Shadow

ভ্রমণ – কিছু স্মৃতি, কিছু বিস্মৃতি” পল্লব চট্টোপাধ্যায়

“ভ্রমণ – কিছু স্মৃতি, কিছু বিস্মৃতি”

পল্লব চট্টোপাধ্যায়

আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সদ্য দু-বছর শেষ করেছি, বাবা ডেকে বললেন,‘ওরে,কোম্পানি যে ছুটিতে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাবার জন্যে চার বছর অন্তর একটা লীভ ট্রাভেল অ্যাসিস্ট্যান্স দেয়,সেটা তো আমি বারবার ছেড়ে দিতাম-ভাবতাম কে এসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পোয়াবে। এখন তুই বড় হয়েছিস,দেখ না কিভাবে গুজরাট ঘুরে আসা যায়,তোর কাকা কতবার বলে।’ ও এই কথা! আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। ‘দাও টাকা, টিকিট করে আনি’- বলে উঠলাম উৎসাহের সঙ্গে।

বাবা-মা,আমরা দুই ভাই দুই বোন,দুর্ভাগ্যক্রমে আমি সবার বড় অর্থাৎ দায়িত্ব বেশি-গ্রীষ্মের এক সকালে ধানবাদ স্টেশনে চেপে বসলাম দিল্লিগামী ডিলাক্সের এসি চেয়ার কারে। পরদিন সকালে দিল্লি। বাবার বন্ধুপুত্র দুলালদা দিল্লিতে কাজ করে-কালীবাড়িতে বুকিং করে রেখেছিল,তিনদিন সেখানে থেকে দিল্লিটা ঘুরে নিলাম। একদিন ট্যুরিস্ট বাসে করে দিল্লির দর্শনীয় স্থানগুলো দেখছি। মায়ের আবার সবকিছুতেই বিরক্তি-‘রাজঘাট,শান্তিবন-এসব অত দেখার কী আছে রে বাবা,শ্মশান-মশানে বেড়াবার শখও হয় মানুষের-আবার ফিরে গিয়ে স্নান করতে হবে!’ হুমায়ুন-টুম দেখতে তো নামলেনই না,বলেন-‘হনুমানের কবর দেখে কাজ নেই আমার,তোরাই যা।’ হুমায়ুনকে হনুমান বললে আজ কী প্রতিক্রিয়া হত ভাবতেই ভয় করে! তাই কুতুব মিনারে আমি আর ছোট বোন চেপে এলাম- তখন পাঁচতলা মিনারের তিনটে পর্যন্ত চড়তে দিত। সন্ধেয় নেমে পড়লাম লাল কেল্লায়,একেবারে লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ড শো দেখে কালীবাড়ি ফিরলাম। পরদিন আর কারো বেড়াবার এনার্জি ছিল না,আমি ভাইকে নিয়ে তিনমূর্তি ভবন,ডল মিউজিয়াম এসব দেখতে দেখতে হেঁটে বেড়াচ্ছি,দেখি একজায়গায় তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা-মির্জা গালিবের বাসভবন। আমরা তখন কলেজের বন্ধুরা গালিব, ফিকরি,মীর তাকি মীর-এদের শায়রি আর গজলের মস্ত ফ্যান,প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হলাম। কোথায় গালিব! নীচের তলায় একটা সাইকেলের দোকান আর ট্র্যাভেল এজেন্সির অফিস। ওপরতলায় একটা ছোট বন্ধ ঘরে খোলা জানলা দিয়ে দেখি একটা গালিচা পাতা,একটা গড়গড়া,পাশবালিশ আর গালিবের একটা ছবি-এটুকুই। যাক,কিছু দেখা তো হল। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে আসল গালিবের মহলে আমাদের ঢোকাই হয় নি,ওটা তখন প্রাইভেট প্রপার্টি। পরে ১৯৯৯তে সরকার সেটা অধিগ্রহণ করে জনসাধারণের জন্যে একটা স্মারক গড়ে তোলে সেখানে। 

পরদিন দিল্লি স্টেশন থেকে মিটার গেজের ট্রেনে চেপে (এখন বোধহয় খুব সামান্যই মিটার গেজ রয়ে গেছে এদেশে) মহেসানায় নামলাম,কাকা তখন সেখানেই পোস্টেড। মহেসানা তখন ছোট একটা জেলা শহর-রাজস্থানের থর মরুভূমি প্রায় গুজরাটের পালনপুরে এসে শেষ হয়েছে কিন্তু বাস্তবে মহেসানা পর্যন্ত ছড়িয়েছে সেই অনুর্বর বালিয়াড়ির সীমা। সেখানে তখন দেখার বস্তু একটাই ছিল। দুধসাগর ডেয়ারি। পশ্চিমবঙ্গে তখন সত্যিকারের সংগঠিত ডেয়ারি প্রকল্প বলতে সবেধন কল্যাণীর হরিণঘাটা। অথচ গুজরাটে ত্রিভুবনদাস প্যাটেল আর ভার্গিস কুরিয়েনের সৌজন্যে শ্বেত বিপ্লব জোরকদমে চলছে আর অপারেশন ফ্লাডে দুধের বন্যা বইছে। দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে ‘আমূল’ পরিবর্তন আসে দেশে জানেন কি তার পুরো নাম? হ্যাঁ, AMUL বা Anand Milk Union Limited. হেড অফিস আনন্দ আর গুজরাটে বিভিন্ন শহরের অজস্র শাখা মিলে যাদের বার্ষিক আয় প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকা! দারুণ আনন্দ পেয়েছিলাম এই দুধসাগর ডেয়ারি দেখে।

পরের গন্তব্যস্থল পোরবন্দর,রাতের ট্রেন কীর্তি এক্সপ্রেসে। উঠেছি শ্রীজি নামে একটা ছোট হোটেলে। ঘোরা হল গান্ধীজির জন্মস্থান কীর্তি মন্দির,কৃষ্ণসখা সুদামার নামে সুদামা মন্দির (সুদামা নাকি পোরবন্দরেরই মানুষ ছিলেন) | যার প্রসিদ্ধি পাখিদের রামদানার খই খাওয়ানো নিয়ে। ফেরার পথে আমার প্রথম সমুদ্র দেখা-আজ্ঞে হ্যাঁ,ঘরের সামনে দীঘা-পুরী দেখেছি তার অনেক পরে। ছোট্ট একফালি বীচ,তাই সই। আমরা ভাইবোনেরা বীচে নেমে খুব হুটোপুটি করছি,মা ভয়ে আর ঘেঁষেন না সেদিকে। তারপর সবার জেদাজেদিতে একপা একপা করে এগিয়েছেন,হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। সমুদ্র কবে কার ভ্যানিটি সহ্য করেছে? অতএব জলে নামতেই পায়ের তলার বালিয়াড়ি সরে জননী একেবারে পপাত সাগরজলে। অগত্যা আমাদের চটজলদি হোটেল ফিরতে হল। বিকেলে বেরিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চেপে ঘুরে এলাম শহরের অন্য প্রান্ত-নাম শুনে গেলাম তারামন্দির,গিয়ে দেখি মা তারার শক্তিপীঠ নয়,প্ল্যানেটোরিয়াম সেটা! পাশেই ছিল ভারত-মন্দির,বাস্তবে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্যের একটা মিউজিয়াম। এখানে দেখি সবকিছুই মন্দির!
একটু রাত করেই সেদিন শ্রীজি-মন্দির,ইয়ে মানে শ্রীজি হোটেলে ফিরলাম। টাঙা নিয়েছিলাম। টাঙাওয়ালা হোটেল চেনেনা। হঠাৎ মাথায় এল হোটেলের কাছে একটা মোড় ঘুরেই পোস্ট অফিস। টাঙাওলাকে বললাম ডাক-মন্দির চল। বাবা এক ধমক দিলেন, ডাকমন্দির আবার কী? তবে টাঙা কিছুতেই পোস্ট-অফিস যাবে না,বলে সাহেব,ডাকঘর এখন তো বন্ধ,গিয়ে লাভ নেই-অন্য কোথাও চলুন। শেষে জোর করে বলতে হল- না,বন্ধ হোক বা খোলা,আমরা সেখানেই যাব!

 পরের দিন গেছিলাম সোমনাথ,ছিলাম সোমনাথ মন্দিরের কাছেই একটা ধর্মশালায়। ইদানীং যাঁরা সোমনাথ গেছেন তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না ১৯৭৯ সালের সোমনাথ মন্দির কী ছিল! প্রায় চৌদ্দশো বছরের পুরনো দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম এই মন্দিরটিতে বোধহয় প্রচুর রত্নাদি ছিল যার ফলে জুনায়েদ,গজনীর মামুদ,আলাউদ্দিন খিলজি,মুজঃফর শাহ,মামুদ বেগদা, ঔরঙ্গজেবরা বারবার এই মন্দির ধ্বংস ও এর ধনসম্পত্তি লুঠ করেন। পরে আঠারো শতাব্দীর শেষভাগে পেশোয়া-ভোঁসলে-সিন্ধিয়া রাজারা আর রাণী অহল্যাবাই হোলকার মিলে মন্দিরটি আবার গড়ে তোলেন। ধ্বংসস্তুপ নাকি সরানো হয় ১৯৫১তে,কিন্তু সেবছরও আমি প্রচুর ভগ্নাবশেষ পড়ে থাকতে দেখেছি এর পাশে I অবশ্য ২০১৯এ গিয়ে দেখি সেসব কিছু নেই। এখন যাঁরা যাবেন,দেখতে পাবেন সোমনাথ-ভালকা-প্রভাসতীর্থকে এক নতুন রূপে। একেবারে কর্পোরেট স্টাইলে সব কিছু সাজানো,সোন-এট-ল্যুমিয়েরে অমিতাভ বচ্চন শোনাচ্ছেন মন্দিরের ইতিহাস-ভক্তি না আসুক,বিস্ময় জাগবেই।

তবে মন্দির যতই সুন্দর হোক,তার পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর-পন্থা যতই উত্তেজনাময় বা জ্যোতির্লিঙ্গের যতই মাহাত্ম্য থাকুক-সে যাত্রায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম মন্দির চত্বরের ধারের পাঁচিলে ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে সমুদ্র দেখার মধ্যে……নাওয়া-খাওয়া ভুলে নিরন্তর দেখতে থাকা…দেখতে থাকা। সমুদ্র দেখা কী যে নেশা! ঈশ্বর বোধহয় সেই বুঝেই আমাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন সমুদ্রবাসের চাকরি,পাক্কা সাত বছর (অবশ্য প্রায় প্রতি মাসেই কিছুদিনের জন্যে বাড়ি আসতাম) আরব সাগরের মাঝে বম্বে হাইয়ে পেট্রোলিয়াম ফিল্ডে ড্রিলিং-এর কাজ। কাজের শেষে অন্যেরা যখন রিক্রিয়েশন রুমে টেলিভিশন দেখছে বা আড্ডা দিচ্ছে,জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখতাম সমুদ্র,একটানা নিরন্তর ঢেউয়ের ওঠা-নামা। কেন জানি না,বিরক্তি বা একঘেয়েমি লাগত না এতটুকু। দেখতাম জেলেরা ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে,তীর থেকে এতদূরে যে ওরা আসতে পারে তা আমার জানা ছিল না,অবশ্য কোস্ট গার্ডের অনুমতি নিয়েই ওরা আসতে পারত এ অঞ্চলে। দেখেছি ডলফিনের ঝাঁক মাঝে মাঝেই ডিগবাজি খেতে খেতে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে পোরবন্দর বা করাচির দিকে,ওদের তো আর দেশের সীমারেখার পরোয়া নেই,নেই কোস্টগার্ড বা নেভির সুরক্ষা-বাহিনীর ভয়। তবে সে সব কাহিনি হবে অন্য একদিন,অন্য সময়।
*********************************

পল্লব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের খনিজ তৈলক্ষেত্রে কাটিয়েছেন সারাজীবন,সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। বিহারের,অধুনা ঝাড়খণ্ড,যে অঞ্চলে তিনি মানুষ সেখানে ‘নানা ভাষা,নানা জাতি,নানা পরিধান’ হলেও একসময় বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চার আবহ ছিল। সেই শিক্ষা থেকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায় ও বিগত কয়েক বছরে অবসর,জয়ঢাক,ম্যাজিক-ল্যাম্প,ছুটির ঘন্টা,আদরের নৌকা,ঋতবাক ইত্যাদি নেট-পত্রিকা ও যুগ,ট্রৈনিক,বোম্বে-ডাক ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায়,ক্যাফে-টেবল প্রকাশিত শরদিন্দু স্মৃতি-সংখ্যায় লিখে আসছেন। তাঁর প্রকাশিতব্য গল্প সংগ্রহ ‘আড্ডা আনলিমিটেড’ ও ‘বরাহ-নন্দন ও অন্যান্য গল্প’- দুটিই এখন যন্ত্রস্থ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!