ভোলা ময়রা
অনির্বাণ সাহা
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার প্রখ্যাত কবিয়ালদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভোলা ময়রা। তিনি তৎকালীন সময়ে একজন রসিক কবিয়াল হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ভোলা নায়েক। তবে এখানেও রয়েছে বিতর্ক। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তাঁর পিতৃদত্ত বা পারিবারিক নাম ছিল ভোলানাথ মোদক। ভোলা ময়রার পরিবারের নবম পুরুষ শ্রীযুক্ত তারক নাগ বা নায়েক মহাশয় জানান যে,এহেন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির জন্মস্থান ছিল হুগলি জেলার অন্তর্গত গুপ্তিপাড়া গ্রামে। তবে অন্য একদল ঐতিহাসিকগণের মত অনুসারে তাঁর জন্মস্থান কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে। “কবিগানে হুগলি জেলা” বইটি থেকে জানা যায় যে ভোলা ময়রা ১৭৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল কৃপারাম। অধুনা গুপ্তিপাড়ার পুরানো বাজার অঞ্চলে ছিল তাঁর পারিবারিক মিষ্টান্নের ব্যবসা। অর্থাৎ জীবিকাগত দিক থেকে তাঁরা ছিলেন মোদক বা ময়রা। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন তাঁদের জীবিকার কারণেই ভোলানাথ মোদক থেকে নাম পরিবর্তিত হয়ে ভোলা ময়রা হয়েছে। News18 বাংলায় ২১শে এপ্রিল,২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,”গুপ্তিপাড়ায় তাঁর আদিবাড়ি যেখানে ছিল,সেই জমিটা আজ বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এখন ওখানে থাকেন ব্রাহ্মণরা। ভোলা ময়রার আর কোনও স্মৃতিই নেই গুপ্তিপাড়ায়। তবে এই প্রতিবেদনটিকে ঘিরে কিছু বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কারণ ৯ই অক্টোবর,২০১৮ তারিখে প্রকাশিত ‘অবেক্ষণ’ ওয়েবপেজে প্রকাশিত পলাশ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত “গুপ্তিপাড়ার গুপ্ত কথা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে,বর্তমান গুপ্তিপাড়া পুলিস ফাঁড়ির ঠিক সামনেই ভোলা ময়রার বাড়িটি অবস্থিত।
বাল্যকালে গ্রামের স্থানীয় পাঠশালা বা টোলে সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন। ভোলা ময়রা সংস্কৃত ছাড়াও ফরাসি ও হিন্দি ভাষাতেও ছিলেন যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ। সাথে সাথে পুরান ও ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কেও বেশ কিছু জ্ঞান আহরণ করেন তিনি। শিক্ষালাভের সাথে সাথেই কবিতা চর্চা করতে থাকেন এবং লিখতেও থাকেন। এছাড়াও ইতিহাস ও সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন তিনি।
শিক্ষালাভের শেষে কলকাতায় পারিবারিক ব্যবসাতে যোগদান করলেও সেখানে তাঁর বেশিদিন মন টেঁকেনি। ব্যবসার দেখাশুনা করতে করতেই তিনি বিভিন্ন কবিতা ছড়া ও গান রচনা করতে তে থাকেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কবিগানকেই তাঁর ধ্যান–জ্ঞ্যান হিসেবে বেছে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। কবিগানের ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত কবিয়াল হারু ঠাকুর। এখানে উল্লেখ্য হারু ঠাকুর ছিলেন তৎকালীন শোভাবাজার রাজবাড়ীর রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের সভাসদ। হারু ঠাকুরের কবিগানের দলেই ভোলা ময়রার “দোহার” রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তী সময়ে নিজের কবি গানের দল গঠন করে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সাম্মানীর বিনিময়ে স্বাধীনভাবে অনেক আসর জমাতে থাকেন তিনি। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি, তাৎক্ষণিক সৃষ্টি,আক্রমণাত্মক বাচনভঙ্গি এবং রস–রুচি পূর্ণ পরিবেশ শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করত। রাম বসু, বলাই সরকার, যজ্ঞেশ্বর ধোপা,এন্টনি ফিরিঙ্গি,হোসেন খাঁ প্রমুখের মতো স্বনামধন্য কবিয়ালেরা ছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষ। কবিগানের আসরে ভোলা ময়রা মূলত গুরু হরু ঠাকুর,গদাধর মুখোপাধ্যায়,ঠাকুরদাস চক্রবর্তী প্রমুখের রচিত গান,স্বরচিত ও তাৎক্ষণিক কবিতা পাঠ করতেন। তৎকালীন সময়ের অন্যতম খ্যাতনামা এই কবিয়াল এক বিদেশী অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কাছে কবিগানের এক আসরে পরাজিত হয়েছিলেন। তবে হার স্বীকার করেও ভোলা সাহেবকে তাঁর কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি ৷ সমাজের উঁচু তলার মানুষ তথা সম্মানীয় ব্যক্তিদের এটার মাধ্যমে ভোলা বোঝাতে চেয়েছিলেন “সাম্প্রদায়িকতার উর্দ্ধে গিয়ে একজন প্রকৃত শিল্পীর গুণের কদর অবশ্যই করা উচিত“৷ শুধুমাত্র এন্টনি ফিরিঙ্গিই নয় তৎকালীন সময়ের অন্যান্য খ্যাতনামা কবিয়াল যজ্ঞেশ্বর ধোপা,হোসেন শেখ,বলাই বৈষ্ণব প্রমুখের সাথেও ভোলা ময়রার কবিগানের সম্মুখ সমর হয়। এহেন উচ্চমানের সুপ্রতিষ্ঠিত কবিয়াল ১৮৫১ সালে পরলোক গমন করেন।
ড: বসন্ত কুমার সামন্ত তাঁর “কবিগানে হুগলি জেলা” নামক বইটিতে উল্লেখ করেছেন কবিগানের মাধ্যমে শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভোলা ময়রাকে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করে বলেছিলেন:-“বাঙ্গলা দেশের সমাজকে সজীব রাখিবার জন্য মধ্যে মধ্যে রামগোপাল ঘোষের ন্যায় বক্তার,হুতোম প্যাঁচার ন্যায় রসিক লোকের এবং ভোলা ময়রার ন্যায় কবিওয়ালার আবির্ভাব হওয়া নিতান্ত আবশ্যক“।
তথ্যসূত্র :
–- “কবিগানে হুগলি জেলা” – ড: বসন্ত কুমার সামন্ত।
— শ্রীযুক্ত তারক নাগ বা নায়েক (সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিক তথা ভোলা ময়রার পরিবারের নবম পুরুষ) ।
— শ্রীযুক্ত সুজিত মুখোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন মহাশয় (পৌরহিত্য প্রশিক্ষক,ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ও লেখক)।
*********************************
অনির্বাণ সাহা – ক্ষেত্র সমীক্ষক ও প্রাবন্ধিক