
প্রেমে – অপ্রেমে
সুরজিৎ সরখেল
ঋতি অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে কিছু একটা চিন্তা করছিল। সারাটা ক্ষণ ঘন, গহীন মেঘেদের মতন ভেসে বেড়াচ্ছিল চিন্তার সমুদ্রে।
” ও দিদি কি ভাবছেন এত? কাঠগুদাম এসে গেছে তো!
আপনার লাগেজ গুলো আমি নিচ্ছি ।আপনি ধীরে ধীরে নামুন।“
কথাগুলো বলেই অতি ব্যস্ত রাজু ঋতির লাগেজ নিয়ে নেমে গেল। প্রতিবছরই ওদের পরিচিত এক নামি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে ঋতি পাহাড়, জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে। আগে একা একাই ট্রেকিং করতে বেরিয়ে পড়তো। পথে কত মানুষের সঙ্গেই তো পরিচয় হয়ে যেত!
ইদানিং কয়েকটা বছর এই এজেন্সির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে দিন কয়েকের জন্য। এবার কুমায়ুন অঞ্চলের আলমোড়া,বিনসর, চৌকরি অনেক স্পট আছে ওদের তালিকায়। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ, ভালোলাগা জড়িয়ে আছে এখানকার পার্বত্য অঞ্চল গুলোর সঙ্গে। আভাষের সঙ্গেই তো বার দুয়েক এসেছিল এখানে। প্রফেশনের তাগিদে আভাষকে যখন তখনই ক্যামেরা কাঁধে করে বেরিয়ে পড়তে হতো। আভাষের কাছেই ওর ফটোগ্রাফির হাতেখড়ি। দিন নেই, রাত নেই, ঘন জঙ্গল, পাহাড়, নদী সমুদ্র, হেন জায়গা নেই, যেখানে ক্যামেরা নিয়ে মানুষটা ঘন্টার পর ঘন্টা, কখনো কিছু না খেয়ে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর প্রতি মনোনিবেশ করে পড়ে থাকত! প্রথম প্রথম ঋতি অনুযোগ করতো। নতুন বউ হিসেবে যখন লেকটাউনের এই বাড়িতে আসে, তখন সংসার বলতে শুধু শাশুড়ি মা আর স্বামী আভাষ। এছাড়া কাঠের বড় দুটো আলমারি ভর্তি ক্যামেরা আর লেন্স! প্রতিটা জিনিসই ভীষণ দামি! আর আভাষ যত্নও করতো সেরকম! ঋতি কপট রাগ দেখিয়ে বলতো ক্যামেরাগুলো তার সতীন! নিপাট ছেলেমানুষি আর সারল্যে ভরা আভাষের মুখ দেখে তখন ঋতির রীতিমতো মজা হত!
” দিদি আপনি এখনও বসে আছেন! সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। শরীর খারাপ লাগছে?”
উদ্বিগ্ন রাজুকে আশ্বস্ত করে ঋতি তার কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো। সত্যিই সবাই যে যার লাগেজ নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত! স্টেশনটা ভীষণ সুন্দর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপস্থিতি চারিদিকে। রীতিমত কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। গাছের ফাঁক–ফোকোর দিয়ে মিষ্টি রোদের আলপনা প্ল্যাটফর্মের ওপর এসে পড়ছে। চারিদিকে পাহাড় আর মহীরুহের উপস্থিতি ভীষণ ভালো লাগছে। প্ল্যাটফর্মের উপর সবাই চ্যাটার্জিদার ভাষণ শুনছেন মন দিয়ে। আসলে এই কটা দিন উনি সবার গার্জিয়ান কাম গাইড। ওনার সহযোগী কর্মী এসেছেন ৬/৭ জন। ডেনিম জিন্স, জ্যাকেট, স্পোর্টস শু আর সানগ্লাস চোখে মধ্য ৫০ এর ঋতি সবার শেষে ট্রেন থেকে নেমে এল। এখান থেকে ফ্রেশ হয়ে ওরা নৈনি লেকের কাছে একটা হোটেলে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবে । প্রায় ২০/২২ জন ট্যুরিস্টের মধ্যে দুই একজন ছাড়া সবাই অচেনা । তবে ওর মতন সোলো টুরিস্ট আর কেউই নেই!
এই ট্যুরিস্ট দলের মধ্যে একজন সুবেশা ,সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে ঘিরে ভিড়। সবাই তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছে! তার হাতে ধরা একটি ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে। ঋতির মুখে একটা রহস্যময় হাসি খেলে গেল যেন!
এদের কর্মচারীদের সবাই ঋতিকে চেনে। সমীহ করে যেমন, ভালোবাসেও তেমন। যেহেতু ও এদের সঙ্গে অনেকগুলো ট্যুর করেছে, তাই এরা ওর পছন্দ অপছন্দ, ওর মননশীলতা সম্পর্কে ভীষণভাবে সচেতন।
কলকাতার আকাশের সঙ্গে, বাইরে যেখানেই যাওনা কেন, বিশেষ করে পাহাড়ী এলাকায় যে আকাশ আমরা দেখি, কতই না পার্থক্য! এই কথাটা আভাষ ওকে প্রতিটা ট্যুরেই ,আকাশ দেখিয়ে বলতো! কোনটা ধ্রুবতারা, শুকতারা, কোন নক্ষত্রের কি নাম, অবস্থান, প্রতিটা খুঁটিনাটি তথ্য, কত সুন্দর করে ঋতিকে শিখিয়েছে।
হোটেলে এসে ওর রুমে লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই ওর রুমে গরম পেঁয়াজি আর ১ ফ্লাস্ক কফি নিয়ে রাজু এসে জানালো সবাই নিচের ডাইনিং হলে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ঋতি জানালো ওর মাথা ব্যথার জন্য যেতে পারছে না। কাল সকালে ব্রেকফাস্ট করার সময় সবার সঙ্গে আলাপ করে নেবে। আসলে ভ্রমণের প্রথম দিনে সন্ধ্যেবেলায় ডাইনিং রুমে সবার সঙ্গেই পরিচয় পর্বটা মিটিয়ে ফেলা হয়। খাওয়া–দাওয়া ,আড্ডা ,গান–বাজনা করে রাতের খাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই রাজু এসে ওর ডিনারটা ঘরে দিয়ে গেল।
আভাষের মতন ফটোগ্রাফি সম্পর্কে অগাধ পান্ডিত্যের মানুষকে স্বামী হিসাবে পেয়ে ঋতিও ফটোগ্রাফির অনেক কিছু শিখেছিল। তাছাড়া ওরা দুজনেই মাউন্টেনিয়ারিং এর বেসিক কোর্স টাও বছর কয়েকের মধ্যেই রপ্ত করে ফেলেছিল। তাছাড়াও আভাষ ভালো কবিতা লিখত , গানে সুর দিত, দরাজ গলায় গাইতো; অথচ প্রথাগত তালিম কারোর কাছে নেয়নি!!
প্রতিদিন ডাইরি লেখার ভালো অভ্যাসটা ওর ছিল।
ওর এভাবে চলে যাওয়াটা ঋতি মেনে নিতে পারেনি! আর কে-ই বা পারে! বিয়ের দু বছরের মাথায় ঋতির মিস ক্যারেজ হওয়ায় শারীরিক অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে! ভবিষ্যতে সন্তান হবার সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যাওয়াতে ভীষণভাবে ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে পড়ে ! তখন আভাষ
ওকে নিয়ে ফটোগ্রাফি, পর্বতারোহণ, এ সমস্ত ব্যাপারের মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ে, এর মধ্যে যে একটা অদম্য অসম্ভব, ভালো লাগার নেশা জড়িয়ে আছে, অনুভব করতে পারে। উভয়ের কাছেই যেন এটা অজানা অচেনা ছিল।
ডিনার শেষ করে পুলওভার গায়ে চাপিয়ে বারান্দায় এসে বসলো ঋতি। তারা ভরা রাতের পরিস্কার আকাশে এক ফালি চাঁদের আলোয়, দূরের চরাচর, আর অনেকটাই দূরে নন্দা দেবী আর পঞ্চচুল্লি পর্বতমালা একটা অপার্থিব দৃশ্য সৃষ্টি করেছে! প্রতিক্ষণেই যেন দৃশ্যপটের পরিবর্তন হচ্ছে! মনে পড়ে গেল এ রকমই এক পূর্ণিমার রাতে আভাষের সঙ্গে নৈনিতালের একটু আউট স্কার্ট এ সাধারণদের অভ্যস্ত ভিড় থেকে, নিরিবিলি সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য , খুঁজে পেতে একটা মাঝারি হোটেলে ওরা দুটো দিন কাটিয়েছিল। সবাই হৈ হৈ করে নৈনিতালের লেকের ধারে আনন্দে কাটায়, কিন্তু ওরা দুজনে নির্জনে প্রকৃতি প্রেমে সময় কাটানোই শ্রেয় মনে করেছিল।
আভাষের নিখুঁত উচ্চারণে ,গম্ভীর ভরাট গলায় স্বরচিত কবিতা পাঠ শুনে পাশের রুম থেকে এক বাঙালি দম্পতি যেচে ঘরে এসে তাদের একরাশ ভালোবাসা আর শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিল। এখান থেকে আরো ২ কিলোমিটার দূরে সেই হোটেল। আজকের রাতও সেদিনের রাতের মতো চাঁদের মায়াবী আলোয় ভরপুর | চোখের কোণ দুটো জলে ভিজে গেল। স্মৃতিরা এসে মনের আনাচে কানাচে কোন ফাঁক আছে কিনা খুঁজে, সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে অনাহুতের মতন।প্রায় দু বছর হতে চলল ওদের ১৫ বছরের দাম্পত্য জীবনের অকস্মাৎ বিচ্ছেদ হয়, আভাষের হঠাৎ করে চলে যাওয়াতে I বাথরুমে স্নান করার সময়ও গুনগুন করে গান করছিল। হঠাৎই ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক | শাওয়ার চালু ছিল। জলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল; কিন্তু আভাষের গলার কোন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল না I প্রায় ৪০ মিনিট পরে ঋতির মনে সন্দেহ হওয়াতে দরজায় ধাক্কা দিয়েও যখন কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না,তখন দরজা ভেঙে ঢুকে ওকে প্রাণহীন অবস্থায় পাওয়া গেল । লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল I সবারই প্রিয় ছিল আভাষ।
সময়ের গতি অপ্রতিহত, অথচ নিস্তরঙ্গ I আভাষের চলে যাওয়ার পর প্রতিটা মুহূর্ত ঋতি কিভাবে কাটিয়েছে, তা জানার আগ্রহ দেখানোরও কোন মানুষ ছিল না । যুগ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে I তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজ ,সংসার ,জীবনের ধর্মও দ্রুত বদলে যাচ্ছে I যৌথ পরিবারের কনসেপ্ট খুব দ্রুতই অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। জন্মের সময় যে শিশু তার শৈশবে প্রচুর মানুষের স্নেহের পরশ পায়, ভালোবাসার বন্ধনে যাদের সঙ্গে বেড়ে ওঠে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কালের স্রোতে সব মিষ্টি সম্পর্কগুলি কেমন যেন অদৃশ্য হয়ে যায় । পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে সময় যেন সযত্নে তা ছাড়িয়ে নেয়।
যখনই বিষণ্নতা এসে গ্রাস করে শরীরে, মনে ,চেতনায় অবসাদ এসে ঘিরে ধরে, ঋতি তখনই খোলা গলায় আবৃত্তি করে, রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে ওঠে, সবই অবশ্য আভাষের অনুপ্রেরণায় শেখা । ঋতি আবৃত্তি শুরু করলো ওই বারান্দায় বসেই…..
” সুন্দর তুমি এসেছিলে, মন বনে
সহসা ,চকিতে একি দোলা দিলে মনে!
প্রাণ ভরে স্মরি যে তাই!
ব্যথার গভীরে ডুবে যেতে যেতে স্মৃতি
মনের অতলে খুঁজি ইতি উতি
বিষণ্ণ আকাশ তলে ধাই! “
আভাষের স্বরচিত কবিতা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই পাশের রুমের আলোটা জ্বলে উঠল! পরক্ষণেই নিভেও গেল I ঋতির মুখেও এক টুকরো রহস্যময় হাসি যেন ফুটে উঠলো I পরপর রুম আর সংলগ্ন লম্বা টানা বারান্দা। আর বাইরে চারিদিকে ঘিরে আছে তুষার শুভ্র পাহাড় চূড়া। চাঁদের মন চুরি করা অপার্থিব আলোয় মাখামাখি যেন সমস্ত বিশ্ব চরাচর। আর ঋতিও যেন সেই নেশায় মাতাল হয়ে, পরপর আবৃত্তি আর সেই সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে চলল। ” সহসা ডালপালা তোর উতল যে ,ও চাঁপা ও করবী “!
ভোরবেলাতেই অনেক মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঋতির ঘুমটা ভেঙে গেল I জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেখতে পেল, প্রত্যেকটা বারান্দায় সব ভিড় করে , সামনের তুষার শুভ্র পর্বত চূড়ায় সূর্যের প্রথম আলো ছিটকে এসে যেভাবে সমস্ত পাহাড় চুড়ো গুলোতে লালচে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তা মোবাইল ক্যামেরায় ধরে রাখছে।আর সমস্বরে আনন্দে চিৎকার করে উঠছে! বেড টি দিয়ে গেছে এরই মধ্যে। রাজু জিজ্ঞাসা করে গেছে “ব্রেকফাস্ট ঘরে দিয়ে যাব, না হল ঘরে গিয়ে খাবে “? ঋতি জানালো গতকাল শরীর খারাপের জন্য ডাইনিং হলে যেতে পারেনি, তাই সকালের ব্রেকফাস্ট হল ঘরেই করবে।
*************** ************ ************
কড়াইশুঁটির কচুরি ,আলুর দম, ফিশ ফ্রাই, মিষ্টি ,কফি সহযোগে ব্রেকফাস্ট করতে, করতে সবার সঙ্গে পরিচয় পর্ব সারতে লাগল ঋতি। যদিও চোখ আর মন খুঁজে বেড়াচ্ছিল অন্য কাউকে I বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হলো না ঋতিকে I সেই সুবেশা, সুন্দরী ভদ্রমহিলা কেমন যেন উদ্বিগ্ন হয়ে ঋতির কাছে এসে, একসঙ্গে অনেক কিছু জানতে চাইল । যেন তর সইছে না । যেমন, ” আপনি কোথা থেকে আসছেন ?, আপনার নাম কি? আপনি যে আবৃত্তি গুলো করছিলেন! যে গানগুলি গাইছিলেন কার থেকে শিখলেন। কোথায় পেলেন?” ভদ্রমহিলাকে আরো চমকে দিয়ে ঋতি বলে উঠলো ” শাশ্বতী ,ওই বাইরের লনটায় আসুন। হাঁটতে ভালোই লাগবে এখন।“
শাশ্বতী..”. আপনি আমার নাম জানেন !”
ঋতি…..”..আপনার মতন বিখ্যাত একজন বিদুষী মহিলাকে কে না চেনে ?? টিভির চ্যানেল গুলোতে আপনার সঞ্চালনা,গল্প,কবিতা,আবৃত্তি পরিবেশনা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি!”
শাশ্বতী বলে ওঠে ” আপনি কাল রাতে বারান্দায় বসে যে আবৃত্তি গুলো করছিলেন, কোথায় পেলেন ওগুলো? কিভাবে পেলেন?”
ঋতি বলে “ওগুলো বোধহয় ,আমার পাওয়ার কথা না | তাই না? “….তির্যক ভঙ্গিতে ঋতির কথায় যেন প্রখর দহন জ্বালা |
–ওই কবিতাগুলো আপনি যেভাবে আবৃত্তি করছিলেন, ঠিক সেই একই ভঙ্গিমায় আমার একজন অত্যন্ত কাছের মানুষ আবৃত্তি করতেন I
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন তার স্বরচিত কবিতা পাঠ শুনতাম “!
-” মন্ত্রমুগ্ধের মতো! অত্যন্ত কাছের মানুষ ! তা সেই কাছের মানুষের প্রতি আপনার মুগ্ধতার রেশ মিলিয়ে গেল কিভাবে ? এত তাড়াতাড়ি আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন কি করে“?
শাশ্বতী বলে – আপনি আমার পরিচিত ভদ্রলোকের লেখা কবিতা যা এখনো অপ্রকাশিত, তা আবৃত্তি করছিলেন ! সেই একই ভঙ্গিমায় রবীন্দ্র সংগীত গাইছিলেন I আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি আভাষ রায় চৌধুরীকে চিনলেন কিভাবে ?
ঋতি ” তার আগে আপনি বলুন , এক মুহূর্ত যাকে না দেখলে আপনার শরীর–মন বিষণ্নতায় ভরে উঠতো ,যাকে আপনি প্রায়শঃই বরাভয় দিতেন ” সমস্যার অপর নাম সমাধান “, যার সংসারের হত দরিদ্র অবস্থা দেখে আপনি তার সেই পবিত্র ভালবাসাকে অবমাননা করার মতন ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন আভাষ শুধুই আপনাকে ভালবাসেনি, আত্মসমর্পণ করেছিল আপনার কাছে I অস্বীকার করতে পারেন কি? শোনা যায়, আপনার প্রতি সেই সময় আরো দুই একজন অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল ! আপনার শুধুই এই রক্তমাংসের শরীরটুকুই আছে, মন তাতে নেই । কি পেয়েছিলেন ওরকম সুন্দর মানসিকতার একজন মানুষকে নৃশংস খুনির মতন তিলে তিলে খুন করে? “
শাশ্বতী বলে- ” বিশ্বাস করুন, আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বাবার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারিনি। বাবা অন্ন–জল ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু আমি সুখী হতে পারিনি । ঈশ্বর আমাকে চূড়ান্ত শাস্তি দিয়েছেন! “
ঋতি-” আপনার ডানদিকের চোখের উপর এই ক্ষতচিহ্ন গতকাল রাতে আপনার কর্তার কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন , তাই তো ? রাতে আমার বেডরুম থেকে স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল।“
শাশ্বতী মাথা নিচু করে করুণ স্বরে বলে উঠলো ” ড্রিঙ্ক করলে ওর মাথার ঠিক থাকে না । মেয়েটাও অকালে চলে গেল, বাচ্চাটাকে আমার কাছে রেখে I সবই আমার কর্মফল। আভাষ কেমন আছে এখন? কোথায় আছে? আপনি কি জানেন?”
ঋতি বলে ” বড় দেরি হয়ে গেছে আপনার | আভাষ অনেকদিন আগেই চিরশান্তির দেশে চলে গেছে ,আমাকে একলা ফেলে | “
এরপর ঋতি তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা সুদৃশ্য ছোট চামড়ার ব্যাগ বার করে শাশ্বতীকে হাতে দিয়ে বলল ” এর মধ্যে আপনার আভাষকে লেখা ৩৪ খানা চিঠি আছে। আপনার জিনিস আপনার কাছে ফেরত দিয়ে দিলাম। কলকাতা থেকে আপনার পিছু নিয়েছিলাম, চূড়ান্ত শাস্তি দেবো বলে I কিন্তু দেখলাম, সময় নিখুঁতভাবে প্রত্যেকের কর্মফল অনুযায়ী বিচার করে ! আপনার নাতনির জন্য মন খারাপ হয়ে গেল! আসলে আমরা প্রত্যেকেই কতগুলো মুহূর্তের জন্য এই মায়াভরা পৃথিবীতে সময় কাটাতে আসি। এই শরীরের মধ্যে কত ক্ষোভ, অভিমান, রাগ, ঈর্ষা ,লোভ পুষে রাখি । আবার সময় শেষ হলেই এই শরীরটাকেই পুড়তে হয় আগুনে কয়েক সের ছাইয়ে পরিণত হয়ে যায় । এটাই কেউ আমরা মনে রাখিনা | যাইহোক, ভালো থাকবেন | ”
****************************
সুরজিৎ সরখেল পরিচিতি :
১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্ম। ২০১৮ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গীতে একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। সেজমাসী এবং মেজমামা প্রখ্যাত সুরকার স্বর্গীয় হৃদয় রঞ্জন কুশারীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। কলেজ জীবন শুরু হবার পর সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। অফিসে কর্মজীবনের ফাঁকেই শুরু হয় সাহিত্য চর্চা। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।