ইউরোপ ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)
বিজিত কুমার রায়
যাত্রা শুরু, বিমান যাত্রা ও লন্ডন ভ্রমণ (প্রথম ও দ্বিতীয় দিন)
আর সব বাঙালিদের মতো আমাদেরও পায়ের তলায় সর্ষে। আর আমার কর্মসূত্রে বহু প্রদেশেই যেতে হয়েছে আর অর্ধাঙ্গিনীকেও প্রায় সব জায়গাতেই নিয়ে গিয়েছি।
তবে তুলনামূলক ভাবে উঁচু পদে থাকার জন্য আর বিশেষ কর্মে নিযুক্ত থাকাতে লম্বা ছুটি পাওয়া বেশ মুশকিল ছিল। তবুও সাহসে ভর করে বড় সাহেবের কাছে দিন কুড়ির ছুটি চেয়ে পাওয়াতে হাতে স্বর্গ পেলাম। আর সাহসে ভর করে বেরিয়ে পড়লাম ১৬ দিনের ইউরোপ ভ্রমণে ২০১০ সালে এপ্রিল মাসে।
যদিও এর জন্য ট্রাভেল গ্রূপ বাছাই ইত্যাদি আগেই শুরু হয়েছিল। আর খরচ আমাদের মাথাপিছু ১.২৫ লাখ একটু চাপের ছিল বিশেষ করে নামকরা ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যাওয়াটা ঠিক করার জন্য। কিন্তু এদের ব্যবস্থা সাধারণত flawless হয়, টাই আপ বিদেশি হোটেল ইত্যাদির সাথে খুবই ভালো হয় তাই এই ডিসিশন।
সবরকম ফর্মালিটি মানে ভিসা ইত্যাদি হওয়ার পর আর কিছু বিদেশি মুদ্রা (পাউন্ড, ইউরো আর ডলার) জোগাড়ের পরে যাওয়ার দিন এলো । ভোর বেলা বিমান বন্দরে জেটের দিল্লি ফ্লাইট ধরতে। আমাদের দলে মোট ৩৬ জন ছিলাম আর সবাই কলকাতার। তার মধ্যে আমাদের পরিচিত দুটি ফেমিলিও ছিল।
ফ্লাইট ধরে ৯.৩০ মিনিটে দিল্লি। তারপর প্রায় দৌড়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক বন্দরের জন্য। সেখানে গাদা গুচ্ছের ইমিগ্রেশন ফরম ভর্তি, পাসপোর্ট চেক ইত্যাদি সেরে আমরা সিকুরিটি চেকে পৌছালাম। সেখানে হলো বিপত্তি। দলের এক মহিলা পা আটকে পড়ে গিয়ে মালাই চাকী ভাঙলেন। ওনাদের যাওয়া তো ওখানেই শেষ। আমরা উঠলাম বেশ বড়সড় একটি এয়ারবাসে। সিট ছিল শেষের দিকে কিন্তু দুইজনের সিটে আর প্রচুর লেগ স্পেস।
প্রায় ৯ ঘন্টার জার্নি ৮৫০০ কিমি। পথে খাওয়া দাওয়া ঠান্ডা গরম পানীয় ইত্যাদির কোনো তুলনা ছিল না। আর স্টুয়ার্ডের কল্যানে লাল পানীয়ের (অতি সুস্বাদু রেড ওয়াইন)। কিছুটা যাওয়ার পরে আমার স্ত্রী যার জানলার সিট ছিল দেখালো যে নীচে হিন্দুকুশ পর্বতের সারি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আনস্মার্ট মোবাইলের ক্যামেরাতে ছবি তোলা হলো।
এরপর আমার সময় কাটলো দারুন দুটি হিন্দি ও ওয়েস্টার্ন সিনেমা দেখে আর লাল পানীয় সেবনে। আর আমার স্ত্রী রেকর্ড করলেন ৭০০০ কিমি ঘুমিয়ে। যদিও লাঞ্চ ও স্ন্যাকস ইত্যাদির জন্য কিছু ব্রেক ছিল। বলার আগেই চিপস বা নাটস ইত্যাদি প্যাকেট দিয়ে যাচ্ছিল ওয়াইনের সাথে।
প্লেনের মধ্যে আইলে কিছুটা হাঁটাহাটিও করলাম অভিজ্ঞ লোকেদের পরামর্শ মেনে। সাধারণ এয়ারবাসের সমান পিছনের বসার জায়গাটি, তারপর আরও দুটি বড়ো কেবিন এ একদম সামনে এক্সাসিউটিভ ক্লাস ও ফার্স্ট ক্লাস। বেশ বড় জাহাজটি হাঁটার জন্য। আমাদের ৩৬ জন ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা জায়গাতে। তাদের সাথে কিছু শুভেচ্ছা বিনিময় ইত্যাদি।
ওদের বিকালে আমাদের প্রথম রাত্রিতে পৌঁছানোর আগে ফ্রান্স আর লন্ডনের দৃশ্য দেখা গেল। একদম পৌঁছানোর আগে চোখে পড়লো লন্ডন আই আর টেমস নদী। নামার পর শুরু হলো আর এক কষ্টের অভিজ্ঞতা। ইমিগ্রেশনের লাইনে। ১.৩০ ঘন্টা লাগলো সেখানে। যদিও আমাদের চোখের পলকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ছাপ মেরে বের করে দিলো কারণ বোধ হয় ট্র্যাভেল গ্রূপ। তারপর মাল নিয়ে বাইরে আমাদের মালয়ালি খ্রিস্টান টুর ম্যানেজারের সাথে মোলাকাত। দাঁড়িয়ে ছিল এক বিশাল মার্সিডিজ টুরিস্ট বাস। আমাদের পুরো জার্নির সাথী ছিল এই বাস আর খুবই আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। সমস্ত মাল গেলো বাসের নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে।
হোটেলে (একটু আউট স্কার্টসে) পৌঁছানোর আগে রাস্তাতে এক ভারতীয় হোটেলে ডিনার।
থাকার হোটেল ছিল টপ ক্লাস। কিন্তু মোবাইল চার্জ করতে গিয়ে মাথাতে হাত। কারন ওদের প্লাগ পয়েন্ট চৌকো। কেউ বলেও নি আমাদের। সে প্রবলেম সলভ হলো কি করে সেটা পরের বলছি। আপাতত গুড নাইট। আরামদায়ক বিছানাতে শোয়া মাত্রই ঘুম। একদম সকালে ঘুম ভেঙে গেলো। আর মনে হলো মোবাইলে চার্জ নেই চার্জারের গণ্ডগোলে। যাই হোক টেবিলে রাখা চায়ের সরঞ্জামে চা তৈরি করে বিস্কুট দিয়ে খেয়ে আলো ফুটলে বাইরে বেরোলাম হোটেলের। লন্ডন শহরের একটু বাইরে বলে খুব ছিমছাম পরিষ্কার শহরতলি আর আকাশ সম্পূর্ণ নীল। হালকা ঠান্ডা। বাইরে হেঁটে আরাম পেলাম। আর যেটা পেলাম সেটা হচ্ছে এক সর্দারজির মাল্টিপারপাস দোকান। সেখানে পেলাম মাল্টিনেশন পয়েন্ট হোল্ডার যেটা পৃথিবীর সব দেশেই প্লাগ পয়েন্টে লাগবে ও চার্জার কাজ করবে। গেল ৫ পাউন্ড। কলকাতাতে পরে দেখেছিলাম ৩০ টাকাতে পাওয়া যায়। যাই হোক হোটেলে ফিরে মোবাইল কাম ক্যামেরা চার্জে বসিয়ে স্নান ইত্যাদি সেরে ডাইনিং হলে পাঁচ তারা ব্রেকফাস্টের জন্য। পেট ভরে খাওয়া হলো। এরপর থেকে আমরা সব সময়েই ব্রেকফাস্ট পেট ঠেসে খেতাম কারণ লাঞ্চ কখন হবে ঠিক থাকতো না আর সাধারণ ইন্ডিয়ান ভাত ডাল মাংসের লাঞ্চ হতো। রোজ একই স্বাদ।
বেড়াতে বেরোনো হলো লন্ডন শহর মালপত্র নিয়ে চেক আউট করে। প্রথমে স্বামী নারায়ন মন্দির। মন্দিরে অভক্তি নেই কিন্তু লন্ডনে এসে মন্দির দেখা মানে সময় নষ্ট। তারপর সোজা বাকিংহাম প্যালেস। বাকিংহাম প্রাসাদ ব্রিটিশ রাজ পরিবারের লন্ডনের বাসস্থান এবং বর্তমানে পৃথিবীতে বিদ্যমান বৃহত্তম রাজকীয় প্রাসাদ। প্রসাদটি রাজ পরিবারের বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠান অবসরকালীন বিনোদনের জন্য নির্মিত হয়েছিল, বর্তমানে এটি একটি পর্যটক আকর্ষন। নির্মাণ কালে প্রাসাদটির নাম ছিল বাকিংহাম হাউজ। এটি ১৭০৩ সালে বাকিংহামের ডিউক জন শেফিল্ডের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল, পরবর্তীতে রাজা তৃতীয় জর্জ ১৭৬২ সালে তার ব্যক্তিগত বাসভবন হিসেবে এটি অধিকৃত করেন। পরবর্তী ৭৫ বছরে এটি আরও সম্প্রসারণ করা হয়। সম্প্রসারণের মূল দায়িত্ব পালন করেন স্থপতি জন ন্যাশ ও এডওয়ার্ড ব্লোর। তারা রাজদরবারের চারপাশে তিনটি শাখা নির্মাণ করেন। বাকিংহাম প্রাসাদ সর্বশেষ ১৮৩৭ সালে রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহণ কালে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের রাজকীয় কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। সর্বশেষ কাঠামোগত সম্প্রসারণ হয়েছিল ভিক্টোরীয় যুগে। বাইরে থেকে দেখা। প্রচুর ভিড়। দেখা হলো বিখ্যাত চেঞ্জ অফ গার্ড। রাস্তাতে বাসের জানলা দিয়ে দেখেছি বিগ বেন, আর্ট মিউসিয়াম ইত্যাদি।
এরপর যাওয়া হলো ম্যাডাম তুসো। মাদাম তুসো জাদুঘর লন্ডনে অবস্থিত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মোম দিয়ে তৈরী মূর্তির সংগ্রহশালা। মাদাম ম্যারি তুসো নামীয় এক ফরাসী মহিলা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালাই পরবর্তীকালে মাদাম তুসো জাদুঘর নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রধান প্রধান নগরগুলোয় এ জাদুঘরের শাখা রয়েছে। লন্ডনের পর্যটনশিল্প ও অর্থনীতিতে মাদাম তুসো জাদুঘর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধুমাত্র মোম দিয়ে গঠিত জাদুঘরটিতে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ও রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, তারকা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খ্যাতনামা খুনী ব্যক্তিদের মূর্তিও সযত্নে রক্ষিত আছে। মূর্তি গুলি অপূর্ব। এখানেও মহা ভীড়। তবে খুব ভালো লাগলো ওর ভিতরেই স্পিরিট অফ লন্ডন টয় ট্রেন জার্নি যেটাতে এনিমেশন টয় আর স্পেশাল এফেক্ট দিয়ে দেখায় লন্ডন শহরের ইতিহাস। শেষ হতে বিকাল তিনটে। কোনো রকমে বাইরে বেরিয়ে রোড সাইড স্টল থেকে বার্গার আর আলুভাজার লাঞ্চ।
সেদিন শহরে ইউএস প্রেসিডেন্টের ভিসিট থাকাতে রাস্তাতে অসম্ভব ট্রাফিক জ্যাম। ফলে টাওয়ার হাউস আর লন্ডন ব্রিজ পৌঁছাতে অনেক সময় লাগলো।পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক নান্দনিক, ব্যতিক্রমী ও বিচিত্র ব্রিজ থাকলেও যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজের মতো খ্যাতি আর কোনো ব্রিজের নেই। বছরের পর বছর ধরেই সমগ্র বিশ্বেই আলাদা একটি আবেদন ও আবহ তৈরি করে রেখেছে লন্ডনে অবস্থিত এ ব্রিজটি। ব্রিজের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এর ওপর রয়েছে বিশাল আকৃতির দুটি টাওয়ার। লন্ডনের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এ টাওয়ার ব্রিজ অন্যতম। হাজার হাজার দর্শনার্থী দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসে এ টাওয়ার ব্রিজ। এ ব্রিজটির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি মাঝ বরাবর আলাদা হয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে পারে যাতে করে বড় আকারের কোনো জাহাজ এর নিচ দিয়ে চলে যেতে পারে। টেমস নদীর ওপর অবস্থিত এ ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ২৬৯ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ মিটার। এ ব্রিজটি ১৯৭৩ সালের ১৭ মার্চ সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ব্রিজের শোভা দেখে তারপর টাওয়ার হাউসের কোহিনুর দেখার সুদীর্ঘ লাইন। ফলে আমাদের আর লন্ডন আই যাওয়ার সময় হলো না কারণ হল্যান্ড যাওয়ার ক্রুসে বোর্ডিং সন্ধ্যা ৭টাতে। ফলে আর কী, সমবেত বাঙালির তর্জন গর্জন। (পরে অবশ্য ৫০ পাউন্ড ফেরত দিয়েছিল)। এরপর সোজা ফেরি ঘাটে। ৮টা নাগাদ বাস গিয়ে ঢুকলো বিশালকায় ১০ তলা উঁচু জাহাজের ভেতরে। শুনলাম ৫০টা বাস রাখার ব্যবস্থা আছে। ক্রুস শিপের ভেতরটি একটি পাঁচতারা হোটেলের মতো। শপিং মল, ক্যাসিনো, চার পাঁচটি রেস্তোরাঁ কি নেই তাতে।
তাড়াতাড়ি জড়ো হলাম ডিনারের জন্য। খুব ভালো নানা আইটেমের বুফে ডিনার। তবে এত টায়ার্ড ছিলাম যে সোজা ঘরে, খাওয়ার পর আর ছোট্ট কিন্তু সুন্দর সাজানো ঘরে ঢুকে ঘুম। পরে শুনেছি আমাদের সহযাত্রীরা অনেক রাত অবধি ঘুরে বেড়িয়েছে জাহাজের ভিতরে আর বাইরে সুয়েজ ক্যানালের শোভা দেখেছে।
আরেকটা কথা বলি আমার মনে হয় এই রকম ঘোড়দৌড় করে কোনো শহর ঠিকভাবে দেখা হয় না আর লন্ডন তো নয়ই। কারন ব্রিটিশ মিউসিয়াম দেখতেই তো পুরো একদিন লাগে। কী আর করা। পরে আবার যাবো কোনোদিন লেক ডিস্ট্রিক্ট, কেমব্রিজ, স্ট্রেটফোর্ড অন এভন আর সুন্দরী স্কটল্যান্ড দেখতে।
******************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।