দূরত্ব
দেবলীনা দে
চোখে আধো আধো ঘুম নিয়ে তনিমা যখন তার পড়ার বইটা বন্ধ করলো,ঘড়িতে তখন রাত প্রায় একটা। বইয়ের লেখা বইয়েই রইল আর তার মন তখন অন্য দিকে। মনে বারেবারে একটাই প্রশ্ন উদয় হচ্ছে,প্রিয়সী কি সত্যিই তাকে চিনতে পারলো না! তার চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে ছোটবেলার সেই স্মৃতি। কত মধুর ছিল সে সব দিন।
আজ থেকে প্রায় ১২ বছর আগের কথা। একটা কাজের সন্ধানে তনিমার বাবা পাড়ি দিয়েছিল নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে। তনিমা তখন অনেক ছোটো। কিন্তু কিছু স্মৃতির বদঅভ্যাস থাকে যে তারা কোনোদিন মন থেকে মোছে না।
প্রণবেশ বাবু ছিলেন গ্রামের মস্ত বড়ো জমিদার। প্রিয়সী তাঁরই মেয়ে। প্রণবেশ বাবুর মস্ত বড়ো বাগানে একসময় মালি ছিলেন তনিমার বাবা। নিজের গ্রাম, কাছের মানুষ ছেড়ে অন্য দেশে পড়ে থাকার যন্ত্রণা তনিমার তখন বোঝার বয়স হয়নি। ওই মেয়েবেলা শুধু একটা সঙ্গীর খোঁজ করতো,যার সাথে সে বেশ অনেকক্ষণ ধরে,প্রায় সারাদিন রাত ধরেই খেলতে পারবে। প্রিয়সী তনিমার বন্ধুত্ব সেই তখনকার। কোনো এক ভরা দুপুরে গোলাপের মত এই সুন্দর মন দুটি একে অপরকে চিনে ছিল গোলাপ বাগানে।
গ্রামে জমিদারের মেয়ে বলে প্রিয়সীর অনুমতি ছিলনা রাজপ্রাসাদের বাইরে যাওয়া। প্রিয়সীরও সেভাবে কোনো বন্ধু ছিল না। বাড়ীর এই বাগানই ছিল তার একমাত্র জগৎ। তনিমার ওপর কড়া শাসন ছিল যেনো সে গোলাপ বাগানে কখনো না যায়। কিন্তু ছেলেবেলা আর কত শাসন মানে!
বাড়ীর সকলের অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠে তনিমা আর প্রিয়সীর নিষ্পাপ বন্ধুত্ব। এই ছোট বাগান,সবার চোখের আড়ালে,তাদের কাছে ছিল একটা গোটা পৃথিবী। মনের সব গোপন ইচ্ছাটুকুর এই একমাত্র ঠিকানা। কল্পনার সেই জগতে পুতুল খেলা আর বাস্তবে পুতুল গড়া, সবটুকু নিয়ে ছিল সেই জগৎ। আর সাথে ছিল সারাজীবনের বন্ধুত্বের অঙ্গীকার। খেলার ছলে সেই বন্ধুত্ব পেলো অন্য এক মাত্রা। তনিমার মায়ের কাছে প্রিয়সী হয়ে উঠল তার মেয়ের মতো। তনিমার মায়ের কাছেই নানা আবদার নিয়ে আসত প্রিয়সী। অনেক ভয় ও কুন্ঠাবোধ পেরিয়ে হাসি মুখে আর গোপনে সব আবদার পূরণ করতো সে।
প্রিয়সীর বাড়ীর কেউই বেশ কিছু দিন এই বন্ধুত্বের কথা জানতে পারেনি। তবে বিধাতার মনে হয়তো অন্য কিছুই ছিল। প্রিয়সী একদিন খেলার ছলে তনিমা কে নিয়ে গেল তার ছোট্ট একটা ঘরে। এত বড় প্রাসাদসম বাড়িতে তনিমার সেই প্রথম আর শেষ প্রবেশ। তনিমা আর প্রিয়সী যখন নিজেদের খেলার জগতে হারিয়ে গেছে, তখনই হঠাৎ করে প্রিয়সীর মা ঘরে প্রবেশ করে। তনিমা কে তার সেই প্রথম দেখা। আর হবে নাই বা কেন। সামান্য একজন মালির মেয়ে। তার থাকা না থাকা রাজপ্রাসাদের মালকিনের কোন কাজেই আসে না। আর প্রিয়সী আর তনিমার মধ্যে তফাৎ ছিল অনেক। প্রিয়সীর ঝকঝকে নতুন কাপড় কিন্তু তনিমার ওই ছেঁড়া ফুটো একটা পুরনো জামা। প্রিয়সীর মা এক লহমায় বুঝে গিয়েছিল এই মেয়ে সেই রাজপ্রাসাদের যোগ্য নয়। সারা বাড়িতে হইচই পড়ে গেল নিমেষে। তৎক্ষণাৎ প্রকাশ্যে চলে এল তনিমা ও প্রিয়সীর সেই অসমান বন্ধুত্ব। এই কথা যখন প্রণবেশ বাবুর কানে ওঠে, তখন তিনি এক কথায় জানিয়ে দেন মালির এই বাড়িতে আর কাজ করা যাবে না। এখনই যেন সে বাড়ি ছেড়ে এবং এই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
তনিমা তার মা-বাবার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে তখন তাদের শেষ জিনিস গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে গ্রাম ছাড়ার জন্য। কিন্তু সেই নিষ্পাপ মন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না কেন তার বন্ধুকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বারবার মাকে তনিমার একই প্রশ্ন,”মা,কেন চলে যাচ্ছি আমরা? আমার তো প্রিয়সীর সাথে এখনো অনেক খেলা বাকি।” “বলোনা মা কোথায় যাচ্ছি আমরা? প্রিয়সী কি আমার সাথে যেতে পারে না? আমরা কি এখানে আর কোনদিনই আসবো না?”
সমাজের তৈরি করা এই অদ্ভুত বৈষম্য তনিমার মা নিজেই কোনদিন বুঝে উঠতে পারেনি। তনিমার কোনো প্রশ্নেরই কোন জবাব ছিল না তার কাছে। চোখ মুছতে মুছতে তনিমার মা শুধু একটা কথাই বলে ওঠে,”বেশি প্রশ্ন না করে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে।” এমন অনেক প্রশ্ন তনিমার মাথায় সারাদিন আসে যে প্রশ্নের উত্তর তার মায়ের কাছে কোনদিন থাকে না। তাই মায়ের এই জবাবও তনিমার কাছে কিছু নতুন নয়। সে যেন বুঝে গেছে সব সমাজেই দুটি শ্রেণী থাকে ধনী আর গরিব। যাদের নাম একসাথে নেয়া হলেও একসাথে থাকা বা বন্ধুত্বের অধিকার হয়তো নেই।
পরবর্তী আশ্রয়ের কথা তারা কেউ কিছু এখন জানেনা। ঘর ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ তাদের দরজায় উঁকি দিল ছোট্ট প্রিয়সী।
“অনেক লুকিয়ে মাকে না বলে তোর সাথে দেখা করতে এসেছি। তুই কি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?”, চোখের জল মুছে প্রিয়সী বলে উঠলো।
তনিমা কিছু বুঝতে না পেরে হঠাৎ করে গিয়ে প্রিয়সী কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো।
“দূরে চলে গেলেও বন্ধুত্ব কিন্তু এরকমই থাকবে আর তুই থাকবি আমার ছোটবেলা এবং সারা জীবনের সেই প্রিয় বন্ধুটা।”
তনিমার এই উত্তরে প্রিয়সী বলে উঠলো,”আমাদের কি আর কোনদিন দেখা হবে না?”
“হবে হয়তো কোন একদিন। তবে তখন কিন্তু আমাদেরকে আর কেউ আলাদা করতে পারবে না।”
নিষ্পাপ এক বন্ধুত্বের এই পরিণতি হয়তো তনিমার মা মেনে নিতে পারেনি। তাই হাত জোর করে সেই দিনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিল এই বন্ধুত্ব যেন সারা জীবনের হয় আর হয়তো তাই আজ এত বছর পর আবার তনিমার সাথে প্রিয়সীর দেখা। এখন জগৎ সমাজ পরিস্থিতি সবই আলাদা। কিছুই আর সেই ছোটবেলার মতো নেই। হয়তো তাদের বন্ধুত্বটাও নেই।
তনিমা বড় হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তনিমার জগত হয়তো খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তার পরনে কোনদিনই সেভাবে দামী পোশাক-আশাক ছিল না। আজও নেই। কলেজের ছেলেমেয়েদের সেই হাই স্ট্যান্ডার্ড তনিমা হয়তো কোনদিনই মেলাতে পারিনি। চেষ্টাও করেনি।
কলেজে যাওয়ার কিছুদিন পরেই তনিমা হঠাৎ একদিন দূর থেকে প্রিয়সী কে দেখতে পায়। প্রিয়সীর রূপ,চালচলন সবই হয়তো আজ অনেক পাল্টে গেছে। কিন্তু তাও কেন জানিনা তনিমার মনে হল এই সেই তার ছোটবেলার বন্ধু। কাছে এগিয়ে গিয়ে তার পরিচয় দিতে প্রিয়সী এক কথায় জবাব দিয়ে দিল,”আমি ঠিক তোমাকে চিনতে পারলাম না।”
“চিনতে পারলি না কি রে? আমি তনিমা। তোর মনে নেই আমার কথা? সেই ছোটবেলায় তোদের বাগানে আমরা খেলতাম। কত সময় একসাথে আমরা কাটিয়েছি, কত স্মৃতি আমাদের। তোর কি কিছুই মনে পড়ছে না? মনে আছে আমরা দুজনে মিলে বাগানের মাটি নিয়ে কি সুন্দর পুতুল বানাতাম?”
“রাবিশ!! কি যা তা বলে যাচ্ছ তখন থেকে। আমার কাছে দামী পুতুল থাকতে আমি মাটির পুতুল বানাতে যাবই বা কেন।”
পাশ থেকে প্রিয়সীর কোন এক বন্ধু হঠাৎ তাকে জিজ্ঞাসা করে বসে,”এই,তুই কি সত্যিই ওকে চিনিস? সত্যিই কি ও তোর ছোটবেলার বন্ধু?”
প্রিয়সী কোন কিছু না ভেবেই উত্তর দেয়,”How can you even think that? ওর জামা কাপড় দেখেছিস। কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই। তোরা ভাবলি কি করে? এইরকম একজনকে আমি আমার বন্ধু করব।”
“তাহলে ও যে বলছে….”
“মিথ্যে বলছে মিথ্যে। এরকম মেয়েদের আমার জানা আছে। বড়লোক দেখলেই তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে আসে।”
ছোটবেলার সেই প্রিয় বন্ধুর দেওয়া এই মিথ্যাবাদী অপবাদ তনিমা নিতে পারেন। আর একটাও কথা না বলে সেখান থেকে তনিমা চলে আসে।
সমাজেরই তৈরি করে দেওয়া দূরত্ব এত বছর পরেও তনিমা কোনদিনই বুঝে উঠতে পারেনি। কিসের এই দূরত্ব, কিসের এই ভেদাভেদ? স্ট্যান্ডার্ড ধনী গরিব এইসব নিয়ে মানুষ কেন এত ভাবে। কি পায় এইসব নিয়ে গর্ববোধ করে। মানুষের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত সে মানুষ।
ছোটবেলার সেই ফিরে পাওয়া বন্ধুকে তাদের বন্ধুত্বের কথা বোঝানোর এক শেষ চেষ্টা করতে চায় তনিমা। তার এখনো মনে পড়ে প্রিয়সী তার মায়ের হাতের পায়েস কতই না পছন্দ করত। ঠিক পরের দিন মায়ের হাতের বানানো পায়েস নিয়ে তনিমা পৌঁছে যায় প্রিয়সীর সামনে। সেই দিন অবশ্য আশেপাশে আর কেউ ছিল না।
“প্রিয়সী, এই দেখ। আজ তোর জন্য মা পায়েস বানিয়ে দিয়েছে। ছোটবেলায় কি খেতেই না ভালবাসতিস তুই এই পায়েস।”
যে মেয়ের সাথে তার স্ট্যান্ডার্ড মেলেনা সেই মেয়ের বারবার বিরক্ত করা হয়তো প্রিয়সীর পছন্দ হয়নি।
প্রিয়সী রেগে গিয়ে পায়েস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাকে জানালো,”তুমি ভাবলে কি করে তোমার মত একজনের হাতে বানানো এই পায়েস আমি খাব।”
“না প্রিয়সী,এটা আমার মা বানিয়েছে। তোর মনে আছে ছোটবেলায় তুই খুব পছন্দ করতিস এই পায়েস খেতে।”
“কিসের ছোটবেলা? কোন ছোটবেলা? আরে বাবা তখন ছোট ছিলাম তখন হয়তো বুঝতাম না। না হলে তোমার মত এক মালির মেয়ের সাথে কখনো আমার মত এক মেয়ের বন্ধুত্ব হতে পারে?”
এই কথা শুনে তনিমা তার চোখের জল ধরে রাখতে পারল না।
“কিন্তু ছোটবেলায় সেই একসাথে খেলা একসাথে ওঠা বসা সেই সবের কি কোন দাম নেই? টাকা স্ট্যান্ডার্ড এইসবই কি সব?”
প্রচন্ড বিরক্তের সাথে প্রিয়সী উত্তর দিল,”তোমার আর আমার ক্লাস এক নয়। তুমি সামান্য একটা মালীর মেয়ে আর আমি গ্রামের বড় জমিদারের মেয়ে। আর ওই ছোটবেলায় কি ঘটেছে না ঘটেছে সেসব আমি এখন আর কোন কিছু মনে রাখি না আর মনে রাখতেও চাই না। তোমার আর আমার পৃথিবী চিরকাল আলাদা ছিল চিরকাল আলাদাই থাকবে।”
প্রিয়সী নিজের কথা শেষ করে তনিমার দিকে না তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। তনিমা চোখের জল নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সেই একই জায়গায় স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু সেই মানুষেরই অন্য মানুষের সাথে মেশার আগে অনেক কথা ভাবতে হয়। বন্ধুত্ব সমানে সমানে হয়। না, সমান মানসিকতা নয়। সমান স্ট্যান্ডার্ড আর সমান টাকা। প্রিয়সীর দেওয়া জীবনের এই এত বড় শিক্ষা তনিমা হয়তো কোনদিন ভুলবে না। এখন থেকে সে হয়তো নিজেকে মানুষ বলে চেনার আগে নিজের অস্তিত্ব টাকা দিয়ে বিচার করবে। মানসিকতার এই পরিবর্তন এই সমাজের অনেক বড় জয়।
******************************
লেখিকা পরিচিতি:
জন্ম কলকাতা শহরে কিন্তু বড়ো হয়ে উঠা হুগলী জেলার এক গ্রামে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে M.A.। বর্তমানে এক এডটেক (EdTech) কোম্পানীতে কর্মরতা। কল্পনার জগতে গল্প কথার মালা গাঁথা অবসর সময়ের শখ ও ভালোবাসা দুইই। পড়াশোনার পাশাপাশি সুরের ভক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে চর্চা বেশ কয়েক বছরের।