ইউরোপ ভ্রমণ (তৃতীয় পর্ব)
বিজিত কুমার রায়
ইউরোপ ভ্রমণ, ফ্রান্স (প্যারিস) দুই দিন।
সকাল সকাল উঠে চেক আউটের জন্য তৈরি। ব্রেকফাস্ট খেয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করা হলো সামনের রাস্তাতে। তারপর প্যারিস রওয়ানা ৪ ঘন্টার রাস্তা। তবে এখানে বাস জার্নি গায়ে লাগেনা কারণ সুন্দর আরামদায়ক মার্সিডিজ বাস আর রাস্তাও মাখনের মতো। আকাশের রং ঝকঝকে নীল। দেখলেই মনে আনন্দ আসে।
দুপুর বারোটাতে এক গ্যাস স্টেশনে বাস থামল ডিজেল নেয়ার জন্য ও আমাদের পেটে কিছু দেওয়ার জন্য। স্যান্ডউইচ ফ্রিটার্টস ইত্যাদি খাওয়া হলো। এরপর একটা নাগাদ প্যারিসের কাছে এলো। আমরা ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে কালকের টাইট শিডিউল থেকে লুভর মিউসিয়াম আজকে নিয়ে এলাম। হোটেল যাওয়ার আগে ওখানে থামা হলো দুই ঘণ্টার জন্য।
লুভ্র জাদুঘরটি লুভ্র প্রাসাদে অবস্থিত। ফ্রান্সের রাজা ২য় ফিলিপ প্রাসাদটিকে আদিতে ১২শ থেকে ১৩শ শতকে একটি দুর্গ হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন। জাদুঘরের ভূনিম্নস্থ তলাতে এখনও এই দুর্গের অবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। সময়ের সাথে সাথে প্যারিস নগরীর আয়তন বৃদ্ধি পেলে দুর্গটির প্রতিরক্ষামূলক সুবিধাটির দরকার ফুরিয়ে যায়। ১৫৪৬ সালে ফরাসি রাজা ১ম ফ্রঁসোয়া এটিকে ফরাসি রাজাদের মূল বাসভবনে রূপান্তরিত করেন। এর পরে বহুবার ভবনটির সম্প্রসারণ সাধন করা হয় যা ভবনটিকে এর বর্তমান রূপ দান করেছে।
১৬৮২ সালে ফ্রান্সের রাজা ১৬শ লুই তাঁর বাসভবন হিসেবে ভের্সাইয়ের প্রাসাদটিকে নির্বাচন করেন ও লুভ্র প্রাসাদ ত্যাগ করেন। এটিকে তখন রাজার রাজকীয় সংগ্রহশালার একটি প্রদর্শনীকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। এর মধ্যে প্রাচীন রোমান ও গ্রিক স্থাপত্যের একটি সংগ্রহ ছিল অন্যতম। ১৬৯২ সাল থেকে আরও প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত ফরাসি খোদাই লিপি ও শিল্প সমালোচনা আকাদেমি এবং ফরাসি চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্য আকাদেমি এই ভবনটিকে তাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেন। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ফরাসি জাতির কাছে থাকা সর্বোৎকৃষ্ট শিল্পকর্মগুলি প্রদর্শনে লুভ্র-কে ব্যবহার করা হবে।
১৭৯৩ সালের ১০ই আগস্ট ৫৩৭টি চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে লুভ্র জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। এগুলি মূলত রাজা ও গির্জাসমূহের সংগ্রহ থেকে নেওয়া হয়েছিল। এরপর সম্রাট নাপোলেওঁ-র (নেপোলিয়ন) শাসনকালে যুদ্ধের সময় ফরাসি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাজেয়াপ্ত শিল্পকর্ম দিয়ে জাদুঘরের সংগ্রহ আরও সমৃদ্ধশালী হয়, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলির বেশির ভাগই আবার মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। এরপর রাজা ১৮শ লুই ও ১০ম শার্লের সময়ে এবং ২য় ফরাসি সাম্রাজ্যের পর্বে জাদুঘরটির সংগ্রহে প্রায় ২০ হাজার শিল্পকর্ম যোগ করা হয়। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে অনুদান ও অধিকৃতির মাধ্যমে জাদুঘরের সংগ্রহের আয়তন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে লুভ্র জাদুঘরের সংগ্রহটি ৮টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলি হল প্রাচীন মিশরীয় শিল্পবস্তুসমূহ, নিকট প্রাচ্যের শিল্পবস্তুসমূহ, গ্রিক শিল্পকলা, এত্রুস্কান শিল্পকলা, রোমান শিল্পবস্তুসমূহ, ইসলামী শিল্পকলা, ভাস্কর্য, আলঙ্কারিক শিল্পকলা, চিত্রকর্মসমূহ, ছাপশিল্প ও অঙ্কন।
ঠিক করা হলো যেহেতু পুরোটা দেখতে হলে সারাদিন লাগে আমরা গ্রীক স্কাল্পচার হল আর ছবির গ্যালারি দেখবো। সেই মতো যাওয়া হলো। অপূর্ব সব মূর্তি এত পেন্টিং। এতকাল যা বইতেই দেখেছি সেই সব বিশ্ববিখ্যাত মূর্তি আর পেন্টিং চোখের সামনে।
আমার নিজের সব থেকে আকর্ষণীয় ছিল জগৎ বিখ্যাত “মোনা লিসা” এর ছবিটি স্বচক্ষে দেখা। যদিও খুবই ভিড় ছিল ছবিটির সামনে তবুও নয়ন ভরে দেখলাম অপূর্ব সৃষ্টিটিকে। শোনা যায় ল্যুভরের ৮০% ভিজিটর নাকি ওই ছবিটি দেখতেই আসেন।
“মোনা লিসা” (ভুলভাবে বলা হয় মোনালিসা) একটি বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম। ইতালীর শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৬ শতকে এই ছবিটি অঙ্কন করেন। ধারণা করা হয়, বিখ্যাত এই ছবিটি মোনা লিসার দ্বিতীয় পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ স্মরণে অঙ্কিত হয়। অনেক শিল্প-গবেষক রহস্যময় হাসির এই নারীকে ফ্লোরেন্টাইনের বণিক ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকন্ডোর স্ত্রী লিসা গেরাদিনি বলে সনাক্ত করেছেন। শিল্পকর্মটি ফ্রান্সের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ল্যুভ জাদুঘরের তথ্যমতে প্রায় ৮০% পর্যটক শুধু মোনালিসার চিত্রটি দেখার জন্য আসে।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে একটি পাইন কাঠের টুকরোর ওপর মোনা লিসার এই ছবিটি আঁকেন। চিত্রকলার ইতিহাসে এই চিত্রকর্মটির মতো আর কোনটি এত আলোচিত ও বিখ্যাত হয়নি। এর একমাত্র কারণ মোনা লিসার সেই কৌতূহলোদ্দীপক হাসি।
যা পরবর্তীতে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে এটি প্যারিস শহরের ল্যুভ জাদুঘরে রাখা আছে। এটি ছিল শিল্পীর সবচেয়ে প্রিয় ছবি এবং তিনি সবসময় এটিকে সঙ্গেই রাখতেন। আর তিনি নিজেই বলতেন এটি হলো আমার সেরা শিল্পকর্ম।
অবশ্য মোনা লিসাকে নিয়ে অনেক ধারণা আছে। কিছু গবেষক মনে করেন মোনা লিসা হলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মা আবার কেউ মনে করেন মোনা লিসা হলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বান্ধবী। তবে সাম্প্রতিক এক কম্পিউটার পরীক্ষায় দেখা গেছে মোনা লিসা’র সাথে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কিছুটা মিল রয়েছে। তাই মনে করা হয় হয়তো মোনা লিসা চিত্র কর্মটি না ছেলে না মেয়ে। বর্তমান সময়ের বিখ্যাত লেখক ড্যান ব্রাউন এর রচয়িত বিখ্যাত বই দ্য দা ভিঞ্চি কোড প্রকাশিত হবার পর মোনা লিসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা’র পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে এবং মানুষের মনে নতুন রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।
এই মোনা লিসা ছবিটি প্রথম দিকে বহু শতক ধরে তেমন জনপ্রিয় ছিলোনা। ১৯১১ সালে এক ইতালিয়ান ফ্রেমের মিস্ত্রী ওই ছবিটি চুরি করেন। কিন্তু সাহস করে দুই বছর বিক্রীর জন্য চেষ্টা করতে পারেন নি। পরে এক ডিলারকে যোগাযোগ করলে উনি ধরা পড়ে যান ও ছবিটি ল্যুভরেতে ফিরে আসে। তারপরেই বিভিন্ন নিউজ পেপারে লেখালেখির ফলে ছবিটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
আরও দেখার ইচ্ছা থাকলেও সময়ের অভাবে ফিরে আসতে হলো।
হোটেল নোভোটেল এ পৌছালাম বিকাল ৪টায়।
কিছু ছবি তোলা হলেও ছবিগুলি খুব একটি ভালো নয়। এর জন্য ভালো ক্যামেরার দরকার ছিল।
সেদিন সন্ধ্যা ছটা থেকে আবার আলাদা পেমেন্ট করে প্যারিস বাই নাইট দেখার প্ল্যান। যাতে আছে সুন্দর আলোক সজ্জিত প্যারিসে ঘোরা রাস্তাতে আর স্টিমারে। তারপর বিশ্বখ্যাত লিডো নাইট ক্লাবে ডিনার ও নাচ দেখা। আমার স্ত্রীর শরীর ভালো না লাগাতে আমরা ড্রপ করলাম।
কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে প্যারিসের রাস্তাতে একটু ঘোরাঘুরি করে ওপেন এয়ার ক্যাফেতে পিজ্জা আর কফি খেয়ে ঘরে। আপাতত গুড নাইট সকলকে। অ রভয়া।
ঝকঝকে সকালে উঠে তৈরি হয়ে বেশ ভালো করে প্রাতরাশ। ফ্রেঞ্চ ব্রেডের যে কত রকম সমাহার সেটা সত্যি চেখে দেখার মতো। আর প্যাস্ট্রিস এন্ড কুকিস।
এরপরে ৮.৩০ মিনিটে বাস ছাড়লো প্যারিস শহর ভ্রমনের জন্য।
প্রথমে মঁ পাসে টাওয়ার। ৫৬ তলা উঁচু টাওয়ার যার ছাদ থেকে পুরো প্যারিসের একটা ৩৬০° ভিউ পাওয়া যায়। আজকাল কার মতো ৩৬০° ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলে রাখতাম। দূরে দেখছিলাম আইফেল টাওয়ার, নত্রে ডাম ক্যাথিড্রাল সাঁ যে লিজে ইত্যাদি। আর লিফটটিও তখনকার সময়ে বেশ বিস্ময়কর। ৩০ সেকেন্ডে ৫৬ তলা।
তারপর বাসে ঘোরা ও দেখা হলো বহু মনুমেন্ট যেগুলো তখনো অবধি শুধু নামই শুনেছি আর বইয়ে পড়েছি। অর্ক দ্য ত্র্য যেটার ভারতীয় সংস্করণ ইন্ডিয়া গেট। সাঁ যে লীজে, নত্রে ডাম ক্যাথিড্রাল আরও কত অপূর্ব গথিক ঢঙের বাড়ি যার নাম এখন মনে নেই।
রাস্তা চলতে চোখে পড়ছিল সুন্দর শামিয়ানা খাটানো ছোট ছোট ক্যাফে যার অনেক টেবিল ফুটপাথের ধারে। আরামে বসে আয়েশ করে কাপল কফি খাচ্ছে আড্ডা মারছে অন্য কিছুও খাচ্ছে যেটা আর লিখলাম না। এছাড়া যাওয়া হলো গ্রেভিনস ওয়াক্স মিউসিয়াম, যেটি লন্ডনের মাদাম তুসোর একটু পরিবর্ধিত সংস্করণ। এখানে সুন্দর লাইটের আরেনজমেন্ট আর মিরর ইমেজের এক সুদৃশ্য উদাহরণ।
নিয়ে গেল ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। সেখানে লাঞ্চ হলো।
এরপর গেলাম আইফেল টাওয়ারে। লম্বা লাইন ওপরে যাওয়ার। ঠিক হোলো আমরা দ্বিতীয় লেভেল অবধি উঠবো।
আইফেলের নিচে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার বলে গর্ব বোধ হচ্ছিল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক সুবিশাল উদাহরণ দেখে।
আইফেল টাওয়ার প্যারিস শহরে অবস্থিত সুউচ্চ একটি লৌহ কাঠামো যা ফ্রান্সের সর্বাধিক পরিচিত প্রতীক। গুস্তাভো আইফেল নির্মিত ৩২০ মিটার তথা ১০৫০ ফুট উচ্চতার এই টাওয়ারটি ছিল ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী ৪০ বছর যাবৎ পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার। গুস্তাভো ইফেল রেলের জন্য সেতুর নকশা প্রণয়ন করতেন এবং টাওয়ারটি নির্মাণে তিনি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন। ১৮,০৩৮ খণ্ড লোহার তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ছোট-বড় কাঠামো জোড়া দিয়ে এই টাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল। ৩০০ শ্রমিক এই নির্মাণ যজ্ঞে অংশ নিয়েছিল।
ওখানে দ্বিতীয় লেভেলে উঠে দেখা হলো চারপাশের প্যারিসের দৃশ্য আর ছবি তোলার সেশন। কিছু সহযাত্রীর কাছে শুনলাম গতকাল রাত্রির প্যারিস বাই নাইট ভ্রমণে ওরা আইফেলের লাইটিংয়ের এক দারুণ দৃশ্য দেখেছে।
নিচে এসে কিছু স্যুভেনির কিনে আর প্যাকড ডিনার নিয়ে হোটেলে ফেরা। শরীর যথেষ্ট টায়ার্ড কিন্তু মন খুব খুশি এতকাল ধরে যা ঘুরে দেখার স্বপ্নই দেখেছি তা চাক্ষুষ দেখা হলো মনের আনন্দে।
এরপর ডিনার খেয়ে বিছানাতে শরীর মেলা। অবশ্যই রোজনামচার একটা খসড়া রোজই লিখতাম আর ভারতীয় সময় বুঝে দুই মেয়েকে ফোন করতাম।
আজকের মতো ইতি গজ। কাল যাওয়া হবে জেনিভা প্রায় ৭ ঘন্টার অতি মনোরম ভ্যালির মধ্য দিয়ে।
******************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।