*”মুহূর্তে বাঁচে প্রেম,মুহূর্তরাই বাঁচে“*
আশিস দাস
“প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন,
সরোবর তো সবার বুকেই
পদ্ম কেবল পর্দানশীন“…
কলেজ ফাংশানে পূর্ণেন্দু পত্রীর এই কবিতা আবৃত্তি করে যেই স্টেজ থেকে নেমে এলাম তখন নুপূর বলেছিল,”ওরে অনি, তোকে আমার ওখানেই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল রে…মাইকে তোর কি রোম্যান্টিক ভয়েস..ওহ !!” সেই নুপূরকে একদিন বলেছিলাম “সিনেমা দেখতে যাবি?” ও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে,আমাকে মোহিনী মায়ায় আচ্ছন্ন করে বলেছিল,”জানিস অনি,তোর সাথে আমি জাহান্নামে যেতেও রাজী |” সেদিন আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম ঠিকই,কিন্তু ওর কথা মতো জাহান্নামে যাওয়া আমাদের হয়নি |
অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে মুছে গেছে,নুপূরও আজ নেই,কিন্তু ওর সেদিনের সেই কথাটা একটুও ঝাপসা হয়নি,অমলিন থেকে গেছে | কয়েকটা মুহূর্ত:সেইসব মুহূর্তের মধ্যেই বেঁচে আছে প্রেম;আসলে প্রেম হয়তো মুহূর্তের মধ্যেই বাঁচে,বেঁচে থাকে মুহূর্তরা |
প্রেম তো মুহূর্তের ঝলক,তাকে ধরিলে সে ধরা দেয় না,সে কেবল পালিয়ে বেড়ায়,দৃষ্টি এড়ায়,ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে কিন্তু সেই ইঙ্গিতও কি সবসময় বোঝা যায় ? যায় না হয়তো |
এক চরম ভালোবাসার মুহূর্তে,সমরেশ বসুর ‘বিবর‘ উপন্যাসের নায়ক প্রেমিকা নীতাকে হত্যা করলো | কিন্তু কেন এই হত্যা ? এই হত্যার মোটিভ কি ? মোটিভ তো হত্যাকারী নিজেই জানেনা;সে তখনো নীতার বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে,ছুঁতে চাইছে তার বিছানার চাদর,সে বলছে,’জানি এখন আর কিছুই নেই তবু মানুষের একটা কী রকম আছে,সে না–থাকা জিনিসকেও পেতে চায়,নীতা তো ওখানেই ছিল” l আসলে এই নায়কও হয়তো মুহূর্তের প্রেমকে ধরে রাখতে চেয়েছিল; যেমন “অপরিচিত” ছবিতে নায়ক এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে নায়িকা কে খুন করলো l
এই রকম অবস্থা দেখা যায় Browning এর “Porphyria’s Lover” কবিতায়;ভালোবাসার মুহূর্তেই Porphyria তার প্রেমিকের হাতে খুন হয়ে গেল;কিন্তু এইসব বিস্ময়কর ঘটনার কারন কি হতে পারে? আমাদের এই রহস্যের উৎস জানা নেই তবে এখানে প্রেমিক হয়তো সেই মুহূর্তের প্রেমকেই চিরন্তন করতে চেয়েছিল ll
মুহূর্তের প্রেমের অপরূপ নিদর্শন আমরা দেখলাম অমিতাভ ঘোষের বিখ্যাত উপন্যাস The Hungry Tide এ ll সেখানে ফকির জেলে আর পিয়ালী রায় এর মধ্যে ভাষাহীন প্রেম l ওরা কেউ কারো ভাষা বোঝেনা কিন্তু দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে অব্যক্ত প্রেম l সুন্দরবনে এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের সময় ফকির পিয়ালী রায়কে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে রাখলো,যাতে ঝড়ের আঘাতে পিয়ালী রায় আহত না হয়,কিন্তু ভয়াবহ ঝড়ের তান্ডবে হঠাৎ বিরাট গাছের ডাল ভেঙ্গে ফকিরের পিঠে পড়লো, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হলো ফকিরের,বেঁচে রইলো পিয়ালী রায়;মর্ত্যলোকে ফকির আর পিয়ালী রায়ের প্রেমের কোনো প্রতিষ্ঠা কোনোদিন সম্ভব ছিল না,কিন্তু মুহূর্তের ঘটনায় ফকিরের মৃত্যুই এই প্রেমকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেল ll আমরা আবার দেখলাম যে মুহূর্তই সৃষ্টি করলো অপরূপ প্রেম এবং প্রেম বেঁচে রইলো মুহূর্তের মধ্যেই;যেমন রমাপদ চৌধুরীর “যে যেখানে দাঁড়িয়ে” উপন্যাসে আমরা দেখলাম প্রেম বেঁচে আছে কয়েকটা মুহূর্তকে নির্ভর করে;চিরপ্রবহমান জীবনে প্রেমই হয়তো নিশ্চল,হাজার পরিবর্তনের মাঝেও দাঁড়িয়ে থাকে একা;অনেক বছর পর মুসাবনিতে হাটের মাঝে অঞ্জলীকে দেখে হতবাক হয়েছিল অনুপম;বহু আগে সিমলা স্ট্রীটে থাকার সময়তো কত কথাই বলার ছিল অঞ্জলী কে,কিন্তু সেদিন কিছুই বলা হয়নি,তাই বলে কি সেই সব না–বলা কথার মৃত্যু হয়েছে? না,সব কথাই জমে স্মৃতি হয়ে আছে;সেইসময়ে দুজনেই দুজন কে একটু দেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতো! একদিন বিয়েবাড়ি গিয়ে অঞ্জলীর ফিরতে রাত হয়ে গেছিল,সেদিন এত রাত্রে ফিরে অনুপমকে দেখতে পাবেনা বলে অঞ্জলীর মনখারাপ লাগছিল কিন্তু সেই রাতেও অঞ্জলী দেখেছিল ওর জন্যে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে প্রেম;প্রেমের একটা নামই হয়তো অপেক্ষা;আজ স্বামীর সঙ্গে মুসাবনি এসে দেখা গেল সেখানে অনুপম ও এসেছে সপরিবারে;অঞ্জলীর মেয়ে ঝুমঝুমের সাথে অনুপমের ছেলে বাপ্পার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল;কিন্তু এই দুই পরিবার অল্প দিনের জন্যে এখানে এসেছে, ওরা যে যার জায়গায় ফিরে যাবে যেদিন সেদিন সবই কি স্মৃতি হয়ে যাবে !! বাপ্পা আর ঝুমঝুম নদীর ধারে বেড়াতে যায়,দুজন দুজনের ছবি তোলে;বাপ্পা বলে,”এখান থেকে তো চলে যাবো একদিন,তারপর হয়তো দেখাও হবেনা তোমার সঙ্গে;তখন এক একদিন বের করে দেখবো তোমাকে” ll তারপর একদিন সত্যিই ঝুমঝুমদের যাবার দিন এসে যায়,অনুপম অঞ্জলীদের ট্রেনে তুলে দিতে আসে,ট্রেন ছেড়ে যায়,তখন বাপ্পা দাঁড়িয়ে থাকে দুরে,নিশ্চল,অপলক শুধু তাকিয়ে থাকে চলে যাওয়া ট্রেনটার দিকে;ট্রেন চলে গেল,শুধু কয়েকটি মুহূর্তের ঘটনা,কিন্তু বেঁচে রইলো প্রেম,ওই বিশেষ কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যেই ll
এইরকমই এক গল্প বললেন Browning;ছেলেটি বুঝতে পারলো যে সে তার প্রেয়সীকে পাবেনা,তাই সে শেষবারের মতো প্রেয়সীর কাছে সামান্য আবেদন করলো,সে শুধুই এই চন্দ্রালোকিত রাত্রে তার প্রেমিকার সাথে ঘোড়ায় চেপে ছুটে যেতে চাইলো দুর থেকে দুরে;এই সামান্য আবেদন শুনে অবাক হলো প্রেমিকা;সম্মতি পাওয়া গেল,চন্দ্রালোকিত রাত্রে যখন ওদের ঘোড়া ছুটে চলেছে তখন ছেলেটি ভাবছে যে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে;এটাই তো জীবনের চরমতম প্রাপ্তি, কারণ কে বলতে পারে পৃথিবী আজ রাত্রেই শেষ হয়ে যাবেনা! “Who knows but the world may end tonight ?” আর যদি তাই হয়,তাহলে তো এই কয়েকটি মুহূর্তই চিরন্তন হয়ে থাকবে,মুহূর্তের কাছে বেঁচে থাকবে ওদের প্রেম !! বলছিলাম নুপূরের কথা,নুপূর আজ কোথায় আছে,কেমন আছে,আমি কিছুই জানিনা, আমার কাছে শুধু বেঁচে আছে নুপূরের সেই কথাটা,”জানিস অনি,তোর সাথে আমি জাহান্নামে যেতেও রাজি“;নুপূর আজ নেই,কিন্তু আজো যেন আমি শুনতে পাই সেই কথা,ঠিক যেন বহু দুর থেকে ভেসে আসা নুপূরের ধ্বনি।।
*********************************
আশিস দাস পরিচিতিঃ
জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়ায়,শৈশব থেকেই কয়লাখনির শহর আসানসোলে বাস। পড়াশোনা আসানসোল, বর্ধমান ও কল্যানীতে। ইংরাজি সাহিত্যে M.A. ত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিশ বছরই আসানসোল মহিশীলা বয়েজ’ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আধুনিক ইংরাজি কবিতার,বিশেষ করে W B Yeats ও T S Eliot এর পরম ভক্ত, ভালো লাগে ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখতে,আর ভালো লাগে রবীন্দ্রসঙ্গীত।
খুব ভালো লাগল দাদা। মন কেমন করা লেখা।