
“অচ্ছুৎ”
পারমিতা নিয়োগী
আমাদের কাছে আগে থেকেই খবর চলে আসে কোন বাড়িতে বিয়ে, কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে ইত্যাদি আর ঐ খবর আমাদের কাছে আনন্দের, আমাদের ভাত-রুটির ইনকামের খবর। খবর পেলেই সময় মতো পৌঁছে যাই সেই সব বাড়িতে কখনো ছেলে নাচাই, কখনো বা নিজেরা নেচে-কুঁদে পয়সা আদায় করি। দাবি মতো পয়সা না পেলে আবার শাপ-শাপান্তও করি ভয় দেখানোর জন্য। ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় না করলে আমাদের পেট চলবে কি করে? আমাদেরওতো ভালো-মন্দ খেতে, ভালো কাপড় পরতে, ভালো ভালো জায়গায় ঘুরতে আরো কতকিছু করতে ইচ্ছা করে।
কিন্তু সমাজ——
জানিনা আমাদের অপরাধ কি, কিন্তু সমাজ আমাদের একঘরে করে রেখেছে। নেতাদের সব বড় বড় লেকচার—কাজের কিছুই না। নেতাদের কথায় বা রাগ করি কেন, যারা জন্ম দিয়েছে তাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
আছে—-
কিন্তু ঐ–,সমাজ–,
সেই সমাজের ভয়ে বুকে পাথর বেঁধে, কান্না চেপে দশমাস সযত্নে তিলে তিলে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বড়ো করা আনন্দের ধনকে নিজের নাড়ীকে ছিঁড়ে অন্যের হাতে তুলে দেয় অসহায় বাবা-মা।
এমনি এক বাবা-মায়ের সন্তান আমি, অনেক কষ্টে বেশ কিছু বছর আমাকে লুকিয়ে রেখেছিল বাবা-মা। বাড়ির বাইরে বের হতে দিতনা। মা সবসময় যতটা সম্ভব কাছে রেখে দিত। মা নিজের হাতে খেলনা বাটি হাঁড়ি,কড়া,খুন্তি,পুতুল সব মাটি দিয়ে তৈরি করে দিত। একদিকে মা সংসারের রান্না করত আর আমি মায়ের দেখা-দেখি খেলনা-বাটি নিয়ে রান্না-রান্না খেলা করতাম। অবসর সময়ে মা নিজেই আমার সঙ্গে পুতুল নিয়ে খেলতেন, কখনো পড়াতেন আবার কখনো কখনো বাবাও পড়াতে বসতেন। বড়ো দাদা,পাড়ার অন্য ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখে বায়না করে মাঝে মাঝে কাঁদতাম তখন মা বলতেন তুই স্কুলে গেলে আমার কান্না পাবে আর ঐ কথা শুনে আমি আর বায়না করতাম না কারণ মাকে কাঁদতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হতো। কিন্তু কপালের লিখন-আমার তখন বয়স ৭-৮ বছর হবে বাড়ির সামনে বাঁদর খেলা দেখাতে এসেছে, আমি ছুটে চলে গেছি। খেলা দেখতে দেখতে আনন্দে হাততালি দিয়ে ফেলেছিলাম আর ওটাই আমার কাল হলো। মা তাড়াতাড়ি কোলে তুলে ভিতরে নিয়ে চলে গেলেও জানাজানি হয়ে গিয়েছিল আমার—–। তারপরদিনই বাড়িতে বড়মাসিরা চলে আসে। মা প্রথমে ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে আমাকে নিয়ে লুকিয়ে ছিল কিন্তু প্রায় গোটা গ্ৰামের লোক সেদিন আমাদের বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল। গ্ৰামবাসীদের একঘরে করে দেবার শাসানি,মাসিদের চিৎকার সব মিলিয়ে মা আর আমাকে ধরে রাখতে পারেনি। বড়মাসিরা টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে চলে এসেছিল পুরুলিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম রতনপুর থেকে। আমার সুখের পুতুল গুলো মা আমার সঙ্গে দেবার জন্য তাড়াতাড়ি এনে দিয়েছিল সেগুলো দেখামাত্র বড়মাসিরা রেগে গিয়ে পায়ে করে গুঁড়ো করে দিল “এসব মিথ্যে,এসব আমাদের জন্য নয়” বলতে বলতে। একে মাকে ছেড়ে আসার কষ্ট তার ওপর সখের পুতুল গুলো কে ঐভাবে ভেঙ্গে দিল চোখের সামনে।
ঝাপসা চোখে পিছন ফিরে আমি শেষ বার মাকে দেখেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে পরে মাথা ঠুকছে।
প্রথম প্রথম অনেক কেঁদেছি,তারপর চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেছে। অনেক গুলো বছর ঘুরতে ঘুরতে আমার জন্মস্থানের পাশের গ্রামে এসে বসবাস করতে শুরু করে আমাদের দলটি। আমি নিজেই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম নিজের গ্ৰামের নাম। হঠাৎ একটা খবর মনকে তোলপাড় করে দিল। পাশে রতনপুর গ্ৰামের সরকার বাড়িতে মানস বাবুর নাতি হয়েছে। খবরটা শুনেই বুকের মধ্যে কে যেন একটা ধাক্কা মারল।
হায় ভগবান—ঐ সরকার বাড়িরই সন্তান আমি,মানস আমার দাদার নাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম দাদার নাতি হয়েছে দিন দশেক আগে,বাবা গত হয়েছেন,মা আছেন। সারারাত যন্ত্রায় ছট্ফট করেছি। ছোটবেলার সেই সুখস্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মায়ের সাথে পুতুল খেলা, কোলে বসে আদর খাওয়া কতকিছু।
মায়ের সেই করুন মুখটা ভেসে উঠলো,কতো সাবধানে কষ্ট করে আমাকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখতো। সন্ধ্যায় তুলসী তলায় যখন প্রদীপ দিতো, তখন আমি মায়ের আঁচল ধরে পিছন পিছন যেতাম। রোজ দেখতাম,মা প্রনাম করছে আর কাঁদছে,তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রদীপের তাত দিত। আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না শুধু তাকিয়ে থাকতাম,আমারও কষ্ট হতো মাকে কাঁদতে দেখে।
বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে তবুও কাঁদতে পারছিনা। কালকেই যাওয়া হবে ঐ বাড়িতে,একাধারে আনন্দ,উত্তেজনা,ভয় সব মিলিয়ে এক অসহ্য যন্ত্রনা। মনে প্রশ্ন জাগছে,মা-কে দেখতে পাবো তো? একবার মনে হচ্ছে এখনি ছুটে যাই,পরক্ষনেই মন ভেঙ্গে যাচ্ছে,কি হবে—আমাকে তো সারাজীবন এইভাবেই কাটাতে হবে।
সকালে বড়মাসি সবাইকে বুঝিয়ে দিল সেখানে গিয়ে কে কি করবে, কিভাবে সকলকে খুশি করে মোটা টাকা আদায় করতে হবে। অনেকটা পথ,রওনা দিয়েও অজানা আশংকায় বার বার হোঁচট খেতে খেতে পৌঁছালাম।
বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে, অনেক বড়ো বাড়ির চেহারা নিয়েছে। আমরা পৌঁছাতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠলো যেন উৎসব লেগে গেল। অনেক দিন পর বাড়িতে পুত্রসন্তান অর্থাৎ বংশধর এসেছে, তার আনন্দ সারা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র আমার চোখ মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছু অচেনা মুখ,তার ভিতর চাতক পাখির মতো আমি আমার মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে একধারে একটি চেয়ারে আমার জন্মদাত্রী মা এসে বসলেন। বয়সের ভারে বেশ কিছুটা কাহিল ও অসুস্থ বোঝা যাচ্ছে। দেখে আনন্দে-উত্তেজনায় নিজেকে দিশাহারা লাগছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নাচ শুরু করলাম।
“মায়ের কোল আলো করে চাঁদ এসেছে ঐ
ওসখি তুই দেখতে এলি কৈ—”
যতই নাচি-গাই মন-প্রান মায়ের গায়ের সেই গন্ধ, ছোটবেলায় কোলের মধ্যে শুয়ে যে গন্ধ পেতাম সেই গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে। মায়ের দিক থেকে চোখ সরাতেও পারছিনা। মনের ভুল কিনা জানিনা,মনে হলো মাও যেন আমাকে লক্ষ্য করছে। এইভাবেই নাচ-গান শেষ হলো। পাওনা-গন্ডা আমাদের চাহিদা মতো বিনা বাক্যব্যয়ে দিয়ে দিয়েছে। এবার ফেরার পালা। তীব্র যন্ত্রনায় শুরু হলো বুকের ভিতর,অসহ্য যন্ত্রনায় বুকটা দুমরে-মুচরে যাচ্ছে। বড়মাসি তাড়াদিচ্ছে অনেকটা পথ ফিরতে হবে কিন্তু আমার পা যেন আটকে গেছে নড়তে পারছি না। আমার সহকর্মী লক্ষীর এক ধাক্কা–“ও মনা তোর হোল কি লো”।
ফিরে যাবার আগে অন্তত মাকে একবার প্রণাম করার ইচ্ছা ছিল,তাই তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে সবাই কে প্রণাম সেরে মায়ের পায়ের কাছে দূর থেকে প্রণাম করতে যেতেই মা উঠে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। সবাই হৈ হৈ করে চিৎকার করে উঠল।
আমি কোনোরকমে পিছিয়ে এসে বলতে লাগলাম—-,”না মা আমাকে ছুঁয়োনা,এই অবেলায় অসুস্থ শরীরে আবার তোমাকে চান করতে হবে–আমাকে ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা—আমি যে অচ্ছুৎ–আমি যে অচ্ছুৎ”।
*********************************************
পারমিতা নিয়োগী পরিচিতি
সঙ্গীত শিল্পী,শিক্ষক, পরীক্ষক।
সমাজ সেবা সাধ্যমত,
গল্প ও কবিতা লিখন মাঝে-মধ্যে।