Shadow

ইউরোপ ভ্রমণ (চতুর্থ পর্ব) – বিজিত কুমার রায়

ভাঙা চেয়ারের প্রতিমূর্তি – জাতিসংঘ অফিসের মূল ফটকের সামনে।   PC:Wikipedia

ইউরোপ ভ্রমণ (চতুর্থ পর্ব)

বিজিত কুমার রায়

ইউরোপ ভ্রমণ – ফরাসি আল্পস এ দুই রাত্রি।
আরামের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল খুব সকালে। তারপর তৈরি হয়ে ব্যাগ পত্র নীচে রেখে রেস্টুরেন্টে। সেখানে বেশ জম্পেশ করে ফল, রকমারি ক্রয়েশে আর স্প্যানিশ অমলেটের ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে।
সকাল ৭টায় ছাড়লো বাস কারণ পাড়ি দেবো ৭ ঘণ্টার রাস্তা। অবশ্য রাস্তা ছিল অনবদ্য সুন্দর দৃশ্যে ভরা সবুজের সমাহার। এই প্যারিস থেকে জিনিভা আসার সময় আমাদের মধ্যে তিনটি ফেমিলি ওরা ইউরোপের বিখ্যাত ট্রেন যাত্রা (ডিডি এলজে খ্যাত) উপভোগ করবে বলে ট্রেনে রওয়ানা হলো।
দুপুর ১২টার সময়ে রাস্তাতে একটি গ্যাস স্টেশনে থেমে সঙ্গে করে নেওয়া প্যাকড লাঞ্চ খাওয়া হলো। তারপর দুপুর ২.৩০ নাগাদ জিনিভা সুইজারল্যান্ডে। সেখানে ইউনাইটেড নেশনসের হেড কোয়াটর্স। এছাড়া আছে আইএলও এর অফিস। এখানে ওই বিল্ডিংয়ের সামনে একটি বিশাল চেয়ারের প্রতিমূর্তি রাখা আছে যার একটি পা নেই। শুনলাম বিশ্বযুদ্ধে মাইন্স এ আহত দের ও বিশ্বশান্তির মেমোরিয়াল হিসাবে এটি তৈরি।
এই চত্বরে অনেকে ঘোরাঘুরি করে, ছবি তুলি। দেখছি ভাঙা চেয়ারের নিচে ভূমিতে খোদাই করে লেখা আছে সশস্ত্র সহিংসতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ:এই ভাঙা চেয়ার হল ভঙ্কুরতা ও সামর্থ্য, অনিশ্চয়তা ও স্থিতিশীলতা, নিষ্ঠুরতা ও মর্যাদার প্রতীক স্বরূপ। জাতিসংঘ অফিসের সামনে কেন এই বিশাল ভাঙা চেয়ার, এর উদ্দেশ্য কী? এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি আজকের এই লেখায়। যা পাঠকদের জানাতে চাই। সুইস শিল্পী ডেনিয়েল বারসেট ও মিস্ত্রি লুইসের তৈরি কাঠের স্মারক ভাস্কর্য হল এই ভাঙা চেয়ার। একে ২১ শতকের সবচেয়ে শিল্প প্রতীকী কাজ বলে মনে করা হয়। বর্তমানে এটি জেনিভার ল্যান্ডমার্ক হিসেবেও গণ্য করা হয়। এই ভাস্কর্যটি তৈরি করতে সাড়ে পাঁচ টন কাঠ লেগেছে। এর উচ্চতা বারো মিটার। মূলত: ভূমি মাইন ও গুচ্ছ বোমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক প্রতীক স্বরূপ এই ভাঙ্গা চেয়ার যা জিনিভায় ভ্রমণকারী রাজনীতিবিদ ও অন্যদের স্মরণ করিয়ে দেয় এই প্রতিবাদের কথা। অর্থাৎ ভাঙা চেয়ারের বার্তা খুব সহজ ও সাধারণ, ভূমি মাইন ও গুচ্ছ বোমার শিকার বেসামরিক লোকদের স্মরণ করা, ভূমি মাইন নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে নিজ নিজ সরকারকে চাপ দেয়া।
এই ভাঙা চেয়ারের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। সুইস এনজিও প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক পল ভারমূলের মূল প্রকল্প হল এই ভাঙ্গা চেয়ার। অক্টোবর ১৯৯৬ সালে তিনি শিল্পী ডেনিয়েলকে বিশাল আকৃতির এক পা দোমড়ানো-মোচড়ানো ভাঙা চেয়ার নির্মাণের আদেশ দেন যা জিনিভার জাতিসংঘ অফিসের মূল ফটকের সামনে স্থাপন করা হবে। উদ্দেশ্য হল ভূমি মাইনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং ভূমি মাইন বিষয়ে ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিতব্য অটোয়া চুক্তিতে অধিক সংখ্যক দেশের সম্মতি লাভ করা। সিদ্ধান্তমতো হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯৭ সালের ১৮ আগস্ট জিনিভায় জাতিসংঘ অফিসের প্রবেশ পথের বিপরীতে ভাঙ্গা চেয়ারের ভাস্কর্যটি স্থাপন করে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অটোয়া চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য এই স্মারকটি স্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য, ৪০টি দেশের অনুমোদনের মাধ্যমে ১ মার্চ ১৯৯৯ সালে এই অটোয়া চুক্তি আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে কার্যকর হয়। এরপর বহু দেশ কর্তৃক এই চুক্তি অনুমোদন না করা এবং অধিক জনসমর্থনের জন্য এই স্বাক্ষরটি ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রদর্শন করা হয়। তবে ২০০৫ সালের শেষে জাতিসংঘ ভবনের ব্যাপক আকারে সংস্কার করার সময় স্মারকটি সাময়িকভাবে সরিয়ে ফেলা হয় এবং সংস্কার কাজ শেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে একই স্থানে তা পুনঃস্থাপন করা হয়।
১৯৯৭ সালে প্রথম জাতিসমূহকে ভূমি মাইন নিষিদ্ধ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, পরে ২০০৭ সালে গুচ্ছ বোমা নিষিদ্ধের লক্ষ্য নিয়ে ভাঙা চেয়ার স্থাপন করা হলেও এটি বর্তমানে ভূমি মাইন ও গুচ্ছ বোমায় বেসামরিক লোকজনের হাত-পা নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিধিবদ্ধ এক প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সব বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক লোকদের রক্ষা করা ও সাহায্য করার জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি দাবির কথা স্মরণ করে দেয় এই ভাঙ্গা চেয়ার।
ঘোরা হলো দারুন সুন্দর জেনিভা লেকের চারপাশে। নীল জলের মাঝে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে বিশাল ফোয়ারা।
দেখলাম ফুলের তৈরি ঘড়ি।
এরপর রওয়ানা হয়ে ১.৩০ ঘন্টার মধ্যে পৌছালাম ফ্রেঞ্চ আল্পসের সামনিক্সে। তবে ৩০ মিনিট নষ্ট হলো একটা ছোট একসিডেন্টে। পাহাড়ে ওঠার সময় বাসটি ঘষা খেলো পাশের লোহার গার্ড রেলে। ওদের নিয়ম অনুযায়ী বাসটিকে চেক করাতে হবে গেরাজে ও দেখতে হবে সব ঠিক আছে কিনা। জিপিএস দিয়ে বাস নাগাড়ে ট্র্যাক করা থাকে ওদের হেড অফিসে। ১৫ মিনিটের মধ্যে অন্য বাস এসে গেলো আর চটপট আমরা ও মালপত্র চলে গেল নতুন বাসে।
পাহাড়ি রাস্তা ধরে উঠে আমরা এলাম ফ্রেঞ্চ আল্পসের সামনিক্সে। হোটেল আল্পীনা। সামনেই ঝকঝকে মঁ ব্লা পাহাড়ের বরফের শৃঙ্গ আর হিমবাহ।নয়নাভিরাম দৃশ্য। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে বরফ গলা জলের ঝর্ণা।
রুমে না গিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সামনে ঘুরতে। মনে অফুরন্ত আনন্দ ওই সুন্দর বরফের পাহাড় দেখে।
আল্পস্‌ পর্বতমালা (ইংরেজি Alps অ্যাল্প্‌স্‌, মূলতঃ লাতিন Alpes আল্পেস্‌ থেকে) ইউরোপে অবস্থিত পর্বতমালাদের অন্যতম। আল্পস্‌ পর্বতমালা পূর্বে অস্ট্রিয়া ও স্লোভেনিয়া এবং পশ্চিমে ইতালি, সুইজারল্যান্ড, লিশ্টেনশ্টাইন হয়ে জার্মানি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত। আল্পস্‌ পর্বতমালার সবচেয়ে উচ্চতম পর্বত ইতালি-ফ্রান্স সীমান্তে অবস্থিত      ম ব্লঁ, যার উচ্চতা ৪৮০৮ মিটার।
আল্পস পর্বতমালার অংশ মঁ ব্লঁ পর্বতটি ইতালির আওস্তা উপত্যকা এবং ফ্রান্সের ওত-সাভোয়া এলাকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। পর্বতশীর্ষটি ঠিক কোন্‌ দেশের চৌহদ্দিতে অবস্থিত তা নিয়ে এখনো বাদানুবাদ চলছে। ফ্রান্স ও ইতালি উভয়েই এটিকে নিজ-নিজ দেশের অন্তর্গত বলে দাবি করে। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স ও সার্দিনিয়া রাজ্যের মধ্যে এক আলোচনায় পর্বতটির শীর্ষবিন্দুতে দেশ দুইটির সীমানা নির্ধারিত হয়।
মঁ ব্লঁ’র কাছে অবস্থিত সবচেয়ে পরিচিত দুইটি শহর হচ্ছে ইতালির আওস্তা উপত্যকার কুরমাইয়োর এবং ফ্রান্সের ওত-সাভোয়া এলাকার শামোনিখ। শামোনিখেই প্রথম শীতকালীন অলিম্পিকের আসর বসে। মঁ ব্লঁ-র তলদেশ দিয়ে ১৯৫৭ ও ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই দুই শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মঁ ব্লঁ টানেল খোঁড়া হয়।
মঁ ব্লঁ ও তার আশেপাশের পর্বতগুলি পর্বতারোহণ এবং স্কি করার এলাকা হিসেবে জনপ্রিয়। এছাড়াও সুইজারল্যান্ড ভ্রমণকারীদের জন্য মঁ ব্লঁ একটি অপরিহার্য পর্যটন কেন্দ্র।
ক্যাসিনো, চকোলেট ফেক্টরী ঘোরা হলো। দেশের বন্ধু ও আত্মীয়দের জন্য প্রচুর টবলারণ বার কেনা হলো ওয়ান ডলার শপ। যা লেবে তাই ছ আনার মতো ওয়ান ডলার শপ। হোটেলে ফিরে রুফ টপ রেস্টুরেন্টে পাহাড়ের সন্ধ্যার দৃশ্য দেখতে দেখতে গরম গরম ডিনার। ঘরে ফিরে গরম কম্বলের তলায়। কালকে আছে শুনলাম সামনের পাহাড়ের ওপরে ওঠা। না হেঁটে নয়। অবশ্যই কেবল কারে। যাই হোক আপাতত আরামের ঘুম।
নিয়ম মত সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। বারান্দার দিকের জানলার পর্দা সরাতেই চোখটা যেন ভরে গেল বাইরের অপূর্ব দৃশ্য দেখে। সকালের রোদে ঝলমল করছে মঁ ব্লা পাহাড় আর হিমবাহ আর সাথে পাহাড়ি ঝর্ণার স্রোত যেটা হোটেলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এই সময় গুলোতেই মনে হয় ওপরে কেউ একজন আছেন যিনি এই অপরূপ দৃশ্যের রূপকার। আজকের সকালের চা বাথরুমের গরম জল দিয়ে বানাতে হলো কারন রুমের কেটলিটা কাজ করছে না। তবে ওখানে সব জলই পানীয়। স্নান সেরে অভ্যাসমত পেট ভরে নাস্তা করা হলো।
বেরিয়ে অল্প দূরে আমরা পৌঁছালাম একটি কেবল কার রাইডের শুরুতে যার নাম আউইগিল ডা মিডি। এটা সামনের পাহাড়ের ১২০০০ ফুট উঁচুতে।
প্রথম রাইডটা নিয়ে গেল মাঝারি হাইটে। এখান থেকে একটা ৩৬০ °ভিউ পাওয়া যায়। তারপরের রাইড নিয়ে গেল একদম ওপরে। সময় লাগলো ৩০ মিনিট মতো। কেপসুলের বাইরে বেরিয়ে খোলা ছাদে এসে এক্কেবারে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কারন নীচের ২২℃ থেকে একেবারে (-)২℃।  ঠান্ডায় আর উচ্চতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ১৫ মিনিট সময় এক অপূর্ব আনন্দে কেটে গেলো। আর হঠাৎ চারদিক ঢেকে গেল মেঘে। অনেক ছবি তোলা হয়েছিল ভাগ্গিস আগেই। আবার সেই রাইড পাল্টিয়ে নীচে নামা হলো।
নীচে নেমে আরামে হেঁটে হোটেলে। নিয়ম মাফিক ভারতীয় স্টাইলের খাবার।
**********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।

1 Comment

  • Sukrit Basu

    খুব ভাল লেখা। ভাঙ্গা চেয়ারের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য জানা গেল।সুকৃৎ বসু

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!