Shadow

ইউরোপ ভ্রমণ (নবম পর্ব)-রোম আর ভ্যাটিকান,তারপর মিলান হয়ে দিল্লী ও কলকাতা – বিজিত কুমার রায়

ইউরোপ ভ্রমণ (নবম পর্ব)-রোম আর ভ্যাটিকান,তারপর মিলান হয়ে দিল্লী ও কলকাতা

বিজিত কুমার রায়

আজ আমাদের ছোট মেয়ের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী তাই ওদের শুভেচ্ছা জানানো হলো।
সকালে ব্রেকফাস্টের পরে পাদোভা থেকে রওয়ানা দিয়ে ৩ ঘন্টা পরে রোম পৌঁছালাম তবে সেদিন ইতালির জাতীয় দিবস থাকার জন্য প্যারেড এর আগে সব গাড়ি বাইরেই আটকে দিলো। এতে অবশ্য খানিকটা শারীরিক কষ্ট হলেও একটা অন্য অভিজ্ঞতা হলো। কারণ অগণিত ইটালিবাসী সুন্দর সাজগোজে শহরে রাস্তাতে বেড়িয়েছেন ও নানা জায়গাতে নাচ গানের উৎসব চলছে।
রোমের ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের বেশি পুরোনো। যদিও খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫৩-এর কাছাকাছি সময়ে রোম প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকে রোমান পুরাণ উল্লেখিত,এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে মানব বসতি ছিলো,যার ফলে এটি ইউরোপের প্রাচীনতম অধ্যুষিত শহরগুলোর অন্যতম। লাতিনদের একটি মিশ্রণ থেকে শহরের প্রথম দিকের জনসংখ্যা সম্ভূত,এত্রুস্কান এবং সাবিন্স। অবশেষে, শহরটি ধারাবাহিকভাবে রোমান রাজ্য,রোমান প্রজাতন্ত্র ও রোমান সাম্রাজ্য-এর রাজধানীতে পরিণত হয়,এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্মস্থান হিসাবে একে গণ্য করা হয়। একে “Roma Aeterna” (শাশ্বত শহর) এবং “Caput Mundi” (বিশ্বের রাজধানী) হিসেবে গণ্য করা হয়,প্রাচীন রোমান সংস্কৃতি দুইটি কেন্দ্রীয় ধারণা। সাম্রাজ্যের পতনের পর,যা মধ্যযুগের শুরু চিহ্নিত করে,রোম ধীরে ধীরে পোপের শাসনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। যা ১ম শতকে নির্ধারিত হয়ে ৮ম শতক পর্যন্ত চলছিলো। তখন এটি পেপাল রাষ্ট্রের রাজধানী হয় এবং ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ছিলো।
রেনেসাঁ-এর শুরু থেকে,পঞ্চম নিকোলাস (১৪২২-৫৫) থেকে প্রায় সব পোপ শহরটিকে বিশ্বের শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করতে লক্ষ্য চারশো বছর ধরে স্থাপত্য-সংক্রান্ত এবং শহুরে পরিকল্পনা সুসঙ্গতভাবে অনুসরণ করেন। এর দরুণ,রোম,ইতালীয় রেনেসাঁর প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে,এবং তারপর বারোক শৈলী জন্মস্থান। বারোক সময়ের বিখ্যাত শিল্পী এবং রেনেসাঁ স্থপতিরা রোমকে তাদের কার্যকলাপ কেন্দ্রে পরিণত করে এবং শহর জুড়ে শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা তৈরি করে। ১৮৭১ সালে রোম, ইতালি রাজ্য এবং ১৯৪৬ সালে ইতালীয় প্রজাতন্ত্রের রাজধানীতে পরিণত হয়।
রোমের গ্লোবাল শহরের স্বীকৃতি আছে। ২০১১ সালে,রোম পৃথিবীর ১৮-তম সবচেয়ে বেশি ভ্রমণকারী শহর,ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে ৩য়,এবং ইতালির সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ ছিলো। এর ঐতিহাসিক কেন্দ্র বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ইউনেস্কো দ্বারা তালিকাভুক্ত।
সৌধ ও জাদুঘর যেমন ভ্যাটিকান জাদুঘর এবং কলোসিয়াম বিশ্বের সর্বাধিক দেখা পর্যটক গন্তব্যস্থলগুলির মধ্যে একটি। রোম ১৯৬০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আসন রয়েছে।
মিলিটারির প্যারেড ও বিমানের মহড়া ও দেখা গেলো।
আমরা প্যালেস বাইরে থেকে,বিখ্যাত কলসিয়াম ইত্যাদি দেখে এলাম ট্রেভিস ফাউন্টেনে। এটি মার্বেল পাথরের একটি সুন্দর ফোয়ারা যেটিকে বলা হয় ইচ্ছাপূরণ ফোয়ারা। ভালো লাগলো সবার সাথে আনন্দ করে।
এরপর আমরা গেলাম টাইম এলিভেটর বলে এক ফোর ডাইমেনশন শো দেখতে যেটা তখন বেশ চমকপ্রদ লাগলেও আজকের দিনে একেবারেই কমন।
এরপর লাঞ্চ হলো।
তারপর যাওয়া হলো ভ্যাটিকান সিটিতে। ভ্যাটিকান সত্যি এক জাঁক জমক পূর্ণ জায়গা। লাইন দিয়ে সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকাতে গেলাম দেখতে। লাইন দিয়েছিলাম পোপ যে জানলা দিয়ে দর্শন দেন তার নিচেই তবে সেদিন দর্শন ছিলোনা। পৃথিবীর সব চেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান সিটি। যা ইতালির রোম শহরের মধ্যে আরেকটি দেশ। এই দেশের আয়তন হচ্ছে ১১০ একর। আর ছোট্ট এই দেশটিতে জনসংখা হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০ এর মতো। এই দেশে মূলত স্থানীয় জনসংখ্যার চেয়ে পর্যটকই বেশি।
ভ্রমণপিপাসুদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত এই ভ্যাটিকান সিটি। জনসংখ্যার তুলনায় এখানে টুরিস্ট বেশি আসে। প্রতি বছর এ শহরে ভ্রমণ করতে আসে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ। কারণ ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভ্যাটিক্যান সিটি বেশ সমৃদ্ধিশালী। দেশটির মূল আয় আসে এই পর্যটকদের মধ্যে থেকেই।
ভ্যাটিকান সিটি সবসময় থাকে শান্ত; এর চারপাশে বিরাজ করে সুনসান নীরবতা, দেশটিতে কোনো রমণী বসবাস করে না বলেই ধরে নেয়া হয়। যারা ভ্যাটিকান সিটিতে বসবাস করে সবাই ক্যাথলিক পোপ। তারা সারা পৃথিবীতে খ্রিস্টধর্মের শান্তির বার্তা প্রচার করেন। প্রথম শতাব্দী থেকেই ভ্যাটিকান সিটিতে খ্রিস্টধর্মের সাধু বা পোপরা বসবাস শুরু করেন। তখন ভ্যাটিকান সিটি স্বাধীন-সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্র ছিল না। শুধু ইতালির অধীনে ছোট শহর বলে পরিচিত ছিল। ১৯২৯ সালে ভ্যাটিকান সিটি স্বাধীনতা লাভ করেছিল। সাধারণ জনগণ ইতালি ও ল্যাটিন উভয় ভাষাই ব্যবহার করে। দেশটির সাক্ষরতার হার ৯৯.২%। বার্ষিক গড় আয় ১৬০০ মার্কিন ডলার। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো,ভ্যাটিকান সিটির যেসব নাগরিক বৃদ্ধ হয়ে যায় তাদের ইতালিতে প্রেরণ করা হয় বাকি জীবন অতিবাহিত করার জন্য। আর এতে বৃদ্ধদের পরিবর্তে আনা হয় তরুণ সাধু-সন্ন্যাসীদের। প্রথম শতক থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ পোপ এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। তবে অন্যান্য দেশের মতো এখানেও রয়েছে সরকার পদ্ধতি মন্ত্রী-এমপি,যারা সুন্দর ও সুচারুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। ভ্যাটিকান সিটির চতুর্দিকে শুধু সবুজ আর সবুজ,নানা গাছ-গাছালিতে এই ছোট্ট রাষ্ট্রটি পরিবেষ্টিত। বিশ্বের নানা প্রান্তের শতকোটি ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখে ছোট্ট এই ভূখণ্ডটিকে। কেনোই বা রাখবেন না এখানেই তো বাস করেন তাদের ধর্মের জীবিত সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি পোপ। যার বাণী বিশ্বাসীদের কাছে তাদের ঈশ্বরের বাণীর মতোই পবিত্র। তাছাড়া ভ্যাটিকান সিটি ব্যাঙ্কে দুনিয়ার তাবৎ গির্জার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে বলেই শোনা যায়। শুধুই কি তাই,পৃথিবীর সবচেয়ে সংরক্ষিত আর্কাইভটিও তো এখানেই। হাজার বছরের পুরোনো দলিল,বই,ছাপা না হওয়া বাইবেল,লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির হাতে লেখা ডায়েরি,গ্যালিলিও এর বই–কি নেই এই সংগ্রহশালায়! তবে সেখানে ঢোকার জন্য অবশ্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। সর্বসাধারণের জন্য এটি নয়। কি ক্ষমতাধর ছোট্ট একটি দেশ! সারা বিশ্বের অন্যতম পবিত্র স্থান বলে ঘোষিত ভ্যাটিকান সিটিকে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব ঐতিহাসিক স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে রাষ্ট্রটি খ্রিস্টান ধর্মের অন্যতম প্রধান স্থান হিসেবে বিবেচিত। সেই সাথে বিশ্বের সবচেয়ে ছোট্ট সুন্দর দেশের খেতাবও অর্জন করেছে ভ্যাটিকান সিটি।
এই ক্যাথিড্রালে যে অপূর্ব ছবি আর ফ্রেস্কো আর মূর্তি দেখলাম তার তুলনা নেই। বিশদ বর্ণনা আমার ক্ষমতার বাইরে। বিশাল ডোমের নীচে এক অপূর্ব সংগ্রহ। দেখলাম পায়েটি যেটা মাদার মেরীর কোলে শায়িত যীশু মৃত্যুর কোলে।
বাইরে দেখলাম বিশাল ওবেলিস্ক।
আমাদের সর্বশেষ দর্শনীয় স্থান হিসেবে এটি অবিস্মরণীয়। ফিরে এলাম হোটেল ফিরেনজি তে। ডিনার খেয়ে আরামের ঘুম।
এই প্রথম সকাল বেলা আরাম করে ঘুম থেকে ওঠা হলো আর জমিয়ে ব্রেকফাস্ট হলো। এরপর জিনিসপত্র ফাইনাল প্যাক করে ১১.৩০ মিনিটে বেরোলাম মিলানের উদ্দেশ্যে। রাস্তাতে এক জায়গাতে বাস থামিয়ে পিজ্জা লাঞ্চ হলো।
চারটের সময় পৌঁছালাম মিলান এয়ারপোর্ট। সোজা চেক ইন এম্বারকেশন ইত্যাদি সেরে লাউঞ্জে তিন ঘন্টা আরামের জন্য আর ডিউটি ফ্রি কেনাকাটার জন্য। আমরা যদিও উইন্ডো শপিং করলাম। অন্য অনেকেই ব্যস্ত রইলো ডিউটি ফ্রি শপ থেকে কেনাকাটা করতে বিশেষ করে পানীয় দ্রব্যাদি কিনতে।
রাত্রি নয়টাতে প্লেন ছাড়লো। এই প্লেনটি সাধারণ এ ৩২০,তাই আসার সময়ের মতো এ ৩৮০ র আরাম নেই। ১১টার সময়ে ডিনার দিলো। রেড ওয়াইনের সাথে ভালো ইউরোপিয়ান ডিনার।
কিন্তু ৪ ঘন্টা পরেই তুলে দিল যে এবার ব্রেকফাস্ট দেবে। ভারতীয় সময় তখন সকাল ৬.৩০। সকাল ৮.৩০ মিনিটে দিল্লি পৌঁছালাম। কাস্টমস ইত্যাদি কোনো অসুবিধা ছাড়াই হয়ে গেল। চলে এলাম ডোমেস্টিক সাইডে। রাত্রি নয়টায় আমাদের কলকাতার ফ্লাইট। তাই অঢেল সময়। কেউ কেউ ওই গরমে দিল্লি দর্শনে গেলো। আমরা আরাম করলাম লাউঞ্জে। আমার ছোট মেয়ে জামাই এসে সময় কাটালো আমাদের সাথে। লাঞ্চ করা হলো। সন্ধ্যা বেলা ওরা ফিরে গেলে সময়মতো আবার চেক ইন,সিকিউরিটি ইত্যাদি। রাত্রি ১২টা নাগাদ বাড়িতে পৌছালাম।
এক অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিময় অভিজ্ঞতার সমাপ্তি।
আমার কথাটি ফুরালো নোটে গাছটি মুড়ালো।
******************************************

বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!