ইউরোপ ভ্রমণ (পঞ্চম পর্ব) : সুইস আল্পস দুই রাত্রি
বিজিত কুমার রায়
আমরা রওয়ানা হলাম সুইস আল্পস এর দিকে। ২ ঘন্টা যাত্রার পর পৌছালাম গাস্টাড নামে এক জায়গাতে। যদিও রাস্তাতে খুব বৃষ্টি ছিল তবে হোটেলে আসার পর পরিষ্কার হয়ে গেল।
জায়গাটি ছিল একটি শহরতলি মতো তাই সুন্দর গ্রামে হেঁটে ঘুরতে খুব ভাল লাগছিলো। কিন্তু ঠান্ডার চোটে সন্ধ্যার আগে হোটেলে। তারপর কিছু আরাম। ফোনাফুনি। তারপর গরম রাত্রিভোজ সেরে কম্বলের তলায়। আজকের মত শুভরাত্রি!
এখানে এতো সুন্দর আবহাওয়া যে এখনো অবধি কারো কোনো শারীরিক অসুবিধা হয়নি যেটা কিনা গ্রূপ ট্যুরের সব থেকে বড় অসুবিধা।
কালকে শুনেছি সব থেকে সুন্দর পাহাড়ে যাওয়া হবে। তাই ভাবতে ভাবতে আরামে ঘুম। অবশ্য নিয়ম করে রোজনামচা লিখে রাখতাম।
সকালে উঠে স্নান ইত্যাদি সেরে সুন্দর বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল ৮.৩০ মিনিটে বেরোলাম গ্লেসিয়ার ৩০০০ দেখতে। এই ট্রাভেলস মাউন্ট তিতলিসের বদলে এখানে নিয়ে যায়। প্রায় ২ ঘন্টা লাগলো শুরুর পয়েন্টে পৌঁছাতে। লাকিলি সেদিন ছিল আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। কেবল কারে ৩০ মিনিট লাগলো ওপরে পৌঁছাতে। ওখানে খোলা টেরেসে এসে দেখি একটা গ্লেসিয়ারের ওপরে আমরা।
এরপর চেয়ার রাইড করে নিচে বরফের প্রান্তরে নামা। চেয়ার গুলি আবার একদম থামেনা। ধীরে চলন্ত অবস্থায় লাফিয়ে উঠতে হবে দুই জনকে। সমস্যা ভালোই। বসার পর দেখি ওপরের একটা বার নেমে এসে আমাদের আটকিয়ে দিলো। কিন্তু বাদবাকি সব খোলা আর নামছে একদম ৮০° তে। ভয়ের চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঠান্ডা তো আছেই। প্রায় ২০ মিনিট লাগলো নীচে নামতে। ছবি তুলব কী! হ্যান্ডেল থেকে হাত ছাড়তেই ভয় লাগছে। নিচে (-)৫℃ এ পৌঁছে বরফের ওপর নামলাম যেটা সেমি সলিড। বুড়োরাও পেঁজা বরফ নিয়ে ছোড়াছুঁড়ি শুরু করলো।
এরপরে একটা স্নো বাসে করে অনেকটা ঘুরে আসা হলো। কিছু ফটো তুলে আবার ওপরে। শুনলাম ওখানে ডগ স্লেজ রাইডও আছে তবে আমাদের চোখে পড়েনি। যারা স্কি করে তারা ওই গ্লেসিয়ার বেয়ে স্কি করে বেরিয়ে যাচ্ছে হুশ হাশ করে। এরপর লাঞ্চ করে আবার বাইরের টেরেসে ঘোরাঘুরি। ছবি তোলা। একটা অল্পাইন রোলার কোস্টার রাইড ছিল যেটাতে দুটো ৩৬০° টার্ন আছে আর নামছে প্রায় ৮০° এঙ্গেলে। কেউ কেউ গেল সেটাতে। এই করতে করতে শিডিউল থেকে একঘন্টা লেট।
এরপর আবার কেবল কার আর বাস রাইড করে যাওয়া হলো মাউন্ট কক্স এন্ড কিংস এ। এখানেও একটু বেটার চেয়ার রাইড আর সবুজ মেডোর ওপর দিয়ে। নীচে দেখা যাচ্ছিল লগ হাটস আর প্রচুর গরু ঘন্টা বাজিয়ে।ওপর থেকে একটা সুন্দর ভিউ পাওয়া গেলো চারদিকের বরফে মোড়া পাহাড়ের। যশ চোপড়ার কোন সিনেমার শুটিং এখানে হয়েছে। এরপর ওখানে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে রেড ওয়াইন সহযোগে ডিনার সেরে আবার কেবল কারে নিচে। তারপর বাসে করে হোটেল রাত ১০.৩০ মিনিটে। রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে কম্বলের নীচে।
কাল নিয়ে যাবে থুমেলবাক ফলস আর জুংফ্রাউজক ঘুরতে।
সকাল সকাল উঠে গরমা গরম প্রাতরাশ খেয়ে বাসে উঠে রওয়ানা বরফের রাজ্যের দিকে। একটা মজার ব্যাপার বলি, আমরা নিজেরাই নিয়ম করেছিলাম যে রোজ বাসে রওয়ানা হওয়ার সময় একটা করে সিট পিছিয়ে বসার যাতে সবাই সব রকম সিটে বসতে পারে আর রেষারেষি না হয়। এই দিনের জার্নি ছিল আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ, পথের দুপাশের সৌন্দর্যের মধ্যে একটা। তিন ঘন্টা আমরা চললাম সুইস কান্ট্রি সাইডের মধ্য দিয়ে। সবুজ ভ্যালি, মাঝে মাঝে কটেজ টাইপের বাড়ি, পপলার গাছ আর ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে তার গলার ঘন্টি শোনা যাচ্ছে হাল্কা। ঠিক যেন দিলবালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গের দৃশ্য। হয়তো এখানেই শুটিং হয়েছিল। আমাদের বাসের যাত্রীরা তো ছবি তুলতেই পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রায় ১১.১৫ মিনিটে পৌছালাম “জুংফ্রাউযক” নামে একটা পাহাড়ি জায়গার নীচে। একে ইউরোপের ছাদ ও বলা হয়। দারুন আরামদায়ক একটা ট্রেনে প্রথমে পাহাড়ের মাঝ রাস্তা অবধি যেতে হয়। তারপর বিশেষ ধরনের ট্রেনে একেবারে ওপর অবধি। বাইরের দৃশ্য খুবই সুন্দর কিন্তু মাঝের স্টেশনে পৌঁছাবার পরে বরফ পড়া শুরু হলো। পৌঁছাতে বেলা ১টা হয়ে যাওয়াতে আগেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ। নাম ছিল “বলিউড”। তারপর পাশে একটা খোলা টেরেসে গেলাম বাইরেটা দেখার জন্য। কিন্তু ঠান্ডার চোটে আর বরফের ঝড়ে মিনিট ১০এর বেশি কাটাতে পারিনি। চারিদিকে যেন বরফের সমুদ্র আর যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে, সেখানটা জমা শক্ত বরফের ওপর।
ভেতরে এসে আমরা আইস ওয়ার্ল্ড বলে একটা বরফের গুহা দেখতে গেলাম। সেখানে বরফ দিয়ে নানা জন্তু জানোয়ার বাড়ি এইসব তৈরি করে রাখা। খুবই সুন্দর কিন্তু সাব জিরো ওয়েদারে বেশিক্ষন থাকা কঠিন। এছাড়া আমাদের সঙ্গের দুই মহিলা যারা শাড়ি ও চটি পরে এসেছিলেন তারা প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন তাই তাদেরকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে। এছাড়া আমার নোকিয়া মোবাইল দেখলাম হঠাৎ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বোধহয় খুব ঠাণ্ডাতে ব্যাটারির প্রবলেম। তাই ভালো করে ছবি তোলা হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ এই বরফের সাম্রাজ্যে কাটিয়ে ফেরার পালা। মাঝের ট্রেন বদলের স্টেশনে এসে দেখা গেল দুটি ফেমিলি ওপরেই রয়ে গিয়েছেন। তাই স্টেশনে ওয়েট করা হলো। হঠাৎ আবার পেঁজা তুলোর মতো বরফ পড়া শুরু হলো। সবাই আনন্দে প্লাটফার্মেই আনন্দ শুরু করলো। আমাদের সহযাত্রীরা ফিরে এলে আবার নীচে নেবে এলাম। কিছু স্যুভেনির কেনা হলো। কিনলাম সেই বিখ্যাত গরুর গলার ঘন্টা যেটা শাহরুখ কাজলকে দিয়েছিল। ফেরার সময় ওয়েদার খারাপের জন্যে আর ক্লান্তিতে তিনঘন্টা প্রায় ঘুমিয়েই কাটলো। ফিরে এসে ঘরে। রাতেও হালকা ডিনার করে কম্বলের তলায়। পরের দিন নাকী আবার একটি বরফের পাহাড়ে যাওয়া হবে।
কাল যাওয়ার প্ল্যান লুসার্ন হয়ে জার্মানি ভায়া ব্ল্যাক ফরেস্ট।
**********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।