প্রেয়ার ফ্ল্যাগ
শাঁওলি দে
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গ্রামগুলো ছবির মতো সাজানো। অনেক বেশি উচ্চতায় উঠে নিচের দিকে তাকালে মনে হয় কালী পূজায় নিজস্ব ছোট্ট পাহাড় বানিয়েছে পাড়ার কচিকাঁচারা। রাতের বেলা ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠলেই ঠিক যেন দীপাবলীর সাজ,একেবারে মনোমুগ্ধকর।
নিজের চার চাকায় একটু একটু করে ওপরে উঠছে অনির্বাণ। পাহাড় ওকে ইদানিং পাগলের মতো টানে,যখনই এক দু’দিনের ছুটিছাটা ম্যানেজ করা যায় তখনই পাহাড়ের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায় ও। এ যে কী এক নেশা কাউকে বলে বোঝাতে পারে না সে। বাড়িতে এই নিয়ে অশান্তিও কম হয় না। কিন্তু পাহাড় ডাকলে সে ডাকে সাড়া না দিয়ে ওর কোনো উপায় থাকে না। ওর এই পাহাড়ের টান কাউকে কি বোঝানো সম্ভব ?
এবারে ছুটিটা একটু লম্বাই হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার একটা ছুটি পড়েছে,শনিবারটা ম্যানেজ করলেই শুক্র,শনি আর রবি তিনদিন টানা পাওয়া যায়। সোমবার সকালে নেমে দিব্য অফিস ধরা যাবে। সুতরাং আর নিজেকে বেঁধে রাখার কোনো মানেই হয় না। পাহাড় দেবতাকে স্মরণ করে তাই ওর এবারের যাত্রা শুরু।
বেশিরভাগ সময়ই অনির্বাণের যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে না। রওনা দেয়,তারপর যেখানে সন্ধ্যা নামে সেখানে হোম স্টে বা ছোট খাট কিছু পাওয়াই যায় ফলে থাকার কোনো অসুবিধা হয় না। বহু বছর ধরে পাহাড় চষে বেড়াতে বেড়াতে অনেক আটঘাঁটই ওর জানা হয়ে গিয়েছে। সুতরাং সমস্যা তেমন হয় না। আর পাহাড়ে ওর আসল কাজ তো খোঁজ,ফলে রাতের কোথাও আশ্রয় না পেলেও চিন্তা নেই,গাড়ি চালাতে চালাতেই রাত কেটে যায়। এইসব এলাকার ছোটখাট ফাঁড়িগুলোর পুলিশরাও এতদিনে ওকে চিনে নিয়েছে,ফলে আটকায় না কেউই। এত বছরে অনেকেই জেনে গিয়েছে এই শহুরে বাবুর কথা,ওর খোঁজের কথা। কেউ কেউ আড়ালে পাগলবাবুও ডাকে। ওরা জানে যে ছুটি পেলেই এক পাগলবাবু আসে আর খুঁজে চলে ওর হারানো সম্পদকে। সবাই আসল সত্যটা জানলেও কেউ আর বাধা দেয় না। এতদিনে ওরাও বুঝে নিয়েছে পাগলবাবুকে আটকানো যাবে না। মৃত্যুর আগ অবধি ও খুঁজেই যাবে,খুঁজবেই।
দূর থেকেই পাঁচ রঙা কাপড়ের টুকরোগুলো চোখে পড়ল অনির্বার্ণের। এক মুহূর্তেই বিষাদাক্রান্ত মনটা ওই রঙিন কাপড়গুলোর মতোই ঝলমল করে উঠল। পাহাড়ি হাওয়ায় একভাবে উড়ে যাচ্ছে পতাকাগুলো। পাহাড় উঠতে উঠতে পাথুরে আঁকাবাঁকা রাস্তায় যখনই ওগুলো চোখে পড়ে মনটা এমনই হয়ে যায়। এই অনুভূতি কাউকে বোঝানোর নয়। গাড়ির গতিও এইসময় কমে যায় ওর। পতাকাগুলোর কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামিয়ে দেয় ও। ধীর পায়ে নেমে আসে অনির্বান। আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে পতাকাগুলোর নিচে হাঁটু মুড়ে বসে। দু’হাতের আঙুলের মধ্যে আঙুল জড়িয়ে প্রণামের ভঙ্গি করে চোখ বুজে প্রার্থনা করে। কত সময় গড়িয়ে যায়,অনির্বাণের প্রার্থনা শেষ হয় না। পাশ দিয়ে হু হু করে ছুটে যায় কত শত গাড়ি। ওর হুঁশ ফেরে না। অনির্বাণ প্রার্থনা করতেই থাকে। এই প্রার্থনার জোর কতখানি ও জানে না,ও শুধু জানে একদিন ঠিক দেখা হবে,হবেই।
দার্জিলিঙ থেকে কিছু দূরের এক পাহাড়ি গ্রাম মাঙ্গওয়া। শান্ত সমাহিত এক গ্রাম,নিরিবিলিও। এখনও সেভাবে ভ্রমণ পিপাসুরা এখানে এসে পৌঁছায়নি। এখানকারই একমাত্র হোম স্টেতে উঠেছিল ওরা সেদিন। একপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা তো অন্য পাশে নাথুলা রেঞ্জের অভিনব সহাবস্থান । অনির্বান নেট ঘেঁটে খুঁজে বের করেছিল এই অপূর্ব ‘ডেস্টিনেশন’। হানিমুনের জন্য এর চাইতে ‘পারফেক্ট ডেস্টিনেশন’ আর হয় নাকি!
সকাল হতে না হতেই কাঁচের ফিনফিনে কাপে ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিঙ চা দিয়ে গেল হোমস্টের ছেলেটি। কাচের জানলায় চোখ রেখে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া মুগ্ধ চোখে দেখছিল অনির্বান। সাদা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়ে যেন শীতের আমেজ নিচ্ছে সুউচ্চ পর্বতটি। ঘাড় ঘুড়িয়ে নিজেদের বিছানার দিকে তাকাল অনির্বান। গত রাতের তীব্র আদরের পর ক্লান্ত শ্রান্ত ঐশীও নিজেকে ঢেকে রেখেছে সাদা গরম চাদরে। অনির্বাণের মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায়। ঐশী ওর কাছে এক পাহাড়ি ঝরনার মতো। আর সেই ঝরনায় খড়কুটোর মতো ভেসে যায় অনির্বাণ।
বিছানার এক কোণে বসে ঐশীর এলোমেলো চুলগুলোর মধ্যে ভেতর আঙুল ডুবিয়ে দেয়। কপালের কাছে জড়ো হওয়া কালো রেশম সরিয়ে দেয় আদর করে। তারপর নিজের মুখটা ঐশীর ঠোঁটের একদম কাছে নিয়ে এসে আলতো করে চুমু খেয়ে নিজের মনেই বলে ওঠে,’আমার পাগলিটা’।
ঐশী টের পায়,ছদ্ম বিরক্তি মাখিয়ে বলে,’উফ,যাও তো! সক্কাল সক্কাল তোমার শুরু হল।’ অনির্বাণ হাসে,ঐশীর ঘাড়ে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে,’সে না হয় যাচ্ছি,কিন্তু ম্যাডাম উঠবেন কখন! এই না কাল বললে,সকালে হাঁটতে বের হব!’
ঐশী চোখ খোলে। অনির্বাণকে একবার দেখে নিয়েই চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর বলে,ধুর! শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে শুয়েই থাকি।
অনির্বাণের ভ্রু কুঁচকে ওঠে মুহূর্তেই। চিন্তিত স্বরে বলে,এ্যাই তোমার কী হয়েছে বল তো! আসার পর থেকে শুনছি ভালো লাগছে না। শরীর ঠিক আছে তো?
চোখ সরিয়ে নেয় ঐশী। যেন এই মুহূর্তে কিছুতেই ধরা দেবে না ও অনির্বাণের কাছে। পাহাড়ের মতো জীবনেও কিছু রহস্য থাকা ভালো। ও অনির্বাণকে জোর করে ঠেলে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। তারপর ঘুম জড়ানো গলায় বলে ওঠে,নাহ,ঠিকই আছে। চলোহ…
পাহাড়ের রাস্তায় উঠতে কষ্ট হয় খুব। ধীর পায়ে অনির্বানের হাত ধরে হাঁটছিল ঐশী। হাঁফ ধরছিল একটুতেই। মনে হচ্ছিল একটু কোথাও বসলে ভালো হয়। কিন্তু অনির্বাণের কথা ভেবে সেটা বলাও হচ্ছিল না। অফিসের চাপে তেমন কোথাও বেরও হয় না ছেলেটা। তাই এই হানিমুন নিয়ে ও নিজেই খুব উত্তেজিত ছিল। খুব আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছিল ও,আর ইচ্ছেমতো ছবি তুলে যাচ্ছিল কখনো পাহাড়ি নানা দৃশ্যের কখনো ঐশীর। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ফুটে ওঠা গোলাপি ফুল তুলে গুঁজে দিচ্ছিল ঐশীর চুলে। ওর এইসব ছেলেমানুষী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল ঐশী। অদ্ভুত মন মাতানো এক শীতল হাওয়া ওদের দুজনের শরীর ও মনকে ভিজিয়ে দিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিল কে জানে। ঐশী সেই অদ্ভুত আবেশ গায়ে মাখতে মাখতে হেঁটে যাচ্ছিল অনন্ত পথ।
পাহাড়ের আবহাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায় ঠিক মানুষের জীবনের মতো। বাঁকের পর বাঁক শুধু রহস্য। গত রাতে এখানে প্রবল বৃষ্টি ছিল,পিছল রাস্তাঘাট তার কিছুটা প্রমান দিচ্ছে। তবে এখন ঝলমলে রোদ উঠছে তার ওপর অদূরের রঙ্গীত নদী থেকে বয়ে আসা মিষ্টি বাতাস তো বইছেই। দূরে কোনো নাম না জানা ঝোরা থেকে অঝোরে জল পড়েই যাচ্ছে। তারই শব্দ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির। পাহাড়ি বুলবুল নাকি হোয়াইট ক্যাপড রেডস্টার্ট? গলা শুনে ঠিক ঠাহর করতে পারে না ঐশী। কিন্তু শব্দটা কানের ভেতর দিয়ে একবারে হৃদয়ে গিয়ে স্পর্শ করছে। পাহাড়ের সব অনুভূতিই স্বর্গীয়।
ওরা উঠছে,উলটো দিক থেকে নেমে আসছে পাহাড়ি কিছু মহিলা। পিঠে বেতের ঝুড়ি আর তাতে বোঝাই কুড়িয়ে নেওয়া টুকরো টাকরা লকরি। গায়ে জড়ানো জংলি ছাপের জামা আর লুঙ্গি। মাথাতেও ওই একই ধরনের কাপড় জড়ানো। অনির্বাণ পটাপট ছবি তুলে নিচ্ছে। ঐশীও ওদের সঙ্গে পোজ দিয়ে দাঁড়ালো। পাহাড়ি মানুষগুলোর কঠিন মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা সহজ সরল মন। ওদের হাসিমুখ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। অনির্বাণ ছবি তুলছে একের পর এক। স্মৃতিগুলো ধরে রাখছে ভবিষ্যতের জন্যে। ঐশীর শরীর খারাপ লাগলেও মন ভরে যাচ্ছে এক আশ্চর্য আবেশে।
হাঁটতে হাঁটতেই আরও কিছুটা ওপরে ওঠে ওরা। অনির্বাণ সরু চোখে ছয় মাস পুরোনো বউয়ের দিকে তাকায়,আদর মেখে বলে,চলো এবার ফিরি। ঐশীরও তাই ইচ্ছে,তবু ও কিছুক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,চলো না ওইদিকটায় একটু যাই একটা মন্দির আছে মনে হয়।
অনির্বাণ বলে,কী করে বুঝলে? ঘন্টা বাজল নাকি? শুনতে পাইনি তো! তোমায় দেখে মনে হচ্ছে তোমার এই জায়গা আগে থেকে চেনা।
কিছু একটা চিন্তা করছিল ঐশী। হঠাৎই যেন থতমত খেয়ে বলে উঠল,না,না ঘন্টা নয়,ওই দেখো প্রেয়ার ফ্ল্যাগ উড়ছে, তাতেই মনে হল আশেপাশে কোনো মন্দির বা মনাস্ট্রি আছে বোধহয়।
প্রেয়ার ফ্ল্যাগ আবার কী? অনির্বাণ অবাক গলায় জানতে চায়।
ঐশী সস্নেহে ওর বরের গালটা টিপে দিয়ে বলে,বুদ্ধু বরটা আমার কম্পিউটার ছাড়া আর কিচ্ছু জানে না! আরে পাহাড়ে পাহাড়ে ওই যে রঙিন কাপড়গুলো ঝোলানো থাকে না,ওগুলোই হল প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বা প্রার্থনা পতাকা।
সে তো বুঝলাম,কিন্তু এগুলোর অর্থ কী? কেন থাকে তাও তো জানি না। বলো তো শুনি। অনির্বাণ বলে ওঠে।
অল্প অল্প হাঁফাচ্ছিল ঐশী। তবু যুগলে এগিয়ে যাচ্ছিল পাহাড়ি পথ ধরে। আন্দাজটা ঠিকই করেছিল ঐশী। তবে মনাস্ট্রি নয়,একটা ছোট্ট মন্দির দেখা যাচ্ছে সামনেই। বড় বড় কতগুলো কালো পাথরের ওপর ছোট্ট একটা কাঠের মন্দির। সামনে দিকে টাইলসে বাঁধানো রাম সীতা লক্ষ্মণ আর হনুমানের ছবি। পাথরের ওপর ফুটো করে করে সরু সরু করে বাঁশ পুঁতে ওতেই লাল,নীল,হলুদ পতাকা ঝুলিয়ে রাখা।
কালো পাথরটায় গায়ে সিঁড়ির মতো কয়েক ধাপ বানানো খোদাই করে। কাছে আসতেই বোঝা গেল মন্দিরটা পাথরের ওপর নয়,পেছনে। কিন্তু বানানোই এমনভাবে যে মনে হচ্ছে যেন ওপরে বানানো। অনির্বাণ ওই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল। ঐশী চিৎকার করে বলল,সাবধানে পেছনে কিন্তু খাদ! অনির্বাণ উঁকি দিয়ে দেখে অবাক হল ৷ সত্যি নিচে ভয়ঙ্কর খাদ। ও খাদের দিকে মুখ করে দু’হাত দু’পাশে মেলে ফিল্মি কায়দায় বলে উঠল,আই লাভ ইউ ঐশীইইইইই। মুহূর্তেই ওর এই চিৎকার হাজারগুন বেশি হয়ে ওদের কাছেই ফিরে এল ৷ ঐশী একটু লজ্জা পেল,ওপর থেকেই মনে হল অনির্বাণের। ও এক পা এক পা করে নিচে নেমে এল ঐশীর কাছে।
কালো পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ঐশী বলল,এই যে চার কোণা আকৃতির রঙিন কাপড়গুলো উড়ছে এগুলো পাহাড়ি এলাকার অন্যতম ধর্মীয় বিশ্বাস,জানো ! লক্ষ্য করে দেখবে প্রতিটি কাপড়ে কাঠের ব্লকের ছাপ দিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য কিম্বা ছবি ছাপানো থাকে। পাহাড়ের লোকেরা মনে করে এই কাপড়গুলো পতাকার মতো ওড়ালে ঈশ্বরের করুণা বজায় থাকে।
অনির্বাণ হাসে। ঈশ্বর দেবতায় ওর একেবারেই বিশ্বাস নেই। তবু ও আগ্রহভরে শোনে বউয়ের কথা।
ঐশী বলে চলে,দেখবে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে মোট পাঁচটি রঙের সেট থাকে,পাঁচটি খাঁটি রঙ। এইসব অঞ্চলের মানুষরা মনে করে পতাকাগুলো যা কিছু লেখা আছে সেইসব বাণী বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে চারিপাশে। বৌদ্ধরা যেমন মনে করেন এর ফলে অহিংসার কথা ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। অবশ্য সেই অতীশ দীপঙ্করের আমল থেকেই এই বিশ্বাস জড়িয়ে রাখে এই পাহাড়ি মানুষগুলোকে। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস নেয় ঐশী ৷
পাহাড়ের সব কিছু জানো তাই না? অনির্বাণ ঐশীর কপালে হালকা টোকা দিয়ে বলে।
জানোই তো পাহাড় আমার কত্তো প্রিয়। বাবার সঙ্গে এইসব পাহাড়ের আনাচেকানাচে ঘুরে বেরিয়েছি কত। তখন তো এত হোম স্টে,রিসর্টের বাড়াবাড়ি ছিল না,ছিল না এত মানুষের আনাগোনা। প্রকৃতি ছিল নির্ভেজাল,এখানকার মানুষগুলোর মতোই সহজ সরল,অনাঘ্রাত।
খুব সুন্দর বললে তো! অনির্বাণ মুগ্ধ হয়ে তাকায় ওর স্ত্রীর দিকে। মাঝেমাঝে এই মেয়েটাকে পাহাড়ের মতোই দুর্বোধ্য মনে হয়,আবার অনেক সময় হালকা,নির্ভার ওই নাম না জানা ঝোরাগুলোর মতো।
ঐশী এক দৃষ্টিতে উড়তে থাকা পতাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনির্বাণ ওকে বিরক্ত করে না। কাঁধে ঝুলতে থাকা ডি এস এল আর দিয়ে বন্দি করে ফেলে নানান মুহূর্ত,দৃশ্য।
পাহাড় কত রুক্ষ,তাও কত সুন্দর না? ঐশীর কথায় এদিকটায় ফিরে আসে অনির্বাণ। ঐশী বলতেই থাকে,জানো মনে হয় যেন এই পাহাড়ই আমার সব। এখানে এলেই আমি প্রাণ খুঁজে পাই।
অনির্বাণ ওর কাঁধে আলতো হাত রাখে। ঐশী ধীর গলায় বলে,এখানে এলে আমি বাবার গন্ধ পাই। জানি বাবাও এদিকেই কোথায় কোনো দূর পাহাড়ের ভাঁজ থেকে আমায় ঠিক দেখছে।
অনির্বাণ ঐশীর বাবার ঘটনাটা জানে,ট্রেক করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল পাহাড়প্রেমী মানুষটা। ঐশীও ট্রেক করত,কিন্তু বাবার এই ঘটনায় ওর মায়ের অনিচ্ছের জোরেই সেসব বন্ধ হয়ে যায়। বিয়ের আগেই এসব কথা জানত অনির্বাণ। তাই তো হানিমুনের জন্য পাহাড়ি এলাকাই বেছেছিল ও,অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। হাঁটতে হাঁটতে যেন ঐশী খুঁজছিল ওর বাবাকে,বুঝতে পারছিল ও। পাহাড়ে এসে ভালো লাগছিল ওর,আর এতেই অনির্বান স্বস্তি পাচ্ছিল মনে মনে।
ঐশী ঘোর লাগা গলায় বলে উঠল,জানো বাবা আর আমি ওই প্রেয়ার ফ্ল্যাগের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতাম। হাত জোড় করে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। পতাকাগুলো হাওয়ার উড়ত আর আমাদের মনে হত সব প্রার্থনা পৌঁছে গেল ঈশ্বরের কাছে।
পরিবেশটা হঠাৎই কেমন ভারি হয়ে গেল। অনির্বাণ তা হালকা করার জন্য বলে উঠল,তা ম্যাডাম কী প্রার্থনা করতেন? আমার মতো বর পাওয়ার? কথাটা বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল অনির্বাণ। কিন্তু ঐশীর মুখে হাসি নেই। অনির্বান ওকে ঠেলে দিয়ে বলল কী ভাবছ এত?
ঐশী অদ্ভুত অচেনা চোখে তাকালো অনির্বানের দিকে। অনির্বাণ ঐশীর চোখ,মুখ এমন আগে দেখেনি কখনো। ওই অদ্ভুত চাহনিতেই অনির্বাণের চোখে চোখ রেখে ঐশী বলল,বাবার সে প্রার্থনা পূরণ হয়েছে জানো। শুধু আমারই…
কোন প্রার্থনা? কী পূরণ হয়েছে? ঐশীর কথায় কেমন যেন লাগে অনির্বাণের। ঐশী হাসে,অথচ সে হাসিতে কোনো উচ্ছ্বলতা নেই,উচ্ছ্বাস নেই। ঐশী যেন এখন কোনো পাহাড়ি ঝরনা নয়,এক শান্ত সমাহিত গভীর নদী যাকে বোঝা আরও শক্ত।
বাবা পাহাড়েই মিশে যেতে চেয়েছিল। যাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি মৃত্যুর পর তার কোলেই বিলীন হয়ে যাওয়া…ঐশী ধীর গলায় বলে থামল কিছুক্ষণ।
অলক্ষ্যে সামান্য কেঁপে উঠল অনির্বাণ। পাহাড়ি হাওয়া গায়ে লাগছে এবারে। কাঁটার মতো বিঁধছে। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য ও বলে উঠল,কাল রাতে কী বলতে চাইছিলে?
ঐশী যেন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ওই মুহূর্তে যেন সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ ও। অনির্বাণ আবার বলে ওঠে,কাল রাতে বললে না,আজ একটা খবর জানাবে? কী সেটা?
ঐশী ডানহাতটা নিজের পেটের ওপর রাখে। তারপর অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে বলে,বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না,না? যাওয়ার আগে বলেছিল ফিরে এসে একটা খুশির খবর দেবে,সেটা কী আজও জানা হল না। খুব জানতে ইচ্ছে করে জানো !
আচ্ছা,আচ্ছা হয়েছে। এবারে চলো ঘরে ফেরা যাক। খিদেও পেয়ে গিয়েছে। অনির্বাণ বলে ওঠে।
ঐশী বলে,মন্দিরে প্রণাম করে আসি তবে !
পারবে? শরীর ভালো লাগছে না বলছিলে না! অনির্বাণ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় ওর দিকে।
ঐশী হাসে। অনির্বাণ জানে এই হাসির অর্থ। ও বোঝে কয়েক বছরের অনভ্যাসেও পাহাড় এতটুকু অচেনা হয়নি ঐশীর কাছে। হাঁফ ধরলেও বেশ তাড়াতাড়িই ওপরে উঠে যায় ঐশী। একটু একটু করে এগোয় মন্দিরের দিকে। অনির্বাণ চিৎকার করে বলে,বেশি এগিয়ো না,সামনে খাদ। পটাপট কয়েকটা ছবি তোলে ও ঐশীর ও আশেপাশের। ঐশী দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটার সামনে,প্রার্থনা করছে হয়ত। অনির্বাণ এক ঝলক দেখেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। উলটো দিকের দৃশ্যাবলী ভরে নিতে থাকে ক্যামেরার মেমোরিতে।
দূরে ঝোরার আওয়াজ আর দু’চারটে পাখির ডাক। হঠাৎ হঠাৎ দু একটা করে গাড়ি যাচ্ছে,আসছে হর্ণ দিতে দিতে। এরই মাঝে ঝপ করে একটা আওয়াজ পায় অনির্বাণ। পলকে ঘাড় ঘুরিয়েই দেখে ঐশী নেই। চারপাশ যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। অনির্বাণ নিচে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশ্চুপ,নিঃশ্চল।
হাসপাতালের বেডে যখন নিজেকে আবিষ্কার করে তখন ওর সামনে ঐশী নেই কোথাও। নিজের বাবা,মা,ভাই আর ঐশীর মা। সবাই কাঁদছে। শুধু অনির্বাণের চোখে জল নেই। ও কেমন অদ্ভুতভাবে সবার চোখের দিকে তাকায়,হয়ত ঐশীকে খোঁজে,কিন্তু ও তো কোথাও নেই,কোত্থাও না।
একটু সুস্থ হলে ঐশীর মা জানায়,এই কারণেই পাহাড় যেতে বারণ করতেন তিনি ৷ সারাদিন শুধু একই কথা,বাবা কী কথা বলতে চেয়েছিল সেটা শোনা হল না। বাবা তো এমন করে না কখনো। মেয়েকে দেওয়া কথা বাবা রাখবেই। তাইতো সে কথা শুনতেই মেয়ে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে পাহাড়ে। ওর খোঁজ এতদিনে হয়ত মিটেও গেছে ৷ ঐশীর মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অনির্বাণের শ্বাস পড়ে না। ও শুয়ে থাকে মড়ার মতো,নিথর।
পাহাড় এভাবেই হয়ত মানুষকে টানে। আগে ঐশীর বাবাকে টানত,পরে ঐশীকে,আর এখন অনির্বাণকে। দশ বছর ধরে তাই অনির্বাণ পাহাড়ে পাহাড়ে এই একই উত্তর খুঁজে চলে। যদি কোথাও ঐশীর দেখা মেলে,যদি ওই পতাকায় গায়ে ওর প্রশ্নের দমকা হাওয়া এসে ঐশীকে জাগিয়ে দিয়ে যায়! ঐশী কি সেদিনও বলবে না,সেই রাতে ও কী বলতে চেয়েছিল?
পাগলবাবু এখন তাই মাঝেমধ্যেই পাহাড়ে আসে। যেখানেই ওই প্রেয়ার ফ্ল্যাগ ওড়ে হাঁটু মুড়ে বসে যায় ও। চোখ বুজে ওর প্রার্থনা পৌঁছে দেয় ঈশ্বরের কাছে।
সেদিন রাতে পাহাড়ের এক ভাঙা ঘরে বসে অনির্বাণ স্বপ্ন দেখে। এক সুন্দর রিসর্টে বসে আছে ওরা দুজন। ঐশী আর অনির্বাণ। ঐশী চোখদুটো আলতো করে বোজে,ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে নিজের জীবনকে মিশিয়ে নিয়েছে ও। আজ এই মুহূর্তে ওর চোখেও লেগে আছে অনির্বাণর স্বপ্নের পেলব পরশ। ও বিশ্বাস করে,ওদের দুজনের ভালোবাসার জোরে সেই স্বপ্ন একদিন পূরণ হবেই। আর সেদিন ওরা ড্রাইভ করে চলে যাবে দার্জিলিঙের ছোট্ট গ্রাম মাঙ্গওয়ার হোম স্টেতে,যার একদিকে নাথুলা রেঞ্জ অন্যদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই হোম স্টেতে যেখানে হানিমুনের পর আর যায়নি অনির্বাণ। সেই রিসর্টে বসেই সেদিন ওরা এমনই প্রথম দেখা হওয়ার দিনের অথবা অন্য কোনোদিনের স্মৃতিচারণ করছে হাতের ওপর হাত রেখে। ঐশী অনির্বাণের কানের কাছে মুখ এনে বলে ওঠে,তুমি বাবা হতে চলেছ।
অনির্বাণ খুশিতে জড়িয়ে ধরে ঐশীকে। ঐশী গায় ওর মায়ের থেকে শেখা গানটা,’এমনই বরষা ছিল সেদিন,শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন,তব হাতে ছিল অলস বীন’,আর অনির্বাণও ওর বেসুরো গলায় সুর মেলাচ্ছে ঐশীর সঙ্গে আর প্রিয়তমার চিবুকটা ধরে বলে উঠছে,’মনে কি পড়ে প্রিয় ?’
কাছেপিঠের কোনো পাহাড়ী রাস্তায় লাল,নীল,সবুজ,হলুদ প্রার্থনার পতাকা হাওয়ায় পতপত করে উঠবে। অনির্বাণ আর ঐশীর এইটুকু চাওয়া কি ওই প্রার্থনা পতাকা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দেবে না? অনির্বান খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ের গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে ঐশীর কাছে গিয়ে পৌঁছায় কিনা কে জানে ?
পাহাড়ে আধো অন্ধকারের ভাঙা এক ঘরে চোখ খুলে শুয়ে থাকে একা অনির্বাণ। এই পাহাড়ে কখন ভোর হবে কে জানে!
*******************************
শাঁওলি দে পরিচিতিঃ জন্ম ১৯৮২ সালে কোচবিহার জেলার প্রান্তিক শহর হলদিবাড়িতে। বর্তমানে বৈবাহিক সূত্রে জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্রী,লেখালিখি শুরু ছোটবেলাতেই। ইংরাজির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। কবিতা দিয়ে শুরু,পরবর্তীতে ছোটগল্প,অণুগল্প ও ভ্রমণ প্রকাশিত হয়েছে বহু পত্র পত্রিকায়। দেশ,উনিশকুড়ি, উত্তরবঙ্গ সংবাদ,এখন ডুয়ার্স,রং রুট,ফেমিনা বাংলা,কথা সাহিত্য,নন্দন,শিলাদিত্য,তথ্যকেন্দ্র,লং জার্নি,উত্তরের সারাদিন,গৃহশোভা,আজকালসহ নানা পত্রিকায় বেরিয়েছে লেখা ৷ ফিচার লেখাতেও সমান স্বচ্ছন্দ। যৌথভাবে অণুগল্প সংকলন (দুই দুগুনে এক) ছাড়াও আরও অনেক সংকলনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা বইমেলা ২০১৯-য় প্রকাশিত হয়েছে ছোটগল্পের বই ‘মায়াঘর’ (প্রকাশক ‘দ্য কাফে টেবল’) ও অণুগল্পের বই ‘বৃষ্টিফোঁটার মতো’ (প্রকাশক-সৃষ্টিসুখ),আছে একটা ই-বুক ‘মেয়েবেলার গল্প’ (প্রকাশক-শপিজেন)। নির্বাচিত গল্পের সবগুলোই কোনো না কোনো বাণিজ্যিক কিংবা ছোট পত্রিকায় প্রকাশিত। উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বই পড়া,গান শোনা নেশা।