Shadow

সমস্যা – সুজয় দত্ত

ছবি – ব্রতী ঘোষ

সমস্যা 

সুজয় দত্ত

নাঃ,থালায় ভাত ফেলে উঠে যাওয়ার জো নেই। একজনের শ্যেনদৃষ্টি আমার পাতের ওপর। পেটে জায়গা থাক আর না থাক,বাকি ডালমাখা ভাত আর তরকারিগুলো শেষ করে তবে নিষ্কৃতি। নাহলেই বকুনি। ওদিকে খাবার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি পাশের ফ্ল্যাট থেকে চিঁড়ে আর দই ডাকছে হাত নেড়ে। এখুনি ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের একচিলতে মাঠটায় দুপুরের বল খেলা শুরু হবে আমাদের,চলবে যতক্ষণ না বিকেলে বড়রা ইস্কুল থেকে ফিরে মাঠের দখল নেয় ততক্ষণ। চিঁড়ে আর দই হল আমার দুই প্রাণের বন্ধু,মুখার্জিবাড়ীর সেজো আর ছোট ছেলে। আসল নাম চিরন্তন আর দ্বৈপায়ন,আমরা পাড়ার ছেলেরা বলে ডাকি। দুজনেই দারুণ তুখোড় খেলাধুলোয়। আর আমি? দিনের পর দিন পেট ঠেসে ভাত গিলে গিলে নাদুসনুদুস চেহারা হচ্ছে,বন্ধুরা আড়ালে মোটা বলে,মাঠে গোলকীপার হয়ে স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকতেই রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা। এই সব কিছুর জন্য দায়ী ওই একজনই। শুরুতে যার কথা বলছিলাম।
সেই একই ব্যক্তি আবার ছুটিছাটার দিনে,এমনকি গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতেও কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে দুবেলা পড়তে না বসলে অথবা হোমওয়ার্ক আদ্ধেক ফেলে রেখে রেডিওতে খেলার রিলে শুনতে বসলে এমন চীৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেবে যে আশপাশের প্রতিটা ফ্ল্যাটের প্রত্যেকে জেনে যাবে কী আমার অপরাধ। শুধু কি তাই? কয়েকবার হাতপাখার ডাঁটি আর রুটি বেলার বেলনের বাড়িও পড়েছে আমার পিঠে,স্রেফ রান্নাঘর থেকে আমার জোরে জোরে মুখস্থ করার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না বলে। আশ্চর্য তো! ইস্কুলে পড়াটা দিয়েছে কাকেতোমাকে না আমাকে? এমন চেঁচিয়ে পড়তে হবে আমায় যাতে তোমারও মুখস্থ হয়ে যায়? আর এর ফলে পাড়ার বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার প্রেস্টিজ যে কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে, সেকথা কে ভাববে?? এইতো সেদিন,বাথরুমের দরজার পাল্লায় হাতটা একটু চিপ্টে গিয়ে কালশিরে পড়েছে,বিকেলে মাঠে দেখা হতেই লাল্টু দাঁত বার করে হেসে বলল,”কিরে,মাসীর কাছে খেয়েছিস তো আবার? কি করেছিলি?”। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে প্রতি বছর ডিসেম্বরে অ্যানুয়ালের রেজাল্ট বেরোবার দিনে যখন ফার্স্ট-সেকেন্ড প্রাইজ নিয়ে ফিরি,তখন দরজায় একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে ঠায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকা মানুষটাকে বলি,”দেবোনা এগুলো তোমাকে,যাও! মোটেই তোমার বকুনি আর পিটুনির জন্য হয়নি এসব”। কিন্তু আবার ওগুলো হাতে নিয়ে এমন ছলছল চোখে পরম যত্নে বুকে আঁকড়ে ধরে, মায়াও হয়।
ইস্কুলের গন্ডী পেরিয়ে বারো ক্লাস পাশ করে কলেজে যাবসেখানেও নিস্তার আছে? পুরো আঠেরোটা বছর আমাকে বাড়ীর নাড়ুগোপাল করে চোখে চোখে রেখে দেওয়ার পর এখন বায়নাকলেজ হস্টেলে থাকতে দেবে না। সেখানে গেলে নাকি আমার শরীরের বারোটা বাজবে আর পড়াশোনার চোদ্দটা। মহা মুশকিল তো! তোমার কোলের খোকন হয়ে থাকার জন্য আমি এরকম একটা নামকরা কলেজে স্কলারশিপ পেয়েও ছেড়ে দেব? যাইহোক,শেষে অনেক জেদাজেদি করে তাকে চোখের জলে নাকের জলে ভাসিয়ে ভর্তি হলাম সেই আবাসিক কলেজেই। ওমা,একদিন বিকেলে কলেজ করে হস্টেলে ফিরে দেখি আমার ঘরের দরজাটা ভেজানো,তালা ঝুলছে কিন্তু খোলা অবস্থায়। দেখেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলআমি কি আজ তালা দিয়ে যেতে ভুলে গেছিসিনিয়রদের মুখে শুনেছি এই হোস্টেলপাড়ায় কিঞ্চিৎ চোরের উপদ্রব আছে।   কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে দেখি হরিআমার বিছানায় বসে পাখার তলায় হাওয়া খাচ্ছেন সেই তিনি। কী ব্যাপার? না,বাড়ীতে কাল অনেকদিন বাদে লোকজন এসেছিল বলে চিংড়ির মালাইকারি আর নলেনগুড়ের পায়েস রাঁধা হয়েছে, আমার তো খুব প্রিয় জিনিস,তাই কৌটো করে আমাকে একটু দিয়ে যেতে মন চাইল। হস্টেলে তো দুবেলা ছাইপাঁশ খাওয়ায়, আজ যেন ওসব না খেয়ে এগুলোই খাই। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলাম,ঘরে ঢুকলে কিভাবে? উত্তর পেলাম আমার রুমমেট দুপুরে লাঞ্চব্রেকে হস্টেলে খেতে এসেছিল,সে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুলে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন,”তুই দুপুরে খেতে এলিনা যে?” আমি আর কী করব,যাহোক একটা মিথ্যে অজুহাত দিলাম। আসলে লাঞ্চের পরের পিরিয়ডেই একটা শক্ত পরীক্ষা ছিল,আমি ওই একঘন্টার ব্রেকে শেষমুহূর্তের পড়াটা একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। ব্যস,সেই যে একদিন দুপুরে না খাওয়ারঅপরাধধরা পড়ে গেল,তার পরের চার বছর আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও বাড়ী থেকে মাঝেমাঝেই চলে এসেছে শিমবেগুনপোস্ত থেকে শুরু করে পমফ্রেট মাছের ঝাল,আমের আচার থেকে শুরু করে পিঠেপুলি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করেই খেতাম সেগুলো,কিন্তু মনে মনে কী লজ্জা যে লাগত। হস্টেলে আমার নামই হয়ে গেছিলরাজভোগ দত্তগ্র্যাজুয়েশন করার পর পোস্টগ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় সেই সুযোগ আর রাখিনি অবশ্য। চলে গেলাম দিল্লীর এক নামী ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে আবার অন্য গল্প। দেখতে শুনতে আমি ফিল্মি হীরোর মতো না হলেও চার বছর হোস্টেলজীবন যাপনের পর খুব একটা খারাপও না। আর পড়াশোনায় ফাঁকি না দিয়েও মোটামুটি মিশুকে। তাই অচিরেই বসন্তের বাতাসে ফুল ফুটতে শুরু করল মধুকুঞ্জে। আর আমি এইসব ‘খেলার’ কথা গোপন রাখতে চাইলেও লোকে দেবে না রাখতে কিছুতেই। চারপাশে সব ‘উপকারী’ বন্ধুরা ঘুরঘুর করছে,তাদের রসালো খবর সংগ্রহ আর সম্প্রচার–দুটোতেই সমান আসক্তি। তাদেরই কারুর মাধ্যমে কথাটা চালান হয়ে গেল আমার কলকাতার বাড়ীতে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনাঘাত। ওপ্রান্তে রীতিমতো হাউমাউ করে আর্জি–আমি যেন এক্ষুণি দিল্লী ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তির অ্যাপ্লিকেশন করি। একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলের চেয়ে একটা বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে কত বেশী সেয়ানা আর পরিণতমস্তিষ্ক হয় সেই জ্ঞানগম্যি তো আমার নেই। তাই বুঝতেও পারছিনা কী মারাত্মক রাস্তায় পা বাড়িয়েছি ! আমার সরলতা আর অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অচিরেই আমার সর্বনাশ করে ছাড়বে ওই–। বলে যে বিশেষণটা দিয়ে তিনি শেষ করলেন সেটা বিশেষ প্রীতিকর নয় বলে এখানে আর লিখছি না। আমি তো হতভম্ব,বাকরুদ্ধ,ফোনের রিসিভার কানে নিয়ে চুপ করে আছি। ওপ্রান্ত থেকে “কী হল কী,কিছু বলছিস না কেন?” বলে প্রবল ধমক ভেসে আসতেই আমতা আমতা করে বললাম যা শোনা যাচ্ছে ওসব গুজব ছাড়া আর কিচ্ছু না। আমি দিল্লী এসেছি মন দিয়ে এম এস সি-টা শেষ করে এম ফিলে ভর্তি হতে। ওটাই আমার পাখির চোখ,আর কোনো দিকে চোখ বা আড়চোখ–কোনোটাই নেই। এই মিনমিনে গলার স্তোকবাক্য শুনে তিনি কি আর আশ্বস্ত বা নিরস্ত হন? সেই সেমিস্টার চলাকালীনই সোজা দিল্লী এসে হাজির বাবাকে জোর করে অফিস ছুটি নিইয়ে। সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে হবে না?
সেই শেষ নয়,এরপর কয়েক বছর ধরে প্রতি সেমিস্টারে চললো আমার ওপর নজরদারি,হাজার মাইল ট্রেন ঠেঙিয়ে দিল্লী এসে এসে। কিন্তু ততদিনে আমার সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে অভিভাবকের সতর্কবাণী বা চোখরাঙানিতে আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্যাঙ্গালোরে বেড়ে ওঠা সেই স্মার্ট,অনাড়ম্বর মেয়েটি আমার জীবনে জড়িয়ে গেছে গভীরভাবে,আমরা যুগল পথচলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। এম ফিলের দ্বিতীয় বছরে গরমের ছুটিতে আমরা পুরো ব্যাপারটাকে প্রকাশ্যে এনে ফেললাম। ও আমাকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে গেল ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে,আর আমি ওকে কলকাতায়। ভাগ্য ভাল আমার,ব্যাঙ্গালোরের উচ্চবিত্ত পরিবারের সচ্ছলতা আর আধুনিকতায় মানুষ হয়েও প্রিয়াঙ্কা কলকাতার আধা-রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত মানসিকতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জাদু জানত। সে জাদু এমন জাদু যে তিন বছরের সব সন্দেহ আর আশংকা ধুয়ে যেতে তিন সপ্তাহও লাগল না। ছুটি শেষে যখন আবার আমাদের দিল্লী ফিরে যাওয়ার সময় এল,তখন কে কার বাবা-মা আর কে কার আঙ্কেল-আন্টি–বোঝা মুশকিল।
এবং এর পরেই ঘুরে গেল খেলাটা। কলকাতার সেই তিনি এখন আমার ওপর পাহারাদারির এক নতুন রাস্তা পেয়ে গেছেন। ফোনগুলো এখন আর আমার কাছে নয়,বেশীরভাগই প্রিয়াঙ্কার কাছে আসে। আমি যে কয়েকটা পাই,তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ দাম্পত্য জীবন নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা উপদেশ। যেমন,প্রেমকে বেশীদিন অরক্ষিত রাখতে নেই,তাড়াতাড়ি বিবাহবন্ধনে বেঁধে ফেলতে হয়। একটা পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করলে তাদের বাচ্চাকাচ্চার শৈশব বিঘ্নিত হয়। এম ফিল শেষ হলে আমি যেন আবার নতুন কোনো পড়াশোনার লাইন বেছে না নিয়ে চাকরির চেষ্টা করি,কারণ সংসারের পুরুষমানুষকেই আগে স্বাবলম্বী হতে হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি চুপ করে শুনতাম,তর্ক বা প্রতিবাদ করার চেষ্টা বৃথা।
জীবন আর কবে সরলরেখায় চলে? আশা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক থেকে যায় হামেশাই। আমরাও ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম তেমন হল না। আমি গোটা দুই লোভনীয় অফার পেলাম মুম্বই আর চেন্নাই থেকে, প্রিয়ঙ্কার দেরী হল একটু। শেষে হায়দ্রাবাদের একটা কনসাল্টিং ফার্মে পছন্দসই পজিশন পেতেই ও চটপট “হ্যাঁ” বলে দিল। আমি ততদিনে দিল্লীকে বিদায় জানিয়ে দক্ষিণ মুম্বইয়ের বাসিন্দা হয়ে গেছি। ঘনসোলি-তে একটা খুপরি ফ্ল্যাটে একার সংসার পেতে বসেছি। মনটা হু হু করছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর যে ছিল সব সময়ের সঙ্গী,আজ সে শুধুই ফোনের ওপারে।
এভাবে বছর দুয়েক কাটার পর হঠাৎই ঘটনার দ্রুত পটপরিবর্তনের ফলে জীবনের চেনা ছকটা কেমন যেন বদলে গেল। শুরু হয়েছিল ভাল খবর দিয়েই। হায়দ্রাবাদের চাকরিটা করতে করতে গোপনে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যাচ্ছিল প্রিয়াঙ্কা মুম্বাই-এর আশপাশে। আচমকা একদিন অফার পেয়ে গেল মালাড-এর এক জাঁদরেল কোম্পানী থেকে। দারুণ সুখবর,কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে তিরিশ কিলোমিটারও নয় ওই জায়গাটা,যাতায়াতের ভাল ব্যবস্থা রয়েছে। এই কথাটা জানিয়ে কলকাতায় সবাইকে চমকে দেব বলে ফোন করেছি,উল্টে নিজেই একটা ধাক্কা খেলাম। শুনলাম সদ্য ষাটে পা দেওয়া বাবার একটু আগেই এক বিরাট হার্ট অ্যাটাক হয়েছে,এখুনি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে গেছে,প্রতিবেশীরা আমাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে পায়নি,নাহলে আধঘন্টা আগেই খবর পেতাম। ব্যস,মাথায় উঠল মালাড,সেই রাতেই ট্রেনের টিকিট কেটে রওনা হলাম আমি,পরদিন সকালে হায়দ্রাবাদ থেকে প্রিয়াঙ্কা।
ভাগ্যিস পেরেছিলাম যেতে। কারণ সেই দেখাই শেষ দেখা,আর বাড়ী ফেরেনি বাবা। দিন তিনেক যমে মানুষে টানাটানি চলেছিল হাসপাতালের আই সি ইউতে। আঘাতটা সামলাতে বেশ কিছুটা সময় লাগলেও জীবনের বাস্তবতার প্রয়োজনে মন শক্ত করলাম আমি। কিন্তু আমার সেই তিনি? দীর্ঘ তিন দশকের জীবনসঙ্গীকে এভাবে হারিয়ে বাঁচার সব ইচ্ছেই যেন খুইয়ে বসে আছেন। ভুল বললাম,বসে নয়,শুয়ে। শ্রাদ্ধশান্তি আর নিয়মভঙ্গের সময় তিনি রীতিমতো শয্যাশায়ী,বাড়ীতে দুবেলা ডাক্তার আসছে। এতদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম সকলে,এবার সবকিছু মিটে-টিটে যাওয়ার পর তাঁর শরীরটা একটু সামলে উঠতেই তড়িঘড়ি একজন চব্বিশ ঘন্টার কেয়ারটেকার ঠিক করে একরাশ দুশ্চিন্তা মনে নিয়ে ফিরে গেলাম আমরা যে যার কাজের জায়গায়।
এর পরের বছরখানেক আমি আর প্রিয়া মুম্বাই থেকে একটু ঘনঘনই কলকাতা গেলাম। তিনি পথ চেয়ে বসে থাকতেন আমাদের। কাছে পেলে  আর ছাড়তে চাইতেন না–বিশেষতঃ বৌমাকে। প্রিয়ার সঙ্গে সবসময়ই দারুণ জমে ওঁর,এখন একা হয়ে যাওয়ার পর তো আরোই বেশী। বার বার আক্ষেপ–কেন বিয়ের অনুষ্ঠানটা আমরা বাবা থাকতে সেরে নিলাম না,এখন কালাশৌচের জন্য কতদিন পিছিয়ে গেল। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ তো সেই কত আগেই হয়ে গেছে। আমরা বলতাম হবে হবে,আর তো কটা মাস,তারপরেই ঘোষণা করব অনুষ্ঠানটা। কিন্তু হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলাম আর এভাবে চালানো যাবে না বেশীদিন–প্রিয়াঙ্কা পেরে উঠবে না। কারণ ওর শরীর সংকেত দিয়েছে আমাদের সংসারে এক তৃতীয় ব্যক্তিকে অভ্যর্থনা করার প্রস্তুতি শুরু করতে। ইতিমধ্যে আমরা সেই ঘনসলির খুপরি ফ্ল্যাট ছেড়ে একটা আরো বড়সড়,সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে উঠে গেছি। সেখানে ব্যাঙ্গালোর থেকে আমার শ্বশুর-শাশুড়িও এসে ঘুরে গেছেন। আর প্রিয়ার শাশুড়ি? ঠাকুমা হতে যাওয়ার খবর শুনে আহ্লাদে আটখানা,আমাদের নতুন ফ্ল্যাটের ছবি দেখে দারুন খুশী,কিন্তু তাঁকে কলকাতার বাড়ী থেকে নড়ায় কার সাধ্যি? “আমার ঠাকুরঘরে রোজ ফল-বাতাসা দেবে কে? ধুপ আর প্রদীপ জ্বালবে কে? গোপালকে চান করিয়ে ভোগ দেবে কে? তুলসীগাছে জল দেবে কে?” ইত্যাদি লম্বা লিস্ট। এর একটার জন্যও কেয়ারটেকারের ওপর নির্ভর করা যায় না। শেষে প্রিয়ার অনেক পীড়াপীড়ি,অনেক ছলছল চোখে আবদার-টাব্দারের পর নিমরাজি হল ওর ডিউডেটের কাছাকাছি সময়ে অল্প কিছুদিনের জন্য মুম্বাই যাবার। এই সমস্যাটা যাহোক একরকম মিটল,কিন্তু নতুন এক সমস্যার চারাগাছ গজিয়ে উঠছিল আমাদের সকলের অলক্ষ্যে। তা হল তাঁর স্বাস্থ্য। ষাট ছুঁইছুঁই শরীরটা যে আর আগের মতো কর্মঠ নেই সেটা অনেকদিন থেকেই দেখছি, কিন্তু বাবা চলে যাবার পর একটু দ্রুতই যেন ভাঙছিল শরীর। খিদে কমে গেছে অনেক,রাতে ভাল ঘুম হয়না,সারাদিন কেমন যেন ক্লান্ত-ক্লান্ত লাগে–এগুলোকে স্বাভাবিক বয়সজনিত লক্ষণ ধরে নিয়ে এতদিন পাড়ার চেনাশোনা ডাক্তারের সাধারণ ওষুধপত্রই চলছিল। এবার কলকাতা এসে যখন দেখলাম দুই পায়ের নীচের অংশ,গোড়ালি আর পাতা বেশ  ফুলে রয়েছে,জোর করে নিয়ে গেলাম একজন স্পেশালিস্টের কাছে। জোর করে,কারণ সেখানেও তীব্র অনীহা,একগুঁয়ে জেদ–“কী হয়েছে কী আমার?”
সত্যিকে তো আর জেদ দিয়ে ঢেকে রাখা যায়না। স্পেশালিস্টের নির্দেশমতো হওয়া পরীক্ষানিরীক্ষায় বেরিয়ে পড়ল সমস্যার উৎস। কিডনী। দুটোর অবস্থাই তেমন ভাল নয়। বড়োজোর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ শতাংশ কর্মক্ষমতা তাদের। কীভাবে,কবে থেকে শুরু হল এই নিঃশব্দ অবক্ষয়, বলা মুশকিল। তবে আমার মামাবাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যেহেতু কিডনীজনিত সমস্যার ইতিহাস আছে, বংশগতিও একটা কারণ হতে পারে। মুশকিল হচ্ছে,এরকম একজন রোগীকে বিপদ এড়াতে যে কড়া সতর্কতার মধ্যে থাকতে হয়,সেটা এই ভদ্রমহিলাকে বোঝানো ভীষণ শক্ত। চিরকাল বাড়ীর অন্য দুই সদস্যের সুস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেকে উপেক্ষা করে আসার যে অভ্যাস শিকড় গেড়ে আছে মনের মধ্যে,তা একটানে উপড়ে ফেলা আমার কম্মো নয়। একমাত্র ভরসা প্রিয়া। ও যদি ওর স্বভাবসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় গলা জড়িয়ে ধরে,কোলে মাথা রেখে,আদুরে গলায় আবদার-টাবদার করে কোনো ম্যাজিক করতে পারে। ও চেষ্টা করল যথাসাধ্য। কিন্তু আমরা থাকি প্রায় উনিশশো কিলোমিটার দূরে মুম্বাইতে। আমাদের অনুপস্থিতিতে তিনি ওষুধপত্র ঠিকমতো খাচ্ছেন কিনা,শরীরের যত্নআত্তি করছেন কিনা–সেসব কে দেখতে আসছে?
সময় গড়িয়ে চলল তার নিজের গতিতে। প্রিয়ার গর্ভে আমাদের সন্তান ক্রমশঃ আরো ঘন ঘন তার অস্তিত্ব জাহির করে জানান দিতে থাকল তার মুক্তির দিন আসন্ন। আর এমনই আমার ভাগ্য,তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খারাপ হতে লাগল কলকাতায় একজনের শরীর। প্রিয়ার ডিউ ডেটের কিছুদিন আগে যে তাঁর আমাদের কাছে এসে থাকার কথা,সেই তোড়জোড় করতে যাওয়ার আগেই খবর পেলাম অবস্থার অবনতি হয়েছে, সর্বশেষ রক্তপরীক্ষায় ইউরিয়া-ক্রিয়াটিনিন সাংঘাতিক বেড়েছে, ডাক্তার ডায়ালিসিসের কথা ভেবে দেখছেন। মরীয়া হয়ে ডাক্তারকে কোনোরকমে ফোনে ধরে জানতে চাইলাম আমার ঠিক কী করা উচিত এই মুহূর্তে,কিন্তু দেখলাম উনি নিজেই একটু দ্বিধাগ্রস্ত। শেষে বললেন সাবধানতাবশতঃ কোনো হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি করাই ভাল। প্রিয়াকে আমার শাশুড়ির জিম্মায় রেখে ছুটলাম কলকাতা,দেখলাম গা-হাত-পা বেশ ভালরকম ফোলা,একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে ভর্তি করে সঙ্গে রইলাম কয়েকদিন,যতক্ষণ না অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। সে-যাত্রা আর  ডায়ালিসিসের দিকে গড়ায়নি ব্যাপারটা,ওষুধপত্র আর পরিষেবা দিয়েই সামলে দেওয়া গেছিল। কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল তাঁর, খাওয়াদাওয়ায় প্রবল অরুচি। ওদিকে আমাকে তো দেশের একেবারে উল্টোদিকে একজনের পৃথিবীতে আবির্ভাবের আয়োজনেও দরকার,সেখানেও যেকোনো দিন ঘটতে পারে ব্যাপারটা।  অতএব তাঁকে বাড়ীতে ফিরিয়ে এনে সকালের আর রাতের শিফটে দুজন আয়া রেখে আমার এক নিকট আত্মীয়কে বললাম কটা দিন আমাদের বাড়ীতে থাকতে। আমাকে বিদায় দেবার সময় হাতটা আর ছাড়তে চাইছিলেন না তিনি।
তার পরের গল্প খুব সংক্ষেপে বলি। কারণ বিশদে বলার সময় বা মন–কোনোটাই নেই এই মুহূর্তে। মাত্র গতকাল,মে মাসের এক মেঘলা গুমোট সকালে আমাদের ঘর আলো করে পৃথিবীতে এসেছে যে,সে এখনো মুম্বইয়ের হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডেই আছে তার মায়ের সঙ্গে। নাম আয়ুষ্মান প্রিয়াংশু। আধখানা তার ঠাকুমার দেওয়া,বাকি আধখানা দিদিমার। তাহলে আমি এখন এই বারোশো মাইল দূরে কলকাতার হাসপাতালে  বসে কী করছি? আসলে অনেক বছর আগে এইরকমই এক মে মাসে আমিও পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম প্রথমবারের জন্য। সেদিন আমাকে যাঁর পাশে যত্ন করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল,আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে যে আজ তাঁর বিদায়ক্ষণ সমাগত,কিন্তু সমস্ত শরীর-মন সেই চিন্তাটাকে নস্যাৎ করে দিয়ে চীৎকার করে উঠতে চাইছে–না,না,না। অবশ্য আমার মন কী বলল না বলল,তাতে তো কিছু আসে যায় না–আসল কথা বলবে হাসপাতালের আই সি ইউয়ের ওই মনিটর আর যন্ত্রপাতিগুলো। কাল মুম্বইয়ের নামকরা হাসপাতালের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডে যখন আমার সঙ্গে ন-বছর আগে দিল্লীর ইউনিভার্সিটিতে আলাপ হওয়া এক ব্যাঙ্গালোরবাসী যুবতীর ক্লান্ত শরীরের পাশে শোয়ানো রক্তমাংসের ছোট্ট পুতুলটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়েছিলাম,তখনই একটা ফোন এসেছিল কলকাতা থেকে। সেখানকার হাসপাতালে একজন লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে। হঠাৎই অবস্থার অবনতি হয়েছে। ডায়ালিসিস চলছে কিন্তু তার শরীর সে-ধকল নিতে পারছে না। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবকিছু ফেলে ছুটে এলাম যখন কলকাতায়,ততক্ষণে লড়াই পৌঁছে গেছে আই সি ইউতে। সেই আই সি ইউয়ের বাইরে এখন বসে আছি আমি ভোর-রাতে। খবরের প্রতীক্ষায়। কী থাকবে সেই খবরে? নিয়তিই জানে। এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা শতাব্দী।
বসে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই কখন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। কী একটা দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ জেগে উঠলাম। আর ঠিক তখনই খবরটা এল আই সি ইউয়ের হিমশীতল নিষ্ঠুর গহ্বর থেকে  কাঁচের দরজা ভেদ করে। জানলার বাইরে ভোরের আকাশও দেখলাম একই কথা বলছে। চাঁদ ডুবেছে। একটা নতুন তারা জ্বলজ্বল করছে সেখানে।
****************************

সুজয় দত্ত বর্তমানে আমেরিকার ওহায়ো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানতত্ত্বের (statistics) অধ্যাপক। তিনি কলকাতার বরানগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র। তরুণ বয়স থেকেই সাহিত্য তাঁর সৃজনশীলতার মূল প্রকাশমাধ্যম,সাহিত্য তাঁর মনের আরাম। ছোটগল্প,বড় গল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতাও লেখেন তিনি। এছাড়া করেছেন বহু অনুবাদ–হিন্দি থেকে বাংলায় এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে। তিনি হিউস্টনের “প্রবাস বন্ধু” ও সিনসিনাটির “দুকুল” পত্রিকার সম্পাদনা ও সহসম্পাদনার কাজও করেছেন। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বাতায়ন’ পত্রিকাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এই পত্রিকাগুলি ছাড়াও ‘অপার বাংলা’ ও ‘গল্পপাঠ’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিন দুটিতে,নিউজার্সির ‘আনন্দলিপি’ ও ‘অভিব্যক্তি’ পত্রিকা দুটিতে,কানাডা থেকে প্রকাশিত ‘ধাবমান’ পত্রিকায়,ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত পূজাসংকলন ‘মা তোর মুখের বাণী’ তে,ভারতের মুম্বাই থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা পরবাসে’ রয়েছে তাঁর লেখা। কলকাতার প্রসিদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবী সংস্থা ‘পোয়েট্স ফাউন্ডেশন’-এর তিনি অন্যতম সদস্য। সম্প্রতি নিউ জার্সির “আনন্দ মন্দির” তাঁকে “গায়ত্রী  গামার্স স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে” সম্মানিত করেছে। সাহিত্যরচনা ছাড়া অন্যান্য নেশা বই পড়া, দেশবিদেশের যন্ত্রসঙ্গীত শোনা এবং কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো।

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!