Shadow

শিউলি সুরভি রাতে – মধুমিতা মিত্র

শিউলি সুরভি রাতে

মধুমিতা মিত্র

 

শ্রাবণের শেষ ভাগে জন্ম মেয়েটার, নামটা শ্রাবণী না হয়ে বাবা পিসীদের শখে হলো একটা আধুনিক নাম সেই নামের সৌন্দর্যও গেল আধুনিকতার জোয়ারে ভেসে, চারিদিকে খালি সেই নামের‌ই ছড়াছড়িসে যাই হোক শ্রাবণ মাসে জন্ম হ‌ওয়ায় একটা লোকসান মেয়েটার, মায়ের কায়দায় প্রতি বছর মায়ের দেওয়া জন্মদিনের আর পূজোর জামা হতো একটাইমায়ের যুক্তি শ্রাবণের পর ভাদ্র পেরিয়েই আশ্বিন, তাই জন্মদিনে নতুন জামা একবার পরে তুলে রাখলে সে জামা নতুন‌ই থাকে, আর পূজোর সময়তেই সে জামা নতুন হিসেবেই পরা যায় তখনকার দিনে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে এমন রীতিই প্রচলিত ছিলবাহ্যাড়ম্বরকে যথাসম্ভব গুরুত্বহীন করে রাখাকলকাতার উপান্তে ভারী খোলামেলা রেলকলোনীতে ছিল এই মেয়েটির বাস সামান্য ছোট সহোদর তার সর্বক্ষণের সাথীমা বাবা কর্মস্হলে বেরিয়ে গেলেই ভাই বোন দুটি কেমন পাখনা মেলে উড়ে বেড়াতো রেলকলোনীর পথে ঘাটে মাঠেপথ ঘাট মাঠ‌ও থ‌ই থ‌ই করতো যেন চারি পাশেযত না বাড়ী, চারিদিকে নানান আকারের মাঠ, পীচ ঢালা-মোরাম ঢালা রাস্তার ছড়াছড়িসেই মাঠগুলিতে, রাস্তায় বিরাট বন্ধুবাহিনী নিয়ে চলতে এদের দৌরাত্ম্যকখন‌ও বড়ো মাঠে কাবাডি, মাঝারি মাঠে ক্রিকেট, ছোট মাঠে পিট্টু-উঁচু বিল্ডিং গুলি নিয়ে আইস পাইস, দৌড়ো দৌড়ি হুড়োহুড়ির অন্ত ছিল না যেনবাড়ি থাকলেই বিকেল হতেই শুরু হয়ে যেত হাঁকডাক-চিৎকার পেয়ে, এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে সব এসে জমা হতো কোনো ফাঁকা মাঠ বা কোন‌ও এক রাস্তায়সেখান থেকেই প্ল্যান তৈরি কি খেলা হবে, কোথায় খেলা হবে, কে কোন দলে থাকবে, কে দুধভাত হবে-এই সব আর কি স্বাধীনতার আগেই এ রেল কলোনীর পত্তন, তাই পুরোনো ধাঁচের বাড়ি, বাংলোর সাথে হাল আমলের বিল্ডিং ছিল মেলানো মেশানো এই রেল কলোনীতে পুরোনো সময়ের বেশ অনেক জায়গা নিয়ে বৃহৎ মাপের বড়ো বড়ো বাংলো ছিল ঐ রেলকলোনীতেএমন‌ই একটি বাংলো ছিল মেয়েটির বাড়ির একদম পাশটি ঘেঁষেই ওদের বাড়ির পশ্চিমে রেলকলোনীর বুক চিরে তার মূল রাস্তাফুট তিরিশেক চ‌ওড়া, দুপাশের ঘাস জমি নিয়ে আরও ফুট পাঁচ সাত বাদ দিয়েই বাংলো বাড়ির বিশাল বড়ো চৌহদ্দীএ্যাসবেস্টস ছাওয়া ঐ বিশাল বাংলোর দুপাশে অজস্র জায়গা তাতে বিশাল বট, অশ্বত্থ নিমের গাছ, আম, জাম, ফুলের মধ্যে কাঠচাঁপা কামিনী আর আছে বেশ মোটা গুঁড়ির এক শিউলি গাছ, তাতে শুঁয়োপোকারা সারাটা বছর‌ই কেমন লেপ্টে থাকে অনেক পুরোনো বট গাছ বাংলো বাড়ীর পিছনে তার অজস্র ঝুরি নামিয়ে যেন ধ্যান মগ্ন সেখানে গেলেই কেমন গা ছমছম করেএই বাংলো বাড়িটিও বাচ্চা বাহিনীর খেলবার এক আস্তানা দুপুর বেলা এখানে চলে মহিলা সমিতির সেলাই ক্লাস, কখনও কখনও কলোনী আবাসিকদের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে এ বাড়িটি হয়তো নামমাত্র ভাড়ায় লোকেরা বাড়িখানি ব্যবহার করে বিকেল বেলায় বাগান বাড়ির বাগানে থাকে না শূণ্যপাঁচিল ডিঙিয়ে, গেট টপকে কুচো বাহিনী বুকে পড়ে বাগানে, বাগান হয়ে যায় খেলার প্রাঙ্গন কিন্তু সন্ধ্যে নামতে নামতেই উঁচু গাছের ছায়ার ফাঁকে পেছনের বড়ো বারান্দার ওপাশ থেকে অদেখা আবছায়া ছায়া ছায়া কল্পনার আভাস পাওয়া যায়, তাই সন্ধ্যার পূর্বাভাসেই কুচো বাহিনী আবার পাঁচিল গেট টপকেই পলয়ানপর হতে দ্বিধা করে না মেয়েটার বাড়ির সাথে ঐ বাংলোর তফাৎ হল একটা রাস্তার মাঝখানে তিরিশ ফুটের রাস্তাটা বাংলো বাড়িটাকে আলাদা করেছে মেয়েটার বারো নং বিল্ডিং থেকেগ্ৰীষ্মে ফোটে কাঠচাঁপা, বাগান বাড়ির থেকে পশ্চিমের হাওয়া এনে দেয় সেই খবর বর্ষায় কামিনী ফুলের গন্ধে ওদের ১২এ ফ্ল্যাট ম’ম বর্ষা শেষের কোনো বৃষ্টি না ঝরা বিকেলে বাগান বাড়িতে  খেলতে খেলতে হঠাৎ চোখে পড়ে শিউলি গাছের ছোট মুকুলিত একটি কুসুম আর চারপাশে আরও কুঁড়িরব উঠলো শিউলি ফুল এসে গেছে—-পূজোও এলো বলে…..সন্ধ্যেবেলায় পড়ার টেবিলে বসে দুই ভাই বোন যেন পায় সেই প্রতিক্ষিত সুবাস, দিন যায়, সূর্যের রোদ অনেকটাই ঘুরে এসেছে দক্ষিণের জানলায়, সন্ধ্যে বেলার সেই সৌরভ যেন আরও ভারী, বাতাস‌ও ভারী শিশির পড়ার শব্দেপ্রতিটি সন্ধ্যেয় পড়ার টেবিলের আকর্ষণ কেন যে বাড়ে! ঐ শিশির পড়ার শব্দ শোনার জন্য নাকি শিউলি ফুলের গন্ধ বুক ভরে নেওয়ার জন্যপ্রতি দিন মনে হয় পূজো আরও একটা দিন এগিয়ে এলো। স্কুলের চাপ না থাকলে দুই ভাই বোন কাকভোরে চুপিসারে উঠে এক দৌড়ে পৌঁছে যায় ঐ শিউলিতলায়,মা বাবা তখন ঘুমের দেশে,বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে, হাতে বেতের সাজি নিয়ে, এ যেন তাদের দুজনের অন্য রূপ ভিন্ন আনন্দ সেখানে জড়ো হয়েছে আরও অনেক, কেউ বা ওদের‌ই মতো, কেউ বা বয়সে অনেকই বড়ো হয়তোতাতে হলো টা কি? আধো অন্ধকারে ফিকে আলোয় চলে ফুল তোলাসাদা কমলায় বিছানো গালিচা পাৎলা হতে থাকে ফিসফিস গুণগণ গল্পের শব্দে হাসির চাপা আওয়াজের মধ্যে দিয়েই ভরে ওঠে ফুলের সাজিগাছতলা ফাঁকা হলেই আবার গাছের ডাল ধরে টান পড়লো কিছু ফুল, আর কিছু পাতাআলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে নিঃশেষ গাছের ফুল

মহালয়ার পর থেকেই ছুটির আমেজ শুরু হয়ে যায়শিউলি সুরভিত প্রতিটি সন্ধ্যেই নিয়ে আসে পরের দিন ভোরের সন্দেশপড়ার টেবিল ছেড়ে মাঝে মাঝেই দুই ভাই বোন জানলার গরাদের নিজেদের মুখ চেপে আরও গভীর নিঃশ্বাস নিতে নিতে আগমণী আনন্দে ভেসে যায়, মাঝে মাঝেই তাদের মা এসে তাঁর ছোটবেলার পূজোর গল্প শোনান তখন পূর্ণ হয় আগমণী ধ্বনি শোনাষষ্ঠীর সকাল থেকেই পূজোর মজা শুরু, এখন খালি নিজেদের আনন্দে ফুল তোলা নয়, পূজো প্যান্ডেলের ফুলের দায়িত্বে ফুল তোলাকিছু ফুল যাবে পূজোর ডালায় কিছু ফুল মালা হয়ে শোভা পাবে মায়ের গলায় হ্যাঁ, মালা গেঁথে নিয়ে যাওয়া প্যান্ডেলে সে ও এক মহা দায়িত্ব আর বিশেষ আনন্দভাই বোন দুটিতে মিলে ফুল তুলে মালা গেঁথে দৌড়োয় পূজো প্যান্ডেলেচলে বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা কে কতটা ফুল তুলেছে, কত বড় মালা গাঁথা হল তা নিয়েএরপর প্রধান সেরে নতুন জামা পরে সারাদিন পূজো মন্ডপে; চোখের পলকে কেটে যায় ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমীমাকে কৈলাসে র‌ওনা করে দিয়ে সবার‌ই মন ভারী, সেই ভারী মন হাল্কা হয় বিজয়ার আনন্দে, নারকেল নাড়ুতে আর ঘুগনীর মটরে একাদশীর সকালে যখন শিউলি তলায় এসে দাঁড়ায় দুজনায় চুপটি করে, শিউলি ফুল গুলিও কেমন জানি ম্লান, তারাও এত কমে গেল কেন? মায়ের আসা যাওয়ার সাথে কি তাদের আসা যাওয়া? আবার শুরু হয় পরের বছরের প্রতীক্ষা
এমনি করেই বছরের পর বছর পার হয়ে কেটে গেছে কত শরৎকাল, কত শিশির ঝরা সন্ধ্যা, শিউলি সুরভিত সন্ধ্যা গড়ানো রাত, প্রত্যুষের সেই সাদা কমলা বিছানো শিউলি তলাসময়ের সাথে রেলকলোনীর সেই বাংলোবাড়ীর সেই শিউলি সৌরভ, ভোরের প্রস্ফূটিত শিউলি তলা আজ হারিয়ে গেছে-জীবনের ওঠা পড়ায় শরৎ সন্ধ্যা, শরৎ প্রভাত নিয়েছে অন্য রূপ, অন্য মহিমা, বয়ে এনেছে যেন ভিন্ন সৌরভ জীবনের প্রায় উপান্তে পৌঁছে প্রৌঢ়া মহিলা খুঁজে চলেছে বাল্যের সেই শিশির ঝরা সন্ধ্যা, জানলার গ্ৰীলে দুই ভাই বোনের মুখ চেপে নেওয়া ঐ শিউলি সৌরভ, ঝরে পড়া সেই শিউলি প্রভাতনা-হারিয়ে তারা যায় নিআছে যেন কালের ওপারে আর আছে মনের মণিকোঠায়।।
————————————————

This image has an empty alt attribute; its file name is --150x150.jpg

মধুমিতা মিত্র পরিচিতি
পেশা–স্বপ্ন দর্শন, স্বপ্ন গুলোই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা–আনন্দ চয়ন, জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল, বোঝা, দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম-রবীন্দ্রনাথ, উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!