স্বাধীনতা : প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ৭৫ বছর
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত
ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে পঁচাত্তর বছর আগে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট।ছিয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে একটু পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করছে। স্বাধীনতা দিবসের সেই সন্ধিক্ষণে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি।যা জেনেছি, শুনেছি পিতামাতা ও প্রবীণদের কাছ থেকে, বিভিন্ন পুস্তক পাঠ করে,বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ থেকে এবং সর্বোপরি পত্রপত্রিকার সংবাদ থেকে।স্বাধীনতার দশ বছর পর এক ভারতীয় নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা গর্বের বিষয়। কিন্ত এর ঠিক দুশো বছর আগে,২৩ জুন,১৭৫৭ সালে একটি বিদেশী বণিকদের কোম্পানি দেশের কিছু ক্ষমতালোভী বেইমানদের চক্রান্তে সুবে বাঙলার নবাব সিরাজদৌল্লাকে হারিয়ে হিংস্র ভাবে একটি দেশের সম্পদ ও সার্বভৌমত্বেকে লুঠ করে। দখল নেয় কলকাতার।সূত্রপাত হয় ১৮৫৮ সাল থেকে দীর্ঘ ব্রিটিশ রাজের।যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৫ অগাস্ট, ১৯৪৭ সালে,মধ্যরাতে। নত হয় ইউনিয়ন জ্যাক,উদ্ভাসিত হয় তেরঙ্গা। বহু ত্যাগ,বহু রক্তের বিনিময়ে।
এক ব্রিটিশ ব্যারিস্টার র্যাডক্লিফ কতিপয় সুবিধাবাদীদের সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠকের পর দেশটাকে তিন টুকরো করেদিলেন। চাষ ক্ষেত্র, বসতজমি, নদী, রাস্তা, শহর গ্রাম চিরে ত্রিখন্ডিত সীমানা তৈরি হলো নবজাতক দুই রাষ্ট্রের। একটি বিশেষ এক ধর্মের মানুষের জন্য, আরেকটি ধর্ম নিরপেক্ষদের জন্য।এগুলো অবশ্য প্রায় সকলেই অবগত।
এখন প্রশ্ন হলো,এই স্বাধীনতার সুফল কী কী আর কী কী এখনো অর্জিত হয়নি? প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্ক কি?
একথা ঠিক,এখনো আমরা অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে। এখন (জুলাই ২২ শেষ সপ্তাহে) ডলার,পাউন্ড এবং ইউরোর বিক্রয় মূল্য ৮১/৯৭ এবং ৮৩ টাকা।অথচ,সে বছর এক ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ভারতীয় মুদ্রায় সাড়ে তিন টাকার একটু কম।সঠিক হিসেবে ১ডলার-৩টাকা ৩৩ পয়সা!যদিও এই দীর্ঘ পৌনে এক শতকের স্বাধীনতায় দেশ দু’দুবার মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হয়েছে।কিন্ত এটাতো বাস্তব,ওই সব উন্নত দেশগুলির তুলনায় প্রাকৃতিক বা জৈব সম্পদে আমরাও কম কিছু নয়।জাপানের কথাই ধরা যাক।দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই কম,বলতে গেলে নাম মাত্র।আমাদের স্বাধীনতার মাত্র দু বছর আগে,১৯৪৫ সালের অগাস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মার্কিন পরমাণুবোমায় দেশটি নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল!জাপান এখন উন্নত অর্থনেৈতিকতায় (Developed Economy) বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।জাপানের উন্নয়ন এসেছে শিল্প থেকে।
বর্তমানে দেশ এক ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির চাপে হাঁসফাঁস করছে।রান্নাঘর থেকে বাইরে সর্বত্র এই ফাঁস।একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।সেটা সত্তর একাত্তর সাল।আমার সেভেন এইট।হিমালয়ের পাদদেশের ছোট্ট মনোরম এক শহরে আমার বাস, জন্ম থেকেই।আমাদের ঝকঝকে মার্ক টু কালো অ্যাম্বাসাডরে তখন সাহস করে, ড্রাইভার কাকুকে পটিয়ে গাড়ি চালানো শিখছি।মাঝেমাঝে ভোরবেলা অসমবাসী ড্রাইভার মোহন কাকুকে নিয়ে গাড়িতে তেল ভরতে যেতাম।এটা ছিলো অজুহাত। বাবা কিছু বলতেন না,টাকা দিয়ে দিতেন। রেজাল্ট ভালো হতো বলে পড়া ফাঁকির প্রশ্ন ছিলোনা। তখনো নিউজলপাইগুড়ি রেল জংশন তৈরি হয়নি। পেট্রোল কিনতাম,আমার স্পষ্ট মনে আছে ১.১৮ পয়সা লিটারে।বাংলাদেশ যুদ্ধের পর ওটা দু’বার বেড়ে হয়েছিল সাড়ে তিন টাকা! আজ কেরোসিনই সেঞ্চুরি পার করেছে।পেট্রোল একশো ষোল থেকে একটু নেমে একশো ছয়। রান্নার গ্যাসের দাম প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ভয়ঙ্কর।
একটি জাতির দৃঢ়তা বহন করে শিক্ষা। স্বাধীনতার পর থেকে কিন্ত শিক্ষা ক্ষেত্রের আপেক্ষিক বিস্তার নিরাশাজনক নয়। স্বাধীনতার বছরে কিন্তু দেশে কোনও আই আই টি ছিলোনা।১৯৫০ সালে দেশের প্রথম আই আই টি শিক্ষালয় স্থাপিত হয়,আজ যার সংখ্যা ২৩। শিক্ষা প্রসারে পরাধীন ভারতে অন্যতম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বরোদার মহারাজা,তাঁর রাজ্যে ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে আবশ্যিক ঘোষণা করে। অভিভাবকদের জরিমানা ও স্কুল ফাঁকিদের হাজত বাসের ব্যবস্থা করে। প্রচুর স্কুল নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এর ফলে এই সময়কালে(১৯০৬-১৯৩৯) সে রাজ্যে স্বাক্ষরতার বিস্তার হয় ৯ থেকে ২৭ শতাংশ। দেশে এখন কেন্দ্রীয়,রাজ্য সরকারি এবং বেসরকারি ইত্যাদি মিলিয়ে ১০২৬ টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এর সংখ্যা ৪৯।সবচেয়ে বেশী রাজস্থানে,৮৫ টি। আর গোয়া এবং লাদাখে ১টি করে! দক্ষিণের রাজ্যগুলি সামগ্রিক ভাবে এগিয়ে।অন্ধ্রপ্রদেশে ৩৮, কর্ণাটকে ৬৯, কেরলে ১৯,পুডুচেরিতে ২, তামিলনাডুতে ৫৬ এবং তেলেঙ্গানায় এর সংখ্যা ২৮।সরকারি হিসেবে দেশে স্বাক্ষরতার হার ৭৭.৭%। পুরুষ ৮৪.৬ % এবং মহিলা ৭০.৩ %। স্বাধীনতার বছরে দেশের স্বাক্ষরতার হার ছিলো মাত্র ১২ শতাংশ। শিক্ষা খাতে বার্ষিক জাতীয় ব্যয় জিডিপি’র (Gross Domestic Product)৪.৬ %।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশকে তিনটি বড় যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমাদের দুই প্রতিবেশী আস্তিনে ছুরি লুকিয়েই রেখেছে। আজ কিন্ত প্রতিরক্ষায় বিশ্বের চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত। পরমাণু অস্ত্র হাতে রয়েছে। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয়ে ভারত আজ তৃতীয় স্থানে।বার্ষিক ব্যয় প্রায় সাতশো কোটি মার্কিন ডলার। কিন্ত এতো গেল বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই। তবে যুদ্ধ কিন্ত আজও সমাপ্ত হয়নি। অনেক লড়াই এখনো বাকি আছে।
আমাদের দেশ হলো কৃষি প্রধান দেশ। সুজলা,সুফলা শষ্য শ্যামলা এই মাতৃভূমি কৃষিজ জমিতে বিশ্বের নিরিখে সর্ববৃহৎ (চাষযোগ্য জমি ১৫৯.৭ এবং ফলন হচ্ছে ৮২.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে)। যদিও স্বাধীনতার পর পর,ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শষ্যক্ষেত্রে দেশজ চাহিদা ছিলো বহির্দেশের ত্রাণ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। কিন্ত ১৯৬৫-৬৬ সালে অনাবৃষ্টি আর খরার পর কৃষিতে ব্যাপক ও সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সেচ পরিকাঠামো তৈরি হয়।ফলও মেলে হাতে হাতে। পঞ্জাব,হরিয়ানা,উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যগুলিতে হয় সবুজ বিপ্লব। এখন দেশ কৃষিতে স্বাবলম্বী। মোট জিডিপি’র ১৭-১৮% আসে কৃষি ও গবাদি পশু,মাছ মাংস,ডিম,দুধ ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি থেকেই।ধান,গম,যবের পাশাপাশি চিনি,শাক সবজি এবং ফলও আজ বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উল্লেখ যোগ্য মাধ্যম। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক,জাতীয় খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) হিসেব অনুযায়ী দেশে শুধু ধান উৎপাদন বেড়েছে প্রতি কিলোগ্রাম প্রতি হেক্টরে) এভাবে:*
১৯৭০-৭১ :১১২৩
১৯৯০-৯১ :১৭৪০
২০১০-১১ :২৯৩৮
২০১৯- :৪০৫৭
(তথ্য সূত্র National Policy for Farmers, Deptt.oa Agril & Co-op,Govt.of India)
মহাকাশ বিজ্ঞানে আমাদের উন্নতি চোখে পড়ার মত।আশির দশকের সেই আর্যভট্ট,রোহিণীর পর ইনস্যাট এখন নানান কাজে লাগছে। এখন দেশের ভিতর থেকেই উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা যাচ্ছে।নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত পিএসএলভি,জিএসএলভি রকেটে অনেক ভারী
নভোযান মহাকাশে পাঠানো যাচ্ছে।অনেক বিদেশী উপগ্রহও এখন পাঠানো হচ্ছে।চাঁদ এবং মঙ্গল ছুঁতে পেরেছি আমরা।ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর বিজ্ঞানীরা অতি অল্প খরচে নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিশ্বের নজর কেড়েছেন।মহাকাশ বিজ্ঞানের হাত ধরে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থারও দ্রুত উন্নতি হয়েছে। রেল বিমান পরিষেবা এখন আন্তর্জাতিক স্তরে।তবে ক্রীড়া ক্ষেত্রে দেশ এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। এর মধ্যেও কিন্ত জনস্ফীতির অশনি সঙ্কেত উঁকি মারছে।রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেবে আগামীতে ভারত জনসংখ্যায় চীনকে পিছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বর হতে চলেছে।
দেশ ভাগ হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের নীতি নিয়ে।কিন্ত পরবর্তী সময়ে কখনও ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে শুরু করে নির্লজ্জভাবে সংখ্যালঘু তোষণ প্রত্যক্ষ করা গেছে। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি,এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাইক বাজানোয় প্রশাসনকে মাইককে বাজেয়াপ্ত করতে,অথচ অন্য ধর্মীয় আর এক অনুষ্ঠানে মাইক বেজে যায়!এই দ্বিচারণ কিন্তু বিভেদ,বিভাজন আর আত্মার বৈরিতা ব্যতীত আর কিছু সৃষ্টি করেনা।
এখন কিছু কিছু বিষয় আবার দুঃখ দেয়। লজ্জা দেয়।ধর্মের নাম নিয়ে কিছু অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা একটা জাতিকে কয়েক যোজন পিছিয়ে দিতে পারে! নতুন ভারত বলে প্রচারে যা দেখানো হয়ে থাকে,বাস্তব চিত্র কিন্ত তার সঙ্গে মেলেনা। আর হলো,অযাচিত সাহায্য।
বিনামূল্যে, আদতে সাধারণ মানুষের অর্থকে বিশেষ কোনও গোষ্ঠী বা শ্রেণির মানুষের মধ্যে দান ধ্যান করে জনপ্রিয় হওয়া,ভোট পাওয়া আর প্রকৃত উন্নয়নের মধ্যে অনেক ফারাক যেমন হয়,তেমনি কর্মবিমুখ করে দেয় গ্রহীতাদের।
দশ বছরের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল সংবিধানে,উদ্দেশ্য ছিলো জাত পাতের অঙ্কুশ বিদ্ধ পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনতে। কিন্ত এই প্রথা বাতিলে আজ পর্যন্ত সাহস দেখায়নি কোনও সরকার! তাই,যে কোনও বিষয়ে একশোতে নব্বই পাওয়া অমলের সঙ্গে টায় টায় তিরিশ পাওয়া বিমলের মেধা কি সমান হয় কখনো?
যা বলেছিলাম কয়েক ছত্র আগে,সেই যুদ্ধের কথা। বেকারত্ব, অর্থনেৈতিক দিকে আজও সেই কাঙ্খিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। তাই কিছু লড়াই,কিছু যুদ্ধ এখনও বাকি আছে। এই যুদ্ধ জিততে আরও কত অপেক্ষা করতে হবে,সেটাই এখন দেখার।
জয়হিন্দ।
**********************************************
প্র ত্যু ষ সে ন গু প্ত পরিচিতিঃ
সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে নানা রকম চাকরী করে এখন বেলাশেষে কলম ধরেছেন। প্রথম চাকরী এক ওষুধ কোম্পানীতে। তারপর চা বাগানে। এরপর দু’দুটি খবরের কাগজে সাব এডিটর। শেষ পর্বে গোপনীয়তায় ভরা সরকারী চাকরী। দীর্ঘ চাকরী জীবনে কাজ করেছেন পশ্চিম বঙ্গের অধিকাংশ জেলায়! অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর। এই শেষ বেলায় ওই অভিজ্ঞতায় নির্ভর করে আবার কলম ধরেছেন।