অরোরার সন্ধানে
ভাস্বতী সাধুখাঁ (বসু)
বছর তিনেক আগে এপ্রিল মাসের এক রবিবার। স্টকহোমের কাজ সেরে চলেছি নরওয়ের দিকে। নরওয়ে মানে আমার কাছে এক অদৃশ্য হাতছানি–নিশীথ সূর্যের দেশ আর অরোরা বোরিয়ালিস। এর আগে একবার সপরিবারে নরওয়ের রাজধানী অসলো ঘুরে এলেও অন্যান্য ছোট শহরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এসব ভাবতে ভাবতে ‘অসলো‘ স্টেশন থেকে ছোট একটি ট্রেনে চড়ে বসলাম লিলেহ্যামারের উদ্দেশ্যে। শহর ছাড়িয়ে দু‘পাশে নৈসর্গিক দৃশ্য, বরফে ঢাকা উপত্যকা, তার মধ্যে দিয়ে দ্রুতগতিতে পোলার এক্সপ্রেস এর মত ছুটে চলেছে আমাদের ট্রেন। এদেশের সবচেয়ে বড় লেক ‘যসা‘(Mjosa), যা সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর তুমুল বৃষ্টির মধ্যে একটি ফাঁকা স্টেশনে ট্রেন আমাকে একা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। হোটেল বেশ কাছে, কিন্তু এত বৃষ্টিতে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা সম্ভব নয়, তাই বৃষ্টি থামতে বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সি ডেকে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। হোটেলে ডিনারে দেখলাম স্হানীয় খাবারের আয়োজন অনেক বেশি, কন্টিনেন্টাল রয়েছে অল্প। একজন ভারতীয় এসেছেন শুনে এক পাকিস্তানী শেফ এসে আলাপ করলেন, কথা দিলেন এক একদিন ওনার ডিউটি থাকলে আমাকে আমার পছন্দ মতো খাবার বানিয়ে দেবেন। হোটেলে বিকেলবেলার মেনুতে থাকে ওয়াফেল। অনেকগুলি ওয়াফেল মেকার রাখা আছে, আর বোর্ডাররা নিজেরাই এসে নিজেদের মত বানিয়ে নিতে পারেন। ভারি মজার ব্যাপার তাই না?
পরদিন ভোরে হোটেলের জানালা দিয়ে অপূর্ব দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। সকালের রোদে স্টেশনের ওপারের লেক আর তার পিছনে পাহাড়ে ঘেরা প্রায় বরফে ঢাকা গ্রামগুলি চিকচিক করছে। এখানে সকালে সাতটা–সাড়ে সাতটার মধ্যেই সকলে কর্মক্ষেত্রে চলে আসেন শুনে এসেছি, তাই আমিও গেলাম। সকাল ন‘টায় সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট খান। সকলের জন্য একটি করে ট্রে রাখা থাকে। ক্যান্টিনে যে যার নিজের মতো বানিয়ে নেন–সসেজ, টোস্ট, পরিজ ও কফি নিয়ে সকলে একসঙ্গে গল্প করে খাওয়া দাওয়া করেন। কদিনের মধ্যে আমিও এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। বেলার দিকে কোন কোন মহিলা সহকর্মীরা কোথায় যেন যান। ঘন্টাখানেক পরে ফেরত আসেন। পরে জানলাম ওরা বাচ্চাদের স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে এসে দুপুরের খাওয়া সেরে অফিসে চলে আসেন। এভাবেই তারা সংসার ও বহির্জগতের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। বেলা তিনটে–চারটের মধ্যে এখানে অফিস ফাঁকা। এবার ওদের পরিবারকে সময় দেবার ও শরীরচর্চা করে কাটাবার অবকাশ। হোটেল থেকে অফিসে যাবার রাস্তা ছবির মতো সুন্দর। কোথাও পাহাড় থেকে বরফ গলা জলে রাস্তা পিছল। কোথাও আবার অল্প চড়াই–উৎরাই ভেঙে চলতে হয়।
ছোট ছোট কাঠের বাড়ির পাশ দিয়ে রিনরিন করে বেজে চলেছে ছোট ছোট ঝরনা। এসব দৃশ্য মনের ক্যামেরায় বন্দী করতে পেরে আমি ধন্য। পিছনে পাহাড়ের মাথায় তাকালেই দেখতাম বরফের মধ্যে দিয়ে একটি খুব খাড়া রোলার কোস্টার নেমে এসেছে; সম্ভবত এটি একটি আ্যমিউজমেন্ট পার্ক। এই শহরে ১৯৯৪ সালে একবার শীতকালীন অলিম্পিকের আসর বসেছিল। এদেশের মানুষ খুব সাহসী ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। আমাকেও সেই দলে নিতে আমার তিন মহিলা সহকর্মী কিছুদিন গোপনে অনেক আলোচনা করলেন। আমার সুইডিশ ভাষার স্বল্প জ্ঞান আর তাদের নরউইগান উপভাষা মেশানো সংলাপ কিছুই বোধগম্য হলো না আমার। বোঝা গেল তারা আমাকে একটি বড়সড় সারপ্রাইজ দিতে চলেছেন।
একদিন অফিস থেকে এদের দলের একজন বেশ তাড়াতাড়ি কোথায় যেন চলে গেলেন সন্ধেবেলা পরিকল্পনামাফিক বাকি দুজন একটি হুড খোলা গাড়ি ও প্রয়োজনীয় জামাকাপড় আর ভারী জুতো নিয়ে আমাকে হোটেল থেকে নিতে এলেন। আমার বহু দিনের ইচ্ছে মেরুজ্যোতি দেখার, জানতে পেরে তারা সেই স্বপ্ন সফল করেই ছাড়বেন। তাই একজন আগেই অন্য একটি পাহাড়ের মাথায় যেখানে আজকে আবহাওয়া দপ্তরের কথামতো বেশ ভালোরকম অরোরা দেখা যেতে পারে, সেই জায়গায় পৌঁছে গেছেন। ভাগ্যক্রমে সেই পাহাড়ের মাথায় তার পিতৃপুরুষের একটি ‘সামার হাউজ‘ আছে, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে তিনি সেখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার স্বপ্নের ‘অরোরা‘, সেই ছোটবেলায় বইতে পড়া মেরুজ্যোতি হলো মেরু অঞ্চলের আকাশে দৃশ্যমান খুব মনোরম আলোকচ্ছটা। এই আলো বায়ুমণ্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন এর সাথে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জ কণাসমূহের সংঘর্ষে তৈরি হয়। সংঘর্ষের কারণে যে অভ্যন্তরীণ শক্তি জমা হয় তাই পরে আলোক শক্তি হিসেবে বিকরিত হয়ে মেরুজ্যোতি তৈরি করে। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রায় রাত সাড়ে নটার সময় সেই পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। ততক্ষনে অন্ধকার নেমে এসেছে। শুধু গাড়ির হেডলাইটে দেখি বরফ আর বরফ। তার মাঝে কোথায় রাস্তা? আমার দুই সহকর্মী জানেন; তারা কিন্তু অম্লানবদনে গল্প করতে করতে একজন ড্রাইভ আর একজন রাস্তা দেখাবার কাজ করছেন। এরকমই একটি বরফ ঢাকা জায়গার মধ্যে গাড়ি এসে থামল। এবার নামতে হবে। আমিতো গাড়ির ভেতর বসেই আছি। নর্দান লাইট দেখবার সমস্ত ইচ্ছা তখন চলে গেছে। শুনলাম ওখান থেকে ওই হাঁটু সমান বরফ ভেঙে একটু দূরে কাঠের বাড়িতে পৌঁছতে হবে। ওরা তো তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন ক্যামেরা স্ট্যান্ড বসাতে আর আমি বরফে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে পিছনে পিছনে চললাম।
অন্ধকারে যেতে যেতে মনে হলো আর কোনদিন কলকাতায় ফেরা হবেনা, বাচ্চাদের আর দেখতে পাবো না। এরই মধ্যে আমার অন্তিম দৃশ্য এবার অভিনীত হবার শুধু অপেক্ষা।
অনেক কষ্টে সে বাড়ির কাছে এলাম। ভেতরে ইলেকট্রিসিটি নেই। চার্চের মোমবাতির মত বড় বড় মোমবাতি জ্বলছে। ওদের দেওয়া সেই বিশালাকার কোট ও জুতো যা গাড়িতে ওঠার আগে পরেছিলাম, সেসব ধড়াচূড়ো খুলে যখন গিয়ে বসলাম তখন পারিবারিক অ্যালবাম দেখা প্রায় শেষ। এই নাকি সেই বাড়ি যেখানে আমার সহকর্মী এমা (নাম পরিবর্তিত) ছোটবেলায় গরমের ছুটি কাটাতে আসত। গরমকালে কিন্তু এ পাহাড়ের ছবি আলাদা। দূরে দূরে অনেকগুলি বাড়ি আর একটি কফি শপ। এমার হাতের কফি খেলাম। সংগে আরও প্রায় চার/ পাঁচ রকমের চিজ ও ক্র্যাকার। এবার সময় হয়ে এসেছে। সে মাহেন্দ্রক্ষণ নিকটবর্তী। মিনিট পনেরো কি কুড়ি স্থায়ী হবে আবহাওয়া দপ্তরের কথায়। আমি কাকুতি–মিনতি করে উঠলাম-“আমি জানলা দিয়ে দেখতে চাই আর কিছুতেই বাইরে যাব না।” ওরা তো সবাই হেসেই খুন। “সে কি কথা? একেবারে তো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া হবে, আলোর ছটা দেখে গল্প করতে করতে যে যার বাড়ি। কাল যে আবার ভোরে অফিস। সেখানে তো কোন পরিবর্তন হবার নেই।” আমি খুব মুষড়ে পড়লাম। পরে মনে হলো আমারই জন্য এত আয়োজন। শুধু এক ভারতীয় বন্ধুর মনের ইচ্ছা পূরণ করতে সকলে পরিবার ছেড়ে এতদূর আমার সঙ্গে এসেছেন। আমিও জানি, আর তারাও জানেন যে মেরুজ্যোতি সবচেয়ে ভালো দেখা যায় এই শহর থেকে অনেকটা দূরে ট্রমসো বা আর্কটিক সার্কেলের দ্বীপে। সেখানে অনেক নামিদামি টু্র কোম্পানি শীতকালে তিন–চার মাস ধরে পোলার বিয়ারের হাতছানি বাঁচিয়ে নর্দান লাইট দেখিয়ে থাকেন। সারা পৃথিবীর টুরিস্ট সেখানে ভিড় করেন। এবারে আমার স্বল্প সময়সীমায় সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই এরা তিনজনেই আন্তরিক চেষ্টা করেছেন যাতে আমার থাকাকালীন সময়ে যেদিন এই শহর থেকে সবচেয়ে ভাল ভাবে অরোরা দেখার সম্ভবনা আছে, সেদিন আমাকে সব থেকে ভালো জায়গা থেকে দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। সত্যিই এই ভালোবাসা অবর্ণনীয়। আজ এঁরা আমাদের দেশে গেলে আমি কি এমন ভাবে পরিবার,সন্তান ছেড়ে মাঝ রাতে আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে আমার দেশের কোন দর্শনীয় স্থান দেখাতে নিয়ে যেতে পারতাম?
আমরা রওনা হলাম পাহাড়ের আরও একটু উপরে ওঠার জন্য। সেখানে গাড়ি থেকে নেমে কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই অপেক্ষা আর ঘনঘন ঘড়ি দেখা। আমাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে কমবয়সী তিনি আসলে পোল্যান্ডের বাসিন্দা; কর্মসূত্রে এদেশে। তার মধ্যে একটু ছটফটানি ভাব দেখে বাকি দুজনে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। নিস্তব্ধ, নীরব প্রকৃতির কোলে অন্ধকারে, মধ্য রাতের আকাশ আর দিগন্তরেখার মিলনস্থলে অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য মনঃসংযোগের দরকার হয়। হঠাৎ জহুরী চোখে ধরা পড়ল অল্প অল্প লাল আলো। সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ গেল পাল্টে। স্থানীয় নানা নিয়ম–কানুনের প্রয়োগ যাকে আমরা বাংলা ভাষায় বলি কুসংস্কার, সেখানে তখন বিজ্ঞান–কম্পিউটার–টেকনোলজি আর প্রকৃতির খেলা, সব মিলেমিশে একাকার। শুধু কিভাবে সব শক্তি প্রয়োগ করে বহু আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখা যাবে তার চেষ্টা। আমরা যে যার মত ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। আমিও কখন ভয়–ডর ভুলে “ঐতো ঐতো” করে বরফের মধ্যে ছুটাছুটি করছি জানি না। মাঝে মাঝে লাল, কখনো খুব হালকা নীল, নীলাভ সবুজ মেশানো রংয়ের খেলা দিগন্তে। হঠাৎ কি যেন পাশ থেকে চলে গেল; শুনলাম ছোট ছোট জন্তু–জানোয়ারের অভাব নেই পাহাড়ে। আলোর ছটা একবার দেখা যায় তো আবার পাঁচ মিনিটের বেশি অপেক্ষা। আবার হয়তো অন্য দিক দিয়ে একটু ঝিলিক। আস্তে আস্তে আলোর তীব্রতা কমে এলে আমরা রওনা দিলাম। এবার দুটো গাড়ি একসাথে একে অপরকে রক্ষা করতে করতে হেডলাইট জ্বালিয়ে বরফের মধ্যে দিয়ে পাহাড় থেকে নামছে। কি বলে ওদের ধন্যবাদ জানাবো জানিনা। আরো বেশি তীব্র আলোর খেলা দেখার জন্য নেমন্তন্ন পেলাম। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম আমার বন্ধু সৌভাগ্যের কথা–কর্মক্ষেত্র, দেশ, ভাষার ঊর্ধ্বে উঠে কয়েকজন নিজেদের দেশের গৌরব এর মর্যাদা রাখতে গিয়ে এক স্বল্প পরিচিত ভ্রমণপিপাসুর সাথে অবলীলায় কিছু সময় কাটিয়ে দিলেন। আসবার সময় তারা আগামী সপ্তাহে কিভাবে আমাকে কুকুরে টানা স্লেজ গাড়ি চড়াবেন, তার প্ল্যান করতে করতে এলেন। দুর্ভাগ্যবশত সেটি আর এ যাত্রায় হয়ে ওঠেনি।
আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তারা ফিরে গেলেন,তখন প্রায় রাত আড়াইটে। বাকি রাত কেমন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। পরদিন সকালে সত্যিসত্যিই সাড়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম কর্মক্ষেত্রে। আমাকে দেখে সকলে অবাক। অভিযান সুসম্পন্ন করে আমি যে কাজের ক্ষেত্রেও অন্যদিনের মত সময়ানুবর্তিতা বজায় রেখেছি এতে উপস্থিত সকলের চোখে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্মিতভাব দেখলাম।
বহুদিন মনের ভেতরে সযত্নে লালিত এই অনন্য অভিজ্ঞতা “কুলায় ফেরার” মাধ্যমে আজ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরে বড় ভালো লাগলো।
*********************************************************
ভাস্বতী সাধুখাঁ (বসু) পরিচিতিঃ
লেখিকার পাঠ্যবিষয় ইলেকট্রনিক্স, পেশায় পূর্বতন আইটি প্রফেশনাল, বর্তমানে একটি এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট এর কর্ণধার। সংগীতে ও ভ্রমণে বিশেষভাবে আগ্রহী। কিছু ম্যাগাজিনে, ট্রিপ এ্যাডভাইজারে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভ্রমণ বিভাগে লেখেন। আর নিজস্ব উদ্যোগ ‘কল্পনার‘ মাধ্যমে শিশু ও মহিলাদের হোমে সোশ্যাল সার্ভিসে নিযুক্ত।