লোকরানি ঝলকারি বাঈ : বিস্মৃত এক বীরাঙ্গনা
কলমে – অজন্তা প্রবাহিতা
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে আমাদের চোখে প্রথমেই ভেসে ওঠে ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই। তিনি সাহসের প্রতীক, প্রতিরোধের প্রতিমা। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রাণীর ছায়াতেই ঢাকা পড়ে গেছেন আরেক সাহসিনী—লোকরানী ঝলকারি বাঈ। অথচ তাঁর আত্মত্যাগ প্রমাণ করে দিয়েছে,পুরুষের কাঁধে যেমন বন্দুক ছিল,তেমনি নারীর বুকেও জ্বলছিল একই অগ্নিশিখা।
১৮৩০ সালের ২২ নভেম্বর, উত্তরপ্রদেশের ভুজনি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেন ঝলকারি। শৈশব থেকেই তাঁর বেড়ে ওঠা দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মধ্যে। কিন্তু এই প্রতিকূলতাই তাঁর সাহসকে আরও শানিত করেছিল। ছোটোবেলার এক ঘটনা যেন তাঁর ভবিষ্যতের আগুনকে আগেভাগেই ঘোষণা করেছিল—গরু চরাতে গিয়ে হঠাৎ জঙ্গলে এক বন্য চিতার মুখোমুখি হয় ছোট্ট ঝলকারি। অন্য বাচ্চারা পালিয়ে গেলেও তিনি লাঠি হাতে লড়ে ওঠেন চিতার সঙ্গে,আর অবশেষে তাকে পরাস্ত করেন। সেই দিন থেকেই গ্রামবাসীর কাছে তিনি হয়ে ওঠেন “বীরবালা”।
বড় হতে হতে তাঁর সাহস ও যুদ্ধদক্ষতা নজরে আসে ঝাঁসির রাজপ্রাসাদের। রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের সঙ্গে তাঁর বিস্ময়কর সাদৃশ্য ছিল। ভাগ্যের পরিহাসে,এই মিলই হয়ে ওঠে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য মুহূর্ত।
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ যখন ঝাঁসির দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছেছে, রাণী লক্ষ্মীবাই তখন ভীষণ সংকটে। সেই সময়ে ঝলকারি বাঈ রাণীর পোশাক পরে ঘোষণা দেন—“আমি ঝাঁসির রাণী।” ইংরেজরা ভুল করে তাঁকেই রাণী ভেবে ঘিরে ধরে,আর এই বিভ্রান্তির সুযোগে সত্যিকারের রাণী পালিয়ে গিয়ে সেনাদল পুনর্গঠনের পথ খুঁজে পান। ঝলকারির আত্মোৎসর্গই রাণীকে নতুন লড়াইয়ের সুযোগ এনে দিয়েছিল।
এক সাধারণ কৃষক পরিবারের কন্যা,নিম্নবর্ণের নারী—কিন্তু তাঁর বীরত্বে সমাজের সকল দেয়াল ভেঙে গিয়েছিল। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, স্বাধীনতার ময়দানে জাতপাত,বর্ণ বা লিঙ্গের কোনো বিভাজন নেই। দেশমাতৃকার টানে সবাই সমান,সবাই যোদ্ধা।
আজও আমরা রাণী লক্ষ্মীবাঈকে স্মরণ করি,কিন্তু ঝলকারি বাঈ রয়ে গেছেন কম আলোচিত। অথচ তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতার ইতিহাস নারীর রক্ত ও ঘাম ছাড়া অসম্পূর্ণ।
নারী শুধু ঘরের মশাল নন,দেশের মুক্তির অগ্নিশিখাও বটে।I
*************************
অজন্তা প্রবাহিতাঃ
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।