সন্ধ্যা
জলি চক্রবর্তী শীল
ঠিক এই বয়সেই সন্ধ্যার বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল | এখন যে বয়স তার মেয়েটার | চোরা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে সে | বাপের মত মুখখানি পেয়েছে‚রঙখানিও| মাস আটেকের ছেলেটার শরীরে তেল ডলতে ডলতে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যা | মাথার চুলখানি একদম তার মত | মোটা‚কালো‚ একঢাল চুল‚খোঁপা করে রাখলে যেন মুখখানির পিছনে একখানা গোল কালো চালচিত্ত মনে হয়| স্বভাবটিও মধুর | এতগুলি ছেলেমেয়ের মধ্যে এই মাইয়াটার মনে বড় মায়া | ভাইবোনগুলোকে বড় ভালোবাসে | কাঁথাকানি পালটে দেওয়া‚তেল মাখানো‚খাইয়ে দেওয়া | সন্ধ্যার পাশে পাশে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে | ‘কি কাম করতে হবে কও না মা‚আমি কইরে দি‘ | এ মেয়ের সংসারে মন | এমন সংসারে মন তারও ছিল | পিছোতে থাকে সন্ধ্যা | সাল‚ তারিখ ওসব মনে রাখার চল তাদের নেই | সেই যে যেবার মায়ের খুব অসুখ হল‚সংসারে মানুষ বলে তো সন্ধ্যা আর তার মা বৃন্দা | সেবার সেই অসুখের সময়ই হল ভারী বন্যা | ঘর–দোর সব ভেসে গেল | স্কুলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল | মায়ের বিছানার পাশটি ছেড়ে দরকার ছাড়া উঠত না সে | মনে হত উঠে গেলেই মাকে সে হারিয়ে ফেলবে | যেমনভাবে হারিয়ে গেছে তার বাবা | বাবাকে কোনদিন দেখেনি সন্ধ্যা বা দেখলেও মনে রাখার বয়সে পৌঁছায়নি সে তখনো তাই মনে নেই | মায়ের কপালের ঐ লাল মস্ত সূর্যটাই ছিল বাবার প্রতিভূ | আজও মায়ের কপালে সেই লাল সূর্যটা জ্বলজ্বল করছে |
সেবার মা সুস্থ হতেই তারা শহরে চলে এসেছিল | লড়াই করে ঘাঁটি গেড়েছিল গঙ্গার ঘাটে | পঞ্চায়েতে বারকতক দৌড়েও বাড়ি করার টাকা মেলেনি | সংসার চলছিল না | কোনদিন আধপেটা কোনদিন না খেয়ে কাটছিল | সরকারী সাহায্য সময়ের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল | কারা যেন বলেছিল শহরে টাকা ওড়ে‚শুধু ধরে নিতে পারলেই হবে | কিন্তু শহরে এসে উড়ন্ত টাকা কোনদিনই দেখা হয়নি সন্ধ্যার | মায়ের তখন পাথরের মত কালো শরীরে পিছলে যেত সূর্যের আলো | এদিকে ওদিকে ছোঁক ছোঁক করত কতগুলো লোক | মা মাছি তাড়ানোর মত করে তাড়াতো তাদের | সেদিন বুঝত না আজ বোঝে | তারপর গঙ্গার ধার থেকে তারা একটা ব্যাঙ্কের সামনে এসে বাস করতে শুরু করল | এদিকে ওদিকে অনেক অফিস | এ ফুটপাট ও ফুটপাতে দু চারটে পরিবার তাদের মত | বেশ আনন্দে বাস করছে | মা ওদের কাছে বলেছিল‚‘আমাকে আর আমার মেয়েকে থাকতে দেবে ?’ মোটা করে একজন মহিলা বলেছিল‚‘থাকতে চাইলে থাক‚থাকতে দিতে পারি‚খেতে দেবার আব্দার করিস নে যেন‘ | মা কুন্ঠিত যেমন হয়েছিল কৃতজ্ঞ তেমন | কি করবে‚কি করে চলবে সেই মহিলাই বলে দিয়েছিল | সন্ধ্যা তাকে দিদা বলে ডাকে | অফিস পাড়া‚লোকে সবাই খাবার নিয়ে আসে না বাড়ি থেকে| কিনে কেটে অনেকেই খায় | তাই তো অফিসপাড়ায় রমরমিয়ে চলে খাবার দোকানগুলো | তেমনি কিছু করার কথা বলেছিল দিদা | কিন্তু অত পয়সা ছিল না মায়ের কাছে | তখন দিদা বলেছিল‚‘তা হলে এক কাজ কর বিন্দা‚অল্প কিছু ভালো ফল নিয়ে বস | এখানে লোকে ভালো জিনিসটা পছন্দ করে | ব্যবহারটা ভালো রাখবি‚দেখবি আস্তে আস্তে ব্যবসা জমে যাবে‘ | তাই করেছিল মা | অল্প কিছু ফল নিয়ে বসতে বসতেই আস্তে আস্তে জমিয়ে নিয়েছিল ব্যবসা | অফিসের লোকজনগুলোর সাথেও দিব্যি ভাব জমে গেছিল তাদের | মা দোকান সামলাত আর সে সংসার | বেশ কিছুদিন পর একদিন দিদা বলেছিল‚‘আগের সোয়ামীর সিঁদুর কপালে পরে কি লাভ মা‚ তার চেয়ে একখানা বিয়ে কর না | কত ছেলেই তো আছে আমাদের এপার ওপার | তোকে বেশ পছন্দও করে | ঐ যে বাঁকে বিহারী ও সেদিন বলছিল‚‘মাসি অগর বিন্দা রাজী হোয় তো হামকো বাতানা‚আমি ওকে সাদী করে নিবো‘‚বাঁকের কিন্তু তিনটে ভ্যান আছে | ভাড়ায় থাকে | নিজের দিকটাও তো ভাব | মেয়েদের একজন পুরুষ মানুষ লাগে | কদ্দিন আর উপোস করে থাকবি | তুই বললে বাঁকের সাথে পাকাপাকি করি বিয়েটা | ‘মা হেসে বলেছিল‚‘আমি বিয়ে করব না মাসি‚তুমি বাঁকে কে বলে দিও | দেশে সংসার আছে আবার একটা বিয়ে করতে চায় কি করে ?’ ‘ওসব নিয়ে ভাবিস না মুখপুড়ি‚ছেলেরা উপোসী থাকতে পারে না। রাজী হয়ে যা না মা‘| ‘না মাসী‚আমার আর বিয়ে করার ইচ্ছে নেই |’
বিয়ে করেনি বৃন্দা | কিন্তু বাঁকের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সে বেশ বুঝতে পারত সন্ধ্যা | মাঝে মাঝেই দুজনেই কোথাও কোন কোনদিন উধাও হয়ে যেত | দিনে দিনে সেও তো ডাগর হয়ে উঠছিল | বুঝতে পারছিল মেয়ে–মরদের সম্পর্কগুলো | আর বুঝতে শুরু করার সাথে সাথেই ওপারের হরির সাথে বিয়ে দিয়ে দিল মা | বিয়ে মানে গঙ্গার পাড়ের কালী মন্দিরে গিয়ে হরির হাতে সিঁদুর পরে এল সে | মাংস–ভাত রান্না হয়েছিল সেদিন | হরিকে অবশ্য দিব্বি লাগত তার | রোগা‚ফর্সা‚লম্বা‚চৌকো মুখে মিস্টি হাসিটা দেখলেই যেন কি একটা হত সন্ধ্যার | কালো পিছলে পড়া শরীরে যেন লঙ্কাবাটার জ্বালা ধরত | বিয়ের বছরে জন্মাল মেয়েটা | পরী | পরীর মতই দেখতে হচ্ছে দিন দিন | তারপর বছর–দুবছর অন্তর বিইয়েই চলেছে সে | আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে এখন আর নিজেকে ঠিক চিনতে পারে না | গালের হাড়গুলো উঁচু হয়ে গেছে‚মনে হয় হাড় আছে মাংস খুব কম | শরীরটা কালো আছে কিন্তু সূর্যের আলো আর পিছলে যায় না | কেমন যেন ক্লান্ত‚অবসন্ন দেহ তার | একপাল ছেলেমেয়ের সামনে দিয়ে পোয়াতী পেট নিয়ে বাচ্চার জন্ম দিতে যেতেও ভালো লাগে না | কিন্তু ভালো লাগে না বললে কে শুনছে | তথাকথিত ভদ্রলোকদের মত জীবন তো তাদের নয়‚তাই এই জীবনে যৌন আকর্ষণ এড়ানো ভীষণভাবে কঠিন | তার ফলে বছর বছর বিয়োনো লেগেই আছে |
‘ও সন্ধ্যা শুনছস বিয়ে দিবি তর মাইয়াটার?’ বলে সন্ধ্যা যাকে দিদা বলে ডাকে সেই মহিলা | বয়সের ভারে এখন ঈষৎ নুব্জ |
‘পরীর কথা কইছ দিদা ?’
‘তর তো বাকি মাইয়াগুলান তো এখনও লায়েক হয় নাই যে তাদের কথা কব ?’ বলেন তিনি |
‘এই তো সবে তেরো পেরিয়ে চোদ্দ পড়ল গো দিদা | এখনি কি বিয়ে দেবো বলো দেখি ! লেখাপড়াটা যখন করতে পারছে করুক না ‘বলে সন্ধ্যা|
‘লেকাপরা এই তোদের এক নতুন জিনিস হয়েছে বটে | তা লেকপরা শিখে কি এমন চাকরি করবে শুনি ? আর এই যে রাস্তার মেয়ে তাকে কি বড়ঘরে কেউ বিয়ে করে নিয়ে যাবে বলে ভাবতাছিস ?
‘না দিদা এসব কিছুই আমি ভাবছি না | যখন লেখাপড়ার জন্য ট্যাকাকড়ি লাগছে না‚পোশাক–আশাক ও লাগছে না‚তখন পড়ুক না | আর পরীটা তো খুব শান্ত‚কথা শুনে চলে‚আর কটা দিন যাক তখন একটা বিয়ে দেবো না হয় | মেয়েমানুষ যখন‚তখন তো বিয়েটা দিতেই হবে |’ সন্ধ্যা বলে|
‘দ্যাখ মেয়ে তুই যা বুজবি করবি‚কিন্তু রাস্তাতে থাকা‚ওঠা–বসা–শোয়া | ভালো–মন্দ কত কি হয় মা‚তা তো নিজের চোখেই দেখতে পাস | কেউ যদি তুলে নিয়ে যায় তখন কি কিছু করতে পারবি? ঐ যে ওদিকের থানার মুখে যে কটা ছেলে থাকে‚কদিন ধরে দেখছি এদিকপানে উঁকি–ঝুঁকি করছে | কি মতলব জানি না | ছেলেগুলো ভালো না | তাই আগে ভাগে বিয়ের কথা কইতে আসা | তা তোর যখন অমত তখন না হয় আর কটা দিন যাক |’ বলে মহিলা চলে যান|
বুকের ভিতরটা ধকধক করে ওঠে সন্ধ্যার| মেয়েটা সত্যি তো ভালো ডাগর হয়েছে | এখনি কি তবে পায়ে বেড়ি দিতে হবে ? কিন্তু মন যে চায় না | চায় না সে চোদ্দ থেকে বছর বছর বিইয়ে তার সোনার প্রতিমার মত মেয়েটার জীবনটা তার মত হয়ে উঠুক | কিন্তু কেউ পরীর ক্ষতি করবে সেও যে মেনে নেওয়া যায় না | সে আবার কারও সাথে পিরীত করছে না তো? ঐ থানার দিকের কোন ছেলের সাথে কি প্রেম করছে ? সে খবরও তো নেওয়া হয়নি | আজ একবার জানতে হবে | মনে মনে এইসব ভাবনার মাঝেই পরী এসে ছোট ভাইটাকে কোলে তুলে নেয়
‘মা‚ভাইটাকে নিয়ে একটু ঘুইরে আসি ?’
‘কোথা যাবি ?’
‘ঐ টেরামইনের দিকটায় ঈদের বাজার বসেছে| ওদিক থেকে ঘুরে আসি |’
‘আজকাল কি তুই ওদিকটা বেশি যাচ্ছিস নে ?’
‘কই বেশি তো যাই না | সেদিন মায়ার সাথে গেছিলাম | তাই দেখলাম সেখানে বাজার বসেছে |’ শান্ত স্বরে পরী বলে |
‘থানার সামনের ছেলেগুলো কি আসবে নাকি ?’ বাঁকাস্বরে জিগোয় সন্ধ্যা|
থতমত খেয়ে যায় পরী |
‘তুই কি কারও সাথে পেরেম করছিস ? করলে পোস্কার করে বল‚তোর বাপের সাথে কথা বলে না হয় বিয়ের ব্যবস্থা করি | ভালো–মন্দ তুই বুঝবি ‘|
‘তোমায় কি কেউ কিছু কয়েছে? ঐ থানার দিকের ছেলেগুলো ভালো না মা‚আমি জানি | আমি ওদের সাথে মিশি না | আজকে ওরা ঐ বাজারে আসবে কিনা তাও আমি জানি না |’ আবার ও শান্তস্বরে বলে সে |
‘ওরা কি তোকে বিরক্ত করে?’
‘সরাসরি করে না | কিন্তু সিটি দেয়‚নোংরা নোংরা কথা বলে চেঁচিয়ে যাতে শুনতে পাই |’
‘আগে বলিস নি কেন ? তোর বাবাকে বলতে হবে | তুই একটু সাবধানে থাকিস মা | এদিক ওদিক বেশি যাস নে |’
‘যাব না‘ |
যায় না পরী | এ মেয়েকে ঠিক যেন এই ফুটপাতে মানায় না | ওকে অন্য কোথাও যদি পাঠিয়ে দেওয়া যেত | সন্ধ্যা‚হরির সাথে দুদিন ধরে আলোচনা করে স্থির করে বিয়েই দিয়ে দেবে | বিয়ে হয়ে গেলেও যে অঘটন কিছু ঘটে না বা ঘটবে না তা নয় | তবু সেটাই এখন একমাত্র পথ |
‘দিদা‚ তুমি যে সেদিন পরীর বিয়ের কথা কইছিলে‚বলি ছেলে কি করে ?’
ছ্যাতলা পড়া দাঁতে হাসি ফুটে ওঠে| ‘ছেলে ভালো বলে তো তোর কাছে ছুটে গেছিলাম রে মা | আমাদের পরীর জন্য কি যে সে ছেলে হলে হবে | আমার বোনের নাতি থাকে সেই যাদবপুরের দিকের একটা বস্তিতে ভাড়া বাড়িতে| বাজারে সব্জি বিক্রি করে| আর একটা ব্যবসা দিয়েচে শুনলাম‚জলের ব্যবসা | তা জলের ব্যবসাও তো ভালো চলছে | বোন বলল‚টাকাপয়সা জমিয়ে একটা জমিও কিনবে | এখন দেক যদি বলিস তো কতা বলি |
সন্ধ্যার চোখজোড়া চকচক করে ওঠে | এই ফুটপাতের জীবন থেকে পরী একটা থিতু জীবন পাবে কোন মা না তা চাইবে?
‘তা দিদা ছেলের স্বভাব চরিত্তির কেমন সেটা তো কইলে না ?’
‘সে মা হরিকে বল হরি খবর নিয়ে নেবে‘খন | ছেলে–পুলে উৎসব–অনুষ্ঠানে কি আর নেশাভান করে না ? এই যে আমাদের হরি কি একটু আধটু নেশা করে না নাকি ? তবে তেমন একটা নেশা নেই | চরিত্তির দোষও নেই | ছেলেটা সেই ছোট থেকে কষ্ট করে বড় হয়েছে তো | তখন থেকেই দেকেছি কি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে সেই চেষ্টা করে গেছে |’
‘বেশ তোমার নাতিরে কই‚সে কি বলে দেখি‚তারপর নয় তোমাকে জানাবো‘| সন্ধ্যা বলে চলে আসে |
‘দিদি যখন কয়ে দিয়েছে মেয়ে রূপসী‚গুনের মেয়ে তখনি আমি থির করেছি এই মেয়েই আমার নাতবৌ হবে | একন এইসব দেখাশোনার বাপু কোন মানে নেই | আমরা সেই গেরস্থদের মত লোকজন নিয়ে দেখতে যাব দশবার‚মিষ্টি গিলব‚সে সব বাপু আমার মোটে পোষায় না | সামনের একটা ভালো দিন দেকে বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই | তোমাদের আপত্তি নেই তো? বর–মুনে বিয়ে দেব‚বরপক্ষ আর কনেপক্ষ থাকবে আর দু–একজন চেনা জানা | তোমাদের কি মত?’ ছেলের ঠাকুমা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে |
হরি‚সন্ধ্যাকে নিয়ে এসেছিল ছেলে দেখতে পরীর জন্য | ছেলে মোটের ওপর ভালো | পছন্দও হয়েছে | এখন বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই হয় | ওদিকে থানার দিকের ছেলেগুলোর উৎপাত দিনদিন বাড়ছে | পরীকে আর কোনমতেই ঘরে রাখতে পারবে না | দূরে বিয়ে হলে মেয়েটাও বাঁচবে | অমত করার মত সংস্থানও নেই |
‘আপনি যেমনটা কইছেন তাতে আমাদের আপত্তির কি আছে | মেয়েটা ভালো থাকলে আমরা নিস্চিন্ত হই |’
‘বেশ তবে ঐ সামনের পুর্নিমেতেই বিয়েটা দেব | তোমরা আগের দিন চলে এসো | মন্দিরেই হবে | সেদিন মন্দিরে একখান মস্ত ভোজও হয় | লোক খাওয়ানোর খরচও বাঁচবে’|
‘কিছুটি আপনারা নেবেন না ? ছেলের পোশাকটাও তো কিনতে হবে আর মেয়ের শাড়ি আরও টুকটাক কিছু জিনিস |’
‘সে তোমাদের দিতে ইচ্ছে হলে দিও‚না হলে এককাপড়ে আমার নাতবৌকে বরণ করতে আমার কোন আপত্তি নেই|
বৃন্দা‚ সন্ধ্যার দিদা‚আর নিজেরা কয়েকজন মিলে পূর্ণিমার দিন চারহাত এক করে দিল পরী আর পরীর বর বিনোদের | সেখানেই ঠাকুরের ভোগ সবাই মিলে খেলে | পরীর দিক থেকে সন্ধ্যা চোখ ফেরাতে পারছিল না | একটা লাল টুকটুকে জরিপাড় শাড়িতে যেন মা লক্ষীটি | বিনোদকে পাজামা আর পাঞ্জাবীতে বেশ লাগছিল | ছেলে মোটের ওপর বেশ ভালো | বস্তির ঘরখানাও মন্দ নয় | অন্তত আব্রু তো আছে | হাটের মাঝে‚রাস্তার ওপর থাকার যে নিদারুণ কষ্ট সে সন্ধ্যা কাকে বোঝাবে | তার চেয়ে এই চার দেয়ালের ঘর‚মাথার ওপর ছাদ‚একটা নিরাপদ আশ্রয় এর মূল্য অনেকখানি | এমন একটা জায়গায় পরীকে মানায় | ঐ বজ্জাত‚হাড়জ্বালানে ছেলেগুলোর থেকে তো মুক্তি পেল | এখানেই ভালো থাকবে পরী |
পরের দিন ফিরে আসার সময় বিনোদের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সে বলে ওঠে‚‘কিছু ভেবো না মা‚তোমার মেয়ে আমার কাছে ভালো থাকবে | ওকে আমি পড়াবো | আমি তো লেখাপড়া জানি না‚ও আমার ব্যবসার হিসাবপত্তর দেখবে‚ও নিজের মত করেই থাকবে মা | জমি আমি দেখছি কিনে সেখানে খুঁটি পুঁতে খুব শিগগির বাড়ি করব | আর তোমার যখন মনে হবে তুমি চলে এসো | ওকে নিয়ে কিছুটি ভেবো না | আর দরকার–অদরকারে তুমি আমাকে ডেকো |’
সন্ধ্যার আর কিছু চাওয়ার ছিল না | রাস্তার মেয়ের কপালে এমন বর–ঘর আর কি চাই | সমস্ত মন–প্রাণ দিয়ে দুজনকে আশীর্বাদ করতে করতে ফিরে চলে নিজের ফুটপাতের সংসারে মেয়ের সুখস্বপ্নের চিন্তা করতে করতে |
************************
জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতিঃ
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।
এ এক উত্তরণের গল্প। পরী, সন্ধ্যা , বৃন্দাদের জীবনযাত্রা, আর মানসিকতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দরদী কী বোর্ডের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছে। অভিনন্দন রইল এমন সুন্দর একটি গল্প উপহার দেবার জন্য