সম্পর্কের মূল্যায়ন
জলি চক্রবর্তী শীল
হাতদুটো প্রায় ছিঁড়ে যাবার জোগাড় | অফিসফেরতা একটু বাজারে ঢুকেছিল বিতস্তা | বাজারে আগুন দাম‚ সেই সঙ্গে সব্জির অপ্রতুলতা | এমনিতে সংসারে সপ্তাহে একদিনই বাজার আসে কিন্তু এবারে সেই সাপ্তাহিক বাজার বাড়ন্ত | অগত্যা বাজারে ঢুকতেই হল তাকে | মা বলতেন‚‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলে ধান ভানে আর তুই বাজারে ঢুকলে পুরো বেহিসেবীর মত বাজার করিস’ | একটা সময়ে মায়ের সংসারে জুতোসেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই তাকেই করতে হত | মা আর নেই ইহজগতে‚কিন্তু অভ্যাসটা রয়ে গেছে | দুহাতে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা ব্যাগে আনাজপত্র নিয়ে বেশ বিপাকে সে | এর মধ্যেই থেকে থেকেই নিয়মিত বিরতিতে কাঁধের ব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইলটা বেজে উঠছে | যেই কল করুক না কেন এই মুহূর্তে বিতস্তা কিছুতেই কলটা নিতে পারবে না | রিং বেজে বেজে থেমে যায় | বাড়ি ফিরে না হয় কল করে নেবে | আবার বেজে ওঠে মোবাইলটা | বাজুক‚যত ইচ্ছে বাজুক | এইসব সময়ে মোবাইল বাজলে‚ কল নিতে না পারলে খুব বিরক্তি আসে বিতস্তার | অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিনী কেন বোঝে না যে বিশেষ কোনো কারণে কলটা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিনী নিতে পারছে না | বেশ কয়েকবার বেজে বেজে থেমে যায় মোবাইলটা |
একটা রিক্সা পেলে ভালো হয় | বাজারের স্ট্যান্ডে একটাও রিক্সা নেই | অন্যদিন হলে সে হেঁটেই চলে যায়‚ কিন্তু আজ এত জিনিস নিয়ে সম্ভব হচ্ছে না | একটা পথচলতি রিক্সা এসে দাঁড়ায়‚ বিতস্তা উঠে যায় তাতে | গন্তব্যে পৌঁছে হাতের তালুতে ধরে রাখা ভাড়ার টাকাটা রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যায় সে | দারোয়ান ছেলেটা এগিয়ে এসে হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে নেয় | সময়ে-অসময়ে বিতস্তার কাছ থেকে ছেলেটা সাহায্য পায় | তারই কিছুটা সে এইভাবে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করে |
‘দিদি হাতের তালুদুটো তো লাল হয়ে গেছে | একটা কাপড়ের ব্যাগ সাথে রাখেন না কেন ? তাহলে এত কষ্ট হয় না আপনার |’
হাসে বিতস্তা| সত্যিই হাতদুটো বেশ টনটন করছে | মা থাকতে প্রতি সপ্তাহে বাজার করত‚একটা অভ্যাস হয়ে গেছিল | এখন তো তা নয় | দেবালয়ই সব বাজার-হাট করে | দেবালয় অফিসের কাজে দিনকয় বাইরে গেছে তাই নিজেকেই যেতে হল | ছেলেটা অবশ্য মন্দ বলেনি‚ একটা ব্যাগ সাথে রাখলে হয় | কিন্তু রাখা আর হয়ে ওঠে না | মাঝে মাঝে অফিসফফেরতা এটা ওটা নিজের মত করে কিনে আনতে পারে | আসলে এসব ব্যাপারে বরাবরের কুঁড়েমি | মা’ও বলতেন‚‘বাঁশি একটা কাপড়ের থলে ব্যাগে রাখিস |’ ‘লিফটে করে সাততলায় এসে নিজের ফ্ল্যাটের দরজাটা চাবি দিয়ে খুলে ঢুকে যায়‚পিছু পিছু ছেলেটি |
‘ওখানে রান্নাঘরের সামনে রাখো শিবেন ৷’
‘আমি জানি দিদি ৷’
শিবেন বাজারের ব্যাগগুলো নামিয়ে দিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে চলে যায় |
বিতস্তা সোজা টয়লেটে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা করে নিয়ে এসে ডাইনিং-এ এসে বসে | শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে| গরমটাও বিচ্ছিরি রকমের পড়েছে | সোফার ওপর পড়ে থাকা ব্যাগের ভিতর থেকে সেলফোনটা বার করে দেখতে যায় এতগুলো কল কার ? কিন্তু দেখার আগেই ফোনটা বেজে ওঠে | ফোনের স্কিনে দেখে অচেনা নম্বর | আজকাল বড্ড অচেনা নম্বর থেকে কল আসে | ‘হ্যালো’ বলতেই ঐদিক থেকে ভেসে আসে একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর |
‘বাঁশি !’
থমকে যায় বিতস্তা | এই নামে ডাকার মানুষগুলো তো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে এক এক করে | তবে এ কে ? গলা চিনতে পারে না বিতস্তা |
‘কে বলছেন ?”
‘চিনতে পারলি না ! তুই বাঁশি তো ? আমি পপি রে‚উফ্! ফোন করে করে আমার হাতব্যথা হয়ে গেল | যা হোক শেষ অবধি যে ধরলি এই অনেক ৷’ ওপ্রান্ত থেকে কলকল করে বলে যায় জনৈকা মহিলা |
স্মৃতির অতলে ডুব দেয় বিতস্তা | পপি ! সেই পপি‚বড়মাসীর মেয়ে পপি | যে পপির সঙ্গে কেটেছে তার শৈশব‚কৈশোর‚যৌবন সেই পপি ! এত দিন পর !
‘ও তুই | না চিনতে পারিনি | চেনার কথাও তো নয় তাই না। তা বল হঠাৎ এদ্দিন বাদে তুই ফোন করলি যে? নম্বর কার কাছ থেকে জোগাড় করলি?’
‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় | আছিস কেমন ?’
‘ভালো‚তুই ?’
‘ঐ চলে যাচ্ছে| আচ্ছা শোন না‚ আগামী গুরুপূর্ণিমাতে আমার বাড়ির গৃহপ্রবেশ | আসিস কিন্তু |’
‘ঠিকানাটা দে?’
‘ও মা তুই জানিস না‚আমি তো মা’র বাড়িটাকেই সারিয়ে নিয়েছি‚এখানে পাকাপাকিভাবে চলে আসব তাই একটা গৃহপ্রবেশ | আসিস কিন্তু দেবালয়কে নিয়ে |’
‘দেখছি ৷’
‘না‚ না তুই আসছিস | মা কিন্তু খুব করে বলেছে‚তোকে আসতেই হবে‚কতদিন কথা হয় না আমাদের | এখন রাখছি |’ কলটা কেটে যায় |
কললিস্ট চেক করে বিতস্তা | পরপর মিসডকল পপির নাম্বার থেকেই |
চাটা ঠান্ডা হয়ে গেছে | চায়ের কাপটা সরিয়ে রাখে | ঠিক তখনি আরও এক কাপ চা করে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে না | বিতস্তা অতীত হাতরায় | পপির সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বাবা যাবার পর | যদিও সেটাকে দেখা হওয়া বলে না | বড়মাসিকে দিতেই এসেছিল পপি বাবার শ্রাদ্ধে | অনেক অনুরোধ করেছিল সে‚খেয়ে যাবার জন্য | পপি খায়নি | খায়নি,তা নিয়ে কিছু বলার নেই‚ কিন্তু পপির উপস্থিতি ছিল বেশ অস্বস্তিকর | জরিপ করতে এসেছিলো তার সংসারের হাল-হকিকত| অহংকারে পরিপূর্ণা এক নারী | সেই দেখাটাকে বাদ দিলে বিগত কুড়ি বছর ধরে পপির সাথে কোন সম্পর্কই নেই | সম্পর্কের সূত্র বড়মাসি অবশ্য এখনো-ও আছে | অথচ একটা সময় ছিল যখন পপি আর বাঁশি ছিল হরিহর আত্মা | দুজনে মিলে ফুচকা খেতে যাওয়া‚বৃষ্টিতে ভেজা‚জলে নৌকা ভাসানো ছোটবেলার একাধিক স্মৃতি | পপির একাধিক প্রেমের সাক্ষীও বাঁশি | তারপর একদিন বিয়ে হয়ে গেল পপির | বিতস্তাও কলেজ পাশ করে ঢুকে পড়ল চাকরিতে | তারপর প্রেমে পড়ল দেবালয়ের | বিয়েতে পপি এসেছিল শুধু এটুকুই দেখতে যে তার মা, মানে বিতস্তার বড়মাসী তাকে কি কি উপহার দিল | প্রথম তো দেবালয়ের সাথে তার বিয়ে হোক সেটাই পপি চাইনি | সেটা যখন আর করতে পারেনি তখন বিয়েতে বাধ সাধতেও এসেছিল | বাসীবিয়ের দিন একটা চূড়ান্ত অশান্তি বাঁধতে বাঁধতে রয়ে যায় | কারণ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তখনও বিতস্তা পুরোটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি | তার বাবা-মা’ও ছিলেন বড়মাসির ওপর নির্ভরশীল | সম্পর্কটা সেদিনই তিক্ত হয়ে গেছিল | তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে‚যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে | কেউ কারও খোঁজ রাখেনি | অবশ্য খোঁজ না রাখলেও খবরাখবর ঠিকই পেত উভয় তরফে বড়মাসী মারফত |
বিতস্তা এখন সম্পুর্ণ স্বাবলম্বী অর্থনৈতিক দিক দিয়ে | দেবালয় একটি সরকারী অফিসের কর্মী | দুজনের সাজানো গোছানো সংসারে অভাবের ছায়া নেই | তাই কি এত বছর পর পপি যোগাযোগ করল ? সম্পর্ক কী তৈরী হয় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে? প্রশ্নটা মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে | মনে পড়ে পপির ছেলের অন্নপ্রাশনে আমন্ত্রণ ছিল না তাদের‚যেহেতু উপহার দিতে পারবে না তাই | বাবা-মা বেশ আপসেট হয়েছিলেন | বড়মাসি পরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেই অন্নপ্রাশনের খাবার‚বিতস্তার গলা দিয়ে সেই খাবার নামাতে কষ্ট হয়েছিল | কি আশ্চর্য! বাবা-মা কেউ আজ জীবিত নন‚তবু কষ্টের অনুভূতিটা একটুও কমে যায়নি |
অনেকদিন পর পপির সাথে কথা হল‚কিন্তু একটুও নষ্টালজিক সে হতে পারছে না‚অথচ একটা সময় ছিল যখন পপি নিজের ফ্রক‚মেক আপ দিয়ে তাকে সাজিয়ে দিত | যেখানে যেত একসাথে যেত | রেস্তোরাতে খেত| খরচ-খরচা ঐ করত | পপি ছিল তার প্রাণপ্রিয় | সেই পপির ফোনে সে আশ্চর্য হয়েছে ঠিকই কিন্তু একটুও খুশি হয়নি | কিন্তু একটুকরো ছোটবেলাকে ফিরে পেলে তো ভালো লাগা‚খুশি হওয়াটাই স্বাভাবিক | আসলে সম্পর্কের মধ্যে অদ্ভুত এক শীতলতা জেঁকে বসেছে | যে শীতলতা প্রতিপন্ন করতে চাইছে আর্থিক কৌলিন্যই নতুন করে সম্পর্কের সারশূন্য সোপান রচনা করছে | পপি জানে‚খবর রাখে‚ কি করে ধাপে ধাপে একটু একটু করে উত্তরণ ঘটেছে বিতস্তা আর দেবালয়ের | বড়মাসির কান বেয়ে সেই উত্তরণের খবর পৌঁছেছে পপির কাছে| তাই কি এই আমন্ত্রণ ! নিজের মনেই হাসি পায়‚ব্রতকথা বইয়ের সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়‚ যেখানে আর্থিক কৌলিন্য এসেছে বলেই ভাতৃজায়া‚ননদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানায় | অথচ একদিন এই ভাতৃবধুই ননদের অভাবের দিনে ননদের আঁচল থেকে ক্ষুদ-কুড়ো কেড়ে নিয়েছিল | ননদের কোন আকুলি-বিকুলিতেই তার হৃদয় গলেনি | ননদ সেই অপমান ভুলে যায়নি | সে তার পুত্রবধূদের দামী গহনায় ঢেকে নিয়ে যায়| ভাতৃবধু আদর-আপ্যায়ন করে যখন তাদের খেতে বসায়‚শাশুড়ির নির্দেশানুসারে পুত্রবধূরা অন্ন গহনাতে দিতে থাকে| ভাতৃজায়া অবাক হলে‚ননদ হেসে বলে‚‘তুমি তো ওদের নিমন্ত্রণ করনি‚ওদের গহনাকে‚অর্থকে করেছ ৷’ ঠিকই তো অর্থনৈতিক কৌলিন্যই সম্পর্কের মুল্যায়ন করে সেই সূদূর অতীত থেকে বর্তমান অবধি |
ফোনটা আবার বাজছে। দেবালয়ের ফোন। এটা-ওটা কথা হতে হতেই পপির আমন্ত্রণের কথা জানায় বিতস্তা।
‘যাবে তো ?’
‘ইচ্ছে নেই‚তবু যাব |’
‘আমাকে বাদ রেখ |’
‘তুমি তার মধ্যে ফিরছ কই যে যাবে ?’
‘হুম‚ ভালো কিছু একটা কিনে নিয়ে যেও |’
‘নেব |’
…………………..
একটু আগেই সত্যনারায়ণের পূজো শেষ হয়েছে | গৃহপ্রবেশে বেশ অনেক লোককেই বলেছে পপি | অধিকাংশ অচেনা| একটা বালুচরী শাড়ি অনলাইনে অর্ডার করে দিয়েছিল দেবালয় | ঠিক ভরসা করতে পারেনি বিতস্তার ওপর | বিতস্তা নিজে অবশ্য এত দামী উপহার আনত না | তার নিজেরই একটা বালুচরী শাড়ি নেই | সবটাতেই একটু একটু বেশি বেশি ব্যাপার দেবালয়ের | এই নিয়ে গত পরশু দেবালয়ের সাথে একপ্রস্থ বাদানুবাদ হয়েছে | সে যাই হোক শাড়িটা দেখে বেশ চমকে গেছে পপি | আশা করেনি হয়ত | তখন অবশ্য বেশ ভালো লাগছিল বিতস্তার |
হাতে হাতে প্রসাদ বিতরণ চলছে | সে নিজেকে একটু আলাদা করেই রেখেছে সবার থেকে | একে তো কাউকেই তেমন চেনে না‚যদিও পপি পরিচয় করিয়ে দিয়েছে | কিন্তু সে ঠিক উৎসাহ পায়নি অতিথিদের সঙ্গে মিশে যাবার | একে তো বরাবরই সে ভীষণ রকমের চুপচাপ | আর .এখন যেন একটু বেশিই| স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে কিন্তু ঠিক যেন স্বাভাবিক হতে পারছে না | আসলে সম্পর্কে সম্পর্কহীনতা বড় কষ্টকর | বড়মাসী এ ঘরে থাকলে তবু একটা ব্যাপার হত | কিন্তু বড়মাসী এখন আর হাঁটাচলা করতে পারে না | একটা ঘরেই খাটের ওপর শুয়ে-বসে থাকে | শরীর অকেজো ঠিকই কিন্তু মাথা সচল | সবাই যখন ব্যস্ত এদিকে ধীরে ধীরে বিতস্তা উঠে গিয়ে বড়মাসীর কাছে গিয়ে বসে | ঘরটায় ওষুধ‚ফিনাইল সবকিছু মিলিয়ে হাসপাতাল গন্ধ |
‘কি রে আমার কাছে চলে এলি যে ?’
‘এমনি মাসীমণি | ওখানে আমার তো কেউ চেনা নেই | তাই ভাবলাম তোমার কাছে এসে বসি ৷’
‘জামাইয়ের জন্য কিন্তু পপিকে খাবার দিয়ে দিতে বলিস |’
‘দেবালয় এখানে নেই |’
‘হ্যাঁ তখন তো বললি কিন্তু এত ভুলে যাই আজকাল| পপি কি বলল ?’
‘ও ব্যস্ত কাজে‚কি আবার বলবে |’
‘এরপর ওর ছেলের বিয়ে দেবে বুঝলি | তখন কিন্তু বরকে নিয়ে আসিস |’
‘মাসীমণি ! একটা কথা বলব‚তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ‚আমি না ঠিক স্বাভাবিক হতে পারছি না | এতবছর পর পপি আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে‚খুব ভালো ব্যাপার কিন্তু বলতো আমি যদি আগের মতই থাকতাম‚দেবালয় যদি ভালো চাকরি না করত‚তাহলে কি পপি আজকে আমায় ডাকত ?’
একটু চুপ করে থাকেন বর্ষীয়ান ভদ্রমহিলা |
‘দেবালয় এখানে থাকলেও আসত না মাসীমণি | বাসী বিয়ের দিনের কথা তুমি ভুলে যাওনি নিশ্চয় | দেবালয়ও ভুলে যায়নি | পপি মনে করে এসেছে তুমি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছ | দিয়েছ মাসিমণি‚সেটা আমি তো অস্বীকার করি না | আজ তুমি ছিলে বলে আমি লেখাপড়াটা শিখতে পেরেছি‚নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি | কিন্তু দেওয়া অর্থে ও যে ভাবছে তুমি আমায় গহনা‚টাকাপয়সা দিয়েছো সেটা তো ঠিক নয় না | তারওপর আজ তুমি আছো বলে ওকে দিয়ে তুমিই আমাকে ডাকিয়েছ | কারণ তোমার মনে হয়েছে আজ ডাকলে আমি শুধু হাতে আসব না | কিন্তু সেদিন তো ডাকোনি‚যেদিন আমার বাবা-মা না খেয়ে বসেছিলো তোমার মেয়ের বউভাতে যাবে বলে | কিছু দিতে পারবে না‚তাদের ক্ষমতা নেই তাই তাদের না নিয়েই তোমার গাড়ি ছেড়ে দিলে | এসব ভাবলে আমার যে বড্ড কষ্ট হয় | আজ তারা কেউ নেই‚আমি আছি সেইসব সত্যের সাক্ষী হয়ে| তাই মাসীমণি‚তুমি যতদিন আছ তোমার এই বাড়িতে আমি আসব‚তোমার কাছে অমি কৃতজ্ঞ কিন্তু তোমার মেয়ের কোন অনুষ্ঠানে আমায় ডেকো না‚আমার এই কথাটা রাখো |’
চুপ করে থাকে বিতস্তার মাসীমণি| কিন্তু বলে চলে বিতস্তা‚
‘সত্য যে বড় রূঢ় মাসীমণি | সম্পর্ক যেখানে অর্থে হয় সেখানে বিতস্তারা থাকে না‚থাকা উচিত নয় | আমি আজ আর কিছু খেতে পারব না মাসীমণি | পপি খেয়ালও করবে না আমি খেলাম কি খেলাম না | ওর বৈভব দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল আর আমার কৌলিন্য দেখানোর ইচ্ছাও ছিল | দুটো উদ্দেশ্যই পূরণ হয়েছে | এবার আমি যাই |’ বিতস্তা উঠে পড়ে| দ্রুত নেমে আসে সিঁড়ি দিয়ে | চোখ ভরে আসে জলে‚ভিতরের কষ্টগুলো একটু একটু করে দ্রবীভূত হয়ে যায় |
********************************
জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতি
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।
সম্পর্কে সম্পর্কহীনতা বড় কষ্টকর- কতবড় সত্যি কথা।
ভালো লাগল জীবনের মধুর প্রতিশোধ।