
পাপের প্রায়শ্চিত্ত
রেশমি দত্ত
আজ ষষ্ঠী ,এবার দুর্গা পুজোয় অন্বেষা ঠিক করেছে প্রতিদিন বয়ফ্রেন্ড এর সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোবে। কোন্ দিন কি পোশাক পরবে,তার সঙ্গে ম্যাচিং করে সাজার জিনিস,জুতো সব রেডি করে রেখেছে সে।পঞ্চমী হয়ে কলেজ ছুটি পড়ে গেছে,ষষ্ঠী থেকেই তাহলে ঠাকুর দেখা শুরু হবে । অন্বেষার বয়ফ্রেন্ড ছেলেটি ওর সহপাঠী,একই সঙ্গে ইউনিভার্সিটি তে পড়ে ওরা। ষষ্ঠীর দিন ঠিক বিকেল ৫ টায় দেখা করবে ওরা,গড়িয়াহাটের মোড়ে।জোসেফ দাঁড়িয়ে সেই পৌনে পাঁচটা থেকে কিন্তু অন্বেষার পাত্তা নেই।জোসেফ হলো অন্বেষার বয়ফ্রেন্ড।ওরা বহু বছর ধরে কলকাতায় আছে,তা প্রায় জোসেফের দাদুর আমল থেকে।জোসেফের পুরো নাম অপূর্ব জোসেফ জন,মা বাঙালি,বাবা খৃস্টান তাই তার এমন নাম। এদিকে ষষ্ঠীর দিনের ঘড়িটায় প্রায় সাড়ে পাঁচটা,কিন্তু অন্বেষার কি হলো!এখনো এলোনা,জোসেফ অনেকবার ফোন করেছে,টেক্সট করেছে,কিন্তু তার ফোন সুইচড অফ বলছে,ভীষণ রাগ হচ্ছে জোসেফের,এতো ইররেসপনসিবল অন্বেষা কবে থেকে হলো? মনে মনে ঠিক করলো আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ি চলে যাবে সে।ঠিক তখনই পেছন থেকে এসে কে যেন জোসেফের চোখ চেপে ধরলো,কানের কাছে দ্রুত নিঃশ্বাস পড়া বুঝতে পেরে জোসেফ বুঝতে পারলো এটা অন্বেষা ছাড়া কেউনা ,চোখ থেকে হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’ এতো হাঁপাচ্ছিস কেন ?এতো দেরি করলি যে?’
অন্বেষা: ‘ আরে শোন ! সব প্ল্যান বাবা ভেস্তে দিয়েছিল,আজ সকালে সকলকে বলে দিলো,”পুজোর এই চারটে দিন বাড়ির পুজো ছেড়ে কেউ বাইরে পা দেবেনা |’ ব্যাস্! হয়ে গেলো আমার বেরোনো । মন খারাপ করে বসে ছিলাম,তাইতো ফোন টাকেও সুইচড্ অফ করে রেখেছিলাম |”
জোসেফ-“ তারপর! আসতে পারলি কি করে তুই?”
অন্বেষা -“ আমার দুর্গা মায়ের কৃপায়।”
জোসেফ: “ আমার মাও সব সময় কোথাও বেরোনোর সময় বলে,’দুগ্গা দুগ্গা ‘বলে, মা দুর্গা নাকি সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন |”
অন্বেষা: “একদম ঠিক বলেন আন্টি,কিন্তু আমি বলছি আমার আসল দুর্গা মায়ের কথা ।”
জোসেফ: “আসল দুর্গা মা,মানে তোর মা? “
অন্বেষা: “ আমার মা নয় রে,আমার ঠাম্মা। চেনোতো না তাঁকে,তাঁর নাম শ্রীমতি প্রেরণা মুখোপাধ্যায়। পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর হন,বিষয় ফিলোসফি।তাঁর কাছে জীবন দর্শন তা পুরোপুরি আলাদা।তিনি মানুষকে বিচার করেন তাঁর জাত,ধর্ম,চেহারা,বংশ দিয়ে নয়।তিনি বলেন, ‘কর্মই মানুষের আসল পরিচয় হওয়া উচিত।’এতো বছর বাদে এখনকার ছেলেমেয়েরা যে শব্দ টা খুব ব্যবহার করছে,” বডি সেমিং“টা ঠাম্মার অভিধানে অনেক পুরনো কথা।তাঁর চোখে সবাই ভালো,সবাই সুন্দর,কারুর নিন্দা করতে কখনো শুনিনি।জাত পাতের কথা উঠলে কাজী নজরুলের কথা বলেন,”ছুঁলেই তোর জাত যাবে ,জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া“।
অন্বেষা : “ মাঝে মাঝে অবাক লাগে ।বাবা কি করে ওর ছেলে হলো।বাবাতো গোঁড়া ব্রাহ্মণ,একটু এদিক থেকে ওদিক হওয়ার জো নেই।আসলে ঠাম্মা বলেন তাঁর ভাবনা চিন্তা,দর্শন বোধ এতটাই আলাদা যে শ্বশুরবাড়ি তে তাঁর মাথায় কিঞ্চিৎ গন্ডগোল বলেই সবাই ভাবে।নেহাত ডিভোর্স করার উপায় ছিল না,বনেদি বাড়ির সম্মান যাবে বলেই হয়তো ঠাকুরদা তাঁকে ডিভোর্স দেয়নি। ওঁদের মতে ঠাম্মার ম্লেচ্ছো চিন্তা ধারার প্রভাব পাছে সন্তান দের ওপর পড়ে তাই ছেলে মেয়েদেরকে তাঁর কাছে বেশি ঘেঁষতে দেওয়া হতো না,সব ছেলেমেয়েকেই প্রায় বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।পরে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে বনেদি বাড়ির বনেদিয়ানা সামলাচ্ছে,যেমন আমার বাবা |”
অন্বেষা ছোট থেকেই ঠাম্মার ভক্ত।আর ষষ্ঠীর দিন অন্বেষাকে মন খারাপ হয়ে বসে থাকতে দেখে ঠাম্মা নিজেই অন্বেষার কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,”কি রে দিদিভাই মন খারাপ? বাবা বেরোতে মানা করেছে ? বয়ফ্রেন্ড দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝি?”
অন্বেষা জড়িয়ে ধরলো ঠাম্মাকে,অবাক হলো এই ভেবে যে ঠাম্মা জানলো কি করে তার বয়ফ্রেন্ড এর কথা ?
যাইহোক ঠাম্মা কায়দা করে বাবাকে বললো যে বাড়ির কাজের লোকের বাচ্চা মেয়েটাকে একটা জামা দিতে চায় সে,তাই আমাকে জামাটা গড়িয়াহাট থেকে কিনে আনতে হবে।বাবা আর না করতে পারলোনা,অন্বেষা ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কোলে তুলে নিলো,বললো “থ্যাংক ইউ বুড়ি“।মাঝে মাঝে অন্বেষা ঠাম্মাকে আদর করে বুড়ি বলেও ডাকতো, আর ঠাম্মা তাকে বলতো ছুঁড়ি।
ঠাম্মা :” আর দেরি করিসনা দিদিভাই,তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পর।”
এতো কথা শুনে জোসেফ সত্যি যেন এক দুর্গা প্রতিমাকে দেখতে পাচ্ছে।মাথায় লম্বা খোলা চুল কিন্তু বেশির ভাগ চুল পাকা,ধবধবে গায়ের রং,পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল,পরনে সাদা শাড়ি ,টানা টানা কাজল কালো দুটো চোখ,টিকোলো নাক,কিন্তু চোখ দুটো ছলছল করছে,আনমনে বললো ~
“ ঐ তো তোর ঠাম্মা,কিন্তু তোর ঠাম্মার কি কোনো কষ্ট হচ্ছে,চোখ দুটো অমন কেন ?”
এদিকে অন্বেষা কখন থেকে ডেকে চলেছে ,” জোসেফ,জোসেফ ! কি এতো ভাবছিস বলতো? এবার বাড়ি যেতে হবেতো।”
অন্বেষা ঠিক করে ফেললো বাড়ি ফিরে বাবাকে সে বলবে,পুজোর সময় রাস্তায় খুব জ্যাম তাই দেরি হলো।
সেদিন বাড়ি ফিরে খুব ভালো লাগছিলো অন্বেষার।ইচ্ছা হলো আজ সে ঠাম্মার পাশে রাতে শোবে।কতদিন শোয় না সে ঠাম্মার পাশে।ঠাম্মার গায়ের গন্ধটা খুব ভালো লাগে তার,আর হাতগুলো কি নরম নরম,পাশে শুলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ঠাম্মা,খুব ভালো লাগে অন্বেষার।ঠাম্মা তাকে কখনো বকেনি।ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরেই কোথাও না থেমে সোজা চলে যেতো ঠাম্মার ঘরে।কিছু না কিছু ঠাম্মা ঠিক রেখে দিত তার জন্য।কখনো নাড়ু,কখনো কেক,কখনো ক্রিম বিস্কুট,কখনো খেলনা আবার কখনো ফুল।ঠাম্মা সবসময় বই পড়তো,তাই বড়ো হওয়ার পর ঠাম্মার কাছ থেকে উপহার মানে বই। ও শুনেছে ঠাম্মার নাকি অনেক গয়না ছিলো,ঠাম্মা তার বাবা,মানে বড়ো দাদুর একমাত্রই মেয়ে ছিলো,গয়নায় মুড়ে দিয়েছিলো বিয়ের সময়,কিন্তু কোনোদিন দেখিনি ঠাম্মাকে খুব বেশি গয়না পড়তে,মাকে মাঝে মাঝে রাগের মাথায় বলতে শুনেছি,”মাথাটাতো পুরো খারাপ,নাহলে কেউ অত গয়না কাজের মেয়েকে দিয়ে দেয়!”
তাতে আন্দাজ করেছিলাম ঘটনাটা।ঠাম্মার আলমারিতে কোন গয়নার বাক্স কখন দেখিনি,যা দেখেছি তা হলো কতগুলো সার্টিফিকেটস।কাউকে কখনো গয়না উপহার দিতেও দেখিনি,আসনে সেলাই করে নিজের লেখা কবিতা উপহার দিত,কত লোক হয়তো তার মান দিত না,কদিন বাদে সেই আসন ঘরের পাপোস করে দিতো ।অন্বেষা ভাবে,কত গুণী তার ঠাম্মা।অন্বেষার কাছে তার একটাই আবদার লাইব্রেরী থেকে বই এনে দিতে হবে ।
রাতের বেলায় সেদিন মাথায় বিলি কাটতে কাটতে ঠাম্মা জিজ্ঞেস করলো,
“কে রে দিদিভাই ছেলেটা?তোর সঙ্গে পড়ে?কি নাম?”
অন্বেষা “জোসেফ |”
ঠাম্মার মুখটা যেন কোন অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠল,অস্ফুট ভাবে বললো ,” খৃস্টান ?”
অন্বেষা:”কি হলো ঠাম্মা?”
ঠাম্মা: “ বড়ো ঝড় আসছে,সামলে রাখতে পারবিতো দিদিভাই তোর ভালোবাসাকে?”
কথা বলতে বলতে ঠাম্মার দুচোখ ছলছল করছে,জিজ্ঞেস করল ,”কি হয়েছে ঠাম্মা?”
ঠাম্মা:,”আমি হারিয়ে ফেলে ছিলাম আমার ভালোবাসাকে,পারিনি তাকে ধরে রাখতে। ”
অন্বেষা:বলোনা ঠাম্মা,কি হয়েছিল?কাকে ভালোবেসেছিলে তুমি?
ঠাম্মা: “আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে, এম এ ফার্স্ট ইয়ার,আলাপ হয়েছিল মাহির আখতার এর সঙ্গে।মাহির আমার সহপাঠী ছিলো,দুর্দান্ত পড়াশোনায়,শান্ত,লাজুক ছেলে।অপূর্ব চেহারা,আর চোখ দুটোর দিকে তাকালে যেকোনো মেয়ে প্রেমে পড়ে যাবে,আমিও পড়েছিলাম তার প্রেমে।প্রথম থেকেই জানতাম গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে আমি, বাড়ি থেকে কেউ মানবেনা। তাই ঠিক করেছিলাম দুজনে মিলে শহর ছেড়ে পালাব।দুজনেই ছিলাম রবিঠাকুরের ভক্ত, তাই ঠিক করেছিলাম গুরুদেব এর জন্মদিনেই পালাবো আমরা। মাহির দাঁড়িয়ে ছিল চৌরাস্তার মোড়ে , কিন্তু আমি পারিনি বাড়ির মায়া ত্যাগ করে বেরোতে,বাবাকে কষ্ট দিতে পারিনি সেদিন,দাঁড়িয়ে থেকে থেকে টেলিফোন করলো সে,বাবার ঘরে রাখা টেলিফোনটা বাজছিলো,বুকের ভেতরে সে কি যন্ত্রণা দিদিভাই,তবু ফোনের রিসিভার টা তুলে বলেছিলাম,’রং নাম্বার‘।তারপর তিলে তিলে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।বংশের মান রাখতে,পিতার সম্মান রাখতে বিয়ে করে নিলাম তোর দাদুকে | তোর দাদু ছিলো আমার পরিবার এর পছন্দ করা ছেলে,বনেদি বাড়ি,ব্যারিস্টার জামাই,পাল্টিঘর ,জন্মছক,একদম হিসেব করে সব মিলে গেছে,শুধু মনের হিসেবটাই কেউ মেলাতে পারেনি।আজও ভুলতে পারিনি মাহিরকে,জানি সেও খুব কষ্ট পেয়েছিল,আর তার জন্যই হয়তো আমিও সুখী হতে পারলামনা কোনোদিন।
এই পৃথিবীতে কোনোকিছুই তো বাড়তি বা কমতি হয়না,সব হিসেব সমান সমান।”
অন্বেষা: “খোঁজ করোনি আর কখনো তার?”
ঠাম্মা:”না রে কোনোদিন আর তার খোঁজ পেলাম না।খুঁজতে খুঁজতে এতগুলো বছর কেটে গেলো,ঠিক ভাবে সংসার টাই করতে পারলামনা।
কিন্তু দিদিভাই,তোমাকে একটা কথা বলি।তুমি যদি সত্যি কাউকে ভালোবাসো,তাহলে তুমি সেই ভালোবাসাকে মর্যাদা দিয়ো,ভালোবাসা ঈশ্বরের দান।আমার মতো পাপ কোর না।”
অন্বেষা দুহাত দিয়ে ঠাম্মা কে জড়িয়ে ধরলো,”তুমি আমার পাশে থাকবেতো ঠাম্মা?”
ঠাম্মা:”তা কবে তোরা বিয়ে করবি বলে ঠিক করেছিস?”
অন্বেষা:”এখন না ঠাম্মা,বছর দুই বাদে।দুজনেরই মাস্টার্স কমপ্লিট হবে,তারপর সোজা বিদেশ,একদম বাবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে,ওখানেই পি এইচ.ডি . আর বিয়ে দুটোই সেরে ফেলবো।শুধু দুঃখ এটাই থাকবে,তোমার সঙ্গে কতদিন দেখা হবেনা!জানি বাবা আমায় ত্যজ্য কন্যা করবে,তাতে কি?”
অন্বেষা আর জোসেফের প্রেম আরও গভীর হতে থাকলো।এদিকে ঠাম্মার ও বয়স বাড়ছে,তার সঙ্গে depression টাও।ডাক্তার সমানে বলে,”আপনার তো এখন আরাম করার সময়,কি এতো ভাবেন বলুনতো?”
ঠাম্মা: “সব কিছু ভাগ করে দিয়েও যদি ভাগ শেষ থেকে যায়, তাহলে মনে কি আনন্দ জাগে?”
ডাক্তার:”কিন্তু আপনার এই বয়সে তো ভাগশেষ থাকার কথা নয়,সব মিলে যাওয়ার কথা I”
ঠাম্মা:”আছে ডাক্তার বাবু আছে!”
খুব আস্তে বললো,“অপরাধ বোধ, অপরাধ বোধ,এতো বছর ধরে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে,এখন যে আর সইতে পারছিনা“।
অন্বেষা শুনতে পেয়েছিল সব কথাগুলো।
এবার মাস্টার্স কমপ্লিট করলো অন্বেষা,দৌড়ে এসে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরল,ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে সে।
অন্বেষা:”ঠাম্মা এবার আর কোনো বাধা নেই,জোসেফ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট,ক্লিয়ার হয়ে গেছে জি আর ই ,এবার আমরা উড়ান ছু হবো।”
কিন্তু প্রেম কি এতো সহজে পাওয়া যায়? অন্বেষার বাবা যেন অপেক্ষা করে বসেছিলো,অন্বেষার মাস্টার্স হলেই তার বিয়ে দেবে।
অন্বেষা: “আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি বাবা,তাকেই বিয়ে করবো।ছেলেটি খ্রীষ্টান,নাম জোসেফ।”
অন্বেষার বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে এই বিয়ে অসম্ভব এবং আজ থেকে অন্বেষার বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ।
ঠাম্মা অনেক প্রতিবাদ করেছিল,অনেক বার বলেছিলো “এতো বড়ো মেয়েকে এভাবে আটকে রাখিস না,ছেড়ে দে ওকে |”
ঘর বন্দি অন্বেষা সারাদিন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন,আর ঠাম্মা সেই তালা বন্ধ ঘরের বাইরে বসেছিলো সারারাত।তারপর অন্বেষার কাছ থেকে জোসেফের ফোন নাম্বার নিয়ে,নিজের ফোন থেকে জোসেফকে জানালো সব কিছু।পাসপোর্ট,ভিসা আগে থেকেই রেডি ছিলো দুজনের।
এদিকে জোসেফ মেইল করলো প্রফেসরকে বিদেশে,উনি বললেন ওদের দুজনকেই ওখানে চলে যেতে।জোসেফ ঠাম্মাকে সব জানিয়ে বললো,পরশু দিন মাঝরাতে অন্বেষাকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রেরণা বুঝতে পারলো তার কঠিন পরীক্ষার সময় চলে এসেছে,নাতনিকে সে দরজা খুলে দেবে । ছেলের বিরুদ্ধে গিয়ে করবে সে এই কাজটা। কিন্তু এইবার সে ভালোবাসাকে হারতে দেবেনা,কোনো ভয় নেই তার আর।তার মন বলছে,এ জীবনে যদি মাহিরকে না-ই পেলো,পর জনমে মাহিরকে পাওয়ার জন্য এই কাজটা তাকে করতেই হবে।
ছেলের ঘর থেকে চুপি চুপি চাবি নিয়ে এসে অন্বেষার ঘর খুলে দিলো।মাঝরাতে বেরিয়ে গেলো অন্বেষা,যাওয়ার সময় ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো,ঠাম্মা নিজের গলার হারটা খুলে অন্বেষার গলায় পরিয়ে দিলো,আর আংটি টা দিয়ে বললো,” এটা নাতজামাই কে দিস |” এটুকুই ছিলো ঠাম্মার শেষ গয়না।
অন্বেষা: “ভালো থেকো ঠাম্মা |”
ঠাম্মা: “আর দেরি করিসনা দিদিভাই,তুই চলে গেলে আমি একটু শান্তিতে ঘুমাবো।”
অন্বেষা: “কিন্তু বাবাতো তোমায় খুব বকবে ঠাম্মা?”
ঠাম্মা: “তোর বাবা আমাকে কিছু বলতেই পারবেনা,দেখ না ,আমি কি করি!”
এই ছিলো তাদের শেষ কথোপকথন।
অন্বেষা যেতে যেতে চেয়ে রইল ঠাম্মার দিকে ,দেখতে পেলো ঠাম্মার চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি,সফলতা চিক্ চিক্ করছে ।
সকাল বেলা বাড়িতে হইচই।অন্বেষা পালিয়ে গেছে,বাবা বুঝেই গেলো এই কাজ ঠাম্মার,দৌড়ে গেলো ঠাম্মাকে জেরা করতে,গিয়ে দেখলো ঠাম্মা ঘুমাচ্ছে, হাতে একটা কাগজ,কাগজে লেখা,”পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলাম“। বিছানার উপর পড়ে আছে ঠাম্মার ঘুমের ওষুধের শিশিটা। ঠাম্মা রোজ একটা করে ঘুমের ওষুধ খেতো,সেদিন পুরো শিশিটাই শেষ করেছিল।
বাবা হয়তো ভাবলো তার মেয়েকে পালাতে সাহায্য করেছে বলে,ঠাম্মা এই কাজ করেছে আর লিখে গেছে এই কথা।নন্দুদা,মানে তাদের বাড়ির সবচেয়ে পুরানো চাকর ফোন করে অন্বেষাকে ঠাম্মার মৃত্যু সংবাদ দেয়।ভেবেছিলো হয়তো ঠাম্মার খবরটা আমাকে জানানো দরকার কারন ও জানতো আমি ছিলাম ঠাম্মার সবচেয়ে কাছের মানুষ।
শুনেছিলাম ,থানা থেকে যখন পুলিশ এসেছিলো,বাবা বলেছিলো,” আমার মা ডিপ্রেশনের এর ওষুধ খেতেন,মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল“।পুলিশ এর রিপোর্ট লিখতে কোনো সমস্যাই হলোনা,রিপোর্ট লেখা হলো, – দিস কেস ইজ কমপ্লিটলি এ কেস অফ সুইসাইড , নো ওয়ান ইজ অ্যাকিইউজড হার |
লেখিকা-রেশমি দত্তঃ জন্ম ও পড়াশোনা কোলকাতায় ৷ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর-পেশায় শিক্ষিকা রেশমির অবসরের বিনোদন হলো বইপড়া ৷ শৈশব থেকে বাবার অনুপ্রেরণায় গল্প ও কবিতা লেখার শুরু ৷ শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ভ্রমণ ওর প্রিয় বিষয় ৷