Shadow

নীরবতা পালন – রাজর্ষি দত্ত 

PC: Shutterstock

নীরবতা পালন

রাজর্ষি দত্ত 

প্যারি কার্ডিনের কলমটা লেখা থেকে উঠিয়ে ঢাকনা বন্ধ করলেন সিরাজুল-দা। বললেন “আয়! বোস এখানে !”    

রাকেশ ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে চেয়ারে বসলো। টেবিলের উল্টোদিকে সিরাজুলদাকে দেখে ছোটখাট লাগছে–সেটা তাঁর নিজের উচ্চতার জন্যও হতে পারে। উনি বলা শুরু করলেন–“দ্যাখ,বেশি কথায় যাচ্ছি না। কাল থেকে সিচুয়েশনটা আটারলি গ্রেভ। শুকিয়াগড় জায়গাটা টার্বুলেন্ট না,আবার প্রায়ই কিছু না কিছু লেগে আছে। কিন্তু কালকের কেসটা খুব সেনসিটিভ। একটি ২২ বছরের মেয়েকে রেপ করে মার্ডার ! তারপর তো সবই জানিস। ঘেরাও,ভাঙচুর,রোড ব্লক…পুলিশ সবটা সামলাতে হিমশিম খেয়েছে। রুলিং পার্টির কেউ যেতে পারেনি–অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যালাও করেনি…মানে এখনো করছে না। এদিকে ঘটনার বারো ঘন্টা পার হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না!”  

মোবাইলটা বেজে উঠলো। সিরাজুলদা নম্বরটা দেখেই কেটে দিলেন। এবার একটু সামনে ঝুঁকে রাকেশের দিকে সোজাসুজি তাকালেন–“মূল কথাটা হচ্ছে আমাদের সিনিয়র লিডারদের কেউ যাচ্ছি না আপাতত। তুইও নতুন না–দুই তিন বছর হয়ে গেছে–অনেকেরই মুখ চেনা। এই সিচুয়েশনে কাউকে না কাউকে তো ফেস করতেই হবে। আমি ডিসট্রিক্ট কমিটিতে কথা বলে নিচ্ছি। তোর উপর আমার পুরো ভরসা আছে।”  

“এবার কয়েকটা কথা শোন।” সিরাজুলদা দ্বিতীয়বার ফোন কল কেটে দিলেন। “মিডিয়া থাকবে…বেশি কথায় যাবি না। অনেক লোক থাকবে ইরিটেট করার জন্য। মাথা ঠান্ডা রাখবি। সবার সামনে ঠিক দেড় দুই মিনিটের একটা স্পিচ–পয়েন্টগুলো এই কাগজে লেখা আছে। ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিস। ব্যস এইটুকু ! আগে পিছে কিচ্ছু বলবি না, খালি শুনবি…”

নেতাদের সময়ের কোন মা-বাপ নেই। নির্ধারিত থাকলেও যা কিছু তা সময়ের পরেই। রাকেশ তেমন কেউ হতে পারেনি বলেই হয়ত একটু আগেই পৌঁছাল নির্যাতিতার বাড়ির সামনে। সঙ্গে দলের কিছু লোকাল ছেলে। রাস্তার পাশে একখানি সাইকেল সারাইয়ের দোকান,যেটি মেয়েটির বাবার। দোকানের পাশে একটি মাটির গলি। বাঁ দিকে গোলাপি মুসাণ্ডা ফুলগাছের সারি রেখে গলিপথ ঢুকে গেছে বাড়ির দিকে।   

ডাকাডাকির পর মেয়েটির বাবা-মা দুজনেই বেরিয়ে এলেন। সব হারানোর শোক দুজনের চেহারাতে একরাতের মধ্যে এতটাই ছাপ ফেলেছে  তা দেখে রাকেশ বেশ ঝটকা খেল।

ঘটনায় নতুনত্ব কিছুই নেই। এদেশে এমনতর কতই না ঘটে ! মেয়েটি স্কুলে চাকরি করতো-পার্টটাইম। যাতায়াতের পথে তাকে রাস্তায় রোজ পিছু করত কিছু সারমেয় সন্তান। সেসব বাচ্চা-কুকুরদের ইশারায় সাড়া না দেওয়া হয়েছিল ভুল। উপদ্রবকে স্বাভাবিক মনে করাটা হয়েছিল বোধহয় আরও ভুল।  অবশ্য ভুল যদি মেয়েটির আদৌ থেকে থাকে ! 

কিন্তু নিখোঁজ মেয়েটিকে চিরুনি তল্লাশির পর গভীর রাতে,বেওয়ারিশ গম ভাঙ্গানোর মিল-এ অর্ধনগ্ন দেহে পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন রেখে,যন্ত্রণাক্লিষ্ট মরা মুখটিতে ভুল খুঁজে হয়রান হয়ে গেছে জন্মদাতা-দাত্রী। বারবার কাতর কণ্ঠে জানতে চেয়েছে উপস্থিত সবার কাছে। উত্তর মেলেনি–

রাকেশ ঘরেও ঢুকল। আলনায় কাপড়,ড্রেসিং টেবিলে চিরুনি,চুল বাঁধার গার্ডার,ক্লিপ,আয়নায় আটকানো কপালের টিপ আর লেখার টেবিলে চোদ্দ বাই দশের ফ্রেম–হাসিমুখের রঙিন ছবি। মেয়েটির দাদা নেই,কিন্তু রাকেশের বোন আছে…এইরকমই তো–আলাদা কিছু তো নয় !     

বাইরে হঠাৎ হট্টগোল। অনেক লোকে ভরে গেছে বাড়ির উঠোন। মিডিয়ার লোকজনও চলে এসেছে। রুলিং পার্টির একটি ছেলে ধর্ষণে যুক্ত। সে বিষয়ে চোখা প্রশ্নের ভান্ডার রেডি। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে বিরোধীরাও গুঁজে আছে। ঘর থেকে রাকেশ বেরিয়ে এল। তার সোয়া ছয় ফুট লম্বা শরীর,পরিধানে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি,গ্রিক দেবতার মত চেহারা,টকটকে রঙ দেখে জনতা হঠাৎ চুপ মেরে গেল। এই ছেলেটি কোন নেতা হতে পারেই না। তার চোখের দৃষ্টিতে যে সামুদ্রিক গভীরতা ও পবিত্রতা !     

সেই দৃষ্টির গভীরতার আকরে সামনের লোকজনকে মেপে দেখল রাকেশ। না–কারুর চোখে সেই জ্বলুনি কোথায়? এরা ক্ষণিক উত্তেজনার পূজারী-দপ করে জ্বলে উঠে খপ করে নিভে যাওয়া পাবলিক! কেচ্ছা বা রটনার বাইরের শাঁসটুকু নিয়ে দাপাদাপি করে–সোসাল মিডিয়ায় অঘোষিত বিপ্লব এনে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। তলিয়ে দেখবার পরিশ্রম,চিনে জোঁকের মত লেগে থাকা এসব কার আছে? দরকারই বা কি? নতুন খোরাকের জন্য শুধু মিডিয়া কেন,তুমি-আমি-সে সবাই শুধু প্রহর গুনি। উঠতে,বসতে খালি নিজের স্বার্থ ! ‘আমাকে দেখুন’-এর নিরলস প্রতিযোগিতা ! রাকেশ জানে এসব–খুব ভাল করেই জানে। এমন জনগণ হচ্ছে সম্পদ ! যথেচ্ছচারের,অরাজকতার বাতাবরণ সৃষ্টির।     

এবার স্পিচটা বলার পালা। তার আগে নীরবতা পালনের কথা বলতে হয়। রাকেশ মনে মনে হাসল। চারদিকের এত অত্যাচার অবিচার দেখতে-শুনতে আর সইতে সইতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে,বধির হয়ে গেছে। এদেরকে বলবে “সাইলেন্স” ! হাস্যকর ! উপরে যাই বাতেলা মারুক,চিৎকারে গগন ফাটাক,অধিকাংশের ভেতরেই বাস করে শামুক বা কেঁচো।

“বন্ধুগণ !!” বোমা ফাটার মত আওয়াজ বের হল রাকেশের গলা দিয়ে। “একটাই কথা–ধর্ষণকারী দের পরিচয়,ধর্ম,পার্টি কিচ্ছু  হয় না–এরা এক-একজন ক্রিমিনাল ! এটাই শেষ কথা ! আসুন ! এর শেষ না দেখে আমরা কেউ থামবো না–”
****************************
রাজর্ষি দত্ত

রাজর্ষি দত্ত পরিচিতি:
শিলিগুড়িতে জন্ম ও উত্তরবঙ্গের আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন চা-শিল্পের সাথে যুক্ত। পরিবেশ ও মানুষের প্রতি টান তার লেখার প্রেরণা। ভালবাসেন বই পড়তে,গান শুনতে,খেলাধূলা আর প্রকৃতির সান্নিধ্য।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!