Shadow

এক ভয়ঙ্কর অনুপ্রবেশ – আশিস দাস

এক ভয়ঙ্কর অনুপ্রবেশ

আশিস দাস

আজ পৃথিবী এক ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন, প্রাণী জগতের রোগজ্বালা আজ মানবশরীর কে আক্রমন করতে আরম্ভ করেছে। বেশ কয়েকবছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে প্রাণী শরীরে বসবাসকারী জীবাণু মানব শরীরে এসে বাসা বাঁধছে আর পরিস্থিতি হয়ে উঠছে প্রাণঘাতী। এই বছর দুয়েক আগেই আমরা শুনেছিলাম Nipah virus (NiV) এর কথা, সে নাকি বাদুরের শরীর থেকে আম ইত্যাদি ফলের মাধ্যমে মানবশরীরে প্রবেশ করছে, কেরলে বহু মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঘটনা আমরা জানি। প্রাণী জগতের ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে মহামারীর সৃষ্টি আজকের ঘটনা নয়। পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম মহামারী হয়েছিল প্লেগ রোগকে কেন্দ্র করে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই প্লেগে। এই প্লেগ এর জীবাণু Yersinia Pestis এসেছিল ইঁদুর থেকে। ভেনিস,ফ্লোরেন্স প্রভৃতি ইতালীর বন্দর শহর থেকে এই রোগ পৃথিবীর অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়লো। Spanish Flu ও পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম মহামারী। এই রোগ পৃথিবীর বহু দেশেই হয়েছিল কিন্তু অন্যান্য দেশ এই রোগের কথা গোপন করেছিল, Spain তা করেনি, Spain এর রাজার এই রোগ হবার পর-ই সেই দেশ দেশবাসী কে জানিয়েছিল, আর মানুষ ভুল বুঝেছিল যে Spain থেকেই এই রোগের সৃষ্টি। কয়েক বছর আগে Swine Flu নামে একটি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল, নাম শুনেই বোঝা যায় যে এই রোগ ও প্রাণীজগতের। এই রোগের ও শিকার হয়েছিল বহু মানুষ..খুব সাম্প্রতিক কালে Avian Flu নামে একটি রোগের প্রকাশ ঘটেছিল। শোনা যায়,পাখী বা মুরগীর শরীর থেকে এই রোগ মানব শরীরে প্রবেশ করেছিল। এই যে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর রোগ মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে মানবশরীরে প্রবেশ করে মানুষের প্রাণনাশ করছে তা দেখে মানব জাতি আজ আতঙ্কিত। এই ধারা যদি অব্যহত থাকে তাহলে মানবজাতি রক্ষা করাই মুস্কিল। প্রাণীজগত যে সব রোগ নিয়ে, যে সব জীবানু নিয়েও বেঁচে  থাকতে পারে, মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়, কারন মানবশরীর এই সব রোগের গতিপ্রকৃতি জানে না, মানব শরীরে এই সব নতুন রোগের প্রতিরোধ বা immunity তৈরী হয়নি ফলতঃ পরিনাম ভয়ানক!! এখন প্রশ্ন হলো পশুপাখি তো আগেও ছিল,তাহলে আজ হঠাৎ এই বিপর্যয় দেখা দিল কেন?
এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হলো মানুষ নিজেই এই পরিনামের জন্যে দায়ী। মানুষের কৃতকর্মের ফলে আজ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট  হয়ে গেছে, প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বিপর্যয়। এখন যে যার নিজের জগৎ ছেড়ে অন্যের জগতে প্রবেশ করছে আর এই ‘ভয়ঙ্কর অনুপ্রবেশ’ এর ফলেই সৃষ্টি  হচ্ছে অনেক অজানা রোগ। বর্তমানে মানুষ নিজের লোভ লালসার তাড়নায় পৃথিবীর বনাঞ্চল নষ্ট করেছে,এই কিছুদিন আগের ঘটনা, আমাজনের rain forest এ  আগুন ধরে গেল, এ ছাড়া, অষ্ট্রেলিয়া,কানাডা প্রভৃতি দেশে মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল দাবানলে শেষ হয়ে গেল, এখন বনচর প্রাণীরা শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে লোকালয়ে আসতে আরম্ভ করেছে। জীবজগৎ আর মনুষ্য জগতের মধ্যে আর কোনো ব্যবধান থাকছে না, এক ধরনের free access বা উন্মুক্ত পথ তৈরী  হয়ে যাচ্ছে এবং এটাই পৃথিবীর পক্ষে বিপজ্জনক। অমিতাভ ঘোষের  Gun Island উপন্যাস পড়লে দেখা যাবে যে উষ্ণ অঞ্চলের ভয়ঙ্কর প্রজাতির সাপ লস্ এঞ্জেলেসের সমুদ্রতীরে এসে উপস্থিত, ভয়াল প্রজাতির মাকড়সা, যার কামড়ে মৃত্যু নিশ্চিত তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে ভেনিস শহরে, শীতল পাহাড়ী অঞ্চলের পোকা Bark Beetle, পাহাড়ি অঞ্চলের শৈত্যাভাব  কমে যাবার দরুন সমতলে চলে আসছে। আসলে তাপ মাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী তাদের বাসস্থান বদল করছে। অমিতাভ ঘোষ লিখেছেন, “temperatures are rising around the world because of global warming – this means the habitats of various kinds of animals are also changing…” কি ভয়াবহ পরিস্থিতি, আর এই পরিস্থিতিও অনেকটাই মানুষের সৃষ্টি!! এই যে মনুষ্য জগতে প্রাণী জগতের ‘অনভিপ্রেত অনুপ্রবেশ’,তার ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে নানা অজানা রোগ। জীবানুদের এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে সহজ সংক্রমনকেই জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে জুনোসিস, (zoonosis)। এইভাবে উদ্ভূত zoonotic virus রাই পৃথিবীতে মহামারীর সৃষ্টি  করছে। মানুষ শুধু প্রকৃতি ধ্বংস করেই ক্ষান্ত না,মানুষের যথেচ্ছ জীবনযাপনও এ সবের জন্যে  দায়ী। মানুষের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন, বিকৃত খাদ্যাভ্যাস,নানা ধরনের প্রাণীর মাংস খাওয়াও এ সবের কারন। সাম্প্রতিক কালের “ভাগাড়ের মাংস উপাখ্যান” সকলেই জানে। মানুষের রুচিবিকৃতি  মানুষের অশেষ ক্ষতি করেছে, আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারছি,তবে একথা বলা যায় না যে এত সব দেখেও মানুষের চৈতন্য হবে। শুধু এইটুকু বলা যায় যে, এখনো সময় আছে, এখনো আমরা যদি নিজেদের সংশোধন করতে না পারি তাহলে ধ্বংস অনিবার্য্য। সেদিন খুব বেশী দূরে নয়…
সময় এসেছে, মানুষ কে সংযত হতে হবে, মানুষের আগ্রাসী লোভ সংবরন করতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে যে, প্রাণীজগতের বিলুপ্তি হলে মনুষ্যজগতেরও অস্তিত্ব থাকবে না। এ পৃথিবী শুধুই মানুষের একার নয়, মানুষ যদি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারে তাহলে পৃথিবী আবার তার নিজস্ব সুষমা ফিরে পাবে। আমরা ফিরে পাবো আমাদের পুরনো পৃথিবী। আমরা জানি অন্ধকার কোনোদিনই চিরস্থায়ী নয়। পৃথিবীতে সুন্দর কোনোদিন নিঃশেষিত হয় না, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও সুন্দর জেগে থাকে তার আপন মাধুরী নিয়ে, নিকষ কালো অন্ধকারেও জ্বলে ওঠে জোনাকির আলো। তাই আজ মনে পড়ছে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা,”শহরে বন্দরে এত অগ্নি-বৃষ্টি বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক-একটি অপরূপ ভোর, বাজারে ক্ররতা, গ্রামে রণহিংসা বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা”
********************************************

আশিস দাস পরিচিতিঃ
জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়ায়, শৈশব থেকেই কয়লাখনির শহর আসানসোলে বাস। পড়াশোনা আসানসোল, বর্ধমান ও কল্যানীতে। ইংরাজি সাহিত্যে M.A. ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিশ বছরই আসানসোল মহিশীলা বয়েজ’ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আধুনিক ইংরাজি কবিতার, বিশেষ করে W B Yeats ও T S Eliot এর পরম ভক্ত, ভালো লাগে ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে, আর ভালো লাগে রবীন্দ্রসঙ্গীত।

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!