কথায় কথায়
(রম্যকথা)
তাপস দে
কিছু প্রবচন ও বাগধারা নিয়ে আজ একটু কাটাছেঁড়া করা যাক।ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় এইসব কথার প্রচলিত অর্থ ব্যবহারিক দিক থেকে অনেকটা আলাদা আর প্রয়োগের কৌশলে কখনও সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থের হয়ে যায়।
প্রথমে লজ্জা নিয়ে পড়া যাক।বাংলায় লজ্জা শব্দটি একটি অনুভূতিবাচক বিশেষ্য।আমরা প্রায়ই বলি “লজ্জার মাথা খেয়ে” এই কাজটা করলাম।মানে লজ্জা না করে কাজটা করলাম।এখানে আক্ষরিক অর্থে অগৌরবজনক ভাবে লজ্জাকে একটি মাথাবিশিষ্ট প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং তার মাথাকেও হেঁট বা হেট( hate) করা হয়েছে। এই কথার সূত্র ধরে একটু তলিয়ে ভাবলে যে ছবিটা ফুটে ওঠে তা হল সমাজে যারা বিশেষ এবং মাথা স্থানীয় তারা সবসময়েই কিছু না কিছুর মাথার খোঁজখবর করতে থাকে যেমন মাছের,দইয়ের অথবা অধস্তনের আর তা সগৌরবে চেটে যেতে থাকে বিন্দুমাত্র লজ্জা না করে।এইভাবেই মূল কথাটার ওপর একটা দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। তারপর “ধার চাহিয়া লজ্জা দেবেন না”।এই বাক্যে লক্ষ্য করুন এখানে ধার চাইতে হয়ত আপনার লজ্জা লাগছে না কিন্তু না দিতে পেরে আমাদের বেশি লজ্জা লাগছে।মানে অধমর্ণ এখানে লজ্জা পাচ্ছেন না কিন্তু দিচ্ছেন।কেমন উল্টো ব্যাপার না! ধরা যাক এই বাক্যটি “হাতেনাতে ধরা পড়ে সে লজ্জায় লাল হল” অর্থাৎ চরম লজ্জা পেল । কিন্তু লাল কেন?কোন তিরস্কারজনক কাজ করলে তো অনুশোচনায় মুখটা তার কালো হবার কথা লাল নয়। এখানে লজ্জা একটি অপগুণবাচক ধর্ম ।আবার আসুন ‘লজ্জাবতী লতা’ কথাটিতে।লতা সতেজ ও সাবলীলভাবে কোন আধারের উপর বেড়ে চলে । কিন্তু এই শব্দবন্ধের ইঙ্গিতে তা দুর্বল এবং মাটিতে আনত কিছুর ভারে। কিসের না লজ্জার ভার। এখানে লজ্জা একটি স্ত্রী গুণবাচক শব্দ এবং ভারাক্রান্ত।আরেকটি বহু ব্যবহৃত কথা-“পেটে খিদে মুখে লাজ”। এখানে লাজ শব্দটির প্রয়োগ মুখোশের মত যা মানুষের আসল চেহারা ও ভাবকে ঢেকে রাখে।এই প্রবণতা আজকের সমাজে প্রায় উল্টে গেছে-কারণ মানুষ নিজের পাওনা গন্ডা জোর গলায় আদায় করে নিচ্ছে। আবার” লজ্জা ঘেন্না ভয় তিন থেকে নয়” এর চালু অর্থ হল এই তিনটি অপগুণ পরিহার কর। কিন্তু শব্দের কারিকুরিতে এই একই কথার এইরকম মানে দাঁড়াতে পারে -এই তিনটি প্রবৃত্তি অবশ্যই থাকবে এবং দিনে দিনে তা তিন গুণে (নয়) বিকশিত হবে।
এরপর আসা যাক চোখ নিয়ে বাগধারায়।”ওর চোখে আঙুল দিয়ে ভুলটা ধরালাম”।এখানে চোখে আঙুল মানে হল কোনকিছু নির্দেশ বা pinpoint করা। এটি অগৌরবার্থে ব্যবহৃত। অথচ বাস্তবে অভ্যাসের বশে সারাদিন আমাদের নিজেদের চোখেই বারবার আঙুল দিতে হয় কিন্ত নিজেদের ভুলভ্রান্তিগুলো কখনই ধরা পড়েনা। (অবশ্য কিছুদিন আগে করোনার সময়ে চোখেমুখে অপরিষ্কার হাত দেওয়ায় বারণ ছিল।) তারপর আরেকটি কথা-“চোখের মাথা” খেয়ে কাজটা করলি। এটিও অগৌরবসূচক বাক্য যার মানে অন্ধের মত কাজটি কেউ করেছে।কিন্তু বাস্তবে মাছের চোখ আর মাথা খেলে লোকের দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।তাই বাগধারাটি প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।তারপর – বিপ্লবকে আমরা “চোখের মণি” র মত রক্ষা করব।’এখানে চোখের মণিকে গৌরবার্থে প্রাণাধিক প্রিয় বোঝানো হয়েছে।কিন্তু নিজের চোখের মণিকে কি আমরা আদতে দেখতে পাই?তার যত্ন নেওয়া তো দূরের কথা।বরং পরম যত্নে থাকা দাঁতের সাথে তুলনা করলে লাগসই হত।সেভাবেই আমরা বলি ‘চোখ পাকিয়ে ‘অর্থাৎ রাগ প্রকাশ করে। এখানে পাকানো মানে ছোট চোখকে বড় করা না ঈষৎ ঘুরিয়ে ছোট করা সে বিষয়েও মীমাংসা হওয়া দরকার। তেমনই ‘চোখ জুড়োনো’ পারফরমেন্স আমাদের চোখকে কি জুড়ে দেয় মানে বুজিয়ে দেয়? না কি সব ভুলিয়ে দিয়ে কান্নার তাপ জুড়িয়ে শীতল করে?আসুন আমরা বরং চোখ কান খোলা রেখে লজ্জা ঢেকে রাখি।
আসা যাক কানের কথায়।” দু কান কাটা” মানে নির্লজ্জ বেহায়া। কিন্ত আগে লিখেছি “লজ্জায় মাথা কাটা” যাবার কথা। তাই কান ও মাথার মধ্যে কার বেশি লজ্জাবোধ তা অমীমাংসিত থেকে যায়। অবশ্য কথাতেই আছে “কান টানলে মাথা আসে”।এই প্রবচনের অর্থ হল ছোট সূত্র থেকে রীতিমতো অনুসন্ধান করে বড় চক্র বা পান্ডার হদিশ পাওয়া যায়।মানে বেশ ঘাম ঝরানো কাজ।বছরের পর বছর লেগে যায় সে’সবে।কিন্তু বাস্তবে কান আর মাথা লাগোয়া।কানে হাত দিলেই তো মাথাতে হাত লেগে যায়।এরপর “কানে দিয়েছি তুলো পিঠে বেঁধেছি কুলো”- এই প্রবাদের অর্থ হল কোন কিছু গায়ে মাখব না,সব সয়ে যাব এবং সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব। প্রবাদটি অগৌরবজনিত অর্থে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে কানে ঠুলি অর্থাৎ আজকের দিনে মোবাইলের ইয়ারফোন লাগিয়ে রেখেই মানুষ সবচেয়ে বেশি জ্ঞান ও আনন্দ আহরণ করে সামাজিক ভাবে সচেতন থাকে আর আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে সকলের পিঠে শোভা পায় কুলোপানা ব্যাকপ্যাক।আবার” চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন” মানে শোনা কথায় বিশ্বাস না করে নিজের চোখে দেখে যাচাই করা।কিন্তু আদতে চোখ ও কান এই দুটি ইন্দ্রিয় একই তালে চলে বলেই আমরা স্বাভাবিক ভাবে জীবন কাটাই।তাই এদের মধ্যে বিবাদ কোথায়!এরপর ধরা যাক “কান নিয়ে গেল চিলে” এই প্রবাদটির কথা।এর মর্মার্থ হল সত্য যাচাই না করে “বুনো হাঁস” অর্থাৎ গুজবের পিছনে ছোটা।কিন্তু আক্ষরিক অর্থে কারো কান চলে গেলে সে তো বধির।তাই সে কি করে গুজব শুনবে? আর চিলের কানে ছোঁ মারার উল্লেখ ইস্কুলের রাগী পন্ডিতমশাইকে মনে করিয়ে দেয় যার অভ্যাসই ছিল অতর্কিতে ছেলেদের কান টানা আর “চিল চিৎকার” দেওয়া।
এরপর আসি হাত নিয়ে কিছু কথায়।”আপনা হাত জগন্নাথ”-এই কথাটি একটি চালু প্রবাদ যার অর্থ হল নিজের হাতে কাজ করা বা স্বনির্ভর হওয়া,কিন্তু যাঁর হাত পা নেই সেই জগন্নাথ ঠাকুরের নাম কেন এখানে যুক্ত তা স্পষ্ট নয়। আমরা কথায় কথায় বলি” উত্তর কলকাতা আমি হাতের তালুর মত চিনি “।মানে খুব ভাল ভাবে চিনি।কিন্ত কথাটা কতটা সার্থক? না মানে চোখ বন্ধ করে নিজের হাতের তালু বা রেখার ছবি কি আমরা মনে করতে পারি যেমন পারি প্রেয়সীর চোখ মুখের কথা! আবার ” যাদবের হাত টান আছে “এই কথাতে না বলে পরের দ্রব্য তুলে নেবার অভ্যাস বোঝানো হয় কিন্তু আক্ষরিক অর্থ করলে হাতে টাকাপয়সার টানাটানি বা অভাবের কথা মনে আসে। অবশ্য একথাও ঠিক যে ” অভাবে স্বভাব নষ্ট” হয়।আবার “হাত সাফাই “কথাটিতে গৌরবার্থে যেমন ফেলুদার ভেল্কি বা ম্যাজিক আর অগৌরবার্থে চুরি বোঝানো হয়। প্রথম ক্ষেত্রে সাফাই মানে হাতের কারসাজি আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হল অন্যের ভার লাঘব করার কায়দা। তাই এখানেও অর্থের দ্বন্দ্ব! “তোকে হাতে না মেরে পাতে মারব”-এই প্রবচনের সরলার্থ হল কাউকে শারীরিক আঘাত না করে অর্থনৈতিক ভাবে শোষণ করা। আক্ষরিক অর্থে কাউকে পাতে মারা মানে খাবারে ধীরে ধীরে বিষ মেশানো যা রাজা সুলতানদের আমলে বা ফরেনসিক সায়েন্স আবিষ্কারের আগে প্রয়োগ হত।’ডান হাতের কাজ’ বলতে শুধু খাওয়াদাওয়া বোঝায় কিন্তু আরো বহু কাজ আমরা ডান হাতেই করি!আবার ‘হিটলারের ডান হাত গোয়েবেলস’ বাক্যে গৌরবার্থে ডান হাতের মানে হল প্রধান অনুগামী।কিন্ত তার পরের জন যেমন হিমলারকে কখনোই বাঁ হাত বলা যাবেনা কারণ তা অগৌরবজনক।অথচ অধিকাংশ সোজা কাজ আমাদের”‘বাঁ হাতের খেল” হয়ে যায়।
বাংলায় এই সব “কানাকানি হাতাহাতি” চলতেই থাকবে – কথার বাক্স এবার বন্ধ করি।
——————————————————-
গাভাস্কার
তাপস দে
কখনো একটা শালিক দেখা পথে
ভোরের স্কুল, কানমলার অভিমান
জড়ানো দুপুর।ঘুম ভাঙায় বুড়ির
সুতো, আইসক্রিমওলার টুংটাং ঘন্টা-
পকেটে ঠাকুমার তামার পয়সার ওম।
কয়েকটা বাড়ি দূরে -ছাদের বাগানে
আলোয় রঙীন ফ্রক আর ফুল ফুটেছে –
তখনই রেডিওতে খেলছে গাভাস্কার,
শেষ বেলার ঘূর্ণি সামলে সাবধানে।
অবশেষে হাফ প্যান্ট আর ফ্রকের
দেখা হল,খেলতে খেলতে -বিকেল
গড়াল হলুদ কুসুম ঘেরা রাতে।
তারপর…অনেকবছর কেটে গেছে
তামার পয়সাটা নেই -দাদু ঠাকুমাও।
উধাও ছাদ আর ফ্রক হয়তো সাদা শাড়ি-
শুধু ইউটিউবে খেলে যাচ্ছেন গাভাস্কার।
**********************************
তাপস দে পরিচিতিঃছোটবেলা থেকে গল্পের বই খেলাধূলো আর সংস্কৃতির কল্পরাজ্যে বাস। পেশায় বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার। দেশের নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি কাজের সূত্রে। কোভিডের সময়ে লেখালেখির আঙিনায় পুনঃপ্রবেশ। গল্প কবিতা রম্যরচনা নিবন্ধ লেখায় সন্ধান মানবিক মুখ ও দৃষ্টিভঙ্গির। দৈনন্দিন অফিস কাছারির ফাঁকফোকরে চালিয়ে যাচ্ছেন ডিজিটাল মাধ্যমে ও পত্রপত্রিকায় ফিচার জাতীয় লেখার কাজ।