মধ্য যান
মণি ফকির
এই নদীর নাম কি?
বাউল মতী।
অদ্ভুত নাম তো।
আপনার নাম কি?
বদরুদ্দীন হোসেন। লোকে বলে ভাদো মিঞা।
আচ্ছা এই নদীর দুই পাড়ে দুটো অনেক পুরনো রাজবাড়ি আছে না?
আছে তো জঙ্গলের মধ্যে। সে এক লম্বা ইতিহাস বোজলেন। এপারে রহমত খাঁ এর আলিশান মকান,ওপাড়ে নরসিং উপাধ্যায়দের দালান। দুই পক্ষের ছিল রেষারেষি। কেউ অবশ্য নদী পেরতো না। এদের ঈদের জশন এ মজলিস বসত তো ওদের কালী পূজোয় আতসবাজি। লাভ ছিল গাঁ এর মানুষ দের। পেট পুরে ভাল মন্দ জুটত। শুধু একটি বার….
রাগেশ্রীর আর্তনাদে কথা থামাতে হল।
এক লোল চর্ম বৃদ্ধা লাঠি হাতে রাগেশ্রীর সামনে দাঁড়িয়ে। উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। তার পর বিড় বিড় করে অস্ফুটে পিয়ারী পিয়ারী বলতে বলতে চলে গেল।
গাইড অশোক বলল: ভয় পাবেন না। বুড়ি কারোর ক্ষতি করেনা। ওকে সবাই চাঁদ পাগলী বলে।
চাঁদ পাগলী, চাঁদ, চন্দ্রা.…..রাগেশ্রীর খুব চেনা চেনা লাগছে। অস্ফুটে বলে উঠল: “চাঁদ চপলার সুখ নেইকো মনে/নাকের নোলক হারিয়ে গেল/হলুদ বনে বনে”
মা আপনি এ জানলেন কি করে? ভাদো মিঞা অবাক হয়ে শুধায়। এতো এতো….
– আপনি পিয়ারী?!
-আ: খুড়ো কি সব বকছ। পিয়ারী কবে মরে ভূ…
আমাদের চোখে প্রশ্ন দেখে অশোক বলল “স্যার ওপাড়ের রাজ বাড়ির ছোট মেয়ে হৈমন্তী আর এ পারের মেজ মেয়ে শবনম খুব ভালো বন্ধু ছিল। এক দিনে জন্ম। একজন গানে আরেকজন নাচে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। গানের ওস্তাদ মনসুর বাবা ওদের নাম দিয়েছিলেন আরি, পিয়ারী।
তখনো সন্ধ্যা নামেনি। নদী পাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে যেন কোমল নিষাদ এর বিষণ্নতা।
আমি মুগ্ধ নয়নে রাগেশ্রীকে দেখি। সদ্য অনুরাগ আবিষ্ট এক কিশোরের মন নিয়ে। এক নদী আকুলতা নিয়ে। আমাদের কাজ, জরাজীর্ণ, ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই না পাওয়া জমিদার বাড়ি গুলি মেরামত করে তাকে নবজীবন দান করা। ওর সাথে আমার আলাপ কলেজেই। আমাদের দশ জনের দল। ছয় জন পুরুষ, চার জন মেয়ে। গত পৌষে জঙ্গলে ট্রেক করতে এসে ইমান এর সন্ধান পায়। অশোক লোকাল ছেলে। প্রায় ভগ্নস্তূপ একটি দেড়শো বছর পুরনো বাড়িতে কাজ করতে করতে প্রথম যেদিন একটি দক্ষিণমুখী ঘরের সামনে হাজির হলাম, অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। সাধারণত এই ধরণের পোড়ো বাড়ি সম্পর্কে যে ধরণের ভৌতিক জনশ্রুতি থাকে তা এখানে ছিলনা। কিন্তু এখানে আসার মাঝে মাঝেই শ্রী কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বলে ওর জায়গাটা খুব চেনা মনে হয়। অনেক কিছু মনে আসে, কিন্তু অস্পষ্ট।
তপোময় বলল,“হ্যাঁ রে তোর যদি দামী পাথর টাথরের কথা মনে পড়ে, আমায় জানাস সবার আগে।” সবাই হেসে উঠলো।
সেদিন মাঘী পূর্ণিমা। আলো কমে এসেছে। কাজ শেষ করে ক্যাম্পে ফিরবো। শ্রী হঠাৎ বলে উঠল,“ইবাদত,তুমি আবার এসেছ। ওরা তোমায় মেরে ফেলবে। পালাও।”
প্রথমে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তার পর দেখি ও আমায় লক্ষ্য করে বলছে। আমি বাকরুদ্ধ কিন্তু আমার মুখ দিয়ে শুধু এটুকুই বেরল, “পিয়ারী, ওয়াক্ত বলবান হ্যায়। ইশক জওয়ান ঔর ইরাদে মজবুত। কলাওয়াতি কি কৈফিয়ত জারি হ্যায়। চলো কুছ হসরত পরওয়াজোঁ কি বাতে করে।”
রাগেশ্রী বিহ্বল হয়ে তুমি……তুমি….বলে ছুটে এসে আমার বুকে মুখ লুকালো।
তখন সবে মাঘী পূর্ণিমার সদ্য যুবতী চাঁদের আলো এসে পড়েছে এপাশের দেওয়ালে।।
*******************************
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত্য চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।