ডায়াস্পোরা
সুজয় দত্ত
এই পৃথিবীর গোলকধাঁধায় অনেক বছর কাটিয়ে শেষে
সাত সাগর আর তেরো নদী,পথ–প্রান্তর পেরিয়ে এসে
হঠাৎ সেদিন শুনতে পেলাম পুরোনো এক চেনা গলায়
ডাক দিল কেউ,বলল “থামো। অন্তবিহীন এ পথ চলায়
শ্রান্ত তুমি। একটু জিরোও। একটু তাকাও পিছন ফিরে।
অনেক হল। এবার খানিক কাটাও সময় আপন নীড়ে —
যেখান থেকে যাত্রা শুরু। স্মৃতিমেদুর,স্বপ্নমাখা,
ফেলে আসা দিনগুলো সব যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখা
নিজের শহর,নিজের বাড়ি,ছেলেবেলার খেলার মাঠে —
গলির মোড়ের আড্ডাতে আর মুখচেনা সব দোকানপাটে।”
যেই না শোনা,উঠল নেচে বুকের খাঁচায় বন্দী পাখি,
ঘরে ফেরার নেশায় মাতাল,সাধ্য কী তায় আটকে রাখি?
অগত্যা এক দিন সাত সকালে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে,
সব পিছুটান ছিন্ন করে,হিসেবনিকেশ মিটিয়ে দিয়ে
রওনা দিলাম জন্মভূমির উষ্ণ আলিঙ্গনের আশায়।
থাকব কাছে আপনজনের,বলব কথা নিজের ভাষায় —
এই ভেবে মন উথালপাথাল,সয় না সবুর নাগাল পেতে,
অতীত সুখের টুকরো ছুঁয়ে খুশিতে চায় উঠতে মেতে।
নামল যখন হাওয়াই জাহাজ,যা দেখি সব মধুর লাগে।
পুরোনো সব ভাললাগাই নতুন রঙে আবার জাগে।
হারিয়ে পাওয়ার বিচিত্র এক অনুভূতি হৃদয় জুড়ে।
হৈহুল্লোড় হাসি মজায় কখন সময় যাচ্ছে উড়ে —
হয়নি খেয়াল। ঘরের দেয়াল ক্যালেন্ডারের পাতায় নজর
হঠাৎ করে পড়ল যেদিন,আচমকা এক ধাক্কা সজোর
লাগল বুকে,ব্যাজার মুখে তাকিয়ে দেখি লম্বা ছুটির
মেয়াদ তো শেষ। স্বপ্ন-আবেশ এক নিমেষে চক্ষুদুটির
মিলিয়ে গেল। ধরল ঘিরে রূঢ়,কঠিন বাস্তবতা —
এড়াই তাকে কেমন করে? পালিয়ে বাঁচার রাস্তা কোথা?
নিত্যদিনের ইঁদুর দৌড়,প্রাত্যহিকের ব্যস্ততারা
ডাকছে নিঠুর হাতছানিতে। কাজ জমেছে। ভীষণ তাড়া।
কাজের টানে মন উতলা,আবার পাড়ি দূর প্রবাসে।
তাকাই ফিরে অতীত-পানে,জীবনটা যেই শুকিয়ে আসে।
হাওয়ায় ভাসা পরাগরেণু–শিকড় ভুলে বাঁচব মোরা?
হেথায় আধেক হোথায় আধেক–এই আমাদের ডায়াস্পোরা।
*****************************
সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প, বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।