঞ্জনে কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে সামনে বসিয়ে খাওয়ার তদারকি করে হাতে সেদিনকার খবরের কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে চন্দন কাকুকে মদনের মা বলল,
“এতদূরে যখন বৌদির সঙ্গে দেখা করতেই এসেছ, তখন যাই;বৌদিকে বৌদির স্কুল থেকে গিয়ে ডেকেই নিয়ে আসি | যদি বৌদি হাফ ছুটি নিয়ে আসতে পারে!
বুড্ঢা–বুঢ়িয়াদের মায়ের স্কুল বুঢ্ঢাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে না হলেও একেবারে কাছে কিন্তু মোটেও ছিল না। পায়ে হেঁটে দুপুরের রোদে সে বেশ অনেকটা….তবুও মদনের মায়ের কর্তব্যপরায়ণতায়,এই পরিবারটির প্রতি তার দায়বদ্ধতায়,এই বেশী পরিশ্রমে এতটুকুও বাদ সাধল না সে (তখন তো আর ফোনের যুগ ছিল না!)।
মজাটা হলো এবার! বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার মায়ের স্কুলে রওনা দেবার সময়! চন্দনকাকু সিগারেটটি ধরিয়ে বিছানায় আয়েশ করে খবরের কাগজটি নিয়ে যেই না শুয়েছেন,মদনের মা বুড্ঢা– বুঢ়িয়াকে পাশের ফ্ল্যাটে জমা রেখে আর বাইরে থেকে চন্দনকাকুকে তালা দিয়ে দৌড়লো তার বৌদির স্কুলের দিকে। বৌদিকে স্কুল থেকে বগলদাবা করে নিয়ে এসে চন্দনকাকুর সামনে বসিয়ে দিয়ে তবে সে তার কর্তব্য সুসম্পন্ন করলো। এদিকে চন্দনকাকু তো হতবাক এবং মুগ্ধ ! যে মহিলা এত যত্ন আত্তি করে তাঁকে আপ্যায়ন করলো,অবিশ্বাসের আঁচ টুকু লাগতে দিল না,সেই মহিলা এমন ভাবে বাচ্চা দুটোকে তাঁর আওতার বাইরে সরিয়ে ,বাড়ির বাইরে থেকে তালা দিয়ে,খোদ তার মালকিনকে তাঁর কর্মস্থল থেকে টেনে এনে তবে তার কাজ থেকে সে ছুটি নিল!!!
এরপর থেকে যতবারই বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার মায়ের সঙ্গে বুড্ঢা–বুঢ়িয়ার চন্দন কাকুর মোলাকাত হয়েছে,মদনের মায়ের কুশল সংবাদ নিতে আর তার কর্তব্য পরায়ণতা এবং উপস্থিত বুদ্ধি‘র শতমুখে প্রশংসা করতে চন্দনকাকু এতটুকু ভুল করেন নি।
**************************
মধুমিতা মিত্র পরিচিতি
পেশা–স্বপ্ন দর্শন, স্বপ্ন গুলোই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন, জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল, বোঝা, দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ, উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..
বেশ মজার গল্প। এমন বুদ্ধিমতী কাজের লোক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।