Shadow

দারে আপা – পল্লব চট্টোপাধ্যায়

p.c. Naya Shatabdi

দারে আপা

পল্লব চট্টোপাধ্যায়

(১)

দুম করে চাকরিটা দিলাম ছেড়ে। আর ভাল লাগছিল না। তাস-পাশার নেশা ছিল না,তেমন কিছু সামাজিকও নই। তবে আর পরের চাকরি করার ইচ্ছে নেই। পয়সাকড়ি যা জমেছে দু’জনের দু’বেলা বাকি জীবনটা বসে খাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তাপসরা একটা এন-জি-ওর মত চালায় পুরুলিয়ার দিকে,ওকে ধরেছি সময় কাটানোর জন্যে কিছু কাজ-টাজ করব বলে। এমনি অবৈতনিক,মাঝে মাঝে টুকটাক গিয়ে ঘুরে আসার ইচ্ছে। তবে তাপস একটু টেড়িয়া মাল,বলে,’তার জন্যে লোক আছে,শখের সেবায় আমাদের কাজ নেই। পারলে কিছু চাঁদা দিস,কাজে লাগবে।’ কি অপমানজনক দেখেছ!
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠতেই দেখি নাম করতেই শয়তান হাজির। ‘কাল সকাল সাড়ে আটটায় হাওড়া থেকে লালমাটি এক্সপ্রেস,প্ল্যাটফর্মের গেটের কাছে চলে আয়। টিকিট কেটে রাখছি।’ এইটুকু বলেই ফোন কেটে দিল তাপস। যাঃ বাবা,এ যে মেঘ না চাইতেই জল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার একটু অদ্ভুত লাগল-এই তাড়া কিসের? যাই হোক কৌতূহল বলে তো একটা জিনিস আছে,তাই ঠিক সময়ে হাওড়া স্টেশনের আঠেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মের মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি তাপস ব্যাটা আগে থেকেই সেখানে হাজির।
‘কি রে, এই এমার্জেন্সী কিসের?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
’ট্রেনে যেতে যেতে বলছি চল’,এই বলে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে ওঠাল লালমাটিতে। গাড়িটা খড়গপুর-টাটা হয়ে পুরুলিয়া যায়। হাওড়া ছাড়তেই তাপস শুরু করল ওর গল্প।
‘আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। এমনই এক সকালে আসানসোল এক্সপ্রেসে হাওড়া এসে নেমেছি। তখন আমি ইস্টার্ণ রেলে কন্ট্রাক্টারি করি। অফিস টাইমের যানজট এড়াতে হাওড়া স্টেশনের জেটি থেকে লঞ্চে ফেয়ারলি ঘাটে নেমে ওখান থেকে হেঁটে রেলের হেড অফিসে যেতাম। জেটিতে যাবার মুখে দেখি একটা জটলা,হাওড়ার পুলিশ কতকগুলো জুয়াড়িকে হাতেনাতে ধরেছে,জেটির পায়ার নীচে বসে তাসেরআমি এগিয়ে জুয়া খেলছিল। এ তো রোজকার ব্যাপার ভেবে  যাচ্ছিলাম,হঠাৎ শুনি একটা গামছা আর গেঞ্জি পরা লোক বিজাতীয় ভাষায় পুলিশকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। পুলিশের কেউ সে ভাষা বোঝেনা,তারা ওকে টেনে হিঁচড়ে অন্যদের সাথে ভ্যানে তুলল। একঝলকের জন্যে লোকটার চেহারাটা দেখলাম। বছর ত্রিশের কৃষ্ণবর্ণ চেহারা,কপালে একটা মস্ত আঁচিল,মাঝে মাঝে ‘তেনালি,তেনালি’ বলে যাচ্ছে। পুলিশের একটা লোক হয়ত কিছু পড়াশোনা করেছিল, সে ধাক্কা দিয়ে বলল-‘হাঁ,সমঝা,তু জোকার মাস্টার তেনালিরাম হ্যায়। সালে কলকত্তে আকে জুয়া খেলতা হ্যায়! অব সসুরাল চল। ‘আমার ভূগোল জ্ঞান কিছুটা ছিল, বুঝলাম, অন্ধ্রপ্রদেশের তেনালিতে হয়ত ওর বাড়ি। চাইলে কিছুটা সাহায্য করতে পারতাম,কিন্তু সেদিন ফেয়ারলি স্ট্রীট অফিসে একটা টেন্ডার ওপেনিং ছিল,তাই আর পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাইনি।’
‘তারপর?’, আমি বললাম,এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলাম।
‘তারপর গত মাসে আমাদের এনজিওতে যাবার সময় ভ্যানে যেতে যেতে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন আষাঢ়ের পয়লা। অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে এখানে এত শিগ্‌গির ত মনসুন আসেনা! বাইরে তাকিয়ে দেখি রাস্তার বাঁদিক জুড়ে শুধু সবুজ মাঠ আর গাছপালা। রাস্তার ডানদিকে মাটিয়ালা-বাঘমুণ্ডি হয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢাল পর্যন্ত শাল-সেগুন-মহুয়া-পলাশের রাজত্ব ছিল বটে, তবে বাসুডির পশ্চিম প্রান্তে ছিল শুধু টাঁড় আর একফসলি পাথুরে জমি। সেখানে কে আনল এত সবুজের সমারোহ?
‘আমাদের এনজিওর কর্মী নিখিলকে জিগ্যেস করে জানা গেল ওখানে গত চার-পাঁচ বছর ধরে একটা আধবুড়ো ম্যাড্রাসি এসে থাকছে। পাগল-ছাগল লোক,তিনকুলে কেউ নেই, একমনে শুধু গাছ লাগিয়ে চলেছে। ওর কাজ দেখে দু-একটা এনজিও থেকে ওকে চারা সার এসব দিয়ে সাহায্য করে,ফরেস্ট বাবুরাও এসে উৎসাহ দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। এই দেখুন না,জায়গাটা পুরো সবুজ করে তুলেছে,মনে হচ্ছে এবার থেকে বৃষ্টিও ভালই হবে।
‘কৌতূহল বাড়ল। দু-একদিনের মধ্যেই অফিসের ভ্যানটা নিয়ে বাঘমুণ্ডি থেকে বাসুডি ঘুরে এলাম,লোকটাকেও দেখলাম। একটু ভাল করে দেখতেই চিনতে পারলাম,অবশ্যই কপালের আঁচিলটা দেখে। কিন্তু যে লোকটাকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে হাওড়া পুলিশ ধরেছিল সে এখানে কিভাবে?
‘কথা বললাম। জানতে পারলাম ওরা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে একটা দল এসেছিল কলকাতা বেড়াতে। ফেরার পথে হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করার ফাঁকে ওর ইচ্ছে হয়েছিল গঙ্গাস্নান করার। ঘাটের কাছে কিছু লোককে তাস খেলতে দেখে দু-চার মিনিট দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছিল ওদের খেলা,আর তখনই পুলিশ এসে পড়ে। তার বিরুদ্ধে কোনও কেসই আনতে পারে নি পুলিশ,অথচ যেহেতু ঘুষ দেবার বা তদ্বির করার কেউ ছিল না,বিনা বিচারে বছরের পর বছর রিমান্ডে রেখে দেওয়া হয় তাকে,সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে।
‘কি আশ্চর্য ভাব? এই আমাদের দেশ,এই আমার বাংলা! ভিক্টর হ্যুগোর ‘লে মিজেরাবলস্‌’-এর নায়ক জ্যাঁ ভালজ্যাঁ তবু পাঁউরুটি চুরি করে জেল খেটেছিল,আর এ তো একেবারে বিনা দোষে!
‘তেনালি,যদি সেটাই ওর নাম হয়,এখন দেখলাম মোটামুটি বাংলা বলতে পারে, তবে স্মৃতিশক্তি একেবারেই গেছে। হাজতে যাবার আগের প্রায় কোনও কথাই মনে করতে পারছে না,এমনকি গ্রামের নাম,মা-বাবার নাম,বৌ আছে কিনা। মনে ছিল শুধু তেনালি কথাটা,সেটা কি ওর নাম না ওর শহরের নাম তাও মনে পড়ছে না। এমন অবস্থায় বছর পাঁচেক আগে ছাড়া পেয়ে সে করমণ্ডলে চেপে বসে,কিন্তু কি ভেবে খড়গপুরেই নেমে পড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে। কলকাতায় জেলের বাগানে কাজ করত,সেই কাজ এখানেও শুরু করে। এখানকার লোকেরা গরীব হলেও ভালমানুষ,একবেলা-দু’বেলা খাবার জুটেই যায়।’
‘তা, এতে তোর অপরাধবোধটা কোথায়? তোর করারই বা কি ছিল ?’ শুধোলাম।
‘সেটা নিয়ে কলকাতা ফিরে গিয়ে অনেক ভেবেছি। তেনালি যদি ওর নাম না-ও হয়,নিশ্চয় অন্ধ্রের গুন্টুর জেলার তেনালি শহরে ওর বাড়ি। সেখানে খোঁজ নিলে হয়ত কিছু জানা যেতে পারত। ওর উপর যা অবিচার হয়েছে,তাতে সরকারকে বাধ্য করা যেত সব করতে। কিন্তু আমি শুধু নিজেদের রাজ্যের কথা ভাবলাম! মনে হল,লোকটা থাকলে পুরো বরাহভূম অঞ্চলটা একদিন সবুজ হয়ে উঠবে। আমরা বিভিন্ন এনজিও আর সরকারি উদ্যমে যা সম্ভব করতে পারিনি,ও নিঃস্বার্থভাবে সে কাজটা করে চলেছে এই বুড়োবয়সে।’
ইতিমধ্যে চাণ্ডিল ছাড়িয়েছে। বরাহভূমে অল্পক্ষণের স্টপেজ,নামবার জন্যে আমরা তৈরী হয়ে নিলাম। গাড়ি অপেক্ষা করছিল। বলরামপুর থেকে ঝালদা রোড ধরে আমরা অযোধ্যা পাহাড়ের গা ঘেঁসে বাঘমুণ্ডির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাঘমুণ্ডিতে তাপসদের এনজিওর হোমে খাওয়া দাওয়া সেরে এবার রওনা হলাম ‘মুখোশ-গ্রাম’ চড়িদার পথে।

(২)

বাঘমুণ্ডি অযোধ্যা পাহাড়ের তলায় এক আধা শহর। এ রাজ্যের ছৌ-সংস্কৃতির জন্ম ও বিকাশ শুরু হয় এখান থেকেই। বাঘমুণ্ডি থেকে অযোধ্যা পাহাড়ের জঙ্গল ঘেরা সর্পিল রাস্তায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে চড়িদা গ্রাম। ঠিকঠাক রাস্তা না চিনলে গ্রামটিকে খুঁজে পাওয়া এক কথায় অসম্ভব। পথনির্দেশ-এর নামমাত্র চিহ্ন নেই। এই চড়িদা গ্রামে প্রায় একশো পরিবারের বাস। কয়েক প্রজন্ম ধরে যাঁরা একটাই কাজ করে থাকেন-ছৌ নাচের মুখোশ তৈরী করা। খুব আশ্চর্য়ের বিষয়, পুরুলিয়ার ছৌ যে মুখোশের জন্য প্রসিদ্ধ-সেই মুখোশের আঁতুড়ঘর চড়িদার কথা সাধারণ মানুষ শোনেননি বললেই চলে। অথচ,এখানে একের পর এক ছোট ছোট বাড়িতে সার দিয়ে সাজানো শুধুই রঙ বেরঙের মুখোশ। সাত-আট বছর আগে এখানে বেড়াতে এসে তাপসের খুব খারাপ লাগে। ছৌ-নাচের মতোই মুখোশ তৈরীও যে কত বড় শিল্প,সে-সম্পর্কে সম্যক ধারণা তার ছিল। যেটা ছিল না,সেটা হচ্ছে এই শিল্পীদের হাল-হকিকত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। চড়িদা পৌঁছে ও বুঝল,একসময় যে শিল্পের সঙ্গে যোগ ছিল ঐতিহ্য আর জাঁকজমকের,আজ সেখানে শুধুই যেন দারিদ্র্য আর হতাশা।
শহুরে জীবন ছেড়ে হঠাৎ এখানে এসে পড়ে একটাই কথা মনে হয়েছিল,‘ইস্‌,এটাই তো হতে পারত এ রাজ্যের অন্যতম বড় একটা শিল্প।’ তারপরেই তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত হল ‘রাঢ়-বাংলা’ সংস্থা,বাংলার রাঢ় অঞ্চলে শিল্প-সংস্কৃতির সঠিক মূল্যায়ন ও বিপণনের উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমেই এরা একটি কো-অপারেটিভ খুলে সংস্থার তরফ থেকে পুরুলিয়ার নামোপাড়ায় একটা মুখোশের স্টল খোলে। দাম কম থাকায় প্রফিট-অন-ভলিউম ভালই হতে থাকে। এখন বাংলার অন্যান্য শহরেও এখানকার শিল্পীরা পরিচিতি পাওয়ায় পুজো-টুজোতে মূর্তি গড়ার কাজেও ডাক পাচ্ছে এ গ্রামের ছেলে-ছোকরারা। তবে কাজের মধ্যে হিমশৈলের উপরের ভাগটিই হয়েছে শুধু,সমস্যার মূল অনেক গভীরে। পরের বছর থেকে বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা আর ডোকরা শিল্প হাতে নেবার কথা আছে,তাহলে কলকাতায় ন্যায্য দামে এদের জন্যে বিপণনের সুযোগ করে দেওয়া যায়।পরদিন গিয়ে তেনালির সাথে আলাপ করে এলাম। পথে চড়িদা গ্রামের মুখে এসে একটা পূর্ণাবয়ব মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়িয়েছি। জীপ থামিয়ে নেমে দেখি আধুনিক ছৌ নাচের পথিকৃৎ পদ্মশ্রী স্বর্গত গম্ভীর সিং মুড়ার মর্মর-মূর্তি। পাশেই একটা বাড়ি থেকে নাচের বোল আর মাদলের আওয়াজ আসছিল। গেলাম সেখানে। দেখি একটা ক্লাবঘরের মত,একজন মধ্যবয়স্ক গ্রাম্য ভদ্রলোক ছৌ-নাচের তালিম দিচ্ছেন। পরিচয় পেলাম-ইনি গম্ভীরজীর সুপুত্র কার্তিক সিং মুড়া। আলাপ হল। দেখলাম একেবারে মাটির মানুষ,বিনয়ী,কথাবার্তায় বোঝা অসম্ভব যে দল নিয়ে কত দেশে বিদেশে অনুষ্ঠান করে এসেছেন। সেখান থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিটে পৌঁছলাম মুখোশ-গ্রামে। সত্তরোর্ধ্ব শিল্পী গণপতি সূত্রধরের সঙ্গে আলাপ হল। লক্ষ্মণ দত্ত,হরেন,শংকর বেরিয়ে এল আশেপাশের দোকান ছেড়ে,বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা হল মুখোশশিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে।পরের গন্তব্য বাসুডি। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি একজন শক্তপোক্ত কৃষ্ণবর্ণ বয়স্ক লোক একমনে কিছু চারাগাছের পরিচর্যা করে চলেছে। ইনিই তাহলে তেনালি! বেশ খানিকক্ষণ ধরে গল্পগুজব হল। ভাঙা বাংলায় ও যা বোঝাল তাতে মনে হল ওর আর বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের উপর কোনও টান অবশিষ্ট নেই। তেমন কিছু মনেও পড়ে না। তাছাড়া একটা অভিমানও আছে,ওরা কেউ কোনদিন খোঁজ করল না বলে। তবে ওর হাতের কাজ যা দেখলাম,পুরো পুরুলিয়া না হোক,বরাহভূম অঞ্চলটাকে যে ও বদলে দেবে সময় পেলে তাতে আর কোনও সন্দেহ রইল না আমার।
* * *
এবার কলকাতা ফিরে এসেও তাপসের মনখারাপ ভাবটা যাচ্ছে না। ওকে বোঝালাম,‘যে অন্যায় ভুলটা পুলিশ বা কলকাতার লিগ্যাল সিস্টেম করেছে তেনালির সাথে,তার দায়িত্ব কি তোর একার?’ ওর বক্তব্য-‘নাহয় সেদিন টেন্ডার ওপেনিং-এ একটু দেরীতে পৌঁছোতাম,এমন কি ক্ষতি হত তাতে? একটা মানুষের জীবন,বা হয়ত একটা পরিবার এভাবে নষ্ট হয়ে গেল আমার সামান্য একটা ভুলের জন্যে।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না,লালবাজারে ক’দিন একটু ছোটাছুটি করলাম আমার এক পুলিশি বন্ধুর সাহায্য নিয়ে। শেষে তেনালির ফাইল হাওড়াতেই খুঁজে পাওয়া গেল। ওর ত্রিশ বছর আগের ছবিটা স্ক্যান করে পাঠিয়ে দেওয়া হল গুন্টুর থানায়।
এই ঘটনার ঠিক দু’মাস পরে হাওড়া সিটি থানা থেকে ফোন এল,তেনালির পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওর বউ থাকে বিজয়ওয়াড়ায়, ওখানকার ভেঙ্কটেশ মন্দিরে ভোগ রান্নার যোগান দেয়,সেখানেই থাকে। তার একমাত্র ছেলে ট্যাক্সি ড্রাইভার,বউ নিয়ে মুম্বাইয়ে থাকে। তেনালির আসল নাম গুন্ডালু,আগে তেনালি সহরের ভেঙ্কটেশ মন্দিরে মালীর কাজ করত। খুব ধর্মভীরু পরিবার,বাপ-মা-বউ-ছেলে নিয়ে সদলবলে কলকাতা এসেছিল তীর্থ করতে। কালিঘাটের আদিগঙ্গায় তেমন জল ছিল না,তাই ফেরার সময় গঙ্গাস্নান করতে গেছিল হাওড়া স্টেশনে সবাইকে বসিয়ে রেখে,তারপরের ঘটনা তো জানা-ই। ওদের দলটা ওর বাবাকে রেখে চলে যায়,তা বুড়ো বাপ আর একা একা কোথায় খুঁজবে,হপ্তাখানেক পরে পয়সার টান পড়ায় সেও ফিরে যায়।
আমি সব শুনে একেবারে করমণ্ডলে বিজয়ওয়াড়ার দুটো রিজার্ভ টিকিট কেটেই ফিরলাম বাড়ি। তারপর সেবার তাপস যেমন আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিল,সেই একইরকম ভাবে ওকে বললাম- ‘পরশু দুপুর দুটোয় হাওড়া স্টেশনে চলে আয়,করমণ্ডলে আমরা বিজয়ওয়াড়া যাচ্ছি। তোর টিকিট হয়ে গেছে।
*                      *                    *
তেনালি, থুড়ি গুণ্ডালুর বউ কিছুতেই শুনল না,চলে এল আমাদের সঙ্গে। শ্বশুর শাশুড়ী মারা গেছেন,ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে, চিন্তার কিছু নেই। বিজয়ওয়াড়া বড় শহর,ও সেখানে থেকে মোটামুটি ভালই হিন্দি বলতে শিখে গেছে এখন……..তারপর ত্রিশ বছর পরে স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন,গুণ্ডালুর স্মৃতিশক্তি ফিরে পাওয়া-সেসব সেন্টিমেন্টাল বর্ণনা নাহয় থাক এখন।
যাক,নিশ্চিন্ত যে এক ঢিলে দুই,না না-চার পাখি মরল। গুণ্ডালু ওর বউ খুঁজে পেল আর তাপসের অপরাধবোধের সমস্যাও মিটল। আর হ্যাঁ,গুণ্ডালু কিছুতেই ফিরতে চাইল না,এ জায়গাটা ওর ভাল লেগে গেছে। গায়ের রঙ কালো বলে ছোটা লাপাং থেকে বাঘমুণ্ডির সাঁওতালরা ত ওকে দেবতা মনে করে,ওর নাম রেখেছে ‘দারে-আপা’ বা গাছ-বাবা। স্বামী-স্ত্রীতে এখন বাসুডি গ্রামেই থাকে। সুতরাং গ্রীন প্রজেক্ট আপাততঃ বন্ধ হচ্ছে না।
আর চার নম্বর পাখি? আমি এইমাত্র বাসুডি থেকে বাঘমুণ্ডি ফিরলাম,ওখানেই মাঝে মাঝে থাকি এসে,ভালই সময় কাটছে এখন। আরও কিছু বলতে বাকি থাকল কি?
-শেষ-
********************************

পল্লব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের খনিজ তৈলক্ষেত্রে কাটিয়েছেন সারাজীবন,সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। বিহারের,অধুনা ঝাড়খণ্ড,যে অঞ্চলে তিনি মানুষ সেখানে ‘নানা ভাষা,নানা জাতি,নানা পরিধান’ হলেও একসময় বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চার আবহ ছিল। সেই শিক্ষা থেকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায় ও বিগত কয়েক বছরে অবসর,জয়ঢাক,ম্যাজিক-ল্যাম্প,ছুটির ঘন্টা,আদরের নৌকা,ঋতবাক ইত্যাদি নেট-পত্রিকা ও যুগ,ট্রৈনিক,বোম্বে-ডাক ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায়,ক্যাফে-টেবল প্রকাশিত শরদিন্দু স্মৃতি-সংখ্যায় লিখে আসছেন। তাঁর প্রকাশিতব্য গল্প সংগ্রহ ‘আড্ডা আনলিমিটেড’ ও ‘বরাহ-নন্দন ও অন্যান্য গল্প’- দুটিই এখন যন্ত্রস্থ।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!