একটি উপন্যাস ও বর্তমান বিশ্ব
আশিস দাস
জীবন থেকেই উঠে আসে গল্পের চরিত্র। জীবনের নানা ঘটনারই চিত্ররূপ দেখা যায় সিনেমায় বা নাটকে, কিন্তু যদি দেখা যায় যে গল্পের চরিত্ররা হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে অথবা যদি দেখা যায় জীবনের রঙ্গমঞ্চে কল্পিত কাহিনীর পুনরাভিনয়, তাহলে সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।
আজ সারা পৃথিবী ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এই ভাইরাসের আক্রমনে চীন দেশ বিপর্য্যস্ত, দেশ জুড়ে মৃত্যুর মিছিল। চীনের উহান শহরে এই রোগের সূত্রপাত এবং ক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। 2019 এর December এ প্রথম এই রোগ ধরা পড়ে এবং সেই থেকে স্তব্ধ চীন। এই রোগের সেবা করতে গিয়ে বহু স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। যে চিকিৎসক প্রথম এই বিপজ্জনক ভাইরাসের সন্ধান দিয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে তাঁরও।
বিখ্যাত নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আলবেয়ার কাম্যু তাঁর “দ্য প্লেগ” উপন্যাসে মহামারীর ভয়ঙ্কর রূপের ছবি দিয়েছেন। ওই উপন্যাসে বর্ণিত সব ঘটনার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর বিশেষ সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় ।
এই উপন্যাসে ফরাসী অধিকৃত আলজিরিয়ার ওরান শহরে একদিন হঠাৎ ইঁদুরের মৃত্যু লক্ষ্য করা গেল। একদিন Dr. Bernerd Rieux প্রথম খেয়াল করলেন একটি ইঁদুরের মৃত্যু, তারপর তিনি নিজের চোখেই দেখলেন আরো কয়েকটি ইঁদুরের অস্বাভাবিক মৃত্যু। প্রতিদিন ইঁদুরের মৃত্যু বেড়েই চললো। ইঁদুরের মৃতদেহে ভরে গেল ডাস্টবিন। Dr.Rieux প্রথমেই অনুমান করলেন যে এটা প্লেগ, তিনি তাঁর অনুমানের কথা অনেককেই জানালেন কিন্তু কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করলো না। কয়েক হাজার ইঁদুরের মৃত্যুর পর মানুষের মধ্যে দেখা দিল এই রোগের প্রকাশ।
Dr.Rieux একই ভাবে বলে যেতে লাগলেন যে ভয়ঙ্কর ধরনের বিউবনিক প্লেগ মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে কিন্তু শহরের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কোনোমতেই প্লেগ শব্দটি উচ্চারণ করতে রাজি নয়, কর্তৃপক্ষ ম্যালিগন্যান্ট ফিভার বা ক্ষতিকারক জ্বর এর বেশি কিছু বলতে চাইলো না।
খৃষ্টীয় সমাজ থেকে Father Paneloux বললেন যে মানুষের পাপই এই রোগের কারণ। ভালোমানুষের কোনো ভয় নেই, খারাপ লোক কে শাস্তি দেবার জন্যেই ঈশ্বর এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। Father Paneloux আরও বললেন, দোষী দের শাস্তিবিধানের উদ্দেশ্যেই এই রোগের সৃষ্টি, এই রোগের মাধ্যমেই ঈশ্বর পৃথিবীকে পাপমুক্ত করবেন, কি অদ্ভুত যুক্তি!! এই মহামারীর দিনে ধর্মযাজক নিজের ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন । বিপর্যয়ের দিনেও মানুষ কিভাবে ধর্মের জিগীর তোলে এবং নিজের ধর্মের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে, এ সব তার ই উদাহরন। এ জিনিস যে আজ ও দেখা যায় না, তা নয়। অনেক রকমের ধর্মীয় কুসংস্কার যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, আরো সংক্রমণের ভয়ে, ওই সময়ে অর্থাৎ তখন পর্যন্ত জীবিত সব কুকুর বিড়াল প্রশাসনিক তৎপরতায় মেরে ফেলা হলো। প্লেগের প্রকোপে সারা দেশ যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো, যখন দেশের মানুষ কার্য্যত: নিজের শহরেই বন্দী হয়ে গেল, তখন মানুষের অবস্থা দুঃসহ হয়ে উঠলো। চার্চে,ক্যাথিড্রালে প্রার্থনাকারীর সংখ্যা বেড়ে গেল আর ধীরে ধীরে সারা শহর স্তব্ধ হতে থাকলো, বলা যায় একধরনের বিষন্নতা শহরের মানুষকে গ্রাস করলো। শহর থেকে পালানোর ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য এক দালাল শ্রেণীর সৃষ্টি হলো, যারা অনেক টাকা পয়সা নিয়ে দেশ থেকে লোক পারাপার করতে থাকলো। আসলে দালাল চক্র সবসময়েই, সব অবস্থাতেই, মানুষের বিপদের সুযোগ নেয়, সে ফ্রান্সের ওরান শহর ই হোক আর যে শহর ই হোক। বিপর্যয়ের দিনে অনেক অসাধু ব্যবসা ফেঁপে ফুলে ওঠে, ব্যতিক্রম খুব কম ই হয়।
লেখক বলছেন “a victim world secluded apart, and of the groans of agony stiffled in its darkness “সারাদিন স্তব্ধ বিষন্নতার মাঝে শোনা যায় গোঙানির আওয়াজ। এই একটানা বিষন্নতার মাঝে থেকে থেকে মানুষের মধ্যে একধরনের মানসিক বিকৃতির সৃষ্টি হলো, অনেকেই এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্যে শহর থেকে পালানোর চেষ্টা করলো আর তখনই গর্জে উঠলো পুলিশের বন্দুক।
আজ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে ইতালীর একাধিক শহরের মানুষ শহরের মধ্যে বন্দী, কিন্তু এই বিপদের দিনেও দেখা যাচ্ছে অনেক মানুষ আতঙ্ক কে উপেক্ষা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান বাজনা করছে। ঠিক এই জিনিষ দেখা গিয়েছিল ওরান শহরেও, সেদিনও মানুষ শুধুমাত্র মানসিক অবসাদ কাটানোর জন্যে গান বাজনায় মেতে উঠেছিল। এ যেন কবির সুরে গেয়ে ওঠা মরণজয়ী গান!
বর্তমানে এই ভয়াবহ সংক্রমণের দিনে আমরা গরম আবহাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি কারণ আমরা শুনেছি যে করোনা ভাইরাসের মৃত্যু হয় গরম আবহাওয়ায়, ঠিক এই রকমই সেদিন ওরান শহরের মানুষও ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করেছিল কারন সেদিনও মানুষ শুনেছিল যে ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্লেগ এর সংক্রমণ প্রশমিত হয়। গল্প আজ এই রকমই জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভয়ঙ্কর মারণ রোগের থাবা চেপে বসেছে পৃথিবীর বুকে। আমরা এর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার অপেক্ষায় দিন গুনছি, আমরা জানি না এর শেষ কোথায়!!
********************************************
আশিস দাস পরিচিতিঃ
জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়ায়, শৈশব থেকেই কয়লাখনির শহর আসানসোলে বাস। পড়াশোনা আসানসোল, বর্ধমান ও কল্যানীতে। ইংরাজি সাহিত্যে M.A. ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিশ বছরই আসানসোল মহিশীলা বয়েজ’ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আধুনিক ইংরাজি কবিতার, বিশেষ করে W B Yeats ও T S Eliot এর পরম ভক্ত, ভালো লাগে ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে, আর ভালো লাগে রবীন্দ্রসঙ্গীত।