Shadow

স্বাধীনতা দিবসে প্রাজ্ঞ প্রবীণদের স্মৃতি রোমন্থন

স্বাধীনতা দিবসে প্রাজ্ঞ
প্রবীণদের স্মৃতি রোমন্থন 

নিখিলরঞ্জন বিশ্বাসের স্মৃতি রোমন্থন

১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের এই শুভ দিনটি প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে। যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে আমরা এই দিনটি পালন করি। সমস্ত সরকারী বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই দিনটি পালিত হয় সসম্মানে। দিনটি অনেকের কাছে শুভবার্তা বহন করে আনলেও, আমাদের মতো ভিটেমাটিহারাদের কাছে তা ছিল চরম বেদনাদায়ক। এই দিনে আমরা জানতে পেরেছিলাম  বিভক্ত হয়ে গেছে ভারতবর্ষ। আমাদের আজন্মকালের বাসভূমি ত্যাগ করতে হবে, কারণ পূর্বতন নদীয়া জেলার আলমডাঙা থানার চুয়াডাঙা সাবডিভিশনের মুন্সীগঞ্জের জেহালা গ্রামে থাকা আর সম্ভব নয়।  অল্পদিনের মধ্যেই কিছু মানুষের অত্যাচারে সর্বহারা নিঃস্ব হয়ে আমরা ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। লাখ লাখ হতভাগ্য মানুষের তখন একটাই গন্তব্যস্থল ভারত। সর্বস্বান্ত হয়ে এক অজানা অচেনা অন্ধকার ও অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা। সেকি করুণ অবস্থা। মনে পড়লে আজও সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। তাই প্রতিটি পনেরই আগস্ট হৃদয়কে রক্তাক্ত করে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়, নীরব ব্যথায় মন ভারাক্রান্ত হয়। তবুও এই দেশকে আমরা মায়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছি, কারণ এই দেশ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে নিরাপত্তা দিয়েছে, অন্ন দিয়েছে।
তাই প্রণতঃ হয়ে শ্রদ্ধার এবং মর্যাদার সঙ্গে আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করি, আজও।
***************************************************
নিখিলরঞ্জন বিশ্বাস পরিচিতিঃ
জন্ম ১৯৩৮ এ অবিভক্ত  ভারতের পূর্বতন নদীয়া জেলার আলমডাঙা থানার চুয়াডাঙা সাবডিভিশনের মুন্সীগঞ্জের  জিহালা গ্রামে। পড়াশোনা মুন্সীগঞ্জ একাডেমী, চুঁচুড়া কলেজিয়েট স্কুল, রানাঘাট কলেজ, সিটি কলেজ (মেইন) এবং কলকাতা ইউনিভার্সিটি। পরাধীন ভারত থেকে স্বাধীন ভারতবর্ষে, সহায় সম্বলহীন হয়ে নিজভূমে ‘রিফিউজি’ হয়ে যাবার, তিলে তিলে জীবন রক্ষা করার এবং নিজের আদর্শে অনমনীয় থেকে জীবন গড়ে তোলার  প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর এই ৮২ বছরের ঝুলিতে আছে।  আজীবন শিক্ষকতা করে আসা প্রগতিশীল মনের মানুষটির আদর্শ, রবীন্দ্রনাথ এবং পড়াশোনা ও চর্চার বিষয় ইতিহাস ও সাহিত্য। সমাজসেবা মূলক সাংগঠনিক কর্মে আজও যুক্ত রয়েছেন সক্রিয়ভাবে। প্রায় ৩৫ বছরের শিক্ষকতার জীবনে শত শত ছাত্র ছাত্রী তৈরী করার সঙ্গে সঙ্গে বই লেখা ও বাগ্মীতায় তাঁর সাফল্য। অবসরের পরে সাহিত্যানুরাগ ও রবীন্দ্র চর্চা বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
———————————————————————————————


জগদীশ কুমার জৈনের স্মৃতি রোমন্থন

১৫ই আগষ্ট, সাল ১৯৪৭!
আমাদের শহর শিয়ালকোট, (যা এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত), হঠাৎ দাবানলের মত জ্বলে উঠলো। আমদের বলা হল যে আমরা আর শিয়ালকোটের বাসিন্দা নই, দেশ বিভাজন হয়ে গেছে, আমাদের এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমাদের মাথায় যেনো বাজ ভেঙ্গে পড়ল। কিছু ঠাহর করার আগেই হিংস্র এক দল লোক আমাদের ওপর চড়াও হতে এগিয়ে এলো হাতে মারণাস্ত্র নিয়ে। শিয়ালকোট শহরে যৌথ পরিবার ছিলো আমাদের। অনেক বড়ো জায়গা নিয়ে এক মহলে বাস করতাম আমরা। আমার বাউজী  (পিতাজী) স্বর্গীয় শ্রী সর্দারী লাল জৈন, একজন স্বনামধন্য অ্যাডভোকেট ছিলেন শিয়ালকোটে। আমার তখন বারো বছর বয়স, কিছুই বিশেষ ঠাহর করতে পারছিলাম না যে কি হচ্ছে। প্রাণ হাতে করে আমার বাউজী আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে গোপন পথে শিয়ালকোট রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন, গন্তব্যস্থল জম্মু। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর জম্মুগামী একটি ট্রেন এলো গুজরনওয়ালা থেকে। কিন্তু ট্রেনে আমরা যে এত ভয়াবহ দৃশ্য দেখবো, স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি। পুরো ট্রেনে কাটা লাশ ভর্তি, চাপ চাপ রক্তে ট্রেনটি নরকে পরিনত হয়েছে। আমাদের আতঙ্ক চরমে উঠলো। বাউজী বুঝতে পারছিলেন, যে চরম বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছি আমরা। তক্ষুনি ষ্টেশন মাষ্টারের সহযোগিতায়,তাঁর পরিচিত আর্মি অফিসারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ঐ অফিসার সঙ্গে সঙ্গে ২০ জনের ম্যাড্রাস রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। স্টেশন মাষ্টার ট্রেনটিকে পরিষ্কার করার অর্ডার দিলেন। ঘন্টা দুয়েক পর ট্রেন রওনা দিলো, কিন্তু বিপত্তি হল শিয়ালকোট ক্যান্ট ষ্টেশন এ পৌঁছে। কোথা থেকে বিরাট এক দল লোক আমাদের উপর হামলা করার জন্য এগিয়ে এলো। সে যাত্রা ঐ ম্যাড্রাস রেজিমেন্ট আমাদের রক্ষা করলো। ট্রেন খানিকটা যাবার পর ডিরেল হয়ে গেলো। সেটা একটা কালরাত্রির মত নেমে এলো আমাদের উপর। খোলা জায়গায় শুধু ম্যাড্রাস রেজিমেন্টের তৎপরতায় ও সহায়তায় রক্ষা পেলাম। ট্রেন আবার চলতে শুরু করল আর শেষ পর্যন্ত আমরা জম্মু পৌঁছলাম। স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমরা আর শিয়ালকোট কখনও ফিরে যেতে পারবো না। পাকিস্তানে আমরা আমাদের সর্বস্ব জন্মের মত খুইয়ে এলাম। ভারত স্বাধীন সার্বভৌম হল ঠিকই, কিন্তু আমাদের মত হাজার হাজার মানুষ সর্বহারা হয়ে গেলো এক লহমায়।
এর পরের জীবন একটা দীর্ঘ সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে কেটেছে আমাদের এই স্বাধীন ভারতবর্ষে।।
*************************************************
জগদীশ কুমার  জৈন পরিচিতিঃ
জগদীশ কুমার জৈনের জন্ম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ শিয়ালকোটে (বর্তমান পাকিস্তানে)। দেশ বিভাজনের শিকার। বিজ্ঞানে স্নাতক আগ্রা ইউনিভার্সিটি থেকে।  কেমিস্ট্রি সাবজেক্ট পছন্দ করেন। কর্মসূত্রে রাউরকেল্লাতে থাকা। জীবনের অনেকটা সময় দিল্লীতে কাটিয়ে বর্তমানে বিশাখাপত্তনম নিবাসী। আকুপ্রেসারে পারদর্শী। ভালবাসেন শৌখিন রান্না করতে।।
অনুবাদকঃ বিশ্বজিৎ সরকার
————————————————————————————-

বীণাপাণি ব্যানার্জ্জীর স্মৃতি রোমন্থন

মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের বিখ্যাত কবিরাজ বাড়ির মেজো বৌ বীণাপাণি দেবী বর্তমানে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা। বয়স ৮৯ হলেও স্মৃতিশক্তি আজও প্রখর। স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তাঁর প্রথম অভিব্যক্তিই হলো একরাশ বিতৃষ্ণা। কারণ দেশভাগ। জন্মভিটে ছেড়ে আসা আজও মেনে নিতে পারেননি এই নবতিপর বৃদ্ধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত আগের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার তাঁদেরকে নিজভূমি ছাড়তে বাধ্য করে। তাঁর কথায় এটা স্পষ্ট যে ১৬ বছরের এক কিশোরীর অভিজ্ঞতা আজও তাঁর স্মৃতিতে কালকের ঘটনার মতো জ্বলজ্বল করছে। তাঁদের গ্রামে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার সম্পর্ক আজও তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বাবা সূর্যকান্ত চক্রবর্তী বনবিভাগে চাকুরী করতেন। আসামে কর্মজীবন শেষ করে ফিরে আসেন বসত ভিটেয়। ঢাকা জেলার অন্তর্গত মুন্সীগঞ্জ মহকুমায় তাঁদের গ্রামের নাম ছিলো কাঠিয়াপাড়া। সেখানেই মা হিরন্ময়ী দেবী সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে বাস করতেন। স্মৃতি হাতড়ে স্পষ্ট করেই জানালেন যে ভিন্নধর্মীয় কোনো সাম্প্রদায়িক হুমকি নয়, একমাত্র রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারই তাঁদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। বাড়ি থেকে নৌকোয় বাগরা স্টীমারঘাট গিয়ে সেখান থেকে স্টীমারে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে ট্রেনে রানাঘাট এবং রানাঘাটে ট্রেন বদল করে বহরমপুর আসার অভিজ্ঞতা তাঁর স্মৃতিতে বিরাট ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে।
স্বাধীন ভারতে ভালো আছেন কিনা জানতে চাওয়ায় তাঁর স্পষ্ট জবাব, দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে কথা সত্যি। কিন্তু, দেশবাসী স্বাধীনতার কি সুফল পেয়েছে? সাধারণ মানুষের অবস্থা সেদিন যা ছিলো, আজ তার থেকে একটুও উত্তরণ ঘটেনি। তাঁর মতে বৃটিশ শাসনকালে আজকের মতো পথে ঘাটে মেয়েদের কোনো ভয় ছিলোনা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আজকের মতো আকাশছোঁয়া ছিলোনা। যাঁরা দেশ স্বাধীন করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে বিপ্লবীর খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন, তাঁদের স্বপ্নের এক কণাও পূরণ করতে পারেনি এই স্বাধীনতা।
*************************************************

 

 

 

12 Comments

  • Chaitali Chatterjee

    স্মৃতি রোমন্থন! খুব ভালো লাগলো অজানা কে জেনে! ভালো থাকুন সকলে। প্রণাম। 🙏

  • চৈতী গুপ্ত।

    শুধু স্মৃতি রোমান্থন নয় সব লেখা গুলোই খুবই আন্তরিক। খুব ভালো লাগে।

    • Brati Ghosh

      প্রতিটি স্মৃতিচারণে যে যন্ত্রণা ~সেটা যেন অনুভব করতে পারছি। খুব ভালো লাগল। আপনারা সবাই আমার প্রণাম নেবেন🙏🙏🙏🙏

  • সোনালী গুহ

    স্মৃতির সরণী বেয়ে যে অমূল্য সব ঘটনা এই সব প্রাজ্ঞজনেরা আজ শোনালেন,তাতে ঋদ্ধ হলাম।অনেক অজানা তথ্য জানা গেল।ওনাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই!!🙏🙏🇮🇳🇮🇳

  • Ratna Banerjee

    স্মৃতি রোমন্থন… সব লেখা মন কে ভীষণ ভাবে স্পর্শ করেছে.. আপনাদের জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা! 🙏

  • Kankana Sen.

    শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে অনেক অজানা তথ্য জেনে ঋদ্ধ হলাম।স্বাধীনতার অপর দিকে কত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে ,তার সাক্ষী একমাত্র এনারাই।আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা পূর্ণ প্রণাম জানাই।

  • Madhumita Mitra

    দেশ স্বাধীন হ‌ওয়া তাঁরা চোখে দেখেছেন,তাঁদের দেশ ছাড়ার মূল্যে আমরা স্বাধীনতার আলোকপ্রাপ্ত(কতটা এবং কেমন আলো তার কথা বাদ দিয়ে)এমন প্রাজ্ঞদের কাছে শুনলাম স্বাধীনতার ক্ষণের কথা!!এ ব্যাথাও আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নবীনতম প্রজন্মের কাছে–তাই এমন নিবন্ধের অবশ্য প্রয়োজন আছেই।

  • শান্তা গুপ্ত

    শান্তা গুপ্ত ,

    মেসোমশায ও অন্যান্য প্রবীণ দের আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, তাঁদের অভিজ্ঞতার নানা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল, আমার মা ও বাবার কাছে শোনা নানা রকম ভয়াবহ সত্য ঘটনা।

  • আশিস কুমার সরকার

    স্বাধীনতাদিবসে প্রাজ্ঞ প্রবীণদের স্মৃতি রোমন্থনগুলি যে শুধু ভাল লাগল, তা নয় — আরও একবার মনে করিয়ে দিল, যে সব মূল্যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, তারই একটি বেদনাসিক্ত দিক !
    এঁদের এখনও না শুকোনো দগদগে ঘায়ে সান্ত্বনা বা সহানুভূতির প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করাও –স্বাধীনতার বছর পাঁচেক পরে জন্মানো — আমার মত কারুর পক্ষে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাবে, বাতুলতার নামান্তর হবে ! এঁদের উদ্দেশ্যে শুধু জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম । কামনা করি এঁদের বাকি জীবন হোক সুখশান্তিময়।

    শ্রী জৈনের স্মৃতিচারণা মনে পড়িয়ে দিল প্র‍য়াত সর্দার খুশবন্ত সিং – এর বিখ্যাত এবং বেদনাদায়ক উপন্যাস, ” ট্রেন টু পাকিস্তান”-এর কথা। সেই বিভৎস লাশ ভর্তি ট্রেন!!

    শ্রীমতী বীণাপাণি ব্যানার্জ্জির সঙ্গে আমি সম্পুর্ণ সহমত, যে, সাধারণ মানুষ – হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে — চির কালই পাশাপাশি শান্তি ও প্রীতিময় পরিবেশে বাস করে এসেছে।… অতীন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা “নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে” উপন্যাসে দেখেছি কিছু মানুষের উস্কানিতে সেই সময় রাজাকার রা ছাড়াও বেশ কিছু মুসলমান যুবগোষ্ঠিও চোখে “মুস্লিম রাষ্ট্রের” স্বপ্ন নিয়ে হিন্দু বিদ্বেষের বিষে জর্জরিত হয়েছিল। পরে অবশ্য খানসেনার ও তাদের তাবেদারদের অত্যাচারে ও নিজভূমে পদদলিত থাকার বেদনায় তাদের অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়েছিল !
    প্রাজ্ঞ প্রবীণদের,– শ্রী নিখিলরঞ্জন বিশ্বাস, শ্রী জগদীশ কুমার জৈন এবং শ্রীমতী বীণাপাণি ব্যানার্জ্জি দের সবাইকে — আবারও আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!