Shadow

পপামাসির গোয়েন্দাগিরি : সোনা চালান আর মুখের মিলে বিপদ – প্র ত্যু ষ   সে ন গু প্ত

PC depositphotos

পপামাসির গোয়েন্দাগিরি : সোনা চালান আর মুখের মিলে বিপদ

প্র ত্যু   সে গু প্ত

 

।। এক।।

  পান্ডুরঙ্গপূরমের ভেনাস অ্যাপার্টমেন্টের ১৪ তলার মিসেস ফার্নান্ডেজ প্রতিদিন ভোরে তাঁর রটহুইলার টি কে নিয়ে হাঁটতে বের হন। নিজেরও তাতে একটু হাঁটাহাঁটি হয়। ওঁর ফ্ল্যাট থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে  রামকৃষ্ণ বীচ। সমুদ্রতটের শহর বিশাখাপত্তনমের সমুদ্রতীর বরাবর অগুন্তি বীচ রয়েছে। রামকৃষ্ণ বীচ বা সংক্ষেপে আর ,কে বীচ এর মধ্যে জনপ্রিয়তম। এই দীর্ঘ সমুদ্র তট টি পরিচ্ছন্ন এবং বেশ ছড়ানো ছিটোনো। এর অবস্থান মূল শহরের গা ঘেঁষে হওয়ায় এটি দারুন জনপ্রিয় এবং জনবহুল। রাস্তা বরাবর দীর্ঘ লোহার রেলিং সমুদ্রতটকে আলাদা করে রেখেছে। একটু উঁচু  ফুটপাথ। রেলিংয়ের মাঝে মাঝে গেট। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বালুকাবেলা। একশো পা হাঁটলে তবে সমুদ্র। সারাবছর টুরিস্টদের ভি লেগে থাকে এখানে । এখানে দ্রষ্টব্য স্থানও অনেক। একটা সাবমেরিন রাখা আছে। আইএনএস কুরুসুরা | এটি সাবমেরিন মিউজিয়াম এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম । টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। উল্টো দিকে,রাস্তার অপর পাড়ে রামকৃষ্ণ মিশন, কালিবাড়ি । সেই সকাল থেকে ভি শুরু হয় এই সমুদ্র তটটিতে। ভি,ধাক্কাধাক্কি  মিসেস ফার্নান্ডেজের আবার একদম না পসন্দ্। তাই নিজের ডার্কএডিশন হুন্ডাই আলকারেজ  নিজেই ড্রাইভ করে ডঃ এন টি আর বীচ রোড ধরে রোজই কৈলাশ গিরির দিকে চলে  যান। পথি মধ্যে ছোট ছোট বীচ আছে অনেক। রূষিকোন্ডা (Rushikonda) বীচের আগে এগুলোর কোনও একটায় দাঁড়ান।গাছগাছালিময় রাস্তার ধারে সুবিধা মতন গাড়ি পার্ক করে নীচে নেমে যান রেমো কে নিয়ে। আজও তাই করেছিলেন। রেমো মনের সুখে বালুতটে হুটোপুটি করছিলো। উনি শক্ত জমির উপর হাঁটাহাঁটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এটি অনামী এক বীচ। এখানে সমুদ্র বেশ অশান্ত। তাই লোকজন কম,একটু নির্জন।ওঁর পাশে দু পাঁচ জন জগারও জগিংয়ে ব্যস্ত। মধ্যপ্রদেশের অবাঞ্ছিত বিস্তার রোধের চেষ্টা তাঁদের। বীচের উপর রাস্তার পাশে একটা কফিশপ্। উনি রোজকার মতন হাঁটা এবং হাঁটানো শেষে আরাম করে কফিতে চুমুক দেবেন। ততক্ষণ ট্রেনিং পাওয়া রেমো ওঁর পায়ের কাছে বসে নিরীহ  ভাবে ডগবিস্কিট চিবোবে। এর পর পান্ডুরঙ্গপূরমের ফ্ল্যাটে ফিরে স্নান। আজ এপর্যন্ত সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। তাল কাটলো রেমোর একটু বেশী লাফালাফিতে। ট্রেনিং পাওয়া এই বছর দেড়েকের রটহুইলারটির ব্যক্তিত্ব বেশ প্রবল এবং গোমড়ামুুখো। মিশুকে তো নয়ই। আজ রেমোর লাফ ঝাঁপের মধ্যে মিসেস ফার্নান্ডেজ সোজা তাকালেন! রেমোর মুখে ওটা কি?

দুই |

  জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলো মুনমুন।কেমন একটা ইউ টার্ন নিয়েছে উপকূলরেখা টা, জলের সঙ্গে  যেন লুকোচুরি খেলছে। ভূমিভাগের উল্টো দিকে বিস্তৃত জলরাশি। রোদ্দুর পড়ে  জরির মতন চিকচিক করছে একটু সবুজ মেশানো নীল সমুদ্রের জল। সোজা তাকালে বহুবিস্তৃত জলরাশি।আর ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের দল। মনেমনে ভারতের মানচিত্র টা কল্পনা করলো মুন। জলটা  বে অফ বেঙ্গলের আর জমিটা অন্ধ্রপ্রদেশের। বিমানটা ফের জলের দিকে সরে এলো। কিছু না দেখেই পপামাসী বললো,তাকিয়ে থাক। এবার ফের সাগরের উপর দিয়েই উড়বে মিনিট খানেক। ডানদিকে,একটু তফাতেজমি,রাস্তা লক্ষ্য করেছিস? ওটা রামকৃষ্ণ সমুদ্রতট। এয়ারপোর্টের কাছে এসে গেছি। প্লেনটা যেন একটু ডানদিকে কাৎ হলো। ঠিক তখনি.. “ল্যান্ডিং প্রোসেস হ্যাজ বিন স্টার্টেড্, অল আর রিকোয়েস্টেড টু ফাসন্ দেয়ার সীটবেল্টস. .. ” জাতীয় ঘোষণা হলো বিমানে। ধীরে ধীরে মাটির কাছাকাছি নেমে আসছিলো আমাদের আকাশযান!একটা সামান্য ঝাঁকি। মুন বুঝতে পারলো প্লেনের চাকা রানওয়ে ছুঁয়েছে। ফাঁকা জায়গায় বেশ ছোট এয়ারপোর্ট। দূরে হাল্কা নীল পাহাড়ের আউটলাইন।

   পপা মাসীর এই প্রথম ভাইজ্যাগ সফর হতে চলেছে।একটা অত্যন্ত জরুরী অ্যাসাইনমেন্টে  দিল্লির নির্দেশে পপামাসীর এখানে আসা।পর্যটকের ছদ্মবেশে কাজ করতে হবে। তাই যাত্রায় মুন রয়েছে সঙ্গে। গত পাঁচদিন ধরে বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে পপামাসী ভাইজ্যাগের নাড়িনক্ষত্র পড়ে ফেলেছে। লাউঞ্জ থেকে বেরোতেই দেখি সাদা কাগজের উপর ছাপার অক্ষরে  ইংরেজিতে লেখা“Welcome to POPA at Vishakhapattanam” ফেস্টুন নিয়ে মাসির বয়সী একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। মাসি বললো, নীলা, ওঁর ছোটবেলার বন্ধু। ট্রলিটা রেখে মাসি দৌড়ে গিয়ে ওঁকে জড়িয়ে ধরলো । আমি এগিয়ে গিয়ে একটু অবাক হলাম।আমার দুহাতে দুটো ট্রলি ব্যাগ।একটা মাসির। নীলা মাসি আমার থুতনী ধরে আদর করলেন। অবাক হয়ে দেখলাম,নীলা মাসির চোখদুটো যেন অবিকল পপামাসীর চোখ। মাথায় সেই লম্বা ঘন চুল। সেই হাইট,পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি।গালে সেই টোল।গলার স্বরও প্রায় একরকম! যেন আইডেন্টিক্যাল টুইন! শুধু ডান গালের ছোট্ট আঁচিলটাই নেই!

তিন |

  এয়ারপোর্ট থানাটি যেন ছোটখাটো একটা একতলা বাড়ি। গাছগাছালি ঘেরা বাড়িটার রঙ খুব হাল্কা গোলাপি। তার সঙ্গে মেরুন বর্ডার। সামনে পরিষ্কার ঝকঝকে পিচ ঢালা পথ। জায়গাটার নাম মাধবধারা।অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়ানো। কয়েকটিতে লালবাতি । মাসিকে দেওয়া হয়েছে ঝাঁ চকচকে একটা টয়োটা ফরচুনার। বেশ বড়োসড়ো ষ্টীল কালারের এস ইউভি।এয়ার পোর্টের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো পুলিশ।ওখান থেকেই সোজা থানায়। ডিআইজি ক্রাইম অপেক্ষায় ছিলেন। কর্পোরেট অফিসের মতন ভিতরটা। নীলা মাসিও এসেছে। ওঁর ফ্ল্যাটটিও কাছেই।  কৈলাশগিরির নীচে বঙ্গোপসাগর। এমন পাহাড়  সমুদ্রের মাখামাখি ভারতের আর কোথাও আছে কিনা জানিনা। সরকার থেকে মাসিকে এখানে একটা বড়ো রিসর্টের মতন বাড়ি দেওয়া হয়েছে। কৈলাশগিরি পর্বতের পায়ে এসে মিশেছে সমুদ্র I পাহাড়ের উল্টোদিকে সমুদ্রঘেঁষা এই রিসর্ট।আশেপাশে আরও অনেক গুলো এমন রিসর্ট বাড়ি।মূল রাস্তা থেকে একটু ঢালু জমিতে এই বাড়িগুলো।গোটা সমুদ্রতট আর রিসর্টগুলো পর্যটকে ঠাসাঠাসি। আমাদের রিসর্টটাও এর ব্যতিক্রম নয়।অনেক মহিলা পুরুষ পর্যটকে ভর্তি। পরে জেনেছিলাম ওগুলো সাদা পোষাকের পুলিশ। সংখ্যায় এত কেন? ওদের কাজ মাসীকে গার্ড করা অপারেশনে অংশ নেওয়া। এরা সব মাসির অধীনে কাজ করবে। কিন্ত দেখে বোঝার উপায় নেই। ছেলেরা বারমুডা আর সানগ্লাস, মেয়েরা সাঁতারের পোষাক পরে সমুদ্রে যাচ্ছে পর্যটকদের মতন। আমরা গার্ডেন আমব্রেলার তলায় লসসী খাচ্ছিলাম। এক ওয়েটার এসে আমাদের টেবিলে এক প্লেট স্ন্যাক্স রেখে গেলো।উপরে ছোট্ট একটা খাম । মাসি দেখে নিয়ে বললো, চল এখনি রূষিকোন্ডা থানায় যেতে হবে।

   রূষিকোন্ডা থানাটা অনেকটা গাছপালার ছায়া ঘেরা সাদা একতলা বনবাঙলোর মতন। আমরা এন টি আর বীচ রোড ধরে একটু এগিয়ে ওয়াল্টেয়ার রোড ধরলাম। তারপর ডানদিকে রূষিকোন্ডা রোড ধরে একটি আঁকাবাঁকা উঁচু পাহাড়ি পথে একটু এগোলেই থানা। আধঘণ্টার মতন লাগলো। তবে পথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। থানা বাংলোর সামনে পিচ মোড়া অনেকটা ফাঁকা জায়গা। কিছু মোটরবাইক, লালবাতি পুলিশ লেখা গাড়ির মধ্যে কুচকুচে কালো এসইউভিটা একদম বেমানান।

চার |

  মিসেস ফার্ণান্ডেজ বেজ কালারের সোফায় গা এলিয়ে বসেছিলেন।সামনে কফির মাগ। প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স। থানার আই সি মাসির সঙ্গে পরিচয় করে দিলে মিসেস ফার্নান্ডেজ দুহাত জোড় করে মাসিকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার স্পষ্ট উচ্চারণে বললেননমস্কার“!

আপনি কি বাংলা বলতে পারেন?

আরে, আমি তো বেথুন কলেজে ইংরেজি পড়িয়েছি বারো বছর!বেঙ্গলী গার্লসরা খুব সুইট হয়। আপনার পাশের জনের মতন।

একেবারে সামনে সরাসরি এই প্রশংসায় মাসি যেন একটু হলেও অপ্রস্তুত! মুখটা একটু লাল হলেও সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিলো। খোশমেজাজে থাকা মিসেস রোজি (রোজালিন) ফার্ণান্ডেজ (পরে নামটা জেনেছিলাম) মাসিকে বললেন, রোজকার মতন খুব সকালে রেমো,মানে আমার পেট ডগ রেমোকে নিয়ে হাঁটার উদ্দেশ্যে আমার এস ইউ ভিতে বেরিয়েছিলাম। আমিই ড্রাইভ করছিলাম এন টি আর বীচ রোড ধরে রূষিকোন্ডা বীচের দিকে। রোজ ওদিকটাতেই যাই। সময়  ট্রাফিক কম থাকে। লুম্বিনী পার্কের কাছে সমুদ্রতটে নেমেছিলাম রাস্তার পাশে গাড়িটা পার্ক করে।

তারপর?

হাঁটাচলা করে ওই বীচে একটা ছোট্ট কফিশপ আছে, সেখানে কফি নিয়ে বসেছি। এবারে বীচে লাফ ঝাঁপের পর রেমো পায়ের কাছে বসে ডগবিস্কুট খাবে। দেখি দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে সমুদ্রের দিক থেকে। মুখে একটা কিছু।

আই সি চিদাম্বরম আলমারি থেকে কাগজে মোড়া কিছু একটা মাসির হাতে দিয়ে বললেন  মিসেস ফার্ণান্ডেজের পেট ডগ এটাই ওর মালকিনের হাতে  দিয়েছিল। মিসেস ফার্ণান্ডেজ কথাটা মেনে ঘাড় নাড়লেন |

  একটা দুইঞ্চির মতন লম্বা চকচকে ধাতব টুকরো।চওড়ায় বড়জোর ইঞ্চিখানেক। গায়ে খোদাই করে ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে চীনা বা জাপানী ভাষায় কিছু লেখা। তবে মাঝখানে ইংরেজিতে বড়করে 200 লেখা। ঠিক নীচে আবার একটা সংখ্যা লেখা,24 হাতে নিয়ে বেশ ভারী লাগলো।পপা মাসী বললো, নে,দেখে নে।এটা দুশো গ্রাম সোনার বাট। চব্বিশ ক্যারেটের। এই সোনার চোরাচালান দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দিচ্ছে। একে রুখতেই হবে।ফিসফিসিয়ে মাসি  আমাকে একথা বলার সময় দেখলাম ওর চোখ দুটো জ্বলছে।


।।পাঁচ।।

  আজকের সকালটা খুব সুন্দর। হাল্কা হাওয়ার সঙ্গে একটু শীত শীত।ঝকঝকে সূর্যের আলো।দুর্গাপুজোর ঠিক আগে যেমন হয়। কিন্ত এটা তো এপ্রিল

  সক্কাল সক্কাল মাসি স্নান সেরে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো। আজ কেন যেন শাড়ি পরে এসেছে।খোলা চুলে বিন্দু বিন্দু জল।সামান্য প্রসাধন,ছোট্ট একটা টিপে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।

হাঁ করে দেখছিস কি?

  –ভাবছি রোজি আন্টির কথা।ঠিকই বলেছিলেন।একদম ঠিক।

কি ঠিকঠিক করছিস?খুলে বল না?

রোজি আন্টি বলেছিলো না?তোমাকে তার থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছে।

পাকামো হচ্ছে ? মাসি কপট রাগ দেখালো।

আজ দুপুরে লাঞ্চ একটা নামী হোটেলে।এরপর মাসির একটা মিটিং,পুলিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে।বলতে ভুলে গেছি,মাসি বিশাখাপত্তনমে এসেছে একটা বিরাট এবং আন্তর্জাতিক অপরাধের তদন্ত করতে।আমাকে মাসি ডিটেইলস কিছু বলেনি।তবে সমুদ্র বিষয়ক কিছু ব্যাপার,সেটা মনে হচ্ছে। মাসি ব্যাকটিরিয়া ফাঙ্গাস নিয়ে জীববিজ্ঞানে ডক্টরেট। বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে যায়।বিজ্ঞান পত্রিকায়  ওর প্রবন্ধ ছাপা হয়।এ নিয়ে অনেক অপরাধের সুরাহাও করেছে।মাছি এবং পিঁপড়ের জীবনচক্রের সাহায্যে দু দুটি হত্যাকান্ডের সমাধান করে মাসী সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিলো।রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছে।তবে এসবের ফাঁকে মাসির গান টা একদম বন্ধ হয়ে গেছে।এজন্য আমার আফসোসের অন্ত নেই।

।। ছয়।।

  গাড়িটা পাক দিয়ে উপরে,আরও উপরে উঠছিল।পাহাড়ের বুক কেটে রাস্তা তৈরি।যেমন হয়।তবে ততটা খাড়া নয় আর বেশ চওড়া।পাশাপাশি তিনটে গাড়ি চলতে পারে।বাঁদিকে নীচে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।বঙ্গোপসাগরের নীল জল সাদা ফেনা হয়ে  যেন পাহাড়ের পা ধুইয়ে দিচ্ছে।চার পাঁচ পাকে পৌঁছে গেলাম শীর্ষে।অনেকটা সমতল জায়গা।সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তিনশো ষাট ফুট উঁচু থেকে সাগরের ঢেউ পরিস্কার চোখে পড়ে।প্রচুর হাওয়া।এখানে ছোট্ট ছোট্ট খেলনা ট্রেন রয়েছে।গোটা এলাকায় পাক মারা যায়।বসে পড়ে আমরাও ঘুরে এলাম।একটা বিশাল শিবমূর্তি রয়েছে এখানে।আর আছে বড় একটা পার্ক।বেশ কিছু দোকানপাট।খাবারের,পোষাকের,মেমেন্টোর। সর্বত্রই ভিড়।কেবলকার লাইন নেমে গেছে নীচে।আমাদের ওঠা হয়নি ওতে, সময়ের অভাবে।লাঞ্চ করে মাসি মিটিংয়ে যাবে পুলিশ শীর্ষ স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে।আমি হোটেলে ফিরে বিশ্রাম করব।

রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ মাসি হোটেলে ফিরলো ।

  অন্ধ্রপ্রদেশের পুব উপকূলে বঙ্গোপসাগরের তীর বরাবর এক সুন্দর শহর হলো বিশাখাপত্তনম।আগে এর নাম ছিলো ওয়াল্টেয়ার। ।সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিটার উঁচুতে এই জনপদটি প্রায় ছয়শো বিরাশি বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত।২০২০ সালের জনগণনা অনুযায়ী লোকসংখ্যা একুশ লাখের কাছাকাছি।অত্যন্ত শিক্ষিত এই এলাকায় শিক্ষার হার বিরাশি শতাংশ।তেলুগু,ইরেজি,ওড়িয়া,হিন্দি এবং তামিল এখানকার মূল ভাষা।তবে বাঙলাভাষী মানুষও আছেন।আছেন শিক্ষিত,সুন্দর, সাংস্কৃতিক মনের বহু বাঙালি ।যাঁরা বাংলাভাষা,বাংলা সংস্কৃতির উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ।যেমন নীলামাসি,যেমন রোজি আন্টি!রামকৃষ্ণ মিশন কালিবাড়িতে পুজোর দিনগুলোতে,নববর্ষের দিন,পঁচিশে বৈশাখ,বিজয়া সম্মিলনীতে নিয়মকরে মাসিরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

।।সাত।।

   বড় একটা টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কিছু জিনিসপত্র,যন্ত্রপাতি।একটা হেলমেটের মতন জিনিস,একজোড়া ছোট সিলিন্ডার,পায়ে পরার হলদে রঙা হাঁসের পায়ের মতন একজোড়া,চাকা লাগানো যন্ত্র আরো অনেক কিছু।এগুলো যে সাঁতার দেবার যন্ত্র তা বুঝতে পারলাম।কিন্ত সাঁতার কেন?আর শুধুমাত্র একটা সেট কেন? আমারটা কইদূর থেকে মাসি আমাকে লক্ষ্য করছিলো। কাছে এসে বললো এটা নাকি এক অত্যন্ত গোপনীয় অপারেশন।আমি থাকতে পারবোনা।এমনটা আগেও হয়েছে। তাই আমার মনে করারও কিছু নেই । মাসি  ডিটেইলস বলে দেবে।দেখে যেটুকু মনে হলো সাঁতারের পোষাক।মাসি কোথায় সাঁতরাবে?একটা ছাইরঙা এসইউভি ঢুকলো গেটদিয়ে।পাঁচ জন মহিলা নেমে এসে সোজা মাসির টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।ইন্ডিয়ান নেভির ইউনিফর্ম পরা এক অফিসার কোথা থেকে এসে মাসিকে স্যালুট করলো।হাত দিয়ে কাউকে ইশারা করতে বড় একটা ট্রলিতে আরও কিছু যন্ত্রপাতি এলো।জোড়া অক্সিজেন  সিলিন্ডার আর পায়ে লাগানোর জিনিসটা চিনতে পারলাম।সঙ্গে মুখঢাকা হেলমেটটাও!

  সারা দুপুর, লাঞ্চের পর মাসি ব্যস্ত রইলো ওদের লোকদের সঙ্গে মিটিংয়ে।ঠিক পাঁচটায় চা পর্বের পর শেষ হলো।মাসি এসে বললো,এবার একটু ঘুমিয়ে নেবে।রাতে কাজ আছে!আমারও ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো।এসির ঠান্ডায় পাতলা চাদর গায়ে নরম বিছানার আরামে কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।মিষ্টি ডোরবেলের আওয়াজে যখন ঘুম ভাঙলো তখন কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটা।ডিনার সেরে মাসি বেরিয়ে গেল রাত বারোটা নাগাদ।

।। আট।।

  বাঁ হাত ছুঁয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেছে।রক্তপাতও হয়নি, ছড়ে গেছে মাত্র।তবে মাসির গুলিতে একটা দুস্কৃতি মারা গেছে।দুটো আহত!প্রথম অপারেশনে প্রায় সাড়ে চার টন সোনা উদ্ধার হয়েছে।পপামাসির কথায়,রাত দুটো নাগাদ ইয়ারাডা সমুদ্র তটে আগে থেকেই খবর ছিলো সোনাপাচার কারীরা তৎপর। এই বীচটা ভাইজ্যাগ শহর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে।পাহাড় আর সমুদ্র এখানেও হাত ধরাধরি করে আছে।বিস্তৃত তটরেখা প্রচুর  নারকেল গাছ আর কলাগাছে দিয়ে ঘেরা।জায়গাটা খুব পরিস্কার। তবে এখানে সমুদ্র বেশ অশান্ত আর গভীর। তীর বরাবর আধ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র ৩০৭০ মিটার গভীর।তার পরের পাঁচ কিলোমিটার ৭০৩০০ মিটার।এর পর মূল সমুদ্র, যাকে অফশোর বলে সেখানে ৩০০৬০০ মিটার গভীর। সাধারণ পর্যটকদের এখানে সমুদ্রেই নামতে মানা | আর এই সুযোগটা বেছে নিয়েছিলো ব্যাঙ্কক, মায়ানমার,চীনের কিছু আন্তর্জাতিক সোনা পাচারকারীরা।কিছু কার্গো জাহাজ রূষিকোন্ডা বীচের কাছে সার্ভিসিং করতে আসে।ফেরার পথে কিছু জিনিস নিয়ে ফেরে।ইয়ারাডা কোস্ট এপথেই পড়ে।এখানেই হাতবদল হয় পাচারের সোনা।কিন্ত কী ভাবে? মাসির কথায় কাজে অতি উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়।বিভিন্ন ধাতু ব্যবহার হয় জাহাজ তৈরি তে।শুধু লোহা বা ইস্পাত নয়।জাহাজের ডুবে থাকা দুপাশের অংশের গায়ে বিশেষ ধরনের প্যাকেটে টন টন সোনা ভরে তা উন্নত মানের অ্যাঢেসিভ দিয়ে আটকে দেওয়া হতো।এখানে আইসোসায়ানেট বেসড পলিইউরিথেন আঠা ব্যবহার হয়েছে।এই প্যাকেটকে জিপিএস ট্র্যাক করার প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা হতো।কন্ট্রোলে বসে ওরা প্রতি মুহূর্তে বাক্সটির অবস্থান জানতে জিপিএস প্রযুক্তি সাহায্য নিতো।তবে এখনও জানা যায়নি আর কত জন এবং কোথায় কোথায় এই প্রথম কাজে জড়িত আছে।তবে খোঁজ চলছে।পপামাসী এই দক্ষিণ জোনের কর্ত্রী। মাসির সংবাদ সূত্র ধরে আজ দুপুরে এক চীনা জাহাজ থেকে দুটি প্যাকেটে প্রায় চার টন সোনা উদ্ধার হয়েছে!সমস্ত টিভি চ্যানেল গুলোয় আজ সকাল থেকেই এই খবর দেখাচ্ছে।এর মধ্যে সকাল থেকেই মাসি বেপাত্তা। হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে লিখেছেব্যস্ত আছি।রাত হবে।খেয়ে নিস।মাসীর মুখের একটা ছবি সব টিভি চ্যানেলে।ওই একটাই।মনে পড়ে,গতবছর পুরীর সমুদ্র তীরে আমি তুলেছিলাম ব্যাকগ্রাউন্ডটা ব্লার করে।আর এই ছবিই যে মারাত্মক বিপদের কারন হবে, সে কথা কে জানতো?

।।নয়।।

   সদ্য কেনা অলিভ ব্রাউন রঙের অডি কিউ সেভেন গাড়ি টা নিয়ে আর কে পূরম থেকে ভাইজ্যাগশ্রীকাকুলাম রোড ধরে মাধবকে পূরম রোড থেকে মাধবধারা I গুগল দেখাচ্ছে একশো মাধবধারায় ওর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরছিলো নীলা।মসৃণ রাস্তায় নতুন অডি চলছিলো নিঃশব্দে। এখান থেকে মাঝারি গতিতে ওর বাড়ি পৌঁছাতে লাগবে ঘন্টা দুয়েক।গাড়ির ড্যাশবোর্ডটা যেন বিমানের ড্যাশবোর্ড।প্রায় দুহাত লম্বা টাচস্ক্রীন! সিস্টেম গুলো চেক করতে করতে চলছিলো। অটোমেটিক মডেলটা নেয়নি।ম্যানুয়াল নিয়েছে।অটোমেটিক চালিয়ে কোনও থ্রিল নেই।আর অটোমেটিক থেকে ম্যানুয়ালের দামটাও বেশ কম।এয়ার কন্ডিশনারটা বেশ অভিনব।অনেকগুলো অপশনস্।আর  চল্লিশ কিলোমিটার। রাস্তাটা দারুণ। নীলা আশি কিলোমিটার স্পীড তুলে দিলো।এই রাস্তায় ততটা ট্রাফিক নেই।গাড়ি নিঃশব্দে এগোতে লাগলো।

ভাইজ্যাগশ্রীকাকুলাম সড়ক ধরে চলতে চলতে নীলা ভাবলো তেল ভরতে হবে।ফুল ট্যাঙ্ক।সত্যম মোড় একটা অর্ধেক ফুটবল মাঠের মতন বড় ছোটবড় আটটা রাস্তার সংযোগ স্থল।একপাশে তেলের পাম্প দেখে তেল ভরার জন্য দাঁড়ালো।সামনে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি। কোনও ভিআইপি এসেছে। ওর গাড়ির পাশে একটা হলুদ রঙের বাইকে তেল ভরতে ব্যস্ত দুটি ছেলে।পিছনে বসাটি হাঁ করে তাকিয়ে থাকায় নীলার অস্বস্তি হচ্ছিলো।কাজ হলে গাড়ি টা নিয়ে ভাইজ্যাগশ্রীকাকুলাম এক্সপ্রেস ওয়ে ধরলো।এবার রাস্তায় প্রচুর গাড়ি।লুকিংগ্লাসে দেখলো ওই হলুদ বাইকটা ওর পিছন পিছন আসছে!নীলা অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়ালো।কিছু বাদে আর বাইকটা খুঁজে পেলোনা।এর মধ্যে সোওয়া একঘন্টা কেটে গেছে।বাড়ির কাছাকাছি এসে ডান দিকে বিশাল শপিং মলের দিকে গাড়ি ঘোরালো নীলা।গেটে টাইম কার্ড নিয়ে সোজা গ্যারেজ মুখে।রাস্তাটা সাপের মতন এঁকেবেঁকে দশতলায় উঠে পেলো। পার্কিংলটে গাড়ি রেখে ইগনিশন বন্ধ করলো।তারপর ডোর লক করে চাবি নিয়ে গাড়ির থেকে নামলো। কী তে চাপ দিয়ে দেখলো দরজায় আলো জ্বলে উঠছে।এবার সোজা মলে প্রবেশের গেট।

।।দশ।।

   পপা আসবে আগামী কাল।এত ব্যস্ত যে ওঁকে পাওয়াই যায়না।কাল বলেছে সময় দেবে।নীলা ভাবলো কাল গান,আড্ডা পুরো চলবে।নীলার মিষ্টি খুব পছন্দ আর তা যদি রসালো হয়!এখানে কলকাতার মতন রসগোল্লা পাওয়া যায়না।নীলা নিলো এক বাটি পায়সম্,গোটা কুড়ি ক্ষীরের পুরভরা কোঝুক্কাট্টাই,এটা সাদা লাড্ডুর মতন,ঠিক ভাবে বললে বড়সর কাঁচাগোল্লা, কলাপাতায় মোড়া পাটিসাপটার  মতন পুতারেকুল্লু,এটা ভাইজ্যাগে খুব চলে আর কেজি দেড়েক  ইল্লাআঢ়া। এটা পপার ভালো লাগবে।আর নিলো মাইসোর পাক হলদে রসসিক্ত সন্দেশ।মটন, ভেটকি নিলো।

রান্নার মেয়ে সাবিত্রী খুব এনার্জেটিক।কাল সকাল থেকেই দুজনে লাগবে।পপা আসতে আসতে বেলা বারোটা।তার আগেই রান্নাটা সেরে ফেলবে।এর আগে পপার জন্যএকটা খুব হাল্কা ম্যাজেন্টা রঙের সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কের শাড়ি,দুর্দান্ত কাজ করা।আঁচলটার তো কথাই নেই।পপা এতো সুন্দর দেখতে কিন্তু সাজগোজ করেনা একদম।মুনের জন্যও সালোয়ার কামিজ সেট। গুচ্চি ব্লুম আর ডিওর্জ অ্যাডোর ফ্রেঞ্চ পারফিউম নিলো দুজনের জন্য। প্যাক দুটো প্রাণপণে আঙুল দিয়ে চেপে দেখলো কাঁচের নয়।কাঁচ হলেই নকল!নিজের জন্য নিলো মার্কজেকব ডেইজি।পপা বেশ বড়োসরো টিপ পরে আর ডিপ কালারের লিপস্টিক। ওকে কিন্ত ছোট টিপ আর হালকা লাল অথবা ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিকে বেশী ভালো লাগে।এগুলো নিলো পপার জন্য।

এত সব কিনতে ঘন্টা দেড়েক লেগে গেলো।এখন সবে সন্ধ্যা সাতটা।মিনিক দশেক লাগবে বাড়ি ফিরতে।পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করতে গিয়ে দূরে পার্ক করা হলুদ বাইকটা চোখ এড়ালো না নীলার।মনে যেন কু ডাক ডেকে উঠলো!

।।এগারো।।

  ভাইজ্যাগকলকাতা হাইওয়েতে উঠতেই বাঁদিক দিয়ে হলুদ বাইকটা ওকে ওভারটেক করলো।নীলা স্পিড বাড়ালো।স্পিডোমিটারের কাঁটা একশো ছুঁই ছুঁই! ঠিক হাত দশেক দূর থেকে পিছনে বসা ছেলেটি পিস্তল তাক করে গুলি চালালো নীলার দিকে। ।নিশানা ঠিক হলোনা। আবার তাক করতেই নীলার কি যেন হয়ে গেল।সিনেমায় যেমন দেখায়,  তেমনি গতি বাড়িয়ে গাড়িটা বাঁদিকে নিয়ে  বাইক টাকে একটু চেপে দিল।চোখেরসামনে তীব্র গতিতে বাইটা প্রথমে ল্যাম্পপোস্ট পরে ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেলো অনেকটা ।নীলা চোখ বুজে পুলিশ স্টেশন।

পপা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো

ভয় না পেয়ে তুই যা করেছিস তা সাংঘাতিক। যাক তোর বা তোর গাড়ির কোনও ক্ষতি হয়নি।

আইজিপি ক্রাইম নীলা কে অনেক ধন্যবাদ দিলেন।নীলার জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলো।নীলার বাড়ির সামনে পাহারা থাকবে চব্বিশ ঘন্টা |তিনি সহাস্যে বললেন,আরে,এতো ডিআইজি ম্যাডাম মিস পমপম বিশ্বাসের কার্বন কপি!সরি,এটা মিস বিশ্বাসের  আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো।শুধু মাত্র চেহারার মিল থাকায় ম্যাডাম নীলা সরকারকে বিপদের মুখে পড়তে হলো।যাইহোক ওঁর কিছু হয়নি।তবে ওঁকে কয়েকদিন সাবধানে থাকতে হবে!

।।শেষ।।
***************************
প্রত্যুষ সেনগুপ্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!