বুলাদির বিড়ম্বনা
অজন্তা প্রবাহিতা
বুলাদি আমাদের পাড়ায় দুটো বাড়ি পরে থাকতো। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। ঠাম্মাকে নিয়ে বুলাদির পরিবারে মোট চারজন সদস্য। এদিকে আমাদের পরিবারে তিনজন। ঠাম্মা আর দিদা মাঝে মাঝে আসে যায়। তখন আমাদের বাড়িতে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়।
বুলাদি যখন ক্লাস টেন, আমি ফাইভে পড়ি। স্কুল ছাড়াও বাইরে কোথাও গেলে বুলাদি শাড়ী পরতো আর বাড়িতে নাইটি। পাটপাট করে গুছিয়ে শাড়ী পরে লম্বা চুলের সুন্দর করে বিনুনি করে,ছোট্ট টিপ্ পরে, ডাইরিটা হাতের ভাঁজে বুকে চেপে ধরে বুলাদি যখন গানের ক্লাসে যেত,আমি জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকতাম,মনে মনে ভাবতাম,আমিও কবে অমন শাড়ী পরে সাপের মতো বিনুনি দুলিয়ে স্টাইল করবো।
চুল পাতলা বলে মা সবসময় বাটি ছাট দিয়ে রাখতো,বলতো,চুলের গোছ থাকলে লম্বা চুল ভালো লাগে,বুলার মতো লম্বা চুল কি আর তোর হবে? অনেক ভাগ্য করলে অমন রূপ আর অমন চুল পাওয়া যায়। রূপ বৃদ্ধি কি করে হয়,জানিনা। তবে, ধীরে ধীরে দিদা,ঠাকুমা স্বরূপ ক্লাসের বন্ধুদের কাছ থেকে চুল ঘন করার অনেক তথ্য জেনে নিলাম। ততদিনে,বুলাদি ফার্স্ট ডিভিশনে স্কুল ফাইনাল পাস করে কলেজে হাইয়ার সেকেন্ডারিতে ভর্তি হয়েছে। বুলাদির বাবা মা ছিলেন আমার জেঠু জেঠিমা।
জেঠু আমার মুখে রসগোল্লা পুরে দিয়ে বললেন,’তুলি,তোকে কিন্তু বুলার থেকেও ভালো রেজাল্ট করতে হবে।’ মিষ্টি রসগোল্লা সেদিন খুব ফ্যাশকা লেগেছিলো। একদিকে বুলাদির রূপ আর চুলের সমকক্ষ হতে গিয়ে বারবার অসফল হচ্ছি, আনারসের খোসা সেদ্ধ করা জল দিয়ে চুল ধুলে নাকি চুল রেশমের মত হয়,সেসব করতে গিয়ে মাথায় পিঁপড়ে উঠে যাচ্ছে। আরতিকে পটিয়ে জবা ফুলের পাতা বেটে চুলে লাগাচ্ছি তো চুল কেমন চিটচিটে হয়ে যাচ্ছে। বাবা একটাই সানসিল্ক শ্যাম্পু কিনে দিয়েছে,সেটা পুরো বছর লাগাতে হবে,তাই, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে ওটাও শোকেসে সাজিয়ে রেখেছি আবার এখন পড়াশোনাতেও পাল্লা দিতে হবে? এত কি পারা যায়? ঠাকুর কেন আমায় বুলাদির পরে জন্ম দিল? ওর আগে জন্মালে তো এমন ভাবে ওর সমকক্ষ হবার জন্য কষ্ট করতে হত না।
পাড়ার বন্ধু মিতালীর কাছে খবর পেলাম বুলাদি প্রেমে পড়েছে। প্রেম বিষয়ে খুব একটা পাকাপোক্ত ধারণা হয়ে ওঠে নি তখনও। তবে,বুলাদির মাথায় শ্যামলদার বাড়ির ফুল দেখে একটু আধটু মনে হলো কেমিক্যাল রিয়্যাকশন টা শ্যামলদার সঙ্গেই ঘটেছে।
শ্যামলদার বাবা ভীষণ ফুল প্রেমী মানুষ। প্রতিবছর বাড়ির সামনে বাগানে মরশুমি ফুল ফোটান,তাছাড়াও অনেক ফুল গাছ ওদের বাড়িতে আছে। ঠাম্মা এলে ওদের বাড়িতে ফুল আনতে যেতে হতো। শ্যামলদার মা ছিলেন আমার মায়ের দূরসম্পর্কের দিদি,অতএব,মাসির বাড়ি গেলে মাসির আদর না খেয়ে কি আসা যায়।
শ্যামলদা তখন শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর,দেবুদা হাইয়ার সেকেন্ডারি ফাইনাল দেবে। ওদের বাড়িটা পাঠশালা ছাড়া কিছু মনে হতো না আমার। যখনি যাও না কেন,সবাই বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে আছে। শ্যামলদা ছুটিতে বাড়ি আসে তখন মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে রেডিওতে চলতে থাকা গানের সুর কানে এসে লাগে। শ্যামলদা এলেই বুলাদির মাথায় ফুল সেজে ওঠে। যেসময়ের গল্প লিখছি,সেটি আশির দশক। সেসময় ব্যারাকপুরের মতো মফ:স্বলের ছেলেমেয়েরা প্রেম বা মনের কোমল অনুভূতি গুলো আড়ালে রাখতেই ভালবাসতো।
দেখতে দেখতে বুলাদি সগৌরবে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হলো। বুলাদি দিন দিন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। আমিও তখন ক্লাস এইট। পুজোর ছুটিতে একদিন বুলাদি আমায় ডেকে বললো,’তোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিলে করতে পারবি ?’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বললাম,’হ্যাঁ পারবো।’
ততদিনে আমার চুল কাঁধ অব্দি নেবেছে। বুলাদি আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’আয়,তোর চুলে সুন্দর করে বিনুনি করে দি। তারপর চুল দিয়ে সুন্দর দুটো কলা বিনুনি করে দিয়ে,নিজের সংগ্রহ থেকে দুটো সুন্দর ক্লিপ মাথার দুধারে লাগিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে বললো,’ দেখ দেখি,কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে। ‘
নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম,বুলাদির মতো রূপসী না হলেও এক্কেবারে ফেলনাও লাগছে না আমায়। এবার বিশ্বস্ত দূতের মতো বুলাদির চিঠি স্কার্টের পকেটে ভরে চললাম শ্যামলদার বাড়ি।
বিজয়া শেষ,লক্ষ্মী পুজো আসছে,কাজেই বাড়িতে বাড়িতে নারকোল নাড়ু,মোয়া ইত্যাদি বানানোর ধুম চলছে। গেটের ভেতর পা বাড়াতেই নারকোলের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। সদর দরজা খোলাই ছিল,তাই আর দেরি না করে সোজা মাসির কাছে চলে গেলাম। দেখি মাসি নাড়ু বানাতে ব্যস্ত। টুক করে প্রণাম সেরে নিতেই মাসি বললো,’কি রে তোর তো দেখা পাওয়া ভার,খুব পড়াশুনা করছিস বুঝি। তা কি নিয়ে পড়বি ভাবছিস?’
মাথা চুলকে নিয়ে বললাম, .’জানিনা,মা যা বলবে তাই নিয়ে পড়বো।’
একটা প্লেটে গোটা কতক নারকোল নাড়ু আর সন্দেশ রেখে এগিয়ে দিতে দিতে মাসি বললো,’ওরে শোন,যে বিষয়টা তোর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে,সেই বিষয়টা নিয়ে পড়বি। তাহলে দেখবি পড়াশোনাটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। ‘
আমি ততক্ষণে নাড়ু সন্দেশ সাবাড় করে জল খেয়ে ঢোক গিলছি। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শ্যামলদা কোথায় মাসি?‘
‘ঐ তো নিজের ঘরে। শোন,তোর দাদা বম্বেতে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। কালীপুজোর পরে জয়েনিং। মা কে বলিস মনে করে।’
আমাদের বাড়িতে নতুন কিছু এলে হৈ হৈ করে পাড়ার সবাইকে বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি,আর,দাদা এতো ভালো চাকরি পেলো,আমরা পাশে থেকেও কিছু জানতে পারলাম না,এ আবার কেমন ব্যাপার।
‘শ্যামলদা ভেতরে আসবো?,’
আমার কণ্ঠস্বর শুনে দাদা বই থেকে মুখ তুলে চাইলে।
‘ও তুলি,আয় আয় ,ভেতরে আয়,’বলে শ্যামলদা চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলো। দাদার হাইট ছয় ফিট। মুখের আদল অনেকটাই সানি দেওলের সঙ্গে মিলে যায়। দাদার ঘরের দেয়ালে সানি দেওলের একটা বড় পোষ্টার দেখে বুঝলাম দাদার প্রিয় হিরো। বাইসেপ এর সাইজ দেখে বুঝলাম দাদাও বেশ শরীরচর্চা করে।
আমাকে খাটে বসিয়ে চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার দিকে মুখোমুখি বসে শ্যামলদা খুব সপ্রতিভ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,’কি রে,তোর এবার ক্লাস এইট তো,ব্যাস আর সময় নেই,দুটো বছর মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। খুব ভাইটাল দিন। এখন যদি ফাঁকি মারিস,তাহলে,কোনোদিনও ভালো রেজাল্ট করতে পারবি না।‘
সুবোধ বালিকার মতো সব শুনে উঠে দাঁড়ালাম,’এবার আসি তাহলে শ্যামলদা।’
‘চলে যাবি? আচ্ছা ! আবার আসিস।’
আস্তে করে স্কার্টের পকেট থেকে বুলাদির চিঠিটা শ্যামলদার হাতে দিয়ে বললাম,’এটা তোমার।’
আর একমুহূর্ত দেরি না করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মাসি তখন রান্নাঘরে। দেবুদা নিজের ঘরে,মেসো বাইরের ঘরে বসে পেপার পড়ছে।
‘আসছি মাসি’,বলে মাসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছুটে গেলাম বুলাদির কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বুলাদির কাছে গিয়ে কানে কানে বলে এলাম,’তোমার কাজ হয়ে গেছে।‘
গাল টিপে আদর করে একটা চুমু খেয়ে বুলাদি বললো,’সোনা বোন আমার।’
কালীপুজোর পরে শ্যামলদা মুম্বই চলে গেলো,আর বুলাদি হোস্টেলে। আমিও পড়াশুনায় ডুবে গেলাম। বেশ দিন কাটছিলো। ছন্দপতন হলো মাস ছয়েক পর। একদিন রাতে বুলাদির বাড়ির কাজের মেয়ে শেফালী এসে আমাদের গেটে দুমদাম আওয়াজ করতে লাগলো,’ ও তুলি,ও কাকিমা তোমরা শিগগির আসো, মেসো যেন কেমন করতাসে।’
বাবা মা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে ছুটে গেলো বুলাদিদের বাড়ি। আমি ও গেলাম পিছু পিছু। গিয়ে দেখি জেঠু মাটিতে পড়ে কেমন একটা করছে। বাবা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তড়িঘড়ি করে জেঠুকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। পরদিন সব টেস্ট রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, স্ট্রোক। তবে এযাত্রায় বেঁচে গেলেন। খুব নিয়ম করে করে ওঁকে রাখতে হবে। পরিচিত আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে গেলো। বুলাদি হোস্টেল থেকে ফিরে এলো। জেঠিমা আর ঠাকুমা দেরি না করে শ্যামলদার মা বাবার সঙ্গে কথা বললেন।
মাত্র দুমাসের মধ্যেই বুলাদি আমার বুলা বৌদি হয়ে গেলো। স্থির হলো,গ্রাজুয়েশন ফাইনাল দিয়ে বুলাদি মুম্বাই পাড়ি দেবে।
এবারে আমিও কিছুটা বড় হয়েছি দেখে বুলাদি বন্ধুর মতো মনের কথা বলতো। একদিন বললো,’ধুর বিয়ে হলো কিন্তু বরটাকে কাছে পাচ্ছি না। এমন ভাবে থাকা যায় নাকি,বল। ওকে ছাড়া কি আর ঘুম হয়?’
এতদিনে আমিও একটু পেকেছি, তাই,বুলাদির কথা শুনে লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে গেলো। ফাইনাল শেষ হতেই বুলাদি শ্যামলদার সঙ্গে সংসার করতে চলে গেলো। জেঠুর শরীর আরো ভেঙে গেছিলো। বছর ঘুরবার আগেই তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। বুলাদি এলো বাবার কাজে,কি সুন্দর দেখাচ্ছিলো। কপালে বড় লাল টিপ্,গাঢ় রঙের শাড়ী আর সবসময় গায়ে একটা সুন্দর গন্ধ। এতো শোকের আবহাওয়াতেও দিদিকে দেখলে মন ভালো হয়ে যেত। সব যেন নতুন নতুন।
ঈশ্বরের মতিগতি বোঝা দায়। পুত্রশোকে বুলাদির ঠাম্মা দুমাসের মধ্যেই ছেলের কাছে চলে গেলেন। জেঠিমাকে একা রাখা যাবে না কাজেই বুলাদি সঙ্গে করে মুম্বই নিয়ে গেলো। কিছুদিনের মধ্যে চিঠি এলো,মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে,ফোর্থ স্টেজ। পরের চিঠিতে জেঠিমার মৃত্যু সংবাদ এলো। আমি তখন হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছি। বারবার মনে হতো,এই তো সেদিন এতো গমগমে পরিবেশ,সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া,অনুষ্ঠান পালন,আজ তিনতিনটে মানুষ পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গেলো?
বুলাদিদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলো। শ্যামলদার ভাই আমেরিকা পড়তে চলে গেলো। আমিও বুলাদির মতই ইতিহাস নিয়ে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হলাম। পোস্টগ্রাজুয়েশন শেষ করে কলকাতায় একটা বেসরকারি স্কুলে পড়াতে আরম্ভ করলাম। এর মধ্যে শ্যামলদার বাবাও গত হয়েছেন। ওরা বাড়ি বিক্রি করে মাসিকে নিয়ে গেছে। মাসির চিঠিতে সব খবরাখবর পাই। বুলাদির একটি মেয়ে হয়েছে। তাকে সামলাতে গিয়ে সবাই ব্যস্ত।
কয়েক বছরের মধ্যে আমারও বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরে বেঙ্গালুরু চলে এলাম। বাবা একদিন হঠাৎ না ফেরার দেশে চলে গেলেন। মা,ব্যারাকপুরের বাড়ি বিক্রি করে মাসির সঙ্গে শ্রীরামপুরে চলে গেল। কিছুতেই আমার কাছে আসতে চায় না। বলে,’আবার নতুন করে ছেলেবেলার আনন্দ গুলো উপভোগ করছি। । চেনা বাড়ি,চেনা রাস্তা, চেনা মানুষ,যারা বেঁচে আছেন,তাদের সঙ্গে ভীষণ ভালো আছি,তোদের হাইটেক সিটিতে গিয়ে আমার দম আটকে আসবে।‘
আমার বর,অংশুমান রাশভারী মানুষ। বিয়ের পর কখনো ওকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখি নি। খুব জোরজার করলে উত্তর দিতো,হাসার পরের মুহূর্তেই যে কাঁদতে হবে,তাই আর হাসতে চাই না। এমন কথা শুনে প্রথম দিকে খুব অবাক হতাম। ধীরে ধীরে আমারও হাসি মিলিয়ে গেলো। যন্ত্র চালিত মেশিনের মতো প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত হয়ে দিনযাপন করতে লাগলাম। অনেক দিন হয়ে গেলো বুলাদির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। সব কেমন হারিয়ে গেছিল।
কি মনে করে একদিন ফেসবুক সার্চ করতে করতে বুলাদিকে পেয়ে গেলাম। মেসেন্জারে কন্টাক্ট করতেই বুলাদি নিজে নম্বর দিলো। বুলাদির মেয়ে এখন এম টেক করছে দিল্লী আইআইটি থেকে। অনেক পীড়াপিড়ির করার পর বুলাদি আর শ্যামলদা হোলির ছুটিতে বেঙ্গালুরু আসতে রাজি হলো।
আমার যেন আর তর সইছিলো না। ৮ মার্চ এ অপেক্ষার অবসান হলো। অংশুমান আর আমি ওদের নিয়ে আসার জন্য এয়ারপোর্ট গেলাম। হিসেবে বলছে মাঝখানে দুটো যুগ পার হয়ে গেছে। সময় কি আর কারো জন্য বসে থাকে? এতো বছর বাদে বুলাদিকে দেখে চমকে উঠলাম,কোমর ছাপানো চুল এখন কাঁধের ওপর উঠে গেছে। পাকা চুল,যত্নের সঙ্গে রং করা হলেও রূপের জৌলুশ ম্লান হয়ে গেছে। শরীরের ভাঙ্গন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চোখের নিচে কালি,কপালে বলি রেখা। শ্যামলদারও মাথায় বিশাল টাক হয়েছে আর সঙ্গে সযত্নে লালিত ভুঁড়ি।
ওদের কাছে পেয়ে অনেক দিন পরে আমার শরীরে যেন প্রাণের জোয়ারে ভেসে গেলো। ঋজু মাসিকে পেয়ে খুব খুশি। কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলো না। অনেক রাত অব্দি আড্ডা মেরে আমরা শুতে গেলাম। ভোররাতে অংশুমানের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেলো। ওর পেছন পেছন ড্রইং রুমে গিয়ে দেখি,বুলাদি গুটিসুটি মেরে সোফার ওপর শুয়ে আছে।
সকালে বুলাদিকে সোফায় এসে শোবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ফোঁস করে উঠলো,’রোজ রাতে তোর শ্যামলদা ডাকাত ধরতে যায়,ডাকাত ডাকাত,বাঁচাও বাঁচাও,বলে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। এমন মানুষের সঙ্গে শোওয়া যায় নাকি? ‘ একটু চমকে উঠলাম,যেই শ্যামলদা ছাড়া বুলাদির ঘুম হতো না,সে-ই এখন তার পাশে শুতে চায় না। সময়ের সাথে সম্পর্কের সমীকরণও কত বদলে যায়।
শ্যামলদার কাছে প্রতিরাতে কান্নাকাটি করে চিৎকার করার কারণটা জানতে পারলাম,চাকরি সূত্রে দাদা বেশ কিছুদিন চম্বলের ঢোলপুরে পোস্টেড্ ছিল। সেই সময় সেখানে ডাকাতের রাজত্ব। প্রতি রাতেই ডাকাত হানা দিতো এবং লুটমার করতো। এইভাবে আতঙ্কে এক বছর কাটানোর পরে দাদা সেই চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি জয়েন করে। চাকরি এবং স্থান পাল্টে গেলেও সেখানকার বিভীষিকা দাদার মন থেকে যায় নি। রোজ রাতে স্বপ্নে সেই ডাকাতরা এসে ভয় দেখাতে শুরু করে।
অনেক মনোবৈজ্ঞানিক,ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ হয় নি। প্রথম প্রথম বুলাদি সব সহ্য করে নিলেও এখন বিরক্ত হয়ে যায়। তাই একসঙ্গে শুতে চায় না। যে মানুষকে দেখবার জন্য,একবার কাছে পাবার জন্য আমরা এত আকুল হয়ে যাই,সেই মানুষকে কাছে পাবার পর যখন তার দুর্বলতা গুলো জানতে পারি,তখন কেন মেনে নিতে পারি না ?
দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে কি পারা যায়,বুলাদির বক্তব্য। সেদিন থেকে ঠিক হলো,বুলাদি,ঋজু আমার সঙ্গে শোবে আর অংশুমান বাইরের ঘরের ডিভানে। শ্যামলদা একা।
তিন দিন খুব হৈ হৈ করে কাটলো। ওদের এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দিতেই আমি আবার যন্ত্রমানব হয়ে গেলাম। বাড়ি ফেরার পথে সেকাল আর একালের সুতো মেলাতে গিয়ে দেখলাম কিছুই মেলাতে পারলাম না। জীবন বড্ডো রহস্যময় এবং অনিশ্চিত। কখন যে কি হবে কেউ জানে না।
**************************
অজন্তা প্রবাহিতা
লেখক পরিচিতিঃ আসামের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম। স্কুলিং আসামের তৈলনগরী ডিগবয়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে উচ্চশিক্ষার জন্য স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে পাড়ি। সেখান থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংকলনে লেখালেখি করেন। বন্যপ্রাণী ও পাখী সংরক্ষণের চেষ্টায় নিকটতম বন্ধুদের সাথে www.lensinwoods com নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। জীবনের লক্ষ্য,নিজের কাজের সাহায্যে যেন পৃথিবীর বুকে নিজের একটা আঁচড় কেটে যেতে পারেন।