আবেগের আরেক নাম–গুলজার
অজন্তা প্রবাহিতা
সারা পৃথিবী যখন অমাবস্যার অন্ধকারে আছন্ন,তখন,একমাত্র বান্দ্রার আকাশে জ্বলজ্বল করে দুধীয়া চাঁদ । আমাদের সবার প্রিয় গুলজার সাহেব । যাঁর অনুমতি না পেলে রাত অপেক্ষা করে,চাঁদ অস্ত যায় না।
“তুম জো কেহ দো তো আজ কি রাত চাঁদ ডুবেগা নেহি । রাত কো রোক লো ।”
শান্ত,মৃদুভাষী,ধবধবে সাদা পাজামা–পাঞ্জাবি পরা এই মানুষটাকে দূর থেকে দেখলেই চেনা যায় । পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না । সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে আগ্রহী গুলজার সাহেবের আসল নাম,’সম্পূরণ সিং কালরা’। তাঁর ওস্তাদ কবিতার প্রতি ভালোবাসা দেখে তাঁকে কলম–নাম ‘গুলজার‘ দিয়েছিলেন,যার অর্থ গোলাপের বিছানা ।
তিনি শিখ–পরিবারে জন্মেছেন ১৯৩৬,মতান্তরে ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট দিনায় (ব্রিটিশ ভারতের ঝিলম জেলা,বর্তমানে যেটা পাকিস্তানে অবস্থিত)।বাবা মাখন সিং কালরা এবং মা সুজান কাউর ।
দেশত্যাগ নামক প্রলয়ের আঘাতে তাসের ঘরের মতো তছনছ হয়ে যায় ছোট্ট গুলজারের দুনিয়া । তাঁর পরিবারকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসতে হয় দিল্লীর রওশন আরা বাগে। খুব অল্প বয়সেই তিনি মা–কে হারান ।
দিল্লীর ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে বম্বে (মুম্বাই) পাড়ি দেন তিনি । কিছুদিন খালসা কলেজ এবং ন্যাশনাল কলেজ বম্বেতে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন বিদায় জানিয়েছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকে। অর্থাভাবে গ্যারেজে মেকানিকের চাকুরি নেন তিনি । কিন্তু,কবিতার প্রতি ভালোবাসাও লালন করতে থাকেন সযত্নে গোপনে।
সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং অসীম ক্ষুধা তাঁকে ঈর্ষণীয় পাঠকে পরিণত করেছিল। একই সঙ্গে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত ও চিত্রকলারও অনুরাগী ছিলেন ।
বম্বেতে তাঁর নতুন জীবন তাঁকে করেছিল স্বাধীন এবং একাকী। এক আনার ভাড়ায় ট্রামে করে পুরো শহরকে চেনা,ছোট–মাঝারি নানা রকম পেশার ভেতর দিয়ে উলটে–পালটে জীবনকে দেখা সাহিত্য,সংগীত ও চিত্রকলার জগৎ গুলজারের শিল্পী মনকে উন্মোচিত করেছিল ।
তিনি উস্তাদ আলী আকবর খান আর পন্ডিত রবিশংকরের কোনো সঙ্গীতানুষ্ঠান বাদ দিতেন না।
PWA রবিবারের বৈঠকে তাঁর কথোপকথনের সময়ই শৈলেন্দ্র এবং বিমল রায় তাঁকে ছবিতে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি বিমল রায় পরিচালিত ‘বন্দিনী‘ (১৯৬৩) চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণের সাথে গীতিকার হিসাবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন।
লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “মোরা গোরা আঙ্গ লাইলে,”গানটির সঙ্গে তিনি যে সফর শুরু করেছিলেন,সেই সফর এখনও চলেছে । “মুসাফির হু ইয়ারো,না ঘর হ্যায়,না ঠিকানা,মুঝে চলতে জানা হ্যায়,বস চলতে জানা।”
আশীর্বাদ,আনন্দ এবং খামোশির মতো চলচ্চিত্রের জন্য সংলাপ এবং চিত্রনাট্য লেখার পর,গুলজার তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র মেরে আপনে (1971) পরিচালনা করেন। ছবিটি তপন সিনহার বাংলা ছবি আপনজন (1969) এর রিমেক ছিল। তিনি এক বধির–মূক দম্পতির মুখোমুখি সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে কোশিশ ছবির গল্প লিখেছেন,যেখানে সঞ্জীব কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন ।
কবি গুলজারের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি সাহিত্য বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। ভিন্ন ধারার সিনেমাগুলো তৈরি হতো ভালো কোন সাহিত্যিকের গল্প–উপন্যাস থেকে। গুলজারের ক্ষেত্রে দেখা যায়,তিনি আগে থেকেই সেসব গল্প–উপন্যাস পড়ে রেখেছেন। গল্প–উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে চরিত্রগুলোর আবেগ,অনুভূতি সম্পর্কে তাঁর ভালো ধারণা থাকতো। সে কারণে চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোকে মূল গল্পের চরিত্রের সাথে মিলিয়ে অভিনয় করতে কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সমস্যা হতো না।
এরপর অনেক ছবি তিনি পরিচালনা করেন । আঁধি,‘মাসুম’ এবং ‘মীরাবাঈ’ তারমধ্যে অন্যতম ।
চিরকালই উনি বাংলা অনুরাগী। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন,গান,গল্প ওঁকে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে,বিয়েও করেন রাখী নামে এক বাঙালিকে। রাখী গুলজার নিজেও চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তী অভিনেত্রী। পঞ্চমদার সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক গান,ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন।
‘ইজাজত ‘ ছবিটি মনে পড়ে ? সেই বিখ্যাত গান,আশাজীর কন্ঠে,মেরা কুছ সামান,তুমহারে পাস পড়া হ্যায়। ১৯৮৮ সালে এই গানটি রচনার জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ঐ ছবিটি পরিচালনাও করেন। ছবিটির কাহিনী গৃহীত হয়েছে সুবোধ ঘোষের “জতুগৃহ” উপন্যাস থেকে।
গুলজার,পঞ্চমদা এবং আশাজীর জুটি আমাদের ভারতীয় সঙ্গীত এবং সিনেমা জগতকে শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। পঞ্চমদার অকালপ্রয়াণ না হলে আমরা হয়তো আর অনেক ম্যাজিক্যাল মোমেন্টস পেতাম।
বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রের খুব কাছের বন্ধু গুলজার সাহেব। একদিন তিনি ফোন করে শান্তনুদা কে বলেন,‘প্লুটো বেঘর হো গয়া। মুঝে বহুত বুরা লগ রাহা হ্যায়।” তাঁর চরিত্রের এই শিশু সুলভ দিকটি থাকার জন্যই আমরা মোগলীর মত চরিত্র পেয়েছি।
“জঙ্গল জঙ্গল বাত চলি হ্যা পাতা চলা হ্যা, চাড্ডি পহনকে ফুল খিলা হ্যা। ফুল খিলা হ্যা। “ছোটবেলা আমাদের মুখে মুখে ঘুরত এই গান । ভাবলে অবাক হই,কেমন করে একটা মানুষ একদিকে লিখছেন,হুজুর ইজ কদর ভি না ইতরাকে চালিয়ে।
লিখছেন,‘লকড়ি কি কাঠি’।
বহুমুখী প্রতিভার এই মানুষটিকে নির্দিষ্ট সংজ্ঞার মাধ্যমে বোঝানো অসম্ভব। ওঁর সম্মুখীন না হয়েও স্ক্রীনের এপাশ থেকে দেখে বুঝতে পারি,তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তি। গুলজার তো শুধু নাম নয়,আমাদের গর্ব,আবেগ এবং ভালোবাসা। আবেগের বিভিন্ন রূপকে সুকৌশলে শব্দের মাধ্যমে যিনি প্রকাশ করেন,তিনি গুলজার। সাধারণ মানুষকে যেন পড়তে পারেন গুলজার। তিনি এমন এক কবি যাঁকে জনসাধারণের কবি বললে ভুল হবে না। তিনি যা–ই লিখুন না কেন,সেটা গান হোক, সংলাপ হোক,গল্প কিংবা উপন্যাস–চিত্রনাট্য হোক,তাঁর লেখা প্রতিটি শব্দই জীবন্ত হয়ে ওঠে।
তাঁর লেখা আমার ভীষণ প্রিয় একটি কবিতা,
কড়ানাড়ার শব্দ
খুব ভোরে স্বপ্ন যখন দরজায় কড়া নেড়ে গেল
দরজা খুলে দেখি সীমান্তের ও পার থেকে
কিছু অতিথি দাঁড়িয়ে, পরিচিত সবাই
সৎকারে অতিথির হাত পায়ে জল দিলাম
আঙিনায় আসন পাতা হল তাদের জন্য
মকাইয়ের মোটা রুটি উনুনে সেঁকে দিলাম
গত বছরের ফসলের কিছু গুড় পুঁটলিতে
করে নিয়ে এসেছিলেন অতিথি আমার
চোখ যখন খুলল আমার
দেখি ঘরে কেউ নেই
তবে দেখি উনুন তখনও নেভেনি
ঠোঁটে তখনও আমার গুড়ের মিষ্টি স্বাদ
বোধহয় স্বপ্ন ছিল
স্বপ্নই ছিল
তার পর শুনি সীমান্তে কাল রাতে
নাকি গুলি চলেছে,সীমান্তে কাল রাতে
শুনেছি কিছু স্বপ্ন খুন হয়েছে।।
*************************************
অজন্তা প্রবাহিতাঃ
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।