অভিশপ্ত রাগিনী(প্রথম পর্ব)
রামানুজ দাশগুপ্ত
ওরা ছিল চারজন। ধরে নেওয়া যাক রাম-শ্যাম-যদু-মধু কারণ ওদের আসল নাম গুলোর অস্তিত্ব আজ আর নেই। অনেকদিন আগেই ধুয়ে মুছে গেছে।ওরা মিলেছিল শেষ পর্যন্ত একই জায়গায় যেমনটা হয়েছিল গুপী আর বাঘার।গুপী বাঘার গানবাজনা সবার কাছে কর্ণ পীড়াদায়ক ছিল তাই সমাজের লোক তাদের বের করে দিয়েছিল, তারপর ভূতের রাজার বর ও বাকি কথা তো সবারই জানা কিন্তু রাম শ্যাম যদুর গান-বাজনা তো একদিন ঘরে ঘরে সোনালী আলোর আবেশ তৈরি করত। তা সত্বেও সমাজ তাদের বার করে দিয়েছে। আজ কোথায় তারা? হয়তো বর্তমানকালের ইউ-টিউব সার্চ করলে তাদের দু চার খানা গান পাওয়া গেলেও যেতে পারে কিন্তু এখনকার কোন সঙ্গীতপ্রেমী কি তাদের মনে রেখেছে না তাদের নিয়ে আলোচনা করে থাকে! ওরা বেঁচে আছে কি মরে গেছে দু-চারজন ছাড়া কেউ জানেনা এই চারজনের মধ্যে ডঃ শম্ভুনাথ মিশ্র একজন যিনি। দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার এক মানসিক হাসপাতালে বদলি হয়ে এসেছেন।প্রথম দিন ডিউটিতে এসে দেখেন একজন রোগী বয়স বেশি নয় তিরিশের এর মধ্যেই হবে, প্রায় সবসময়ই দেওয়ালে কান লাগিয়ে কি যেন শোনার চেষ্টা করে। তার অধীনে যেসব রোগীরা ছিল এই রোগীটি তার মধ্যে ছিল না। কিন্তু কৌতূহলবশত একদিন ডঃ মিশ্র জিজ্ঞাসা করে বসেন, “কি শুনছো তুমি?” পাগল মুখে তর্জনী লাগিয়ে ইশারা করে, চুপ,কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। হিংস্র নজরে ডাক্তারকে দেখে তারপর প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে ,তারপর ভাঙা ও কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে বলে, “আমার গলার সুর তুমি কেড়ে নিয়েছো। লজ্জা করেনা জিজ্ঞাসা করতে- শুনে রাখো ওই দেওয়ালের মধ্যে আমার হারিয়ে যাওয়া গানকে আমি শুনতে পাই। যদি আমার সাথে শত্রুতা না করতে, তবে তুমিও শুনতে পেতে”।ডাক্তার মিশ্র সেখান থেকে সরে আসেন ডাক্তারের কেন জানিনা মনে হল এই ছেলেটি বোধহয় ভাল গায়ক ছিল। তিনি নিজেও একজন সঙ্গী প্রেমিক তার উৎসাহটা খুব বেড়ে গেল। ডাক্তার রায় এর আন্ডারে এই রোগীটি ছিল। তার কাছে কেস হিস্ট্রি টা জানতে চাইলেন ডাক্তার রায় বেশ কিছুটা সিনিয়ার। সেই কারণেই বোধহয় একটু ইগো প্রবলেম ছিল,তাই তিনি রাজি হলেন না কেস হিস্ট্রি দিতে।
রবি একজন ভালো তবলা বাজিয়ে অনেক নামী শিল্পীদের সাথে স্টেজে ও রেকর্ডিংয়ে বাজায়। ডঃ মিশ্র কয়েকদিন আগেই এক ঘরোয়া আসরে একজন বিশিষ্ট শিল্পীর সাথে সঙ্গত করতে দেখেছেন এবং মুগ্ধ হয়েছেন। একদিন রাতে ডিউটি চলাকালীন হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন।
সেই পাগলটি প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেছে, “আমার গান কোথায় হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে এনে দাও” ।এই বলে ভাঙা গলায় প্রচণ্ড চিৎকার করছে, কয়েকজন ওয়ার্ডবয় তার হাত-পা চেপে ধরে আছে এবং একজন নার্স তাকে ইঞ্জেকশন দিতে যাচ্ছে। এই ওয়ার্ডবয়দের মধ্যে একজনকে দেখে খুব চেনা লাগলো্ এবং কয়েক সেকেন্ড লাগলো চিনে নিতে। আরে এত তবলা বাজিয়ে রবি!একি করে সম্ভব! পাগল শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরলো ডাক্তার মিত্র রবিকে ডেকে পাঠালেন. তুমি এখানে ওয়ার্ডবয়ের কাজ করো তুমি না একজন ভালো তবলা বাজিয়ে !রবি একটু হাসির চেষ্টা করল সে হাসির মধ্যে কোন প্রাণ নেই। আজ দীর্ঘদিন ধরে সে হাসি-কান্নার জগত থেকে বাইরে, তার কোনো ভাবাবেগ সেরকম ভাবে কেউ দেখেনি, যবে থেকে সে এখানে কাজ করতে এসেছে।
তবে পাগলরা ক্ষেপে গেলে তখন তার অন্য চেহারা। গলা খুলে কাঁচা খিস্তি দেয়, দরকার পড়লে তাদের মারধরও করে। স্ত্রীর হার্টের গুরুতর অসুখ একদম শয্যাশায়ী জলের মতো টাকা খরচ হয়, দুই মেয়ে। তাদের পেছনেও অনেক খরচা। শুধু তবলা বাজিয়ে সে পয়সা একত্র করা যায় না ।বাবার সংসারের অবস্থাও ভাল ছিল না, অল্প বয়সে বাবা চলে যান ।ক্লাস এইট এর বেশি পড়া হয়নি সুতরাং এই কাজটাই ভবিতব্য ছিল এবং সে তা করে চলেছে একনিষ্ঠভাবে। ডাক্তার মিশ্রের দিকে তাকিয়ে জবাব দেন আপনি দেখেছেন আমাকে, তবে জেনে রাখুন গত কুড়ি বছর ধরে এই কাজ করে আসছি আর ছাড়তে পারিনি বাকিটা জেনে আপনার কোন লাভ নেই । নমস্কার। আর কিছু না বলে অন্য দিকে চলে যায়। ডাক্তারের কৌতূহল আরও বেড়ে চলে।
ওদিকে মধ্য কলকাতার এক বনেদি বাড়ির ছেলে দিব্যপ্রেম। সবাই জানত খুব ভালো সুরকার ।গোটা দুয়েক ছবিতে সুরও দিয়েছিল ,নাম হচ্ছিল, তবে তখনও তেমন করে পয়সার মুখ দেখেনি। বাড়ির ছাদটা আর যৌথ পরিবারের খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতোই মিলতো। মাকে ছেলেবেলাতেই হারিয়েছে হঠাৎ করে বাবা মাস দুয়েক আগে গত হলেন। বাড়িতে তিন দাদা আর বৌদি। বাবা মারা যাবার পর থেকেই তারা কেমন যেন অদ্ভূত আচরণ শুরু । বছর দুয়েক আগে অনিরুদ্ধর লেখা গান, তার সুরে রঙ্গনাথ মুখার্জীর গলায় কলকাতা তথা সারা বাংলার আকাশ বাতাস ভরিয়ে দিয়েছিল।এরপর ভালো সুযোগ পেয়ে মুম্বাই চলে যায় সেখানে গিয়ে ও সফলতার প্রাথমিক মুখ দেখেছিল। দিব্য আর অনিরুদ্ধ চায়নি রঙ্গনাথ চলে যাক ।সে চলে যাওয়াতে তাদের টিমওয়ার্কটা বেশ ঢিলে হয়ে গিয়েছিল এরপর রঙ্গনাথ হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন সেলফোনের এত রমরমা বাজার শুরু হয়নি তবে নেট চালু হয়েছিল।
ই-মেলেই তাদের বার্তালাপ হত। রঙ্গনাথের একটা গান তখন সারা ভারত জুড়ে হিট। কিন্তু শেষ ই-মেইলটাতে দিব্য জানতে পারে রঙ্গনাথের পেছনে শত্রু লেগেছে, দিব্য তাকে কলকাতায় চলে আসতে বলে । আবার তারা একসঙ্গে কাজ করবে। কিন্তু এরপর আর কোনো ই-মেল আর আসেনি,আর রঙ্গনাথ, সেই সময় থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়। আসলে সেই সময় থেকেই দিব্য আর অনিরুদ্ধর জীবনে এক নাটক শুরু হলো, তাই আর তারা রঙ্গনাথের কথা জানতে পারেনি।
——————————————————————
অভিশপ্ত রাগিনী (দ্বিতীয় পর্ব)
রামানুজ দাশগুপ্ত
দিব্যর বড় দাদা একদিন তাকে ডেকে বাবার উইল দেখালো। বাবা বাড়ির একখানা ঘরও তার নামে নাকি লিখে দিয়ে যাননি। বড়দা বলে,” শোন, শুধু তো গান বাজনা নিয়েই পড়ে রইলি। তিন পুরুষের ব্যবসা, কটা দিনই বা ব্যবসার কাজে মাথা ঘামিয়েছিস? বাবা-ই ঠিক করে গেছেন সব”। দিব্য ভাবে, এটা কি করে সম্ভব! বাবার প্রেরণা আর উৎসাহতেই গান বাজনার জগতে আসা। বাবা-ই তো একদিন বলেছেন ব্যবসা দেখার জন্য তো ওরা আছে তুই তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা কর। আমি তো আছি মাথার ওপর। বাবা তাকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িও কিনে দিয়েছিল। সেই বাবা তাকে একখানা ঘরও দিয়ে যাননি, এটা কি করে সম্ভব ! দিব্য চুপ করে বসে থাকে। বড়দা বলেন, “শুনছি তো বেশ নামডাক হচ্ছে। পয়সাও নিশ্চয়ই ভালো কামাস।কটা পয়সা সংসারে দিয়েছিস ? যাক,একটা কথা শুনে রাখ, ছয় মাস সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে বাড়ির একটা সামান্য অংশ যদি কিনে নিতে পারিস তো ভালো হয় । নয়তো অন্য রাস্তা দেখে নিতে হবে তোকে।
– অন্য রাস্তা মানে বুঝলাম না ।
একটু গলার স্বরটাকে উঁচু করে চিবিয়ে চিবিয়ে বড়দা বলে, “এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও উঠতে হবে”।
– বাবা আমাকে একদম বঞ্চিত করে যাবেন এ কথা আমি বিশ্বাস করি না তাছাড়া বাবা থাকাকালীন তো এসব কথা হয়নি !
– তাহলে কি বলতে চাস আমরা মিথ্যেবাদী ? ঠিক আছে, আইন-আদালতের পথ খোলা আছে , সেখানে যেতে পারিস।
দিব্য কিছু বলে না, মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে বুঝতে পারে দাদা বৌদিরা বাবার দলিল নিয়ে জালিয়াতি করছে। আদালতের দরজার কড়া নাড়া তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। কিছুক্ষন মাটির দিকে তাকিয়ে রইল, বুঝতে পারল একেই বলে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া। আত্মীয়স্বজন কেউ এই অবস্থায় তার পাশে এসে দাঁড়াবে না।কারণ, তার অপরাধ সে ব্যবসা না দেখে গান-বাজনা নিয়ে পড়ে আছে এবং সে ভাবে এখনো সাফল্য লাভ করতে পারেনি। বন্ধু বলতে দুজন তার মধ্যে রঙ্গনাথের কোন খবর নেই, অনিরুদ্ধর অবস্থাও তথৈবচ। তার পরদিন সকালে উঠে ও অনিরুদ্ধর বাড়িতে গেল। অনিরুদ্ধ বলছিল বটে, সে একজন প্রডিউসার পেয়েছে যে তাদের হয়ত একটা কাজ দিতে পারে।
অনিরুদ্ধ গান লেখে তাছাড়া একটা প্রাইভেট স্কুলে বাংলা পড়িয়ে আর গুটিকয় টিউশনি করে মোটামুটি চলে যায় । বেলেঘাটার কাছে একটা ভাড়ার ফ্ল্যাটে থাকে। বছরখানেক আগে ভালোবেসে সুন্দরী স্বাতীকে বিয়ে করেছে । কয়েকটা মাস ভালোই চলছিলো । কিন্তু তারপরই স্বাতীর নানা রকমের চশিদা বাড়তে শুরু করলো। অনিরুদ্ধ আর পেরে ওঠে না। এর মধ্যে ঘটনার সূত্রে মিস্টার ভিমানি নামে একজন বড় ব্যবসায়ী, যে ইদানিং ফিল্মের জগতে টাকা ঢালতে শুরু করেছে, তার সাথে অনিরুদ্ধর আলাপ হয়। ভিমানি একটু আশা দিয়েছিল অনিরুদ্ধকে যে সে তাকে কাজে লাগাতে পারে। এই কথা সে বন্ধু দিব্য কে বলেছিল । দিব্য সকালে এসে অনিরুদ্ধর বাড়ি হাজির হয়ে সব কথা বলে দুজনে মিলে ভিমানির কাছে ঘোরাফেরা শুরু করে। ভিমানি শেষ পর্যন্ত তাদের কাজটা দেয়, অনিরুদ্ধ তখনো জানতে পারেনা এই কাজটা পাবার পেছনে কী রহস্য কাজ করছে ……
——————————————–
অভিশপ্ত রাগিনী (তৃতীয় পর্ব)
রামানুজ দাশগুপ্ত
ভীমানি একটা সাইনিং মানি তাদের হাতে দেয়,তারা যেন হাতের কাছে চাঁদ পেয়ে যায়৷ টাকার বান্ডিলটা নিয়ে বড়দার কাছে আসে,”দাদা এই টাকাটা আজ একটা নতুন কাজের জন্য পেলাম৷ তুমি এটা রাখো৷” কিন্তু বড়দা টাকাটা এক নিমেষে গুনে নিয়ে বলে,”ছ্যা ছ্যা এই টাকায় তো বাড়ির একটা বাথরুম ও হবে না রে!” “আমি জানি দাদা,ভগবান চাইলে আমি আরো টাকা এনে দেবোI” “রাখ তোর ভগবান,তোদের মতো অকাজের মানুষের জন্য ভগবান নেই,আমি তোকে তিন মাস সময় দিলাম৷ না হলে নিজের পথ দেখে নিবি৷ “দিব্য বাবার দেওয়া সাধের গাড়িটা বেচে দিল,সামান্য টাকায়,কিছু দিনের জন্য তো হাত খরচা চালাতে পারবে৷ কাজও শুরু করে,দুখানা গানের রেকর্ডিংও হয়ে যায়৷ নতুন একটা ছেলেকে দিয়ে গান গাওয়ানো হলো,ভীমানি তাকে প্রথম ব্রেক দিল৷ যদিও ওরা তার গাওয়াতে খুব একটা খুশী হলো না,রঙ্গনাথকে ওরা খুব মিস করছে যে শুধু তাই নয়,রেকর্ডিং এ রবি কে ডেকেছিল বাজানোর জন্য,রবি যথারীতি গম্ভীরভাবে এলো,বাজালো,আর যাবার সময় যা বলে গেল তাতে দুজনেই খুব ভেঙ্গে পড়লো৷ রঙ্গনাথ পাগল হয়ে মুম্বাই থেকে ফিরেছে,তাকে জুহুর সি বিচে মৃতপ্রায় অবস্থায় পুলিশ আবিস্কার করে৷ ঘটনায় জানা যায় প্রসিদ্ধ সঙ্গীত পরিচালক য়শপাল সিং তাকে দিয়ে দু খানা গান গাইয়েছিলেন তার মধ্যে একটা গান খুব হিট করে সারা ভারতে৷ সমসাময়িক আরেকজন উঠতি গায়ক ষড়যন্ত্র করে ড্রিংকসের সাথে বিষ দেয়,কোনমতে প্রাণ বাঁচলেও গলাটা একদম নষ্ট হয়ে যায় ও একদম উন্মাদ হয়ে যায়৷
বাবা খবর পেয়ে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসেন,তারপর এই অ্যাসাইলামে৷ পরদিন ওরা দুজন যায় তাকে দেখতে,রঙ্গনাথ হয়তো ওদের চিনতে পেরেছিল,ওদের দেখে বলে,”আমার কাছে বোসের সাউন্ড সিস্টেম আছে দেওয়ালে ফিট করা,আমার নতুন গান শোনাই তোদের আয়৷ “দিব্যর চোখে দুফোঁটা জল,ফিরে আসে ওরা৷
ভীমানির ফরমাস মতো আরো দুটো গান রেকর্ড হবে,তারপর হয়তো আরো কিছু টাকা পাওয়া যাবে৷ ভীমানি তার অফিসে একটা ঘর দিয়েছিল,সেখানে বসেই ওরা কাজ করতো৷ সেদিনও তারা দুজন বসেছে,অনিরুদ্ধও ঠিক মতো লিখতে পারছে না আর দিব্যর মাথায় তো কোন সুরই আসছে না৷ এরমধ্যে দিব্যর শরীরটা খারাপ হয়ে উঠলো,গা টা গুলিয়ে বমি এল,অনিরুদ্ধ বলল,”চল,বাড়ি ফিরে যাই,একটু বিশ্রাম দরকার৷”
অনিরুদ্ধ সাধারণত রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরে না৷ সেদিন চারটের মধ্যে ফিরে এল,কিন্তু বাড়ি এসে যা দেখল এক মুহুর্তে সমস্ত ছবিটা তার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল৷ বুঝল কেন এই হাই বাজেটের ছবি এক কথায় ভীমানি তাদের দিয়েছিল৷ ভেতর থেকে দরজা লক করা ছিল না,চাবি ঘুরিয়ে ল্যাচ টা খুলতেই দেখে স্বাতী ভীমানির সাথে অতি অন্তরঙ্গ অবস্থায়,অনিরুদ্ধের হঠাৎ এসে পড়ায় ওরাও হতচকিত৷ অনিরুদ্ধের মুখে কোনও কথা নেই,বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর দুজনকে দেখে যাচ্ছে,কয়েক সেকেন্ড পর ভীমানি বলে,”তুমি কিছু দেখনি অনিরুদ্ধ, কিছুই হয়নি, সব ভুলে যাও,কালই তোমার নতুন গাড়ি এসে যাবে আর ছবি শেষ হলেই একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট,আর তোমার বন্ধুর প্রবলেমও সলভ্ড| “অনিরুদ্ধ আরো জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে,হঠাৎ করে নজর পড়ে স্বাতীর গলার দামি নেকলেসটার ওপর,ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর,স্বাতী টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়,মাথাটা জোরে ধাক্কা খায় একটা লোহার টেবিলে,সাথে সাথেই প্রবল রক্তপাত সাথে অজ্ঞান| অনিরুদ্ধ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভীমানি বাইরে বেরিয়ে যায়,অনিরুদ্ধ আস্তে আস্তে নীচু হয়ে স্বাতীকে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না৷ দশ মিনিটে ভীমানি ফেরে,সাথে ডাক্তার,ডাক্তার বলে সব শেষ৷ অনিরুদ্ধ একই ভাবে স্বাতীর পাশে বসে থাকে,এত অল্প সময়ের মধ্যে কি যে ঘটে গেল বুঝে উঠতে পারে না৷ আরো ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাইরের লক খুলে ভীমানি ঘরে ঢোকে,সাথে পুলিশ| হাত কড়া পরিয়ে অনিরুদ্ধকে ভ্যানে তোলা হল,আর আরেকটা গাড়িতে স্বাতীর ডেড বডি।
দিব্যকে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছাড়তে হল,গিয়ে উঠল একখানা বস্তির ঘরে| যাবার আগে অনিরুদ্ধর বাড়ি এসেছিল, এসে দেখে তালা বন্ধ,পাশের ফ্ল্যাটের লোকের কাছে সব ঘটনা জানলো,মাথাটায় হাত দিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে রাস্তায় নামল,দু দিন দু রাত রাস্তায় উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরা ঘুরি করছিল,এক কাঁধে একটা ব্যাগ অন্য কাঁধে গিটার৷ মাঝরাতে পুলিশে ধরল,কেন জানি না পুলিশ পাহারাদার তার কথা একটু খানি শুনে কি মনে করল,এক বস্তির একটি ঘরে অস্থায়ী থাকার বন্দোবস্ত করে দিল৷
কোর্টের শুনানির দ্বিতীয় দিনেই বোঝা গেল অনিরুদ্ধ পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে,সুতরাং মামলা সেখানেই স্থগিত এবং যেহেতু তার কাছের কোন মানুষের সন্ধান সেভাবে পাওয়া গেল না,তাকে স্থানান্তরিত করা হোল সেই অ্যাসাইলামে যেখানে রঙ্গনাথ বোধহয় তার পথ চেয়ে বসে ছিল৷ দুজনেই বোধহয় দুজনকে চিনতে পারলো,একে অন্যকে জড়িয়ে সে কি অট্টহাসি,রবি ছুটে এসে কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে সেও সেই হাসির আসরের সামিল হয়ে গেল৷ যে মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে রবি কাটাচ্ছিল তাতে মনের মাঝে বানের জল প্রায় বাঁধ ভাঙতে যাচ্ছিল,এবার পুরোপুরি ভেঙে গেল,রবি ওয়ার্ড বয় থেকে পেশেন্ট হয়ে গেল। দিব্য প্রায় সারাদিনই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত,নাওয়া খাওয়ার পাট প্রায় চুকেই গিয়েছিল৷ কখনও হয়তো মুড়ি বাদাম খেয়ে কোথাও থেকে জল খেয়ে নিতো৷ একদিন সন্ধ্যাবেলা বর্নালী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখে নতুন ছবির রিলিজ “নতুন যুগের আইকন”৷ চমকে উঠল,আরে! এই ছবিতেই তো অনিরুদ্ধ আর সে কাজ করছিল৷ ওই তো লেখা ডিরেক্টর প্রডিউসার রমেশ ভীমানি,ছবি শুরু হতে দেরি,পকেটে যা টাকা ছিল তা দিয়ে একটা টিকিট কিনল৷ ছবি শুরু হল৷ টাইটেলে গীতিকারের নাম এল শরৎ ঘোষ এর আর সঙ্গীত পরিচালনায় বুবাই পাল৷ কিছুক্ষণ বাদে যখন সেই আইটেম সং টা এলো “এ যুগের আইকন লোড করো মগজে”। অনিরুদ্ধের লেখা আর তার সুর,জনতা হাততালি আর সিটি বাজাতে লাগলো,মনে হল তাদের হৈ চৈ তে বোধহয় হলের ছাদটা উড়ে যাবে৷ দিব্য নিজেকে আর সামলাতে পারলো না৷ “শুয়ারের বাচ্চা! চোর! আমাদের পেটে লাথি মেরে রুবাবি দেখাচ্চ”,প্রচন্ড জোরে আরো গালি,আরো কিছু বলতে লাগলো,স্বাভাবিক ভাবে জনতা গেল ক্ষেপে,কেউ তার আসল কথা শোনে না,কয়েক জন মিলে এলোপাথাড়ি মার দিয়ে ধাক্কা মেরে হলের বাইরে ফেলে দিল,কাঁধের গিটারটা ভেঙেচুরে রাস্তায পড়ে রইল,সেই অবস্থাতেই গালি দিতে দিতে এক সময় জ্ঞান হারালো। কয়েক দিন বাদে এক সমাজ সেবী সংঘের কয়েক জন যখন তাকে আবিস্কার করল,তখন সে হা হা করে হাসছে,ভাঙা গিটারের একখানা টুকরো বুকে আগলিয়ে ধরে আছে৷
ঘটনাক্রমে তারও সেই একই জায়গায় স্থান হল,চার বন্ধু আবার একসাথে৷ এখন আর তাদের আর কোনও দুঃখ বা অভিযোগ কিচ্ছু নেই৷ ওরা আবার নিজেদের মধ্যে সৃজনশীল জগৎ তৈরি করে নিত্যি নতুন গান বাঁধে৷ রঙ্গনাথ ভাঙা গলায় কাল্পনিক মাইকের সামনে গায়,রবি হাতের সামনে যা পায় তার মধ্যেই তালের তরঙ্গ তোলে৷ ওরা এখন খুব ভাল আছে৷ ডঃ মিশ্র মাঝে মাঝে এসে শ্রোতার স্থান নিয়ে বসেন৷
********************************************
রামানুজ দাশগুপ্ত :
শ্রী রামানুজ দাশগুপ্ত একজন বিশিষ্ট গায়ক,সুরকার ও বহুমুখী সঙ্গীত প্রতিভার অধিকারী। শাস্ত্রীয় সংগীত, ভজন, গজল, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, শ্যামা সংগীত থেকে আধুনিক গানের মাধ্যমে তাঁর প্রতিভা প্রকাশিত হয়। তিনি দীর্ঘদিন মুম্বাইতে প্রবাসী ছিলেন । দূরদর্শন কলকাতায় মিউজিক ডাইরেক্টরের পদ সামলেছেন। পরবর্তীকালে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ডিভিশন অফ ইন্ডিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়াও প্রখ্যাত মিউজিক ডাইরেক্টর আর ডি বর্মন, স্বপন চক্রবর্ত্তী ,শ্রীধর ফার্কে, রঘুনাথ শেঠ এর পরিচালনায় গান গেয়েছেন। রামানুজ মহাশয় এর সংগীত পরিচালনায় মহম্মদ রফি সাহেব, হৈমন্তী শুক্লা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অনুপ জালোটা, অনুরাধা পড়োয়াল, সুরেশ ওয়াডকর, রুনা লায়লা, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির মতো স্বনামধন্য গায়ক–গায়িকারা গান গেয়েছেন। আমেরিকার নিউ জার্সির মেয়র শ্রী দাসগুপ্তকে ২০০০ সালে ” THE CITATION ” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং ২০১৫ সালে নজরুল একাডেমী তাঁকে ” নজরুল পুরস্কার ” প্রদান করে।